অরণ্যা থাকতো একটা গোল গন্ডীর ভিতরে, একটা বৃত্ত। কিন্তু বৃত্তটাকে দেখা যেতো না। অরণ্যা যখনই চলতে চাইতো, সোজা চলতে চলতে একজায়গায় পৌঁছে কিছুতেই আর তার থেকে দূরে যেতে পারতো না, আবার ফিরে আসতে হতো চেনার দিকে। কেবল সে দূরের একটা নদীর আভাস দেখতো সে, একটা নীলচে পাহাড়ও যেন দেখতে পেতো, আর ওর মনে হতো কোথায় দূরে দূরে দূরে কী যেন রয়েছে অচেনা। কী অপূর্ব সেই অচেনা! কেন সে সেখানে যেতে পারে না?
সন্ধ্যা সন্ধ্যা ধূপছায়া-আলোর ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, একটা নীল পর্দা সামনে, আরো কাছে গিয়ে দেখি নীলের উপরে লাল আর সবুজ দিয়ে ইকড়িমিকড়ি নকশা, কীসের ছবি চিনতে পারি না। কখনো মনে হয় ডানা মেলা পাখির দল ফট ফট করে উড়ে যাচ্ছে ঘুরতে ঘুরতে, আবার কখনো মনে হয় লালমাথাওয়ালা শত শত উদয়নাগ, সেই সাপগুলো সব একসাথে ফণা তুলে নাচছে। হাওয়ায় পর্দা সরে গেল, টুক করে ঢুকে পড়লাম একটা ঘরে। সেই ঘরে চারিদিকে আশ্চর্য সব ছবি ঝুলছে,
আমি সবসময় স্বপ্নে ছিলাম। একদম ছোট্টো থেকে, শৈশবের যতদূর মনে করতে পারি ততদূর পর্যন্ত নিজেকে স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পাই। ঘুমের ঘরের মধ্যে স্বপ্নের নীল বিছানা, রেশমী চাদরে ঢাকা। ধূপের ধোঁয়া দিয়ে ঘেরা। মেঝেতে লাল আর সাদা চৌকো চৌকো নকশা, সেই ঘরেই আমি শুরু থেকে রয়ে গেছি।
আমি তাকে বিকেল থেকে চিনতাম, সেই তখন থেকে, যখন আলো ছিলো অনেক বেশি। মাঠের সবুজ জ্বলজ্বল করছিলো, তার উপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিলো আমাদের কাকজোড়া খেলা। মাথার উপরে উপুড় হওয়া আকাশে নীলের সঙ্গে ভাব করে উড়ছিলো সাদা, সবুজ, লাল গোলাপী ঘুড়ি- ঘুড়ির পাশে ঘুড়ি।
শীতের দুপুরজাগা কমলা রঙের রোদ্দুরের মধ্যে মিশে থাকা প্রিয় শব্দমালা, "হরেএএএক মাল পাঁচসিকা"র ফেরিওয়ালা, শিল-খোটাও ওয়ালা, টিন আর লোহা ওয়ালা। আরও ছিলো কাগজকুড়ানি মেয়ে, নিঃশব্দ, ছেঁড়াখোঁড়া রঙ জ্বলে যাওয়া ফ্রক পরা, রুখু চুল লালচেবাদামী হয়ে গেছে রোদে রোদে। কোথায় তারা আজকে?
শেষরাত্রির কুয়াশার জালে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে নিশিজাগরণক্লান্ত সাদাটে চাঁদ, দিঘির আয়নাজলে তার ছবি কেঁপে উঠলো ঘুমভাঙা মাছের আঁকাবাঁকা জলকেলিতে। অক্ষয়বটের ছায়া ঘন হয়ে ছড়িয়ে আছে ঘাটে। সেখানে চুপ করে বসে আছে শ্রমণা, সে আজ জাগনরাত কাটিয়েছে ওখানেই, কেজানে কী ব্রত ছিলো!
স্বপ্নচিঠি ভর্তি করি মেঘের খামে
মুখ এঁটে দিই শক্ত করে ঠোঁটের ঘামে,
পাঠিয়ে দিয়ে মাঝআকাশে
চুপকথাদের দিঘির পাশে
ভোর হয়ে আসে পুবের দিগন্তে। একটা অতি হাল্কা সাদা আলোর চাদর এসে পড়ে মাটিতে, সেই ক্ষীণ নীহারশুভ্র আলোয় ঢেকে যায় নক্ষত্রমালা, হারিয়ে যায় সেই টলটলে নিবিড় রাত্রিনীল যার মধ্যে মণিকণার মতন টলমল দুলছিলো নক্ষত্রেরা, নীহারিকাসমূহ ছড়িয়ে ছিলো শুভ্র উর্ণাতন্তুর মতন!
নীলাভ সাদা রহস্যের ঠান্ডা আলো পার হয়ে সবুজ মেরুজ্যোতিতে মিলিয়ে যায় ভবিষ্যযান, যাত্রীরা স্মৃতি হয়ে যায়, রয়ে যায় শুধু আমাদের নিওলিথিক স্বপ্নে। বহু লক্ষ বছর পরে কখনো জেগে উঠবে বলে। লোনা হাওয়া ছুটে আসে সমুদ্র থেকে, পরাক্রান্ত সেই হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে যায় আনাচে কানাচের জমা হওয়া ধূলিবসন।
টলটলায়মান অবস্থায় এসে কোনোরকমে নিজেকে ঢেলে দিলাম বিছানায়, "বিছানায় বিছাইয়া দিলাম" বলা যেতো কাব্য করে। কিন্তু কাব্যের অবস্থা নাই, ক্লান্তিতে আধামরা অবস্থা। অথচ ঘুম আসে না, ক্লান্তি একটা আলগা পোশাকের মতন জড়িয়ে থাকে দেহমনের উপরে। রাত এখন অনেক।
এইসব চৈত্রদিনে সেই বাড়িটা মনে পড়ে। ছোট্টো একটা বাড়ি, চারপাশে একটু উঠান আর ফলফলারির গাছ। বেড়ালতার বেড়া দেওয়া সীমানা। তার পরেই বিরাট এক আদিগন্ত ধানক্ষেত। আর একটা শিমূলগাছ, বাড়ীর লাগোয়া দক্ষিণের একটুখানি ফাঁকা জমিতে। ওটা ধানক্ষেতের পাশেই। আশ্চর্য গাছ এই শিমূল, শীতে পাতাটাতা সব ঝরে ন্যাড়া ডালপালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, শীতের শেষে হঠাত করে ভরে যায় কুঁড়িতে,সেই কুঁড়ি ফুটে টকটকে লাল ফুলের মেলা বসে যায় বসন্তে,