[justify]
সকাল সাতটার দিকে আমরা কাকেলছেও গ্রামের নদীর ঘাটে। ইলিয়াস পড়েছেন গাঢ় সবুজ রংয়ের একটা ইউনিফর্ম পায়ে বুট মাথায় ক্যাপ। জানালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন দেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের পোষাক এটি। ইলিয়াস তার সবথেকে বেদনাবিধুর যুদ্ধক্ষেত্রে আজ ফিরে যাবেন প্রায় ৪৪ বছর পর যোদ্ধার সাজে।
আমাদের আজকের পরিকল্পনায় জগতজ্যোতি দাসের গ্রাম জলসুখা। না তার পরিবারের কেউ সেখানে নেই এখন আর, ভিটে বিক্রী হয়ে গেছে। আমরা যাবো তার ছোটবেলা বন্ধু ও যুদ্ধদিনের সহযোদ্ধা আব্দুর রশিদের সাথে দেখা করতে, যে জায়গা দিয়ে তার লাশ রাজাকারেরা নিয়ে এসেছিলো প্রদর্শনের জন্য সেই জায়গাটা দেখা। তারপর জগতজ্যোতি দাসের শেষযুদ্ধের স্থান খৈয়াগোপির বিল, সম্ভব হলে পাহাড়পুর এবং অবশ্যই মাকালকান্দি।
এবার আমাদের নৌকা চলছে উজানে, কাকেলছেও থেকে আজমিরীগঞ্জের দিকে। এখনো রোদ উঠেনি তেমনভাবে, ছায়া ছায়া ভেজা ভেজা ভাব, আকাশে মেঘ আছে, নদী ও বিশাল। গতকাল সারাদিন যে জায়গাগুলো ঘুরেছি সেগুলো ক্রমশঃ পেছনে সরে যাচ্ছে।
[justify]
১৯জুন। পহেলা রমজান। সকাল বেলা।
কাকৈলছেও, আজমিরীগঞ্জ, হবিগঞ্জ।
সেহরীর পর সামান্য কিছু সময় আমরা ঘুমিয়েছি। আটটার দিকে বের হই। আমি, নজরুল, তানিম ও ইলিয়াস। সামান্য পায়ে হেঁটেই নদীর পাড়ে আসি। কাল রাতে এসে পৌঁছে ছিলাম অন্ধকারে। এখন সকালের নরম আলোয় নদী দেখি, নদীবর্তী জনপদ দেখি। শেরপুর থেকে কুশিয়ারা নদী আজমিরীগঞ্জ হয়ে এদিকে এসেছে ভেড়ামোহনা নামে। ভেড়ামোহনা নেমে গেছে আরো ভাটিতে। পেছন দিকে সুনামগঞ্জ, দিরাই হয়ে কালনী এসে মিশেছে। ভেড়ামোহনা ও কালনী মিশেছে আরেকটু ভাটিতে, সেখান থেকে মেঘনার মোহনা। ঐ মোহনা ধরে এগুলেই ভৈরব। আমর দাঁড়িয়ে আছি কাকেলছৈও লঞ্চঘাটের কাছে। একসময় কাঠের ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ছিলো এইঘাট।
নদী এখানে বিশাল। ইলিয়াস তার পরিচিত এক ইঞ্জিন নৌকা নেন। ছোট্ট একটা নৌকা। মাঝি ও ইলিয়াস হালের কাছে বসেন, আমি তাদের সামনে দাঁড়াই। নজরুল ও তানিম সামনের দিকে। নৌকা ভাসে ভাটিতে, আমরা পশ্চিমে নামতে থাকি- যতো ভাটিতে যাই ততো নদী আরো প্রশস্ত হতে থাকে। কিছুক্ষন যাওয়ার পর নদীর বুকেই বিদ্যুতের খুঁটির লম্বা সারি দেখি উত্তর-পুর্ব কোনে। ইলিয়াসকে জিজ্ঞেস করি- কোন এলাকা? বলেন- জয়সিদ্ধি। ইটনা থানার জয়সিদ্ধি। বাংলার প্রথম র্যাং লার আনন্দমোহন বসুর বাড়ি, ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ তার অবদান।
[justify]
দাসপার্টি নিয়ে কাজ শুরু করার প্রথম থেকেই একটা মানুষকে খুঁজছি।
