টাল বাদশা জাহাঙ্গীরের বউ নূর জাহান ছিলেন ব্যাপক চালাক মহিলা। তার আগের ঘরের একটা মেয়ে ছিল, মোগলাই খুঁটি শক্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি সেই মেয়ের সাথে বিয়ে লাগালেন জাহাঙ্গীরের ছোট ছেলে শাহরিয়ারের। এইবার নূর জাহান ভাবলেন জামাতা শাহরিয়ার বাদশা হলেই কিল্লা ফতে!
মুস্কিল বাধালেন নূর জাহানেরই ভাই আসফ খাঁ সায়েব, তার মেয়ে মুমতাজ মহলের সাথে তখন জাহাঙ্গিরের তিন নং ছেলে খুররমের ব্যাপক ভালোবাসাবাসি। আসফ খাঁয়ের টার্গেট পরিষ্কারঃ শাহরিয়ারের গুলি মারি, তখতে বসাতে হবে জামাতা খুররমকে।
এই লাগল ভাইবোনে জামাতা ঘটিত গিয়াঞ্জাম।
আগস্ট মাস, ১৬৫৯। দিল্লী।
নাজিরের কথাঃ
জিনিসটা ধরে আমি মুখ কুঁচকে বললাম, এহ দুনিয়ার রক্ত। এইটা দেখে কিছু বুঝার উপায় আছে নাকি?
আছে, মোতালিব ঘাড় নেড়ে বলল, যে চেনার সে ঠিকই চিনবে। সময় অল্প, বাহাসের সময় নাই। ধুয়ে পরিষ্কার করি আয়। বাইরে পানি আছে না?
আব্বা তুমি নাকি হাতির খেলা দেখাও?
শিশু নাসিরুদ্দিনের কথায় একটু হাসে আজিম, হ দেখাই। এখন খা।
আলুভাজি রুটির দিকে তাকালোই না নাসিরুদ্দিন। মুগ্ধ চোখে পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমারে নিয়া যাইবা আব্বা হাতির খেলায়? আমি তোমার মত হইতে চাই। আমারে খেল শিখাইবা?
পাশে বসা নাসিরুদ্দিনের মা একটু শিউরে উঠে ছেলেকে একহাতে জড়িয়ে বলে না না, হাতির খেল তোরে শিখতে হইব না। তুই লেখাপড়া কইরা কাছারিতে যাবি, দেখবি তোর কত সম্মান হইব।
কাছারিতে কি হাতি আছে আম্মা?
মোগল বাদশাদের সবসময়ই ধারণা ছিল সফরের সময় পাত্রমিত্রসিপাইসান্ত্রী কাঁধে নিয়ে ঘুরলে বিপদেআপদে কাজে আসবে। সফরের মূলমন্ত্র ছিল গতি, থামা চলবে না। বলা হত এমনকি চমৎকার দিলখোশ নদীর পারের সূর্যাস্তের ভিউওলা স্থানেও এক রাতের বেশী দুরাত আরাম করে তাঁবু গেড়ে বসা যাবেনা অযথা। আওরঙ্গজেব বলেনঃ “সম্রাটের কখনোই আয়েসে গা ঢেলে আরামে মত্ত হওয়া যাবেনা। এভাবেই একের পর এক দুর্বল রাজ্য হার মেনেছে। সবসময় চলার উপর থাকতে হবে যথাসম্ভব। উত্তম রাজা বহমান পানির ধারার মতই, থেমে গেলে সর্বনাশ।”
আওরঙ্গজেব এই সর্বদা দৌড়ের উপর থাকার পলিসি খাটিয়ে নিজের বাপকেও কোণঠাসা করে এনেছিলেন, পিতা শাজাহান আগ্রা আর দিল্লীতেই ছিলেন গ্যাঁট হয়ে বসা।
মোগল সম্রাটদের মধ্যে তৃতীয় আকবরেরই প্রথম হিন্দুস্তান পছন্দ হয়। পিতামহ বাবুরের মত তিনি ভারতের আদব লেহাজ কায়দা কানুন দেখে নাক সিটকে ছ্যা ছ্যা করেননি, হারানো মধ্য এশিয়ার ফেলে আসা ঘরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলার বদলে তিনি সুগঠিত মোগল হিন্দুস্তান গড়ার দিকে মন দেন। এই করতে গিয়ে তিনি বাপদাদার পলিসি বদলে দিতে থাকেন। প্রচুর হিন্দু মন্ত্রীমিনিস্টার দরবারে আনা হল, বাবুর হুমায়ুনের আমলে যত ছিল তার প্রায় কয়েকগুণ। ধর্মীয় বৈষম্যমূলক জিজিয়া কর বাতিল করা হল, রাজস্থান হাতড়ে যে সব হিন্দু বউ তিনি ধরে এনেছিলেন তাদের হারেমে নিজস্ব কোয়ার্টারে দেবদেবী পূজা করার অনুমতি মিলল। মাঝে মাঝে তিনি তাদের সাথে দিওয়ালিও উদযাপন করতেন।
প্রিয় পাঠক আজ আপনাকে পড়া থেকে ছুটি দিয়ে দিলাম। প্লে বাটনে চিপি দিয়ে ভল্যুম বাড়িয়ে পিছনে হেলান দিয়ে দেখুন আওরঙ্গজেব আর শিবাজীর কিচ্ছা। সম্পূর্ণ রঙ্গীন।
ভিডিও ব্লগিং আনন্দময় হউক।
