কাঁচা ঝাল হিসেবে একটা জিনিসই ব্যবহার করতাম পটপটির ফল। যার ভালো নাম রুয়েলিয়া। রুয়েলিয়ার ফল নিয়ে ছিল বিরাট আগ্রহ। কাঁচা পাকা দুই রকম ফলেই আমাদের আগ্রহ। কাঁচা ফল দিয়ে বানাতাম কাঁচা মরিচ। তবে বলে রাখি, রুয়েলিয়র ফল কিন্তু মোটেও ঝাল নয়। তবু কল্পনার রঙে তাকে ঝাল বানাতে আপত্তি কোথায়!
রুয়েলিয়া বুনো গুল্ম, একেবারে দুষ্প্রাপ্য নয়। কিন্তু তবুও এর ফল সহজে পাওয়া যেত না। কারণ ওগুলো সাবাড় করার জন্য আমাদের মতো ছেলেমেয়ের অভাব ছিল না। ফল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও ফুল নয়। ফুল দেখতে সাদামাটা। অবশ্য সেটা কিশোর চোখে। আজ চোখ বদলেছে। তাই রূপ বদলেছে রুয়েলিয়ার ফুলেরও। রীতিমতো মুগ্ধ করার মতো এক ফুল।
বর্ষায় বান ডাকে প্রকৃতিতে। ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে অঝরে ঝরে বৃষ্টি। সবুজে সবুজে ছেয়ে যায় প্রকৃতি। ভাঁট-আশশ্যাওড়ার দাপট পথের দুধারে। আকন্দ তো সারা বছরই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে বেগুনি সাদা ফুলের গয়নায় সেজে। বনওকড়ার চারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সবুজের মিছিলে। কিন্তু কিছু উদ্ভিদ একেবারে নীরবে-নিভৃতে চুপটি করে মাথা তুলে দাঁড়ায় সবুজের কোন্ গহীন কোণে। অনাদর অবহেলায় কখন বেড়ে ওঠে তার হদিস রাখে না কেউ। কিন্তু প্রয়োজন হলেই খোঁজ পড়ে। ওষুধ বানাতে হবে না! এখন তো ওদের বড্ড কদর।
মনভোলানো ফুলের নেশায়
আকাশটা কালো করে মেঘেরা আসে। ঝমঝম বৃষ্টি নামে গাঁয়ে। প্রকৃতিতে সবুজের প্রলেপ বুলিয়ে দেয় বর্ষা। মাঠে, জঙ্গলে, বাগানে। আম-কাঠালের বনে শুধু নয়। শীত আর গ্রীষ্মের অত্যাচারে এতদিন পর্যদুস্তু হয়ে হয়ে ছিল নাম-পরিচয়হীন গুল্মলতারা। এখন তাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সময়। ভাট-আশ্যাড়ার শরীরে আগেই বান ডেকেছে। কিন্তু কিছু গুল্মের বীজেরা মাটির গভীরে শুয়েছিল। অপেক্ষায় ছিল বর্ষার রিমঝিম শব্দের। এখন তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসবে আলোকের আহবানে। দুটি লকলকে কচি পাতা মাটি ভেদ করে বেরিয়ে আসবে প্রবল বিক্রমে। তারপর কয়েকদিনের অপেক্ষামাত্র। দুটি-চারটি-ছয়টি করে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়াবে তার পাতার সংখ্যা। বাড়বে ডাল-পালা। সবুজে সবুজে ছয়লাব হয়ে যাবে আম-কাঠালের বন, ফসল ক্ষেতের বেড়া, নদী-খাল-বিলের কিনারগুলো। সবুজের সেই রাহাজানিতে যোগ দেবে আমাদের বনওকড়া। তারপর শীতের শেষ পর্যন্ত তাদের রাজত্ব।
সরষেফুল শীতের মাঠকে অন্যরকম সৌন্দর্য দেয়। কিন্তু সেই সৌন্দর্যের আড়ালে হারিয়ে যায় প্রকৃতির ক্ষুদ্র অনেক সুন্দর। কবি গুরু যেমনটি বলেছিলেন, পার্বতমালা, সিন্ধু দেখতে গিয়ে ধানের শীষের ওপর শিশিরকণার সৌন্দর্য আমাদের দেখা হয়ে ওঠে না। শীতে সরষে ফুলের আগুনলাগা সৌন্দর্যও তেমন। মাঠ-ঘাটের অনেক সুন্দরকে আড়াল করে দেয়। বিশেষ করে ঘাসফুল তার নির্মম শিকার।
সাদা খইয়ের মতো ফুটে রয়েছে অজস্র মেঠোফুল। ভ্রমর, বোলতারা ব্যাকুল হয়ে ছুটোছুটি করছে কে কোনটার দখল নেবে। খই ভেবে যদি অবচেনে আপনার হাত চলে যায় পুষ্পমঞ্জরির দিকে। যেতে দিন। আলতো করে তুলে নিন একটা সাদা খই। নির্ভয়ে ফুলের বোটার দিকটা মুখে পুরতে পারেন রাখাল বালকের মতো। মিষ্টি একটা রস এনজামই বাড়িয়ে দেবে জিভের তালুতে। এরপর নিশ্চয়ই দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন গোল একটা চাকের ওপর। সুন্দর না!
