ইচ্ছেগাঁও, কী চমৎকার একটা নাম! শুনেই মনে হচ্ছে নানা রঙের ইচ্ছেরা সব একজোট হয়েছে স্বপ্নের মত সুন্দর এক জায়গায়। এই নামে জনপদও হতে পারে? তাও আবার হিমালয়ের কোলে যেখানে মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ! গেল ফেব্রুয়ারিতে ভারতের কালিম্পং ভ্রমণের সময় এক হিম মেঘজড়ানো দিনে ভাবলাম নগর ছেড়ে নিসর্গ মাঝে গেলে কেমন হয়, যেখানে অন্তত গাড়ির ভেঁপু আর মানুষের কোলাহল থেকে ছুটি মিলবে। সেদিন আবার কালিম্পং মেঘপিয়নের চাদর জড়িয়ে খুব রহস্যময় করে রেখেছে চারপাশ, যেই ভিউ পয়েন্টেই যায়, কাছের বা দূরের হিমালয়ের তুষার মোড়া পাহাড় অদৃশ্য থেকেই যায়! তখনই গাড়ির চালক বিনোদ বলল তোমরা তো জনপ্রিয় স্পটগুলোর বাহিরে অন্য নিরিবিলি জায়গা দেখতে চাচ্ছ, আর সেই তালিকায় তো ইচ্ছেগাঁও আর সিলারিগাঁও দুইই আছে বললে, তা চলো একটায় ঘুরে আসি, যেহেতু শহর থেকে খানিকটা দূরে সেই হিসেবেই না হয় ভাড়াটা বাড়িয়ে দিও।
আসলে ইচ্ছে ছিল প্রাচীন সিল্ক রুটের যে অংশ কালিম্পং দিয়ে সিকিম হয়ে তিব্বতে চলে গেছে তার কিছু অংশে যাওয়া, সেই অতি প্রাচীন নির্জনতায় মোড়া কালের আর কাফেলার সাক্ষী গ্রামগুলোতে দুদণ্ড বসে সেকালের বণিকদের স্মৃতি আর সিল্করুট নিয়ে পড়া বইগুলোর লাইন রোমন্থন করা। কিন্তু এবারে বিধি বাম, কারণ সিল্করুটে আপাতত ভারতীয় নাগরিকরা ছাড়া অন্য দেশের নাগরিকদের যাত্রার অনুমতি নেই। তাই সেদিকে আর ইচ্ছেগাঁওইয়ের বেশ কাছেই অবস্থিত সিলারিগাঁওতে না যেয়ে সিদ্ধান্ত হলো সেই ইচ্ছে পূরণের জন্য আমরা যাবো ইচ্ছেগাঁও। সাথে আছেন ভ্রমণপিপাসু কাছের মানুষ মোশাররফ ভাই এবং স্কুটার নিয়ে সারা বাংলাদেশ দাবড়ে বেড়ানো সজীব ভাই।
তবে চালক সতর্ক করে দিল যে শেষের বেশ খানিকটা রাস্তা পীচ ঢালা নয়, এবড়ো থেবড়ো নুড়ি-পাথরের পথ। ঝাঁকুনি খেতে খেতেই নাকি শেষের পাহাড়ি পথটুকু পার হতে হবে। তবে আঁকাবাঁকা পথের দুধারে ছাপানো সবুজ আর নানা রঙিন পাখিদের দেখে এতই মুগ্ধচিত্তে ছিলাম সবাই যে সেই সামান্য ঝাঁকি আমাদের মুগ্ধতায় কোন ফাটল ধরাতে পারে নি।
পাকদন্ডী পথ বেয়ে গ্রামের শুরুতেই ছড়ানো এক জায়গায় পৌঁছে গাড়ি থামল, বোঝা গেলে এখন পর্যন্ত গাড়ি আসে, তারপর পার্কিং শেষে পদব্রজে যাত্রা। গ্রামে পা রাখতেই বাতাসে বেশ একটা চনমনে মৌ মৌ সুবাসে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল, গন্ধের উৎস চারপাশেই ছড়িয়ে রয়েছে- এলাচের বাগান! সিকিমের জন্য প্রধান অর্থকরী ফসল এলাচ, এখানেও তাই। সবুজ উৎস থেকে ছড়িয়ে পড়া পাহাড়ি সুগন্ধে মাতোয়ারা হয়ে আমরা গ্রামের মাঝে পা রাখতেই থমকে গেলাম রঙ দেখে!