বসন্তকাল, ১৬৪১। দুই পর্তুগীজ পাদ্রীকে নিয়ে যাওয়া হয় লাহোরের এক চমকদার প্রাসাদের গ্র্যান্ড রিসেপশন রুমের লাগোয়া ব্যালকনিতে। প্রাসাদের মালিক মোগল সাম্রাজ্যের অন্যতম কুতুব আসফ খাঁ, আরজুমান্দ বানু বেগম ওরফে মুমতাজ মহলের পিতা।
ঐ সন্ধ্যায় আসফ খাঁ আর তার বউ মহান বাদশা শাজাহানকে চাট্টি ভাত খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিলেন। লুকিয়ে ব্যালকনি থেকে দুই পাদ্রী এই ব্যাপক খানাদানার আয়োজন দেখতে থাকেন হাঁ করে। ঝলমল করছে সিল্কি রূপালি সোনালি জরির কাজ করা কার্পেট, চতুর্দিকে মৌমৌ করছে সুগন্ধী আতরের বাস। রুমের ঠিক কেন্দ্রে মিহি মসলিনের কাজ করা টেবলক্লথ আর তার চারধারে নানবিধ কুশন। সোনামোতির হার গলায় ঝুলিয়ে রুমে ঢুকলেন মহান মোগল সম্রাট, আগেপিছে দাসীবান্দি সহকারে। কুশনে আরাম করে বসে সকলে হাত ধুয়ে নিলেন অত্যাধিক কচি ও ততোধিক সুন্দরী দাসীদের এগিয়ে দেওয়া পানিপাত্রে।
শাজাহান বাদশার ফ্যামিলিটি ছিল একটি আস্ত চিড়িয়াখানা। তার সাত ছেলেমেয়ের কেউ বাঘ তো কেউ সিঙ্গি, কেউ ধুর্ত শিয়াল তো কেউ মাথামোটা বেবুন। এক ভাই গান গায় তো আরেক ভাই কুরান মুখস্ত করে, এক বোন বই লেখে তো এক বোন সারাদিন আয়নার সামনে বসে কপালের টিপ সোজা করে। এক ভাই লালপানি টানতে টানতে ফার্সি বয়েত পড়ে তো আরেক ভাই কুস্তি লড়ে। ব্যাপক হুলস্থুল কান্ড। প্রতিটি বৃহৎ পরিবারের মতন সেখানে দলাদলিও ছিল, যাকে বলে রাজকীয় দলাদলি। বড়ভাইবোন দারা আর জাহানারা এক টীম, পিতার আশির্বাদধন্য। পরে অবশ্য অসুস্থ হওয়ার পরে দারার ব্যবহারে শাজাহান কিছুটা সন্দিহান হন, তবে কন্যা জাহানারাকে আমৃত্যু অত্যাধিক স্নেহ করতেন সম্রাট। পাঠক “অত্যাধিক” শব্দটি খেয়াল করবেন। অনেকেই এর বিশেষ অর্থ করেন যা কখনোই প্রমাণিত হয়নি।
টীম নম্বর দুই তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেব আর দ্বিতীয় কন্যা রওশনআরা। মৌলবাদী আওরঙ্গজেবের চক্ষের বিষ দারাশুকো, আর কুটিল রওশনআরার টার্গেট বড়বোন জাহানারা। আমে দুধে হল মিল। রওশনআরা ছিলেন হারেমে আওরঙ্গজেবের স্পাই। দ্বিতীয় পুত্র শা সুজা একটি প্রকৃত ইডিয়ট, মদ খেয়ে গদির স্বপ্ন দেখা ছাড়া তিনি তেমন কিছু করতেন না। এই রাজপুত্রের পারস্যের প্রতি বিশেষ আকর্ষন ছিল, শিয়াদের তিনি খুব ভালো পেতেন। আওরঙ্গজেব পরে ছড়িয়েছিলেন যে সুজা শিয়া হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তা সত্য নয়। আওরঙ্গজেব সত্য বলতেন অল্পই।
কোলকাতা জয় করে নবাব মুর্শিদাবাদ ফিরে গেছেন। ইংরেজ বাহিনীর ক্ষুদ্র অংশ ফুলতা গ্রামে দুর্দশার মধ্যে আছে। বাংলা পতনের খবর অন্য বড় ইংরেজ কুঠি মাদ্রাজে এখনো যায়নি। এরকম অবস্থায় শেষ হয়েছিল গত পর্ব। আজ ইংরেজ মাদ্রাজ থেকে জাহাজ পাঠিয়ে কোলকাতা পুনর্দখল করবে, হুগলীতে অন্যান্য ইয়োরোপীয় জাতের সাথে কাইজা লাগাবে আর নবাব ফৌজের হাতে মারা যাবেন কাজিন শওকত জং। এছাড়া বাংলা অ্যাফেয়ারে প্রথমবারের মত নোংরা নাকটি গলাবেন কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ।
শাজাহান বাদশা আর মমতাজ মহলের দ্বিতীয় পুত্র শা সুজা ছিলেন একটি অপদার্থ, জীবনে তিনি তেমন কিছুই করে যেতে পারেননি। কিন্তু তাই বলে যে পন্থায় তার ও তার পরিবারের বাত্তি নিভিয়ে দেয়া হয় তা এমনকি শয়তানের পয়গম্বর আওরঙ্গজেবেরও পাওনা ছিলনা। জেনারেল মীর জুমলার ধাওয়া খেয়ে পলাতক রাজপুত্র সুজা পরিবারসহ গিয়ে ওঠেন আরাকান রাজার আশ্রয়ে। কথা ছিল রাজা মক্কাগামী জাহাজের ব্যবস্থা করে দেবেন, বদলে সুজা দিবেন মণি মাণিক্য। কেউ কথা রাখেনি।