গ্রামেই আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন। আমার এক চাচার বাড়ি বড় একটা শিমুল গাছ ছিল। এখন সেটা আছে কিনা ঠিক জানি না। বসন্তকালে শিমুল গাছে ফুল ফোটে। লাল লাল বড় পুরু ফুল। ফুলের কুড়ি ঠিক কুড়ির মতো নয়। বসন্তে পাখিরা শিমুল গাছে ভিড় করে। কেউ শিমুলের ফুলের মধু চুষতে আসে। কেউবা আসে পোকার লোভে। মধুপায়ী পোকাদের আনাগোনা কম নয় শিমুল গাছে। কিছু পাখি আসে স্রেফ ভালোবাসার টানে। তবে ভালোবাসাটা তাদের শিমুলের প্রতি নয়। সঙ্গিনীর টানে আসে ওইসব পাখিরা। চোখগেল, বসন্তবৌরি, বেনেবউ পাখিগুলো কিছুটা লাজুক প্রকৃতির। বছরের অন্যসময় লোকালয়ের ধারেকাছে এদের খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু বসন্তকালে ওরা মরীয়া। তাছাড়া পুরুষপাখিগুলো সঙ্গিনীকে ডাকার সময় এলাকা ভাগ করে নেয়। পারতপক্ষে একজনের এলাকায় আরেকজন পা দেয়। যদিবা দেয় যুদ্ধের জন্য আটঘাট বেঁধেই দেয়। যেসব পাখি মাঠে সুবিধা করতে পারে না, তারা সঙ্গিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বেছে নেয় লোকালয়। মানুষকে এড়িয়ে চলা পাখি। যে-সে গাছে বসলে মানুষের সান্নিধ্যে চলে আসার আশঙ্কা আছে। তাই বেছে নেয় শিমুলের মতো উঁচু গাছ। চোখগেল আর বসন্তবৌরি শিমুলের মগডালে বসে তারস্বরে চিৎকার করে। তবে ওদের কণ্ঠ মধুমাখা। আর বেনেবউ, যাকে আমরা হলদে পাখি বলি--ওদের গলায় অত জোর নেই। তাই সবসময় এক জায়গায় বসে ডাকে না। এ গাছে, সে গাছে ঘুরে ঘুরে ‘খোকা হও... খোকা হও’ স্বরে ডেকে বেড়ায়। আমার ওই চাচার বাড়ি প্রায়ই একটা বেনেবউ ডেকে বেড়াচ্ছে। শুধু সে বাড়িই নয়, আশপাশের সব বাড়িরই মেহমান সে।
এমনিতে ওদের ওই ডাকে কেউ পাত্তা দিত না। কিন্তু যে বাড়ি নতুন বউ আছে, সে বাড়িতে খুশির রোল পড়ে যেত। সবাই ধরেই নিত নতুন বউয়ের গর্ভে একটা পুত্র সন্তান আসছে। পরে নতুন বউয়ের মেয়ে সন্তান জন্মালে বেনেবউয়ের কথা কেউ মনে রাখত না। তবে ছেলে হলে বলত--‘ওই দেখো, এ বাড়িতে ‘খোকা হও’ পাখি ডেকেছিল, খোকা না হয়ে যাবে কোথায়। এ বিশ্বাস আদ্যকালের। যুগ যুগ ধরে বাংলার ঘরে ঘরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সংক্রিমত হয়ে হয়েছে বিশ্বাসের ভিত। এই ডিজিটাল যুগে এসেও সে বিশ্বাস কিছুটা হয়তো নড়চড় হয়েছে, তবে একেবারে ধুয়েমুছে যায়নি।