ক্ষুদ্রতম পেঙ্গুইনের খোঁজে

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: সোম, ২৬/০৪/২০২১ - ৫:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় মেলবোর্ন নগরী থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরে ফিলিপ আইল্যান্ড নামের এক অপূর্ব নৈসর্গিক জায়গায় আমরা এসেছি পেঙ্গুইনদের খোঁজে! জি হ্যাঁ, পেঙ্গুইন! কোট পরা ভদ্রলোক পাখিরা, যাদের নাম উচ্চারিত হলেই আমরা ভাবি বরফ মহাদেশে হেঁটে যাচ্ছে গুটি গুটি পায়ে, কিন্তু আমাদের অধিকাংশই যেটা জানি না তা হচ্ছে আমাদের গ্রহে এই মুহূর্তেই ১৮ প্রজাতির পেঙ্গুইন আছে, এবং তাদের অনেকেই বরফে নয় বরং মরুভূমিতে থাকে, এমনকি ক্রান্তীয় অঞ্চলেও! এবং এদের মধ্যে আকৃতিতে সবচেয়ে ছোট যে পেঙ্গুইন তাই এই ক্ষুদে নীলাভ পেঙ্গুইন, ফুট খানেক উচ্চতার এই বিস্ময়েরা থাকে অস্ট্রেলিয়ায় ও নিউজিল্যান্ডের উপকূল ঘেঁষে নানা জায়গায়।

ফিলিপ আইল্যান্ডে আমরা এসেছি বিকেল বেলা, রওনা দিয়েছিলাম জিলং শহর থেকে, সেখানেই থাকেন আমাদের প্রিয় পাড়াতো মামা রুবেল মামা, তাঁর ডেরাতেই এসেছি ক’দিনের জন্য আমি ও বড় ভাই তানভীর অপু। মামা অস্ট্রেলিয়াতে থিতু হয়েছেন বেশ অনেক বছর হল, ভ্রমণপ্রিয় মানুষ, সময় পেলেই এদিকে ওদিকে ঘুরতে যাচ্ছেন আমাদের নিয়ে। উনিই বলেছিলেন যে ফিলিপ আইল্যান্ডে যেতেই হবে, শুধু যে বুনো পেঙ্গুইন দেখার জন্য
তা নয়, জায়গাটি নৈসর্গিক সৌন্দর্যেও নাক তুলনাহীন।

এবং যেই মুহূর্তে পেঙ্গুইন প্যারেড দেখবার বেশ চড়া মূল্যের টিকেট কেটে আমরা সেই সংরক্ষিত এলাকার ভিতরে প্রবেশ করলাম, নানা রঙের ঘাস ও গুল্মে ঢাকা অপূর্ব সব ঢিবির মত ল্যান্ডস্কেপ ও প্রান্তদেশে সমুদ্র যেন আমাদের আসলেই এক ভিনগ্রহে নিয়ে গেল! একরত্তি এক জায়গায় যে এত রঙের ছড়াছড়ি, তাও আবার জীবন্ত রঙ, মানে কিনা ঋতু অনুযায়ী উদ্ভিদদের পরিবর্তনের সাথে সাথে সেই ল্যান্ডস্কেপও পরিবর্তিত হয়ে যায়। সাগরের ফেনা যেখানে আছড়ে পড়ছে সেখানে পাথুরে সব দেয়াল আর স্তম্ভের যত পানকৌড়ি আর গাঙচিলদের সমারোহ, আর অধিকাংশ জায়গায়ই মানুষের প্রবেশ নিষেধ, কারণে সেখানে পেঙ্গুইনের বাসা! তাদের নিজেদের তৈরি গর্ত বাড়ি তো আছেই, আবার মানুষে দেওয়া বাক্সবাড়িও আছে, যাতে ক্ষুদে পেঙ্গুইনরা নিশ্চিন্তে ডিম ফুটাতে পারে।

এমন জায়গাতেই প্রথম দেখা হল নীলাভ পেঙ্গুইনদের সাথে। নির্লিপ্ত মুখে আরামরত, হয়তো চিন্তা করছে সমুদ্রযাত্রার। বেশী কিউট পাখি, দেখলেই অধিকাংশ মানুষ তাদের কোলে নিয়ে আদর করতেই চাইবেন বিধায় সবখাতে লেখা যে ‘পেঙ্গুইনদের ছোঁয়া যাবে না, এতে তাদের ক্ষতি হয়’। যদিও তাদের ছানারা এতটা সুদর্শন নয়, কারণ শরীর ভরা তুলো তুলো বাদামি পালকে। কেমন হতশ্রী লাগে দেখতে, কিন্তু কয় মাস পর এরাই ‘কুচ্ছিত হাঁসের ছানা’ গল্পের মতো সুন্দর সব পেঙ্গুইনের পরিণত হবে।

