একদিন সব ভেঙে গিয়েছিল একলহমায় । সম্পর্কটাকে পরিত্যক্ত বাড়ির মতন পেছনে ফেলে পথে বার হয়ে গিয়েছিল তারা দু'জনেই । তিল তিল করে গড়ে ওঠা বহু সুখদুঃখের মুহূর্ত মালা থেকে ছিঁড়ে যাওয়া মুক্তোর মতন ছড়িয়ে পড়েছিল ধুলোয় বালিতে বাতাসে জলে আগুনে শূন্যে ।
মাঘদুপুরের ফড়িংডানা-রোদ্দুরে আস্তে আস্তে মিশে যায় তোমার জাফরানি ওড়নার রঙ। দিঘির পাশের নারকেলগাছগুলোর নিচ দিয়ে যে পথটুকু চলেছে আলোয় ছায়ায়, সেই পথের নাম ছায়াবিতান । এখন ঘুঘুর ঘুমেলা ডাকে ভরে আছে এই রাস্তা। আর একটু পরে এই পথ দিয়ে তুমি আসবে।
ছোট্টো সেই খাতা, প্রত্যেকটা পাতা হাতের পাতায় ধরে যায়।আর সেই কলমটি, ছিপছিপে পাতলা গাঢ় নীল রঙের কলম, গলার কাছে এক চিলতে সোনালীর ঝিকমিক।
কমলালেবুগন্ধী শীত-দুপুরের রোদে পা মেলে দিয়ে সাবধানে খুলি খাতা। পাতাগুলো জীর্ণ, পুরানো, ঝুরঝুরে। কতকাল কেটে গেল ঐ শৈশবের খেলাখেলা লেখাগুলোর পরে? কতবার সূর্যপ্রদক্ষিণ করে এলো পৃথিবী তার অন্তহীন পরিব্রজনের পথে?
আমার ছোট্টো নদীটা হারিয়ে গিয়েছিল। ওর নাম ছিল ক্ষমা, আমার পাথরঘরের কাছ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে যেত ওর চঞ্চল ধারা। ও ছিল ছোট্টোবেলার প্রিয় খেলার সাথীর মতন, স্বচ্ছ, অনাবিল, যার মধ্যে নিবিড় শান্তি আর আনন্দ, যার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যা্য, যার কাছে সব কথা বলা যায়। মধ্যগ্রীষ্মের প্রচন্ড বালিঝড়ে একদিন নদীটা নেই হয়ে গেল ।
তোমার চোখ দুটি ভারী আশ্চর্য ছিল। কেমন যেন গভীর, অতল, একটু উঁকি দিলেই মনে হতো টুপ করে পড়ে যাবো। সেই চোখে কখনো চিকমিক করতো রোদ্দুর, কখনো বা মেঘলা হয়ে যেত, কখনও আবার তারা ঝিকমিক করতো। তবু সেই চোখের অপার রহস্যের দুয়ার কোনোদিন খুলতো না আমার কাছে।
রাত্রি এক স্নিগ্ধ নদীর মত, ভোরের মোহনার দিকে বইছে চুপি চুপি। রাত্রি সেই প্রিয়তম মুখ, যা আমি কোনোদিন দেখিনি স্পষ্ট করে, স্বপ্নের ভিতরে আস্বচ্ছ নীলচে কুয়াশায় যে মুখের আদল দেখি শুধু। তার আকুল চোখ দু'টি দেখতে পাই, কিন্তু মুখের বাকী অংশ আচ্ছন্ন হয়ে থাকে স্বপ্ন-কুহেলিতে।
নরম ফুরফুরে পালকের মতন উড়ে যায় না-পাঠানো চিঠিরা, অথবা টুকরো টুকরো হাল্কা মেঘের মতন। স্পর্শের মায়াটুকু শুধু রয়ে যায়, অকারণ বিষাদের মতন।
কত চিঠিই তো লেখা হয়েও পাঠানো হয় নি, কত চিঠি লেখাই হয় নি । শুধু স্বপ্নের ভিতরের শ্বেতপাথরের টেবিলের উপরে ভাঁজ ভাঁজ করে সাজিয়ে রাখা ওরা। সব না লেখা চিঠি, কবিতা, গল্প, না গাওয়া গানের কলি, না ফোটা ফুলেরা ---
তোকে ছেড়ে যাইনি কখনও
সবসময়েই কাছে কাছে থাকি,
কিছু কথা আগুনের কাছে বলি। ওরা কিছু বা নিঃশেষে পুড়ে যায়, কিছু বা মিশে যায় লকলকে শিখায়, কিছু বা ধোঁয়া হয়ে যায়। ওদের আর দেখতে পাই না।
কিছু কথা নদীর কাছে বলি, নদীর পাশে ঝুঁকে পড়া অশ্বত্থের মূলে চুপ করে বসে বসে বলি নদীকে। স্রোতের টানে ফেনিয়ে ফেনিয়ে ওঠে নদী, কলকল কুলকুল করে নিজেও কত কথা বলে। আমার বলা কথা ঘূর্ণীতে ঘোরাতে ঘোরাতে কেজানে কোথায় নিয়ে যায়, হয়তো বা দূরের সমুদ্রে, যে সমুদ্র নাকি নীল।
নদীর একেবারে ধারেই গাছটা। পাড় থেকে জলের উপরে ঝুলে থাকা শিকড় কাঁপে ঢেউ লেগে লেগে। মাঝে মাঝে জলের জোর ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দেয় ওদের। ঝাপটা শেষ হলে ফোঁটা ফোঁটা মুক্তোর মতন জলবিন্দু ঝরতে থাকে। স্নান-অবশেষ জলকণা। অনেক উপরে রোদ্দুরে কাঁপে ওর নতুন পাতারা। নরম সবুজ রঙ তাদের। ওরা জন্মেছে এই বসন্তদিনে।
যেখানে ক্লান্ত, আহত ঈশ্বর বসে আছে নতমুখে-
সাদা পাখি হয়ে উড়ে এসে ঈশ্বরী
ডানার হাওয়ায় জুড়িয়ে দেয় সব তাপ-