প্রাচীন সাবিনো গাছের ডাল পালার ফাঁক দিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। সিঁদুর লাল সূর্যটা এক রকম তাড়াহুড়ো করে ডুবে গেল। এক ঝাঁক পাতি হাঁস প্যাক প্যাক করে ডুবন্ত সূর্যটাকে ধাওয়া করে উড়ে গেল পশ্চিম দিকে। সূর্য মরে যাবার পরও হালুদ লাল একটা আভা ঝুলে রইল আকাশের ক্যানভাসে। আস্তে আস্তে আঁধার হল চারদিকে। বড্ড ক্লান্তি নিয়ে রাত নামল ওয়াহাকা'র আকাশে।
১
রফিক হা করে সাবেরের দিকে তাকিয়ে থাকল। লোকটা নিজেকে সাবের হাসান নামে পরিচয় দিয়েছে। পদবী নিউ এরাইভ্যাল এডমিনসট্রেটর। সাবের মৃদু হেসে বলল,
আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না, না?
রফিক কি বলবে ভেবে পেল না। তার একবার মনে হয়েছিল এসব ভাওতাবাজি। কোথায় না কোথায় এসে পড়েছে। এরা তাকে ভোদাই বানিয়ে মজা নিচ্ছে। রফিক আমতা আমতা করে বলল,
না মানে...এ কি করে হয়? আমার বয়স কত বল্লেন?
সাবের বলল, পয়ত্রিশ বছর তিন মাস।
রফিক বলল, আমার জন্ম তারিখ ১৮-১০-১৯৭৭। ভাই, সে হিসাবে আমার বয়স চৌত্রিশ।
সাবের দৃঢ় গলায় বলল, আপনার বয়স পয়ত্রিশ বছর তিন মাস। আমাদের মেশিন যেভাবে ক্যালিব্রেট করা আছে তাতে ২/১ মাসের হেরফের হতে পারে, কিন্তু এক বছর অনেক বড় ব্যাবধান। এত বড় ভুল হবার কথা নয়।
রফিকের ধাই করে তখন একটা জিনিস মনে পড়ে গেল। তার সার্টিফিকেটের বয়স আর সত্যিকারের বয়স এক নয়। সরকারি চাকুরির বয়সসীমা থাকার কারণে অনেকেই এস এস সি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের সময় বয়স কমিয়ে দেয়। তার বাবাও দিয়েছিল। সত্যিকারের বয়স হিসেব করলে তার বয়স দাঁড়ায় পয়ত্রিশ বছর তিন মাস। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তার হাত ঘেমে গেল।
১
লিস্ট। যা যা কিনতে হবেঃ
১) চা।
২) দুধ।
৩) সকালের নাস্তাঃ ব্যাগল এবং ক্রিম চীজ।
৪) এনভেলপ।
৫) অরেঞ্জ জুস।
৬) মাংসঃ গরু এবং মুরগী দুইটাই।
৭) হলুদ।
৮) ডিশ ওয়াশিং সোপ।
৯) পেঁয়াজ।
১০) গার্বেজ ব্যাগ।
১
হাটখোলা বাজার থেকে উত্তর দিকের মাটির সড়ক ধরে আধা ক্রোশ দূরে মন্ডল বাড়ি। সড়ক এখানে অনেকটা ইংরেজী বর্ণ 'এস' এর মতন এঁকে বেঁকে ছিলিমপুরের দিকে চলে গেছে। সড়কের বাঁকে বাঁশ ঝাড়। তার পাশেই বিশাল এক কড়ই গাছ। কড়ই গাছের পাতায় বাতাসের বাড়ি লেগে যখন ছর ছর শব্দ উঠে তখন মনে হয় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে উদ্দাম নৃত্য করছে অজানা কোন দানব। দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে জোড়ে বাতাস বইছে। মেঘে ঢাকা অন্ধকার আকাশে এক ফোঁটা চাঁদও নেই। কড়ই গাছের মাথা থেকে কিছু একটা ঝুলে ছিল। দূরে মন্ডল বাড়ির লাইটের আলোয় আবছা দেখা গেল এক জোড়া অস্বাভাবিক লম্বা পা ফেলে বসে আছে কেউ।
১
গত তিন মাস ধরে লিনা নামের এক মেয়ের সাথে চুটিয়ে প্রেম করছি। অসম্ভব রকমের মিষ্টি গলা লিনার। সে গান গায়। যখন আমাকে রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে শোনায় আমার বুকের ভেতর চিন চিন করে ব্যাথা করে। যার গলার স্বর এত শ্রুতি মধুর সে না জানি দেখতে কত সুন্দর! লিনাকে আমি কখনও সামনা সামনি দেখিনি।
আধুনিক যুগে মানুষের সাথে পরিচয়ের অনেক মাধ্যম হয়েছে। মোবাইলের কথা না হয় বাদই দিলাম, ইন্টারনেট এখন অনেক সহজলভ্য। ফেস বুক, স্কাইপ, ভাইবার আরও কত কি করে মানুষের সাথে মানুষের কথা হচ্ছে, পরিচয় হচ্ছে, এমনকি বিয়ে সাদীও হয়ে যাচ্ছে। লিনার সাথে আমার কিন্তু এসবের কোন কিছুতেই পরিচয় হয়নি। তাঁর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল খুবি সনাতন পদ্ধতিতে। লিনাকে আমি পেয়েছিলাম স্বপ্নে।
১
মাঘ মাসের মাঝামাঝি। বেজায় শীত পড়েছে। জয়নাল ঘড়ির দিকে তাকাল। সকাল ১০ টা বাজে, কিন্তু মনে হচ্ছে শেষ রাত এখনও পোহায়নি। ঘড়িটা জয়নালের শ্বশুর বিয়েতে উপহার হিসেবে দিয়েছিল। ক্যাসিও ডিজিটাল ঘড়ি। জয়নালের লেখা পড়া ক্লাস সিক্স পর্যন্ত। ঘড়িতে সময় দেখতে তাঁর অসুবিধা হয় না। শ্বশুরের দেয়া ঘড়ি আর ৬ আনার একটা সোনার আংটি জয়নালের সর্ব সময়ের সঙ্গী। পানিতে ভিজলেও কিছু হয়না বলে ঘড়ি আর আংটি পড়েই খাওয়া গোসল সারে সে। হাসিনার সাথে বিয়ের পর তাঁর ভাগ্য খুলে গেছে। তাত বুনে দিন চালায় জয়নাল। হাসিনার সাথে বিয়ের পর পর তাঁর বিক্রি বেড়ে গেছে। মহাজনরা দামও দিচ্ছে ভাল। ঘড়ি আর আংটি সে ভাগ্যের প্রতীক হিসাবে পড়ে।
১
৪ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড। কাঁটায় কাঁটায় চার মিনিট ৩৭ সেকেন্ড। আমি ঘড়ির দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। জিনিশটা অদ্ভুত। কারও সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করতে পারলে মনটা একটু হাল্কা লাগত। কিন্তু কে বিশ্বাস করবে আমাকে?
সারওয়ার? লায়লা ডাকল।
ঠিক ৪ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড আগেই আমি জানতাম আমাকে লায়লা ডাকবে। আমি কোন উত্তর দিলাম না। লায়লা আমাকে কেন ডাকছে সেটাও আমি এই মুহূর্ত থেকে ৪ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড আগেই জানতে পেরেছি। বসার ঘরে পত্রিকা পড়ছিলাম। দরজায় এসে দাঁড়াল লায়লা।