এটা আমার তৃতীয় বুনো পেঙ্গুইন দেখা, আর আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় আফ্রিকান পেঙ্গুইন আর গ্যালোপাগোস দ্বীপপুঞ্জে গ্যালাপাগোস পেঙ্গুইন দেখা হয়েছিল, এবং এখানেই সেই মেছো গন্ধ অত্যন্ত প্রকট, কারণ তারা মূলত মাছখেকো পাখি, আর বেশ সরব উপস্থিতি।

ভিনগ্রহের মত জায়গাটি এক ঘোর লাগা অনুভূতি নিয়ে দেখছি, ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসছে, আর তখনই শুরু হবে এখানের মূল আকর্ষণ, যার কথা বলেছি প্রথমেই, সেই মহাবিশ্ব মঞ্চে একের পর এক মহাসমুদ্র থেকে উঠে আসবে বীর ক্ষুদে পেঙ্গুইনেরা। এমন গোধূলি কালে ওঠার মূল কারণ যে স্কুয়া ধরনের শিকারি পাখি বা অন্যান্য প্রাণীর শিকার না হতে হয় তাদের, তাই কোটি বছরের বিবর্তন ও অভিজ্ঞতা এই অভ্যাস গড়ে দিয়েছে টিকে থাকার তাগিদে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে ক্ষুদে পেঙ্গুইনেরা সমুদ্র নেমে একটানা কয়েকদিনও থাকে, যথেষ্ট খাবার সংগ্রহ হলে তখনই কেবল তীরে ফিরে, এবং তীরে তারা ফিরে সবসময় কয়েকজন মিলে। আর তার জন্যই মানুষ এই ফেরার নাম দিয়েছে পেঙ্গুইন প্যারেড।

মহাবিশ্ব তখন এক রঙ্গমঞ্চ হয়ে আমার সম্মুখে, সাথে শ’খানেক মানব সন্তান,, বেলাভূমির বালিতে নিশ্চুপ বসে আছি, সামনে প্রশান্ত মহাসাগর, ঢেউ এর পর ঢেউ এসে আসছে সাদা ফেনায় স্নান করিয়ে দখল করে যাবার চেষ্টা করছে ভূভাগ, তারপর ফের টগবগ করে অক্ষম ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে নেমে যাচ্ছে সফেদ স্মৃতি রেখে, আর মাথার উপরে খোলা সুবিশাল সুমহান সীমাহীন আকাশ। সন্ধ্যে নামলো বলে, আঁধার ডানা মেলে ধেয়ে আসছে নিশ্চিন্ত গতিতে, তবুও দিগন্তে সামান্য যে সূর্যের অস্তিত্ব সেটাই মহাসাগরের চকচকে পৃষ্ঠে । মনে হচ্ছে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের কোন নাটকের দৃশ্য ঢুকে পড়েছি আলগোছে, সব দৃশ্য আসবে এখন একে একে আমাদের সামনে, আর সাগর, আকাশ, বেলাভূমি মিলিয়ে সেই বিশাল মঞ্চ।

আমরা সবাই সারিবদ্ধ ভাবে বসা, নিশ্চুপ, কড়া ভাবে বলা হয়েছেন কোন রকম ছবি বা ভিডিও তোলা যাবে না, এবং শব্দ করা যাবে না। সামান্য শব্দেই পেঙ্গুইনেরা ভড়কে যেতে পারে এবং দেখা গেছে এতে তারা দিকভ্রান্ত হয়ে অনেক সময় সাগরের দিকে ফিরে যায়! সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা, এতগুলো মানুষ নিস্তব্ধ হয়ে অপেক্ষায় রয়েছে, এই সময় মৃদু গুঞ্জন উঠল, ‘ঐ যে, ঐ যে, ওরা আসছে’, ঠিক হেলে দুলে আসা শুরু করেছে ছোট ছোট দলে পেঙ্গুইনেরা। টেলিভিশনের পর্দার চেয়ে অনেক বেশী প্রাণবন্ত, ছবির চেয়ে অনেক বেশী সুন্দর। খুব ভি আই পি মেজাজে হেলেদুলে আমাদের মুগ্ধ করে রেখে তারা চলে গেলে যে যার গর্তবাড়ির দিকে একে একে, এতগুলো মানুষ যে বসে আছে , সেখানে বিন্দুমাত্র পাত্তাও না দিয়ে।