ভালো লাগার রঙ, ভালোবাসার রঙ, জীবন ঘেঁষা উজ্জল রঙদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে কোন রঙধনু কারিগর সারা গ্রামে! গ্রামের নিচু এলাকা থেকে পাহাড়ি পথ আর সিঁড়ি চেলে গেলে ক্ষুদে জনপদের শেষ সীমা পর্যন্ত, রূপকথার রাজ্যে মত সব কুঁড়েঘর ধরনের একতলা-দ্বিতল বাড়ি, ছোট ছোট, সামনে আঙ্গিনা আর বাগান, ছিমছাম, নিখুঁত, সুন্দর!
কিন্তু আমাদের চোখ সেঁটে রইলো সেই ঝলমলে রঙদের দিকে, প্রতিটি বাড়ী দেয়াল, জানালা, দরজা, বারান্দা, ছাদ নানা রঙে রাঙা!
আর সেই সাথে আছে ফুলের বাহার, সবই বাড়ীর সামনে যেমন এক টুকরো বাগান আছে, তেমনই প্রতিটি বারান্দায় আছে সারি সারি ফুল গাছের টব, যার প্রতিটি টবেই ফুটে আছে বহুবর্ণা ফুল, পাশাপাশি নানা জাতের ফুলগাছ থাকায় বাড়ীর বারান্দার রেলিং আর ফুলের রঙ মিলিয়ে মনে হচ্ছে প্রতি বাড়িতে এক টুকরো রঙধনু আপাতত বিশ্রাম নিচ্ছে।
গ্রামের মানুষ বাসিন্দারা খুবই অতিথিপরায়ণ, যে কজনের সাথে দেখা হয়েছে, নারী-পুরুষ-শিশু সকলেই হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালো, কৌতূহল ভরে জানতে চাইলাম তাদের জীবন নিয়ে, ইচ্ছেগাঁও নিয়ে। প্রায় ৬০টা বাড়ি আছে এখানে, এবং সবগুলোতেই হোম-স্টে ব্যবস্থা চালু আছে অতিথিদের জন্য, সেই সাথে খাবার ব্যবস্থা তিন বেলা। তবে সেটা মৌসুম অনুযায়ী, যেমন শীতের জন্য ফেব্রুয়ারি মাসে বন্ধ ছিলো, জানালো যে মার্চ থেকে এগুলো সব খোলা থাকবে, আর তখন তিন বেলার খাবার সহ একজনের থাকার খরচ পড়বে ৯০০ ভারতীয় রূপী।
ইচ্ছাগাঁওয়ের অন্যতম আকর্ষণের সাক্ষী আমরা হতে পারি নি সেদিন, সে হচ্ছে বিশ্বের ৩য় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ মোহময়ী কাঞ্চনজঙ্ঘা, যা মেঘমুক্ত পরিষ্কার আকাশের দিনে গ্রামের যে কোন জায়গা থেকেই দেখা যায়। এমনিতেই এখানে যানবাহনের চলাচল নেই, মানুষেরা উচ্চস্বরে কথা বলে না, শব্দ বলতে পাখির কূজন আর পাহাড়ি বাতাসের সরসর শব্দ নানা গাছ আর ঝোপের সাথে, এর মাঝে এলাচির মাতাল করা গন্ধ, ভাবছিলাম শুধু কাছের দিগন্তে কাঞ্চনজঙ্ঘা উঁকি দিলেই কী অপার্থিব একটা দৃশ্যের না জন্ম হয়ে যেত সারা জীবনের সঞ্চয় হিসেবে!
