বছর দুই আগে একটা ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ সিরিজ লিখেছিলাম। তিক্ততা দিয়ে শুরু, ভালোর পূর্বাভাস দিয়ে শেষ। সেই ভালোটা পর্যায়ক্রমে ভালোলাগা এবং পরে কিভাবে ভালোবাসায় পরিণত হয়েছিলো, সেই গল্প না বললে জায়গাটার ওপর অবিচার করা হবে।
মাটারহর্নের খোঁজ প্রথমে পাই এক সহকর্মীর কাছে। কয়েক মাস আগে দুইজন মিলে অফিসের দেয়ালে টানানো একটা ত্রিমাত্রিক মানচিত্র দেখছিলাম। সুইজারল্যান্ড বলতে আমি তখন চিনি কেবল ইয়ুংফ্রাউইয়োক আর ইন্টারলাকেন, সেখানেও আবার যাওয়াও হয় নি, গরমকালে যাব এরকম প্ল্যান। সম্ভাব্য সেই যাত্রার খুঁটিনাটি নিয়ে দুইজনে কথা বলছিলাম। সে হঠাৎ বলল, ‘তুমি মুঁ স্যারভাঁতে গিয়েছ’?
আমরা লেক জেনেভার উত্তর তীরে থাকি। জায়গাটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি লেকের ঠিক মাঝামাঝি, পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে অতি বিখ্যাত জেনেভা শহর, পূর্ব প্রান্তে মন্ট্রু (এটা আমার বাঙালি উচ্চারণ, আমার ফ্রেঞ্চ কলিগের উচ্চারণে, MONTREUX = মনথখ্রো)। দক্ষিণ দিক বাদ দিয়ে আমার বাসার তিনদিকে পঞ্চাশ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের সব এলাকা মোটামুটি ঘুরে ফেলেছি, কখনো গ্রীষ্মে, কখনো শীতে। আজকাল আর তাই সহজে মন ভরে না, ইচ্ছে করে দূরে দূরান্তে যেতে।
ঘোরাঘুরি আমরা বেশ ভালো পাই। আমরা বলতে আমি, আমার গিন্নি আর এক বছর বয়েসি কন্যাটি। পৌণে ছয় এর পুত্র ঘুরতে যাবার কথা শুনলেই মুখ গোমরা করে ল্যাচা মেরে বসে পড়তে চায়, ঘুরে ঘুরে পাথর গাছপালা পানি দেখার চাইতে ইউটিউবে কার্টুন দেখা তার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দদায়ক। বেশিরভাগ দিনে তাকে ধমক দিয়ে কিংবা টেনে হিঁচড়ে বাড়ির বার করতে হয় এবং সেইসব দিনগুলোতে অবধারিত ভাবে কানের কাছে সারাক্ষণ বাজতে
সচলে ভ্রমণ কিংবা ছবি ব্লগ দেয়া একটা লজ্জ্বার বিষয় হয়ে গেছে আমার মত কিছু “আম” পাবলিকের জন্য। চোখ ধাঁধানো সব ছবি কিংবা দুর্ধর্ষ দুর্গম লোমহর্ষক রোমাঞ্চকর যাত্রা কাহিনী এখন ডালভাত। এভারেস্টে না উঠেও মহামতি তারেকাণু নিজেকে নিয়ে গেছেন এভারেস্ট উচ্চতায়, বাকিরাও সেখানে পৌঁছুবার পথ ধরেছেন।
মাত্র ছয়দিনের ছুটি, চোখের নিমেষে ফুরিয়ে গেল। ২২শে মে ঢাকায় গিয়েছিলাম, ২৮শে মে লুজানে চলে এলাম। ইয়ান চলে গেছে, কাজেই বাসা খালি। আমার রুমের দরজা অর্ধেক খোলা যেত কেবল, আগেই বলেছি। গভীর রাত, ক্লান্ত শরীরে সেখানেই শুয়ে পড়লাম তিনজনে, বাসা ঠিকঠাক পরে করা যাবে।
জীবনের কাছে আমাদের প্রত্যাশা কি? ওয়েল, এটাই মনে হয় জগতের সবচেয়ে বেশিবার জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন। উত্তর পাওয়া সহজ নয়, যারা পেয়ে যান তাঁরা মহামানব। নিজেকে দিয়ে বলতে পারি, মানুষের চাওয়ার শেষ নেই। খুব ছোটবেলায় ভাবতাম, বড় হয়ে খালি চা খাব। আরেকটু বড় হলে ভাবতাম, কেউ যদি ভুল করে একব্যাগ টাকা ফেলে যেত আর আমি কুড়িয়ে পেতাম, তাহলে অনেক সুতো কিনে মাঞ্জা দিতাম, বারবার ঘুড়ি কেটে গেলেও সুতোয় টান পড়ত না।
আমার বন্ধুভাগ্য নিয়ে আমি অত্যন্ত গর্বিত। যাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে দাবী করি, তারা যে শুধু খুব চমৎকার মানুষ তাই নয়, অসম্ভব নিঃস্বার্থ এবং উদারমনা, আমার সুখ দুঃখের সঙ্গী । আমার শত বিপদেও তারা বিন্দুমাত্র দূরে সরে যায় নি, প্রবল সুখেও তাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি নি।
বাংলাদেশ ছেড়ে বাইরে থাকা যুগপৎ সুখের এবং বেদনার ব্যাপার। সুখ এইজন্য যে, আয় এবং ব্যয় সঙ্গতিপূর্ণ। সুখ এইজন্য, কারণ লোডশেডিং নেই। সুখ এইজন্য, সরকারী অফিসগুলো ঘুষ ছাড়াই কাজ করে দেয়। সুখ এইজন্য, কথায় কথায় স্থানীয় প্রভাবশালী মাস্তানেরা ধমক দিয়ে যায় না। এতসব সুখের ভীড় ছাপিয়ে কেবল দুঃখটাই প্রবল হয়ে ওঠে, নিঃসঙ্গতা। চেনা মানুষগুলো কেউই যে পাশে নেই!