২০০০ সালের জানুয়ারি যেমন ছিল একটি নতুন শতাব্দীর সূচনা তেমনই বাংলাদেশের পাখি দেখার জগতে এটাও ছিল এক নতুন পর্বের শুরু। গ্রিমেট এবং ইনস্কিপের দক্ষিণ এশিয়ার পাখি নিয়ে প্রকাশিত প্রথম আধুনিক ফিল্ডগাইড আমাদের ব্যাকপ্যাকে ঠাঁই পেয়েছিল বছর দুই আগে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাখিদের নিয়ে রবসনের যুগান্তকারী কাজটি কেবল আমাদের হাতে পৌঁছে ছিল। বাংলাদেশের পাহাড়ে শান্তি ঘোষিত হয়েছিল এবং বিদেশীরা সেখানে যাবার অনুমতি পেয়েছিল। প্রথমবারের মতো পাহাড়ে পাখি দেখে সেটাকে চিহ্নিত করার যাবতীয় সরঞ্জাম সহ সামরিক বাহিনীর সাথে অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার ইনাম আল হকের যোগাযোগ সুবিধা নিয়ে আমি ডেভ জনসন, ইনাম এবং রনি (ডা: রোনাল্ড হালদার) বান্দরবানের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। আমাদের হাইকিং-এর রাস্তা ছিল রুমা বাজার থেকে বগালেক, দার্জিলিং পাড়া এবং বাকলাই হয়ে থানচি যাওয়া এবং সেখান থেকে রুমাতে নৌকায় ফিরে আসা। এর মধ্যে বেশ কিছু জায়গা কেবলমাত্র পায়ে হেঁটেই যাওয়া যেত এবং পাখি-দর্শক ও বিদেশী এই দুই ধরনের মানুষই ছিল একেবারেই নতুন।
৫ জানুয়ারি হাইকিং এর প্রথম দিনের সকালটা ছিল ডেভের জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয়। বেচারা পুরো ভ্রমণের চলার মতো প্রচুর পরিমাণ পাউরুটি, পিনাট বাটার এবং জেলি নিয়ে এসেছিল। কিন্তু মাত্র দুই একটা কামড় দেওয়ার পরে টের পাওয়া গেল যে তার নাস্তা রাখার ব্যাগের চেইন ঠিকমতো কাজ করেনি যার জন্য শত শত খুদে খুদে পিপড়ে সেখানে ঢুকে ছিল, যারা তার মুখ এবং ঠোট কামড়ে এতটাই ফুলিয়ে দেয় যে সে সারা দিন আর কথা বলতে পারেনি। পাখি দেখার বিচারে দিনটা খুব একটা আকর্ষণীয় ছিল না যদিও কালা-বাজ ( Black Baza) এবং পাহাড়ি-নীলকান্ত ( Dollarbird) ছিল চমৎকার রেকর্ড। পথ চলার সময় পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত গ্রামগুলোতে ওঠা নামা এবং সেইসাথে বগালেক পৌঁছানোর জন্য একটি লম্বা খাড়া পিচ্ছিল কিন্তু কাদায় ভরা ঢাল বাইতে বাইতে আমরা আবিষ্কার করলাম যে হাইকিং পথ হিসেবে এটা বেশ কঠিন।