গ্রামের শেষ মাথায় স্কুলের সাথেই টিনের এক মুদি দোকান, সেই সাথে চা, গরম গরম নুডুলস ইত্যাদি মেলে। আকাশে রোদ থাকলেও ৬ হাজার ফুট উচ্চতার বাতাসে খানিকটা হিমহিম ভাব ছিলই, তার মাঝে উঞ্চ মশলা-চা বেশ লাগলো তাড়িয়ে তাড়িয়ে খেতে, সাথে মরিচের চাটনি আর সদ্য পোড়ানো টমাটো সহকারে ম্যাগি নুডলস। গুরু সৈয়দ মুজতবা আলীর সাথে একমত হয়ে সুযোগ পেলেই শুধু দৌড়ে দৌড়ে ঘুরে বেড়িয়ে সব একসাথে দেখে শেষ করে ফেলার চেষ্টা না করে মাঝে মাঝেই বিরতি দিয়ে কোথাও বসে সেই দিনের স্মৃতি রোমন্থন করার চেষ্টা করি, তাতে সেই স্মৃতিও গেঁথে যায় মানসপটে আবার আরামও হয় দেহ-মনের-চোখের।
সেই সময় দেখা হয়ে গেল কলকাতা থেকে আগত এক পর্যটকদলের সাথে। তাদের সবারই বয়স ষাটের কাছাকাছি, তিন জন মহিলা আছে দলে, গ্রামের শেষ সীমানায় যে এলাচি বাগান তা ছাড়িয়ে খানিকটা পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা করে তারপর এখন নামার পথে! তাদের উৎসাহ অনুসরণ করার মতো। বেশ খানিকক্ষণ আড্ডা হল চা খেতে খেতে। উনারা কাল যাচ্ছেন সিল্ক রুট ধরে সিকিমের দিকে, জানালাম যে আমাদের সেদিকে যাবার পারমিট নেই, কিন্তু কোন একদিন নিশ্চয়ই সকল বিদেশীদের জন্যও সেই পথ খুলে দেওয়া হবে যেমন ছিল হাজার বছর আগে, তখন হয়তো আমরা আবারও ফিরব।
কিন্তু ইচ্ছাগাঁওতে যে আবার ফিরব, এবং বাহিরের জগতের সাথে যোগাযোগ বন্ধ রেখে শুধু বই, সঙ্গীত আর জাদুপাহাড়ের মাঝেই থাকব জীবনে কয়েকটি দিন তাতে কোন সন্দেহ নেই। নির্জনতা, রঙ ও জীবন প্রিয় প্রতিটি বন্ধুকেই জানিয়ে রাখলাম ‘ইচ্ছাগাঁও’ নামের সেই রঙিন জাদুরাজ্যের কথা। যে কোন ছুটিতে ক’দিনের জন্য ডুব দিন সেখানে নিজের ও নিসর্গের মাঝে, দেখেন জীবন আরও অর্থবহ হয়ে ওঠে কিনা আমাদের এই অতি ব্যস্ততার মাঝেও।
( যাবার উপায় – ভারতের শিলিগুড়ি থেকে খানিক পরপরই গাড়ি ছাড়ে কালিম্পঙয়ের উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে ভালো হবে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করলে, সেখান থেকে শিলিগুড়ি মাত্র ৮ কিলোমিটার। কালিম্পং যেয়ে জিপ ভাড়া নিয়ে সোজা ইচ্ছেগাঁও)।
(আজ প্রিয় বড় ভাই অনিক চন্দ দাদার জন্মদিন। দাদা ও মনিকা বৌদি এই ইচ্ছেগাঁওতে আমাদের বেশ আগেই তাদের দুই পুত্র টিনটিন এবং পাপাইকে নিয়ে ঘুরে এসেছিলেন। দাদা ও বৌদি দুইজনেই চিকিৎসক, কিন্তু করোনাজনিত কারণে দাদা নিজেই বেশ কয়েক মাস যাবত হাসপাতালে থেকে অবশেষে বাড়ি ফিরেছেন কিন্তু এখনো আরও সময় আগের মত হিমালয়ে যেতে। কিন্তু আমরা জানি দাদা অবশ্যই পারবেন। এই পোষ্টটা তাদের পুরো পরিবারের জন্য। দেখা হবে-)
মন্তব্য
প্রিয় তারেক অণু,
খুবই সুন্দর লেখা। আপনার লেখা পড়লে মনে হয় আপনার সাথে আমরাও যেন ঘুরে এলাম এইসব অনিন্দ্যসুন্দর জায়গা থেকে। অনেকটা মানস-ভ্রমণ আর কি! বাড়ির পাশে এত সুন্দর বেড়ানোর জায়গা ছিল, কে জানতো!