দাসপার্টি সংক্রান্ত প্রকাশনা ও আলাপচারীতা থেকে জেনেছি- জগতজ্যোতি দাসের সবচেয়ে আস্থাভাজন ও ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা ছিলেন আঠারো/ উনিশ বছরের এক তরুন। নাম তার ইলিয়াস চৌধুরী। জ্যোতির সাথেই যুদ্ধের প্রশিক্ষন নিয়েছেন এবং প্রতিটি যুদ্ধে তার সাথে ছিলেন। শেষ যুদ্ধে ও শেষ পর্যন্ত ইলিয়াসই ছিলেন একমাত্র তার সাথে। ইলিয়াস নিজে ও গুলীবিদ্ধ হয়েছিলেন বুকে কিন্তু জ্যোতিকে একা ফেলে যাননি। তার কমাণ্ডার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে পর, বিলের পানিতে কমাণ্ডারের মৃত শরীর ডুবিয়ে গুলী করতে করতে পিছিয়ে এসেছিলেন- তখনো তার নিজের বুক থেকে ও রক্ত ঝরছে।
সালেহ চৌধুরী বলছিলেন- ১৬ নভেম্বর জ্যোতির মৃত্যুর পর ইলিয়াসরা যখন কুঁড়ি-বলনপুরের ক্যাম্পে ফিরে আসেন তখন তার বুকের ক্ষত দেখতে পান। বাম পাশে গুলী লেগে বের হয়ে গেছে আর এক ইঞ্চি দূরে হলেই হৃদপিন্ড ছেদ করতো। সালেহ চৌধুরী তাকে টেকেরঘাট পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেখানে তখন অস্থায়ী হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া প্রয়োজনে শিলং ও পাঠানো যেতো।
কিন্তু ইলিয়াস যেতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান, দাদার খুনের প্রতিশোধ নিতে চান। চিকিৎসার জন্য আর কোথাও না গিয়ে স্থানীয়ভাবে ব্যান্ডেজ করেই ইলিয়াস যোগ দেন দাসপার্টির পরবর্তী একশনে এবং দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত পরবর্তী একমাস যুদ্ধ করতে থাকেন।
[justify]
২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৫।
দাসপার্টির খোঁজে আমাদের যাত্রা শুরুর আজ প্রথম দিন। আমি এবং নজরুল ইসলাম- সচলায়তনে আমার সহ ব্লগার, নাট্যনির্মাতা- আমরা দুজন এসেছি উত্তরার একটি বাসার খোঁজে। সকাল দশটা বেজে কয়েক মিনিট।
এই মানুষটার খোঁজ আমাকে দিয়েছেন সিলেটের সিনিয়র সাংবাদিক আল-আজাদ। আল-আজাদ নিজে ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করেন বহুবছর। ক্যাপ্টেন মুত্তালিব এর সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মুত্তালিব এর শেষ সময়ে, যখন গুরুতর অসুস্থ তখন আল-আজাদ তার ভাষ্যে উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনের একটি বিস্তারিত বর্ণনা নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপুর্ণ একটি কাজ।
আমরা এসেছি সালেহ চৌধুরীর খোঁজে। ইনি ও সাংবাদিক। বাংলাদেশের সিনিয়র সাংবাদিকদের একজন। এপ্রিল ১৯৭১ পর্যন্ত দৈনিক পাকিস্তানের সাব-এডিটর ছিলেন। তারপর আবার বাহাত্তুর থেকে অবসর নেয়া পর্যন্ত দৈনিক বাংলায়। মাঝখানে মুক্তিযুদ্ধের মাসগুলো ছিলেন অস্ত্রহাতে যোদ্ধা। না, সালেহ চৌধুরীকে ঠিক অস্ত্র হাতে যোদ্ধা বললেই তার ভূমিকা শেষ হয়ে যায়না।
[justify]
১৭ এপ্রিল ২০১৫।
বাসা থেকে বের হয়েছি সকাল সাড়ে সাতটায়। বৈশাখের আজ চতুর্থ দিন। গত চারদিন প্রচন্ড গরম, কড়া রোদ নেই অথচ চড়া তাপমাত্রা, বাতাস নেই- হাসফাস লাগে আমার। অথচ আজ এই সকালবেলা, বৈশাখের চতুর্থদিনের সকালবেলা হেমন্তের সকালের মতোই স্নিগ্ধ ও মায়াময়- হালকা কুয়াশার মতো চারদিক, ঘাসের ডগায় একটু শিশির।