সেইবার শরৎকালে অসংখ্য নীলপদ্ম ফুটেছিল দহে। পদ্মের সবুজ পাতাগুলো গোল গোল রুমালের মতন বিছিয়ে ছিল দহের জলতলের উপরে মিশে, সূর্যের নরম আলো খেলা করছিল পদ্মের পাপড়িতে, পাতায়, রেণুতে। অসংখ্য মৌমাছি ও ভোমরা ব্যস্ত ছিল ফুলে ফুলে। মাঝে মাঝে কোথা থেকে অশান্ত হাওয়া ছুটে আসতো, পদ্মের পাতাগুলো উলটে উলটে যেত, সঞ্চিতার মনে হতো ওরা হাত নেড়ে নেড়ে ওকে বলছে, যেও না যেও না, যেও না।
রূপকথার নক্ষত্রের আলো পড়েছে
সূর্য আকাশের বিষুববৃত্ত পার হয়ে একটু উত্তরে সরতেই ম্যাজিক হলো আবার। খড়-খড় রঙের শীতার্ত মাঠখানা ভরে গেল তরুণ নরম সবুজে। এখানে সেখানে মাথা তুললো ছোটো ছোটো সূর্যরঙের ফুল, ড্যান্ডেলিয়ন। আরো ফুটলো ছোট্টো ছোট্টো নীল তারার মতন দুপূরনীলা (আসল নাম না এটা) ফুলের রাশি, ওরা বেলা বাড়লে তবে ফোটে আবার সূর্য একটু ঢলে পড়লেই বুজে যায়। আরো ফুটলো বেগুনী, গোলাপী, বাসন্তী, লাল ঘাসফুল, নাম জানিনা ওদের কারুরই। নামে কীই ব
"ভুলে যা" "ভুলে যা" "ভুলে যা" বললেই কি কিছু ভোলা যায়? কোন্ বহুদূরের পাহাড়ের চূড়ার উৎস থেকে উৎপন্ন হয়ে, কত মাঠবন পার হয়ে, কোন্ সুখ-উঠানের পাশ দিয়ে কলকলিয়ে, কোন্ দুখ-পাথরের গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বয়ে যেতে থাকা ছলাৎছল নদীকে কি উৎসে ফিরে যা বললেই সে ফিরতে পারে?
শীতপাহাড়ী কুয়াশার ভিতরে একলা চুপচাপ
দাঁড়িয়ে থাকা এক দৃষ্টিহীন সরলগাছ
আমাকে বলেছিল, "জানো, দক্ষিণে বসন্ত এসে গিয়েছে?"
আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, সে জানলো কেমন করে?
এখনও তো যাযাবর পাখিরা ফিরে আসে নি!
বাতাসের ভিতর অস্ফুট গানের মতন ফিসফিস করে
সে বললো,"ভাবছো আমি জানলাম কেমন করে?"
আমি ওর খসখসে বাদামী কান্ডের উপরে হাত রাখলাম,
আলো। ছায়া। রঙ। কম্পন। হাসি। কান্না। রোদ। মেঘ। বৃষ্টি। জীবনতৃষ্ণা। শিমূল, পলাশ, সূর্যমুখী, শিউলি, স্থলপদ্ম, নীলকমল। গোছা গোছা সূর্যমুখী ফুটে আছে রঙপাগল চিত্রকরের আঁকা ছবিতে। কী সতেজ, কী উজ্জ্বল! মনপ্রাণ উজার করা আলোছায়ার কম্পন।
সে অনেকদিন আগের কথা। দূর দক্ষিণের এক ছোট্টো সবুজ শহরে তখন থাকতাম। আপনদেশের মাঠের থেকে শিকড়সমেত উপড়ে নেওয়া একলা একটা গাছের মতন গিয়ে সেখানে যখন প্রথম নামলাম, তখন ঘোর শীত। গাছপালা বেশীরভাগই পাতাহীন বিবর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু চিরসবুজ পাইনেরা সবুজ করে রেখেছে শহরের আকাশরেখা। তারপরে প্রকৃতির অনিবার্য নিয়মে সূর্য সরে গেল উত্তরে, হয়তো কোনো দূর কাননের কুন্দকলি করুণ চোখে শেষ চাওয়া চেয়ে নিয়ে ঝরে গেল ধূলায়।
দাঁড়িয়ে আছি একটা মস্ত ঘরের মধ্যে, হা হা করছে ফাঁকা ঘর, কোনো জানালা নেই, শুধু অদ্ভুত সবুজ রঙের দেওয়াল ঘরের চারিদিকে। ছাদ অনেক উঁচুতে। ছাদ থেকে ঝুলছে একটা সোনালি শিকলি, তার ডগায় একটা অদ্ভুত আকৃতির পলকাটা ঝাড়বাতির মতন জিনিস, কিন্তু আলো জ্বলছে না সেখানে। শুধু কোথা থেকে লুকানো আলো এসে ওটার উপরে পড়ে চিকমিক করছে।
কারা যেন কানের কাছে ফিসফিস করে ওঠে, শুনতে পাই অনেক গলার স্বর-- কোনোটা হাল্কা কচি স্বর, কোনোটা গম্ভীর জোরালো, কোনোটা মেয়েলী কোমল স্বর-প্রায় গানের মতন সুরেলা, কোনোটা দানা-দানা পুরুষালী স্বর, কোনোটা তীক্ষ্ণ চড়া স্বর, কোনোটা তরুপত্রে বাতাসের মর্মরের মতন নরম স্বর। ওরা বলে, "বলবে না আমাদের কথা?"
একাকী নদীটির ধারা আলোর সীমা ছাড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে চলে গেছে চুপচাপ। গভীর, নীল, নির্জন স্রোত। আধা ঘুম, আধো জাগা সেই ধারা বয়ে চলেছে নিজেরই নীলাভ সবুজ স্বপ্নের ভিতর দিয়ে।