ছবিগুলোও খুবই সুন্দর হয়েছে। এরপরেরবার গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবিসহ পোস্ট দেবেন। আমরা অঞ্জন দত্তের গান ব্যাকগ্রাউন্ডে ছেড়ে লেখা পড়ে নেব। আর কোনদিন যদি নিজে যেতে পারি তবে জানাবো।
আপনার ঘোরাঘুরি এভাবেই জারি থাক। ভালো থাকবেন।
স্বরূপ-সন্ধানী
---------------------------------------
অন্ধকারে সব-চেয়ে সে-শরণ ভালো
যে-প্রেম জ্ঞানের থেকে পেয়েছে গভীরভাবে আলো।
আশা করি কাঞ্চনকে পাব সেখানে যেয়ে, টানা কয়েকদিন থাকার ইচ্ছে আছে, সেই সাথে প্রাচীন সিল্ক রুটে যাবারও
facebook
'ইচ্ছেগাঁও' যারা মিষ্টি মিষ্টি রঙে, ফুলেে ফুলে, ছিমছাম রেখে এলাচের গন্ধ ছড়িয়ে দেয় সেইসব গ্রামবাসীদের কিছু ছবি, কিছু কথা থাকলে লেখাটা আরও বেশী ভাল লাগত। আপনার বিভিন্ন বিষয়ের অভিজ্ঞতা পড়তে সর্বদাই ভাল লাগে।
ধন্যবাদ, গ্রামবাসীদের কথা আলাদা ভবে লিখতে হবে, সাথে এলাচের কথাও
facebook
মরিচের চাটনি আর ম্যাগি নুডলসের ছবি কুথায়?
রঙবেরঙের বাড়ি দেখে চমৎকৃত হইলাম।
..................................................................
#Banshibir.
স্লুপ স্লুপ খেতে খেতে ছবি খুব যুইতের আসে নাই, দিব নি কোন এক লেখায় ফের কালিম্পং নিয়ে
facebook
আহ, আলো আর রঙের কী অপূর্ব মিশ্রণ। চমৎকার।
ভোগী মানুষতো, খাওয়ার ব্যাপারটা মানস চক্ষে দেখতে চাই।
কিছু একটা বাদ পড়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
ঠিকই ভাইডি, টমাটো! পোড়া টমাটো বাদ পড়ে গেছে!
facebook
নেওড়া ভ্যালি, ইচ্ছেগাঁও, সিলারিগাঁও প্ল্যান করলাম আমি আর গিয়ে ঘুরে আসলেন আপনি- পুরাই নেপোর দই মেরে দেওয়া সিনারিও।
তবে আপনাদের গ্যাংটক গিয়ে ধরতে পেড়েছিলাম এই যা স্বান্তনা
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
এইসব না বলে ইজিপ্টের গল্পটা শুনান আমাদের!
****************************************
কথা সত্য ওডিন লেখা শুরু ক্রুক
facebook
আরেহ ম্যান, সিলারিগাঁও তো যাই নাই, লোলেগাঁওতেও না! আবার যাই চলেন
facebook
চমৎকার লাগলো পড়তে। যাওয়া হবে নিশ্চয়ই কখনো সেই রঙিন জাদুরাজ্যে।
নুশান
অবশ্যই হবে আশা করি
facebook
ছবিগুলো দেখে সত্যি এমনই লাগলো। তবু
এ প্রশ্ন থেকেই যায়। তবুও মনে হয় আমি একদিন ইচ্ছেগাও কালিম্পং যাবো।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
হয়ে যাবে , হয়ে যাবে, কোথায় আছেন ভাইডি?
facebook
চমৎকার এক নির্মল সুন্দর জায়গা থেকে ঘুরে আসলাম তোমার বর্ণনা অনুসরন করে। ভালো লাগলো।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
আবার যেতে হবে, প্রাচীন সিল্ক রুট ধরে
facebook
রং-এর ছড়াছড়ি। ভালো লাগল।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
হ, অনেক
facebook
হেলমুটের সাথে দেখা হয়নি?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ডালমুট?
facebook
লিস্টে রেখে দিলুম। এই রংগীন বাড়ীর একটিতে থাকার প্ল্যান করতে হবে।
অবশ্যই, পরের বার একাধিক দিন নিরিবিলিতে থাকব
facebook
আপনার লেখা মানেই, আমার কাছে প্রিয় মুহূর্ত।
এ অনেক বড় পাওয়া, শুভেচ্ছা
facebook
নতুন মন্তব্য করুন