পৃথিবীর সব প্রজাতির পেঙ্গুইনদেরই পিঠের দিকে কালো বা গাঢ় বর্ণের আর পেটের দিকে সাদা। কারণ সম্ভবত পরিবেশের সাথে মিশে শিকারি প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া, পেটের দিকে সাদা হওয়ায় পানিতে থাকা পেঙ্গুইনদের শত্রু নানা প্রজাতির সীল, হাঙ্গর ইত্যাদি তাদের সহজে দেখে চিহ্নিত করতে পারে না, আবার পিঠের রঙ কালচে হওয়ায় স্কুয়া বা ঈগল জাতীয় পাখিরা তাদের সহজে আলাদা করতে পারে না উপর থেকে, কোটি বছরের বিবর্তন এই অপূর্ব ক্ল্যামোফোজ এনে দিয়েছে তাদের।

তবে পেঙ্গুইন প্যারেডটি শেষ পর্যন্ত মনমতো হলো না, কোথা থেকে দমকা বাতাস নিয়ে এলো জলভরা মেঘ,আর ঝুম বৃষ্টি! হঠাৎ দেখেই পেঙ্গুইনদের পাশাপাশি আমরা সবাই হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে চলেছি, অবশ্যই মানুষের জন্য বাঁধানো কাঠের রাস্তায়, কারণ এই অসময়ে ঝুম বৃষ্টির জন্য প্রস্তুতি ছিল না কারোই। সেই ফাঁকেও যতখানি পারি পেঙ্গুইনদের দেখার চেষ্টা চললো নিখাদ আনন্দ নিয়ে।

গাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমরা ভিজে একসা, আর কোন উপায় না দেখে তিনজনেই শুধু অন্তর্বাস ছাড়া সমস্ত কাপড় খুলে চিপে গাড়ির পিছনে ফেলে রাখলাম। গাড়ি ছাড়া হল, কিছুক্ষণ পর রুবেল মামা গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আচ্ছা, এখন পুলিশ যদি হাইওয়ের গাড়ি থামিয়ে বলে যে তোমরা তিন তিনজন মানুষ এভাবে অ্যান্ডার ওয়্যার পরে গাড়ি চালাচ্ছ কেন, আর আমরা যদি উত্তর দিই পেঙ্গুইনদের জন্য, তাহলে কেমন হবে?’

অট্টহাসিতে দুলে উঠল গাড়ি। ক্ষুদে পেঙ্গুইনদের আপন পরিবেশে দেখার অনন্য সুখস্মৃতি নিয়ে আমরা ছুটে চললাম জিলং এর পানে।

( গতকাল ছিল বিশ্ব পেঙ্গুইন দিবস। এই উপলক্ষে এই লেখাটি থাকল, নেটের সমস্যার কারণে অধিকাংশ ছবিই দেয়া গেল না, ভবিষ্যতে যোগ করে দিব। আর নিচে থাকল পেঙ্গুইন দেখা ও পেঙ্গুইন নিয়ে সচলায়তনে প্রকাশিত ৩টি লেখার লিঙ্ক-

আফ্রিকায় পেঙ্গুইন, আফ্রিকার পেঙ্গুইন !

গ্যালাপাগোসের পেঙ্গুইন

বই পরিচিতি -‘পেঙ্গুইন’


মন্তব্য

সত্যপীর এর ছবি

মেলাদিন পরে লেখা দিলেন। পেঙ্গুইন ভালা পাই।

..................................................................
#Banshibir.

তারেক অণু এর ছবি

লিখব গো পীর সাহেব

মন মাঝি এর ছবি

ইজিপ্ট / জর্ডান এসব ভ্রমণের ভ্রমণকাহিনির কি হল? মন খারাপ

****************************************

তারেক অণু এর ছবি

আসিবেক

সৌখিন  এর ছবি

আমার বাসা ফিলিপ আইল্যান্ড থেকে ১ ঘন্টার দূরত্ব। সুযোগ পেলেই চলে যাই।

তারেক অণু এর ছবি

চমৎকার, লেখা দিয়েন মাঝে সাঝে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।