অস্ত্রোপচার একটা হয়েছে বটে, সেটার ব্যথাও পুরোপুরি ভালো হয় নি এখনও, কিন্তু গুটলু আছে মহাসুখে! নিয়ম-নীতির কড়াকড়ি নেই। সারাদিন পড়ো পড়ো বলে চাপাচাপি নেই। কাজের মধ্যে এখন কাজ কেবল খাওয়া, ঘুম আর বাকি পুরোটা সময় গেম্স খেলা। অন্য সময় দিনে আধঘণ্টার বেশি কম্প্যুতে বসবার কথা কল্পনাও করতে পারে না সে। কিন্তু এখন! আহা!
“পড়াবি?”
বাল্যবন্ধু সুমনের পাল্লায় পড়ে ‘মহাকবি’ বনে যাবার উপক্রম হয়েছিল কিছুদিন আগে। এরপর থেকে টিউশনি নিবার আগে যোগ-বিয়োগ করি অনেক।
“ছাত্র না ছাত্রী?”
“ছাত্রী।”
“কস্মিন কালেও না!”
“মানে? আরে ব্যাটা ক্লাস ওয়ানের ‘শিশু’, লজ্জা পাওয়ার কিছু নাই।”
“তা শাফকাত কেমন করছে, ভাবী?”
“আর বলবেন না! পড়াশোনার তো ধারে-কাছেই নেই সে। সারাদিন শুধু গেম্স, কার্টুন আর কমিক্স! পড়তে তো বসাতেই পারি না ওকে!”
“ও মা ভাবী, আপনি বলছেন এ কথা! আমি তো এই ক’দিন সকাল-বিকেল-রাত যখনই যাই আপনার ওখানে, দেখি টেবিলে বসে একমনে ড্রয়িং প্র্যাকটিস করছে ছেলেটা! কী লক্ষ্মী ছেলে আপনার! আর মোটা ফ্রেমের ওই চশমাটায় যা মানিয়েছে না ওকে ভাবী, হঠাৎ দেখায় মনে হয় যেন কত বড় সায়েন্টিস্ট!”
ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হইয়া শয্যাশায়ী ও। সাথে নিজেরও কেমন ভার ভার লাগিতেছে মাথা, জ্বর হইবার পূর্ব লক্ষণ। পুত্রকে কহিলাম, “বাবা, আজ একটু নিজ হাতে খেয়ে নে? শরীরটা খারাপ লাগছে খুব, আমি একটু শুই গিয়ে?” ‘বাবা’ তখন কম্প্যু গেমে মত্ত। মহাজগতের আর কোথায় কী ঘটিতেছে, তাহা সম্পর্কে ভাবিবার বিন্দুমাত্র রুচি বা ফুরসত সেই মুহূর্তে তাহার নাই। অনুরোধ তাই পুনরাবৃত্তি করিতে করিতে শেষমেশ তৃতীয় বারের মাথায় তাহার কর্ণপটে আঘাত হানিতে সক্ষম হইল এবং তৎক্ষণাৎ রেডিমেড জবাব আসিল, “উঁহু, হবে না”।
যেমন হাহাকার করে মানুষ তার শৈশবকে ফিরে পেতে, জীবনের আর কোন সময়ের জন্য কি করে? আধো-আধো বোলে, হাঁটিহাঁটি পায়ে দুনিয়ার তাবৎ বাঁদরামি-গুণ্ডামি-ষণ্ডামি করে অতঃপর “থাক মেরো না, নেহায়েত ছোট মানুষ” নীতির আওতায় সাতখুন মাফ! ‘দুঃখ’, ‘কষ্ট’, ‘শোক’ ঘরানার শব্দই যার অভিধানে নেই, জগতে তার চেয়ে সুখী আর কে! যান্ত্রিকতার এই ‘কর্পোরেট’ নিষ্পেষণে চিঁড়ে-চ্যাপটা হতে হতে হঠাৎ হঠাৎই আজকাল মনে পড়ে ফেলে আসা সেই দিনগুলি। আহা, কী সুখেই না ছিলাম! সে জীবন তো আর ফিরে পাব না কোনদিন!