অক্টোবর স্তন ক্যান্সার সচেতনতার মাস। গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন জায়গায় দেখলাম "সূত্র: ইন্টারনেট" থেকে যে যা পারছে তুলে দিচ্ছে, এবং স্তন ক্যান্সার নিয়ে বাংলায় একটি অশ্লীল সুড়সুড়িপূর্ণ নিম্নরুচির বিজ্ঞাপনও দেখলাম (সেই বিজ্ঞাপনটি নিয়ে বেশি কথা বলতে চাই না, স্তন ক্যান্সারের মত একটি অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় নিয়ে কেউ এরকম ইতরামি করতে পারে সেটা বিশ্বাস করতে খুবই কষ্ট হচ্ছিলো।) এবং অনেক জায়গায় দেখলাম নিজে নিজে স
সকালে ঘুম ভেঙ্গেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ি, যেন ফাইনালে উঠা বাংলাদেশকে নিয়ে চিৎকার করতে পারি। টেলিভিশন ছেড়ে ,ওমা একি, বৃষ্টির কারণে ম্যাচ প্যাচে পড়ে আছে। টেলিভিশন চালু রেখে ভাবলাম, খেলার খবর দেখার ফাঁকে রান্নাটা সেরে ফেলি। কিছুক্ষণ পর দেখি আমার ছেলে চ্যানেল ঘুরিয়ে দিয়েছে। আমি রান্না ঘর থেকে এসে আবার খেলার চ্যানেল নিয়ে আসি। আর আমার ছেলে "শেইপ" বলে বলে নাঁকা কান্না করছে। কি করি?
শিরোনামটা বলে দিচ্ছে আমি একজন পুরুষ, অন্তত: নিরানব্বুই ক্ষেত্রে। বাংলায় লিখছি, কাজেই এবার অনুমিতি নিরানব্বুই দশমিক নয় নয়ে অথবা একশতে গিয়ে ঠেকা উচিত। নিপীড়নে বাঙালি পুরুষের জুড়ি মেলা ভার। সেটা যৌন হলে তো কথাই নেই। আমি ব্যক্তিগত কিছু ঘটনা বলব, পাঠক প্রতিক্রিয়া নিয়ে আপাতত: মাথা ঘামাচ্ছি না। ব্যক্তি আমাকে নিয়ে কে কি ভাবলো সেটাতে আসলে আমি ছাড়া ম্যাস পপুলেশনের কিছু যায় আসে না। ঘটনাগুলো বাস্
দুপুর দুইটায় ফ্রেশার ডিউটি ডাক্তার চলে গেলেন। পরে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার এলেন আর এলেন দারুণ এক নার্স। মরমা এই মেয়ের নাম তিংতিং! একদম শেষ পর্যন্ত আমাকে অসম্ভব সাহায্য করেছে সে। বিকাল তিনটায় আমাকে ব্যাথা বাড়ার ঔষধ দেয়া হলো। ব্যাথার ঔষধ মানে Oxytocin।মেয়েদের শরীরে সহজাতভাবেই এটা তৈরি হয়। সিন্থেটিক ফর্মে Pitocin দেয়া হয় স্যালাইনের মাধ্যমে যাতে ব্যাথার তীব্রতা বাড়ে আর জরায়ুর মুখ তাড়াতাড়ি খুলে যায়। নার্স মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম কতক্ষন লাগবে, সে বললো তিন ঘন্টার মতো। আমি জানতাম লেবার এর গড়পড়তা সময় আট ঘন্টা তবু সেসময় সেটা ভুলে গেলাম। তিনঘন্টা কে আঁকড়ে ধরলাম...দিহান, দেখতে দেখতে কেটে যাবে ১৮০ মিনিট, এমন কোনো ব্যাপার না।
ডাক্তার আমার EDD (Expected date of delivery) লিখে দিলেন ৭ই অক্টোবর। ডেট দেখে আমি খুশি, লাকি সেভেন বলে কথা। কিন্তু পরে জানতে পারলাম এই ডেট ৯৮% ক্ষেত্রে সঠিক হয়না। কন্সেপশনের সময়টা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। সাধারণভাবে প্রেগন্যান্সির মোট সময়কাল ধরা হয় ৪২ সপ্তাহ।(আমাদের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত দশ মাস দশ দিন কথাটা সত্যি!) তবে ৩৭/৩৮ সপ্তাহ পরে যেকোনো সময়ে বাচ্চার জন্ম হতে পারে। শেষের দিকে বিশ্রাম খুব জরুরী তাই আমি ঠিক করলাম ১৫ই সেপ্টেম্বরের পর ছুটি নিয়ে নেবো। আমার ম্যানেজার জানালেন ১৪ই সেপ্টেম্বর অফিসে বড় একটা ইভেন্ট, নতুন ডিপার্টমেন্ট চালু হবে। সেটা ভালোভাবে শেষ করে আমি ছুটি নিতে পারি।
বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে ‘সাদ’ (অথবা কাছাকাছি উচ্চারন) নামে একটা অনুষ্ঠানের চল আছে। প্রেগন্যান্সির সাত মাসে পড়লে অথবা সাত মাস পূর্ন হলে এটা করা হয়। হবু মাকে মজার মজার খাবার খাওয়ানো, উপহার দেয়া,নবজাতকের যত্নআত্নি বিষয়ে পরামর্শ দেয়া ইত্যাদি মিলিয়ে ঘরোয়া সুন্দর একটা অনুষ্ঠান।(আমাদের চিরায়ত রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠানগুলো মেয়েদের গুরুত্ব দেয়, সম্মান দেয়। মোল্লারা ধর্মের নামে আজব কিছু জিনিস আমদানি করে সমাজে মেয়েদের অবস্থান নড়বড়ে করে দিয়েছে...)