পরদিন শুরু হয়েছিল বগালেকের নৈসর্গিক দৃশ্য দিয়ে যেখানে আলোময় ঢালেরা ঘন নীল মেঘের আঁচলে ঢাকা ছিল। জুম ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ চড়াই-উৎরাই পেরোনো ছিল সেই গরমে ঘর্মাক্ত কলেবরে বেশ কঠিন কাজ, খুব অল্প সংখ্যক পাখির মাঝে দেখা মিলে ছিল পাহাড়ি বাঁশবনের পাখি ধলাভ্রু-কুটিকুড়ালির ( White-browed Piculet)। চারপাশের সবুজে ইতিমধ্যেই তা ছিল বাংলাদেশের মাঝে যেন এক ভিনগ্রহ। আস্তে আস্তে আমরা ৯৫০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত দার্জিলিং পাড়ায় পৌঁছাই।
সেখানে একটা পুরো দিন আমরা ট্রেকিং ছাড়া আশেপাশে ঘুরেই কাটিয়ে দিই, যার জন্য আমরা নিজেরা ভাগ ভাগ হয়ে গিয়েছিলাম। ডেভ বাঁশের লাঠি হাতে খাড়া পাহাড়ের ঢালের বন দেখতে গেল, আমি পাতলা হতে থাকা বুনোপথের মধ্যে দিয়ে খুবই ছায়াময় সরু গিরিখাদে ঢুকে গেলাম। সেই এলাকা পার হওয়ার সময় একটি মরা গাছের ডালে বসে থাকা দুইটা পাহাড়ি-ধুমকলের (Mountain Imperial Pigeon) ছবি তুলতে সক্ষম হই যা ছিল বাংলাদেশে প্রথম আলোকচিত্রের রেকর্ড, এর পরবর্তীতে আরেকটি পাহাড়ি-ধুমকল আমরা বাকলাই থাকার সময় দেখি। বনের প্রান্তে অনেক দাগি-মাকড়মার ( Streaked Spiderhunter) এবং কমলাপেট-হরবোলা ( Orange-bellied Leafbird) ছিল। এরপরে সূর্য এড়িয়ে আমি আস্তে আস্তে সেই চওড়া এবং ছায়াময় পাহাড়ি ঝিরি ও গিরিখাদ দিয়ে এগোনো শুরু করি। সেখানে দেখা একাধিক বাতাই ( Patridge) অথবা মথুরা ধরনের পাখির( Pheasant) পরিচয় আর কোনদিনই জানতে পারবো না, যারা প্রথম দেখাতেই একঝটকায় দৃষ্টির বাহিরে চলে গেছিল। কিন্তু একটি নিচু ডালে লুকিয়ে বসে থাকা ছায়াচ্ছন্ন দেহের আকৃতি দেখে বুঝতে পেরেছিলাম এটা কেবলমাত্র লম্বাঠোঁট-দামা (Long-billed Thrush) হতে পারে, যা ছিল বাংলাদেশের জন্য প্রথম নিশ্চিত রেকর্ড।
ছায়াতে কিছুক্ষণ বিশ্রামের পরে ফেরার পথে দেখা হয়েছিল একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ দেশি-নীলরবিনের ( Indian Blue Robin) সাথে যা প্রমাণ করে যে এরা মাঝে মাঝে শীতেও বাংলাদেশ থাকে এবং এটি ছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় রেকর্ড। এরপরে ঝিরির মুখে দেখা হয়ে গেল একটি স্ত্রী অথবা তরুণ পুরুষ কমলাপাশ-বনরবিনের (Orange-flanked Bush Robin) সাথে। ঠিক একই সময়ে দেব তার সেই ঘন বাঁশের জঙ্গলে ভরা খাড়ির মধ্যে দেখছিলেন দাগি-ইউহিনার ( Striated Yuhina) একটি ঝাঁক যেখানে কমপক্ষে ১০টি পাখি ছিল এবং এটি ছিল বাংলাদেশের জন্য প্রথম রেকর্ড।