ওটাই কিন্তু ফুলটার মঞ্জরি।
কিছু জিনিস থাকে প্রিয় থেকেও বেশি প্রিয়। আমার প্রিয় গাছের তালিকাটা বেশ লম্বা। কিন্তু অতিপ্রিয় গাছের কথা বললে সবার আগে আসবে পেটারির নাম। কবে কোথায় গাছটা প্রথম দেখি, সে স্মৃতি নিউরণের অতল সমুদ্রে গা ঢাকা দিয়েছে। তবে প্রথম মুগ্ধতার কথা এখনও স্পষ্ট। সে প্রায় বছর পচিশেক আগের কথা। ৮৯-এর বর্ষণমূখর এক দিনে গিয়েছিলাম এক ফুপুর বাড়ি। গ্রামটা ভারি সুন্দর। ঝোপ-জঙ্গল, নদী, মাঠ, শস্য, ঘাসফুলে আচ্ছাদিত এক আদর্শ বাঙালী গ্রাম। বর্ষার বিশুদ্ধ পানিতে গা ধুয়ে গোটা গ্রামটাই যেন পবিত্র চেহারা পেয়েছে। বৃষ্টিস্নাত গাছপালায় সবুজের অভিযান। সবুজ-সতেজ গাছপালা যেমন আমার শিশুহৃদয়ে দাগ কাটছিল, তেমনি বাহারি ফুলের নানা রঙে স্মৃতির ক্যানভাসে অঙ্কিত হচ্ছিল অমোচনীয় সব ছবি। সেই বর্ষার সেরা ছবি হয়ে আজও আমার মানসপটে গেঁথে আছে মামুলি এক মেঠো ফুল। এরপর পল্লীবাংলার কত গাঁয়ে, কত মাঠে কত অজস্রবার একে দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই। প্রতিবারই গাছটা আমার বুকে অন্যরকম এক অনুভূতির জন্ম দিয়েছে, বুনেছে অন্যরকম ভালবাসার জাল। আর স্মৃতির পর্দায় ডানা মেলেছে শৈশবের সেই ছবি।
ধুতরাকে গাঁয়ের মানুষে ভয় পায়। কারণ এর ফুল বড্ড বিষাক্ত। আমরাও ভয় পেতাম। কিন্তু মাঝে-মাঝেই ভুলে যেতাম ভয়ের কথা, ধুতরার বিষের কথা। মা-দাদীরা বলতেন, ধুতরোর ফুল নাকে শুঁকলে মানুষ পাগল হয়ে যায়। কথাটা কতটা সত্যি জানতাম না। তবে ধুতরোর ফুল নিয়ে খেলা করলেও নাকে শুঁকতাম না কখনও।
পেয়েছি! আর কিছু চায় না। এ যে বিভূতিভূষণের ময়নাকাঁটা। কত বন-বাঁদাড়ে এর খান তল্লাস করেছি, পায়নি। চিনিই না তো পাব কীভাবে? যারা দেখেছেন, চেনেন, তাঁদের মুখে বর্ণনা শুনে খোঁজার চেষ্টা করেছি। তবুও দেখা মেলেনি। আজ এভাবে অপ্রত্যাশিত দর্শনের কথা ভাবিইনি। ময়নাকাটা বাংলাদেশের সবজায়গায় ছিল কিনা জানা নেই। তবে আমাদের এলাকায় যে এর প্রাচুর্য ছিল তার সাক্ষ্য বিভূতিভূষণই দিয়েছেন।
তারপর সে ভয়ে ভয়ে বনের মধ্যকার সুঁড়িপথ দিয়ে বিছুটি লতার কর্কশ স্পর্শ গায়ে মেখে, সেঁয়াকুল কাঁটায় শাড়ির প্রান্ত ছিঁড়ে অতিকষ্টে এসে গ্রাম-প্রান্তের কাওয়ার পাড়ায় পা দিলে।
—ইছামতী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়