আমি অন্তঃস্বত্তা এটা কাউকে জানানোর পর দুটো প্রশ্ন শুনতে হতো অবধারিতভাবে।
এক- ছেলে নাকি মেয়ে জানো? ছেলে চাও না মেয়ে চাও? আমার উত্তর ছিলো ‘আমার কাছে ছেলে মেয়ে সব সমান। ছেলেও যদি হয় মেয়ের মতো আদর যত্ন দিয়েই বড় করবো’!
দুই- সিজারিয়ান করাবে নাকি নরম্যাল ডেলিভারি?
প্রেগন্যান্সির প্রথম পাঁচমাস পর্যন্ত পাঁচতলায় ছিলাম। অফিস থেকে এসে বেহুশের মতো শুয়ে থাকতাম। বর আসতো আমার আরো ঘন্টা দুয়েক পরে। একদিন ফোন করলো -দিহান, একটা পাখি আনবো?
-কি পাখি?
-ঈগল পাখি।
-ঈগল আমরা কোথায় রাখবো? আচ্ছা নিয়ে আসো।
বর ফিরলো। আমি বললাম ‘পাখি কই’?
-আরে পাখি নাতো, আমি একটা শীতল পাটি কিনবো কিনা সেটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তুমি ভেবেছো পাখি?
-আমি ভেবেছি ঈগল পাখি!!
অন্তঃস্বত্তা অবস্থায় মনটা খুব দুর্বল হয়ে যায়। প্রাথমিক শরীরখারাপ ভাব একটু সামলে উঠার পর আমি দেখতে পেলাম চারপাশে অটিস্টিক এবং প্রতিবন্ধি মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। আগে কিন্তু এরা আমার চোখে পড়েনি। আমার গলিতেই চারতলার এক বারান্দায় এক মাকে দেখলাম বুদ্ধি প্রতিবন্ধি ছেলেকে নিয়ে দিশেহারা মুখে বসে থাকেন। অফিস বিল্ডিং এর লিফট ম্যানের কাছে একজন বসে থাকে প্রতিদিন। ট্রাফিক সিগন্যাল এ পড়লে তো হাত নেই, পা নেই, চোখ নেই এমন অনেকে ছুটে আসে টাকা চাইতে। রাস্তার পাশে হিজড়াদের আমার চোখ খুঁজে নিতো। প্রচন্ড ভয়ে মন কুঁকড়ে যেতো। সুদূর শৈশবে বাসার বুয়ার কাছে শোনা গল্প মনে পড়ে যেতো ‘এক মেয়ের সাপের মতো দেখতে বাচ্চা হয়েছে...’। দিনরাত একটাই চাওয়া ‘একটা সুস্থ বাচ্চা হোক’।
একটা মেয়ে যখন জানতে পারে সে অন্তঃস্বত্তা ততোদিনে তার ভেতরের স্বত্তাটির বয়স প্রায় এক মাস হয়ে যায়। মা’র শরীর ভ্রুন টাকে মানতে চায়না প্রথমে, এদিকে ভ্রুনটা চায় যেকোনো প্রকারে মা’র শরীরে টিকে যেতে। ব্যস শুরু হয় যুদ্ধ, ভ্রুনটার টিকে থাকার লড়াই। প্রথম তিনটা মাস এই যুদ্ধ চলে। মা’র শুরু হয় প্রচন্ড শরীর খারাপ লাগা,বেশির ভাগ মেয়ের বেলায় ই বমি হয়। অনেকে সবকিছুতে গন্ধ পান। একটা ক্ষুদ্র সংখ্যার ভাগ্যবান মেয়ে ছাড়া বাকি সবাই খেতে পারেন না।