ইনাম এবং রনি গ্রামের নিচের দিকের ঘন বাঁশঝাড়ে কয়েকটা ধলামুখোশ-ছাতারে (White-hooded Babbler) দেখছিল, যেখানে তারা বাংলাদেশের প্রথমবারের মতো এ প্রজাতি আবিষ্কার করেছিল ১৯৯৯ সালে।
অষ্টম দিন খুবই স্মরণীয় হয়ে আছে আমাদের কেওকারাডাং শিখরে আরোহণের জন্য, ভোরের পুবের হাওয়া একের পর এক বনপথ ধরে জুম এবং বাঁশ বনের মধ্য দিয়ে আমরা কুয়াশাঘেরা সব উপত্যকার অস্তিত্ব টের পাচ্ছিলাম। বেশ ঘন বনের মধ্যে দিয়ে খাড়ির ঢাল বেয়ে নামা অ্যাডভেঞ্চারময়ই ছিল। সেই ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তাটা পাখি দেখার বা বিশ্রামের সুযোগ দেয়নি বললেই চলে কিন্তু যখন আমরা একটা ঝুড়ির পাশে মোটামুটি সমতল জাগায় আসি তখন একটা জলপ্রপাত এর পাশে কালাপাশ-দামা (Dark-sided Thrush) চরে বেড়াতে দেখি আধাঘণ্টা ধরে, যাচ্ছিল বাংলাদেশের কেবলমাত্র তৃতীয় রেকর্ড।
যতদিনে আমি এবং ডেভের পা সারাদিন হাঁটার জন্য মোটামুটি প্রস্তুত হয়ে গেছে তখনই আসলো আমাদের সারাদিন হাঁটার শেষ দিনটি। যাত্রা শুরুর অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা একটা গানগাওয়ারত পুরুষ খুদে-খাটোডানার ( Lesser Shortwing) পিছু নেই। পাহাড়ের ঢালের চূড়াগুলো, কিছু ছায়াচ্ছন্ন জায়গা এবং দূরের গ্রামগুলো অতিক্রম করার সময় আমরা জানতাম যে আমাদের বেশ কয়েকবার চড়াই উতরাই অতিক্রম করতে হবে। থানচির কাছাকাছি এসে আমরা পাতি-তুতির (Common Rosefinch) কমপক্ষে ২০টার ঝাঁককে পাহাড়ি ঝোপে খাওয়া-দাওয়া করতে দেখি। সেদিন রাতে সেখানে থাকার পর পরের দিন নৌকায় করে বেশ আরামে নিচের দিকে নামার সময় আমাদের ক্লান্ত পাগুলো ভালো বিশ্রাম পেয়েছিল। অবশেষে রুমাতে পৌঁছানোর সাথে সাথে সেই অজানা বাংলাদেশের শেষ হয়ে যায় যা আমরা গত ক'দিন ধরে দেখেছিলাম।
পাখি দেখা যেকোনো সময় শেষ হয় না তার একটা প্রমাণ মিলল যাত্রাপথে ,মানুষ এবং নানা যন্ত্রপাতিতে ভরা আমাদের মাইক্রোবাসটি ঝাঁকি খেতে খেতে পাকদণ্ডী বেয়ে বান্দরবানের দিকে ফেরার পথে আমরা একটি পুরুষ ডাউরিয়ান-গির্দি ( Daurian Redstart) দেখতে পাই, যা ছিল সেই ভ্রমণের বাংলাদেশের জন্য প্রথম পাখি দেখার শেষ রেকর্ড!
