…
বিদ্বত্ত্বঞ্চ নৃপত্বঞ্চ নৈব তুল্যং কদাচন।
স্বদেশে পূজ্যতে রাজা বিদ্বান্ সর্বত্র পূজ্যতে।। ০১।। (চাণক্য নীতিশাস্ত্র)।
অর্থাৎ : বিদ্যাবত্তা এবং রাজপদ কখনোই সমান হয় না। রাজা কেবলমাত্র নিজ রাজ্যেই সম্মান পান, বিদ্বান (স্বদেশ-বিদেশ) সর্বত্র সম্মান পান।
চাণক্য নীতিশাস্ত্রের প্রথম শ্লোক এটি। শ্লোকটির বহুল ব্যবহৃত দ্বিতীয় চরণটা আমাদের কাছে খুবই পরিচিত মনে হওয়ার কথা। কারণ, ‘স্বদেশে পূজিত রাজা, বিদ্বান সর্বত্র’- এরকম একটা ভাবসম্প্রসারণের বিষয় মাধ্যমিক ক্লাসের জন্য যথার্থই বলা চলে। এবং মজার বিষয় হলো, এরকম একটা বিষয় নিয়ে ভাবতে বসলে আমরা যে-যত বিদ্যাদিগ্গজই হয়ে উঠি না কেন, বিশেষ ব্যতিক্রম বাদ দিলে, আমাদের মাধ্যমিক পর্যায়ের জ্ঞানটাই খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় হয়ে ওঠে।
চাণক্য
চাণক্যের প্রধান পরিচয় অতিপ্রসিদ্ধ একজন প্রাচীন ভারতীয় কূটনীতিজ্ঞ হিসেবে। মানবজীবনের প্রায় সকল কর্তব্যাকর্তব্য বিষয়ে তাঁর শ্লোকসমূহ শিক্ষিত অশিক্ষিত প্রায় সকলের কাছেই অল্পবিস্তর পরিচিত। ভারতীয় বিভিন্ন প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থে এযাবৎ যতজন পণ্ডিত-রত্নের কথা আমরা জানি, তাঁদের মধ্যে চাণক্যকেই সবচাইতে প্রতিভাবান ও বাস্তববাদী বলে মনে হয়। বিখ্যাত ‘অর্থশাস্ত্র’-প্রণেতা কৌটিল্য আর ‘চাণক্যশ্লোক’ নামে প্রসিদ্ধ শ্লোকসমূহের রচয়িতা একই ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও চাণক্যের একাধিক নামের মধ্যে কৌটিল্যও অন্যতম।
তাঁর একাধিক নাম বিষয়ে হেমচন্দ্রের ‘অভিধান-চিন্তামণি’ গ্রন্থে বলা হয়েছে-
‘বাৎস্যায়নো মল্লনাগঃ কৌটিল্যশ্চ ণকাত্মজঃ।
দ্রামিলঃ পক্ষিলস্বামী বিষ্ণুগুপ্তোহঙ্গুলশ্চ সঃ।।’
ভর্তৃহরি
.
সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য রক্ষিত না হওয়ায় সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম কবিশ্রেষ্ঠ ভর্তৃহরির জীবন-চরিতের জন্যে জনশ্রুতি-নির্ভর হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। বিভিন্ন জনশ্রুতি-প্রসূত তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকরা খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতককে ভর্তৃহরির অধিষ্ঠানকাল হিসেবে চিহ্নিত করেন। কিংবদন্তী অনুযায়ী- ভর্তৃহরি ছিলেন মালব দেশের অধিবাসী এবং জাতিতে ক্ষত্রিয়। রাজপরিবারে জন্মগ্রহণকারী ভর্তৃহরির পিতার নাম ছিলো গন্ধর্ব সেন। গন্ধর্ব সেনের দুই স্ত্রী। প্রথমা স্ত্রীর পুত্র ভর্তৃহরি এবং দ্বিতীয়া স্ত্রীর পুত্র বিক্রমাদিত্য- যার নামে ‘সম্বৎ’ সন বা ‘বিক্রমাব্দ’ প্রচলিত। উল্লেখ্য, বিক্রম সম্বৎ গণনা শুরু হয় ৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে।
প্রাচীন নীতিশাস্ত্র
.
প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে ‘নীতিশাস্ত্রম’ নামে একটি বিভাগ স্বীকার করা হয়। যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়- নীতিশাস্ত্র। নামের মধ্যেই যেহেতু শাস্ত্র কথাটি যুক্ত রয়েছে, তার উপর আবার সংস্কৃত ভাষা, তাই ধারণা হয় নিশ্চয়ই এতে মারাত্মক সব জটিল তত্ত্বের সমাহারে ভয়ঙ্কর সব শাস্ত্রীয় কপচানিই থাকবে। এবং যার ফলে, এ বিষয়ে বিরাট পাণ্ডিত্য ধারণ করা না-গেলে এই শাস্ত্র উপভোগের শুরুতেই সহজ-সরল সাধারণ পাঠক-মনে প্রথম যে ইচ্ছেটাই গজিয়ে ওঠা স্বাভাবিক, তা হলো- থাক্ বাবা! এ রাস্তায় এগোনোর চাইতে পাথর চিবানোও বুঝি সহজ কর্ম ! ভাগ্যিস এগুলো আসলে সে জাতীয় ভয়ঙ্কর কিছু নয়। এবং এগুলো যে মোটেও রসকষহীন কিছু নয়, বরং অধিকাংশই মনোগ্রাহী কাব্যধর্মী রচনা, এর উদ্দেশ্য থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। কারণ, এর উদ্দেশ্য হলো আকর্ষণীয় উপায়ে কিছু সদুপদেশ বিতরণ বা কাঙ্ক্ষিত কিছু নীতির প্রচার।