[এইটা একটা ফাঁকিবাজি পর্ব]
আর কথা খুঁজে পায় না। চুপ হয়ে যায় দু'জনেই, বেশ কিছুক্ষণের জন্যে। বেশ অস্বস্তিকর নীরবতা বেশ কিছুক্ষণ। এদিকে মনে মনে অস্থির হয়ে উঠছে হেলাল। একবার ঘড়ির দিকে তাকায়। বেশী সময় আর হাতে নেই। আরও ছোটখাট কিছু কাজ এখনও বাকি রয়ে গেছে।
মাথার ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করে। চট করে কিছু মনে পড়ে না। কোথায় আছে কেন আছে বুঝে উঠতে বেশ সময় লাগে। চোখের পাতা খুলতেও কষ্ট হচ্ছে ওর। নিজের শরীরের ওজনও যেন অনুভব করতে পারছে। ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে আবার। চোখ খোলে। কিন্তু কিচ্ছু দেখতে পায় না। শুধু নিকষ কাল, একেবারে অন্ধকার, আলোর ছিটেফোটাও নেই কোথাও। প্রচণ্ড ভয়ে আত্না শুকিয়ে আসে। ওরা কি ওকে অন্ধ করে দিয়েছে তাহলে?
ডাইনিংএ মেয়েটার সাথে প্রায় প্রতিদিন দেখা হয়। এটা একটা আশ্চর্য ব্যপার। ওর খেতে যাওয়ার সময়ের কোন ঠিক নেই। খাওয়া দাওয়ায় ওর বরাবরই অনিয়ম। দেশে থাকতে তাও বাসার সবার সাথে বসে সবার সাথে খাওয়া হত, তাই কিছুটা হলেও একটা সময়সূচী ছিল। কিন্তু এখন তো সেরকম কোন বালাই নেই। কোনদিন ডিনার করে সন্ধ্যা ছয়টায় তো কোনদিন রাত বারটায়। কিন্তু ডাইনিং এ যাওয়ার তিন থেকে চার মিনিটের মধ্যে মেয়েটা হাজির। কোন কথা বলে না মেয়েটা। একটু নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বসে থাকে শুধু।
গ্রীসের একেবারে দক্ষিণের শান্ত শহর কালামাতা। একেবারে মেডিটেরিয়ান সী এর কোলঘেঁষা শহর। শহরের একেবারে দক্ষিণে সাগরের কোল ঘেঁষে চলে গেছে একটা রাস্তা, পসিডোনাস এভিনিউ। এমনিতে খুব বেশী লোকসমাগমস নেই, শহরটার মতই শান্ত, কিন্তু মাঝে মাঝে আশে-পাশের বাড়িঘরের মানুষের কান ঝালাপালা করে প্রচণ্ড গর্জন করে চলে যায় রেসিং কার। কার রেসিং এই রাস্তায় নিত্যদিনের ঘটনা। রাস্তার দক্ষিণে সাগর, নগরের শাসনে অনেকটাই শান্ত। ইয়াট আর স্পিডবোটের জন্যে জেটি করা আছে সেখানে।
টিএ শেষ করেই এক দৌড়ে বিল্ডিংএর পাঁচতলায় উঠে যায়। মাথায় বনবন করে সেই এক কথাই ঘুরছে শুধু, কামালি আর অনি, অনি আর কামালি, যোগসূত্রটা কোথায়? কিছুতেই ভেবে পায়না। মাথায় ঘুরতে থাকে অনির রেখে যাওয়া সেই নোট আর ছয়টা সার্কেল আর ছয়টা নাম। কামালির রুমে গিয়ে একটু দেখতে চায়, কোন অন্যরকম কিছু চোখে পড়ে কিনা। অন্যরকম কিছু কেন খুঁজছে হেলাল? অন্যরকম কোন কিছুতে তো ওর বিশ্বাস নেই! কিন্তু অনির ওই নোটের কথা শোনার পর থেকে হুট করে সবকিছু উড়িয়েও দিতে পারছেনা। এতদিনের বিশ্বাসে কি একটু চিঁড় ধরে ওর? বিশ্বাস কি এত সস্তা? নিজের মনে ভাবতে ভাবতে পাঁচতলায় উঠে আসে।
ঠাণ্ডা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। বরফ পড়া এখনো শুরু হয়নি যদিও, কিন্তু উইন্ডচিল আসলে বরফের চেয়েও খারাপ। বাতাস না থাকলে এখানে মাইনাস পাঁচ-দশেও দিব্যি একটা জ্যাকেট পরে চালিয়ে দেয়া যায়। আর বাংলাদেশের কাঁঠাল-পাকা শীতেও বাতাস আর কুয়াশার জন্যে মাফলার ছাড়া বের হওয়া যায় না। মানুষ যতটা ভাবে এখানে আসার আগে, ব্যাপারটা আসলে অতটা খারাপ না। শীতে একদিকে যেমন কষ্ট আরেকদিকে তেমন আরাম, যদি কাজকর্ম না থাকে আরকি। প্রফেসর এক সপ্তাহের জন্যে আম্রিকা গেছে, কি জানি কনফারেন্সে। সেই সুযোগের প্রথম দিন আজকে, সকালে ইচ্ছে করেই ঘড়ি আর মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রাখা যাতে ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। শীতের সকালে লেপ কাঁথা মুড়ি দিয়ে জাগা-জাগা ঘুম ঘুমাতে হয়। মরার মত ঘুমালে শীতের ঘুম আসলে পুরাই মাটি।
‘জীবনটা এইভাবে কাইটা গেলে মন্দ হইত না’ ভাবতে ভাবতে আবার জাগা জাগা ঘুমে তলিয়ে যায়। দু-একটা মনোরম আধা-উষ্ণ স্বপ্নও বোধহয় দেখা শুরু করে। প্রচণ্ড উইন্ডচিলের মধ্যেও স্বপ্নের বালিকারা বেশ খোলামেলা, বাতাস তাদের কাপড় উড়িয়ে নিয়ে যায় যায়, শীতে কাঁপতে কাঁপতে বালিকারা লেপের নীচে আশ্রয় নিতে চাইছে বোধহয়, স্বপ্নটা কেবল জমে উঠছে, এমন সময় বেরসিকের মত চুতমারানি মোবাইলটা বেজে ওঠে। ‘থাক ধইরা কাম নাই, এত সক্কালে কোন বালছাল ফোন দিছে!’, কেটে দেয় গালি দিতে দিতে। একটু পরে আবার বেজে ওঠে, ধরে না, কিন্তু আবার বাজে। বেশ কয়েকবার। মেজাজ খারাপ করে ফোন ধরে অবশেষে,
ওরা এক বাসায় তিনজন থাকে। রাসেল, তন্ময় আর তাহসীন। ব্যাচেলর গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টদের জন্যে এটাই সবচেয়ে ভাল ব্যবস্থা। একটা দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট। একজন লিভিংরুমে থাকে। খাওয়া দাওয়া একসাথে, রুটিন অনুযায়ী রান্না। ওদের অ্যাপার্টমেন্টের ঠিক উপরতলায়ই একটা এক বেডরুমের ফ্ল্যাট। কামালি ভাই ওখানেই থাকে। কামালিকে এখানকার সবাই 'কামালি ভাই' বলেই ডাকে।