২০ বছর আগের স্মৃতিরোমন্থন করলে আমার বলতেই হবে এটা বাংলাদেশ কাটানো আমার সেরা সপ্তাহগুলোর একটি ছিল।
( ডঃ পল মাইকেল থমসন, বাংলাদেশের সকল পাখিপ্রেমীর কাছে পরিচিত পল থমসন বা পল নামে।
ইংল্যান্ডেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মত এসেছিলেন তাঁর পি এইচ ডি'র গবেষণার জন্য, বন্যা নিয়ে। সেই থেকে যাতায়াতের মাঝে থাকলেও গত ২৫ বছর ধরে বাংলাদেশেই তাঁর ঘর। কাজ করেছেন বন্যা, মৎস্য সম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ বিষয়ক নানা সংস্থা ও প্রকল্পে। কিন্তু তাঁর প্রফেশনাল জীবন নিয়ে আমাদের বলার চেয়ে আমরা তাঁর প্যাশন নিয়ে বলতে চাই।
পলের নেশা হচ্ছে পাখি দেখা, ৫ বছর বয়সে জনৈক প্রতিবেশী তাকে শিশুদের পাখি চেনার রঙচঙে এক বই দিয়েছিল, সেই বইই তাকে নিয়ে আসে পাখিপ্রেমের জগতে। ৬০ বছর ছোঁয়া এই তরুণ এখনো পারলে প্রতিদিনে নিসর্গে যান, পাখিদের পর্যবেক্ষণ করেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। আর শুধু দেখেনই না, সব তথ্য লিপিবদ্ধ করেন, সবসময়ই। যে কারণে বাংলাদেশের গত ৩০ বছরের যে কোন পাখি বিষয়ক তথ্য লাগলেই সবার আগে আমরা পলকেই বুঝি। অতি অল্প সময়ে চুলচেরা নিখুঁত তথ্য তিনি আমাদের দিয়ে দেন যত ব্যস্তই থাকুন না কেন।
আজীবন ব্যাচেলর, অতি নিভৃতচারী মানুষ তিনি, ব্যক্তিগত ব্যাপারকে কোনসময়ই সামনে নিয়ে আসেন না। পাখিরদলে সবচেয়ে বেশী পরিশ্রম করেন যেচে যেচেই। পল বেশ ভালো বাংলা বুঝেন, বলতেও পারেন (যদিও আমাদের সাথে সহজে বলেন না)৷ হাত দিয়ে চমৎকার ভাত-মাছ খেতে পারেন।
পলের জীবন নিয়ে বাংলাদেশের পাখিপ্রেমীরা অনেক কিছু জানলেও একটা তথ্য খুব কম লোকই জানেন যে নার্গিস আক্তার পরিচালিত শাবানা আজমী ও মৌসুমী অভিনীত 'মেঘলা আকাশ' সিনেমায় পল অভিনয় করে ছিলেন, স্বনামেই, যদিও কয়েক মূহুর্তের জন্য।
বাংলাদেশের পাখি বিষয়ক কাজের জন্য পলের নাম সবসময়ই বাংলাদেশ মনে রাখবে। খুবই সুখের কথা যে ইনাম আল হকের অনুরোধে পল ‘বাংলার পাখি’র জন্য তাঁর নানা সময়ের নানা অঞ্চলের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা শুরু করেছেন কয়েক সংখ্যা ধরে, তাঁর অনুমতি নিয়ে সেগুলোর অনুবাদ শুরু করলাম, মূল্য উদ্দেশ্য যাতে তরুণেরা কিছুটা হলেও বুঝতে পারে যে বাংলাদেশে মাত্র কয়েক দশক আগেও পাখিবৈচিত্রে কতটা ঐশ্বর্যশালী ছিল। )
মন্তব্য
চোখের পাওয়ার কমে যাচ্ছে বয়সের ভারে। রিডিং গ্লাস ব্যবহার করে অনেকদিন পর আরাম করে এক দমে পড়ে ফেললাম চমৎকার লেখাটা।
নিয়মিত ঢুঁ মেরে দেখবো আরও কিস্তি এসেছে কি না
------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ
পল যে কটা লিখেছে বাংলা করে ফেলব ভাই। এর আগে আরও দুইটি সচলে দেওয়া আছে।
facebook
সামান্য অপ্রাসঙ্গিক একটা জিজ্ঞাসা। অনেক পাখির ইংরেজি নামে pied এর বাংলা হিসেবে পাকড়া দেখি। এ শব্দটা কি বাংলাদেশের কোনো উপভাষায় pied/piebald অর্থে এরই মধ্যে প্রচলিত?
আমি শুনলাম যে বহুকাল ধরেই সাদা-কালো প্রাণী বাংলা ভাষায় পাকরা নামে প্রচলিত আছে।
facebook
নতুন মন্তব্য করুন