একদিন ঝড়ের রাতে মাতাল নাচের বৃত্তে তাকে দেখেছিলাম প্রথম। ভবঘুরে ধূমকেতুটির মতন নক্ষত্রারণ্যে একা। বুকে ঢেউ উঠেছিলো সেদিন ঝঞ্ঝা-উত্তাল সমুদ্রের মতন। পরে যখনই কাছাকাছি হয়েছি, তখনই জেগেছে ঢেউ, কখনো সমুদ্রে, কখনো বুনো ঘাসঝোপে।
কেমন একটা অবাক-ঠান্ডা লাগছিল, যেন এইমাত্র জন্মালাম। মায়ের উষ্ণ গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে যেন এসে পড়েছি এক বিপুলবিস্তার জগতে। সেখানে অনেক আলো, অনেক হাওয়া আর অদ্ভুত কনকনে এক হঠাৎ শীত যাতে অভ্যস্ত হতে আরো সময় লাগবে। একটা পর্দা যেন সরে যাচ্ছিল মনের চোখের উপর থেকে। আর, এক আশ্চর্য কোমল সম্মোহনী শব্দ আসছিল, কোনো স্রোতের শব্দ। পরে সেই স্রোতের উৎস খুঁজে পেয়েছিলাম, একটা ছোট্টো ঝর্ণার মতন, দু'পাশে সারি সারি পাইনের
এখন এখানে বাতাস স্থির, রোদ্দুরের মধ্য দিয়ে ধোঁয়ার মতন কীযেন আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। এই শুকনো গরমে সব কিছু কেমন পুড়ে পুড়ে ওঠে। অথবা আমার চোখেই সব দগ্ধ লাগে? লালচে বাদামী পর্দা দোলে চোখের সামনে?
জ্যোৎস্নারাতের ড্রইং খাতায় ফেলে আসি আমার নীল পালকের পাখিদের। আরো ফেলে আসি লালচে-বাদামী ভুলভ্রান্তির বিষাদ-দাগ, সাদা হয়ে নামা তুমুল বৃষ্টির ঝরোখার ওপারে হারিয়ে যাক ওরা। অবিশ্রান্ত বর্ষণে ধুয়ে যাক, ধুয়ে যাক ওদের সবকটি আঁচড়।
প্রতিদিন সকালে ইমেল দেখা শেষ হলেই ঢুকি সচলায়নে। একদম নিয়ম হয়ে গেছে। একদিন ঢুকতে গিয়ে দেখি পাতাটা খোলে না। প্রথমে ভাবলাম হয়তো সাময়িক কোনো সমস্যা, দ্রুত নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পরে আবার চেষ্টা করলাম, খুললো না। সারাদিনে পারলাম না খুলতে।
চৈত্ররাত্রির তারা-ছলছল অন্ধকারের ভিতর দিয়ে তোর পায়ের চিহ্ন খুঁজে খুঁজে হাঁটতে থাকি, হাঁটতে থাকি, হাঁটতে থাকি। এ অন্বেষণের কথা কেউ জানে না, কেউ জানবেও না কোনোদিন। শুধু আকাশ ধরে রাখবে স্মৃতি, দ্যুতিময় মেঘের ডানার ভিতরে, সঙ্গোপণে। ভোরে এসে তুই দেখবি পড়ে আছে নীলকন্ঠের পরিত্যক্ত পালক আর ম্লান রক্তকরবীর কঙ্কণ।
রাত্রির অন্বেষণকথা জানে না দিনের আলো
অবাক বাতাস তার কানে কানে বলে ইতিহাস,
আলো আর ছায়া, মেঘ আর রোদ। বৃষ্টি আর বিদ্যুৎ। এরা ঘুরে ঘুরে লিখে যাচ্ছে ধারাপাত আর বর্ণপরিচয়। গণিত, গান, গল্প, কবিতা। রচনা করে চলেছে অনন্ত সুর আর অগণিত কাহিনী। দেখতে পাই তবু পাই না। শুনতে যেন পাই মনে হয়, তারপরেই দেখি - না তো! মাঝে মাঝে যেন মনে হয় ওদের ভাষা একদিন বুঝতাম, কিন্তু তারপরেই চমকে জেগে উঠে দেখি- স্বপ্ন!
পুরানো ক্যালেন্ডারের নীল রঙের তারিখগুলোতে লুকানো অশ্রু আর লালরঙের তারিখগুলোতে লুকানো রাগ, সব রয়ে গেছে ঐসব দিনগুলোর খাঁজে-খাঁজে ভাঁজে-ভাঁজে। নিষ্ফল অশ্রুর বৃষ্টি যা শুধু নিজের ভিতরটাকেই ভিজিয়েছে আর নিষ্ফল ক্রোধের আগুন যা শুধু নিজের হৃদয়কেই পুড়িয়ে পুড়িয়ে মরে গেছে। আজ পিছনে ফিরে দেখি সব ঐসব দিনের মধ্যেই রয়ে গেছে, নিজের সঙ্গে কিছুই নিয়ে আসিনি। কিংবা হয়তো এনেছি, হয়তো স্মৃতির পাথরে ভাস্কর্য করে গেছে ওরা
বিরাট এক স্পন্দনশীল অন্ধকার আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরেছে, চারিদিকে কালো জল ছলছল করছে। ওর মধ্য দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে বেরিয়ে আসতে চাইছি আলোয়। তখনও কালো বা আলোর কথা ঠিক বুঝতে পারি না, কিন্তু একটা অদ্ভুত তাড়না আমায় ঠেলা মারে, আমার সদ্য তৈরী হওয়া মগজে কোটি কোটি বছর আগের যে স্মৃতি খোদাই হয়ে আছে, সেই স্মৃতিই আমার পূর্বসংস্কার, সেই আমাকে জানায় আলো আর কালোর গল্প।
লামেহা অব্যয়বোঝাই ঝোলাটা কাঁধে তুলে নিয়ে রওনা দেয় সবুজ-জমি বালি-জমি পাথর-জমি পার হয়ে নীল পর্বতের দিকে। সে চলে, চলে আর চলে। ভোরবেলার কোমল টুকটুকে সূর্য ঝকঝকে রাগী হয়ে আকাশের কত উপরে উঠে গেছে, লামেহার চলা থামে না তখনো। অব্যয়গুলো তার ঝোলায় কোলাহল করে। আঁ আঁ আহ আহ ঈশ কিংবা সুতরাং এবং ইত্যাদিরা নানারকম সুরে গান ও কথা চালাতে থাকে। ঠিক দুপুরবেলায় ক্লান্ত লামেহা ঝোলা নামিয়ে শুয়ে পড়ে পান্থপাদপের ছায়ায়।