পাবলো নেরুদা একই সাথে বাঙালি সমাজে চরম জনপ্রিয় অথচ প্রায় অপরিচিত। মানে কবি হিসেবে তাঁর সুনাম পাঠক মাত্রই জানেন, তাঁর সৃষ্ট কিছু গনগনে অবাক স্তবক সকলেরই মুখে শোভা পায় কিন্তু এক জীবনে যে প্রায় অসম্ভব সাড়ে তিন হাজার পৃষ্ঠা কবিতা তিনি পৃথিবীকে দিয়ে গেছেন, এবং যে পাবলো নেরুদার নির্বাচিত কবিতার সাম্প্রতিক প্রকাশিত সংকলনটি ১৫০০ পাতার ( পৃথিবীর আর কোন কবির নির্বাচিত কবিতা হাজার পাতা পেরিয়েছে বলে জানা নেই!
সমুদ্রের নীলাভ লবণ, বিপুল ফেনীল ঢেউ
আর সূর্যকিরণ, যখন তোমার ওপর ঝাপটে পড়ে
ইসলানেগ্রায়, তখন আমি চেয়ে দেখি কর্মব্যস্ত বোলতাটিকে,
স্বকীয় পৃথিবীর মধুর কাছে ওর আত্মসমর্পণ।
দেখি ওর নিয়ত আসা-যাওয়া; নিয়ন্ত্রিত, সোনালী উড়ান।
যেন কোনো অদৃশ্য, সরল তারে ও পিছলে যায়,
দৃপ্ত নাচে, নিপুণ ভঙ্গিমায়। দেখি ওর পিয়াসী কোমর,
একটি একটি করে ওর সূক্ষ্ম সুঁচ নিঃশেষিত হওয়া।
একটি অনচ্ছ কমলা রংধনুর ভেতর
ভালবাসা তার লম্বা লাঙ্গুলে
একরাশ অদম্য, কর্কশ কাঁটার রেখাপথ রেখে যায়,
আর আমরা দু'জন চোখ মুদে পার হই এ বেভুল পথ,
যেন কোনো জখম আমাদের চিরে ফেলতে না পারে দু'খণ্ডে।
অপরাধী কোরো না তোমার জলভরা চোখ,
তোমার হাত তো বিদ্ধ করেনি তরবারি,
তোমার পদতল খোঁজেনি এ পথ,
এক ঘট শ্যামল বিষণ্ণ মধু, নিজেই এসে ভরেছে হৃদয় তোমার।
যখন বিপুল ঢেউ-তোলা প্রেম, আমাদের লুফে
আছড়ে ফেলে বিশালকায় পাথরের গায়, সে আঘাতে
তোমার বাড়িটা দুপুরের রেলগাড়ির মত,
মৌমাছির ব্যস্ত গুঞ্জন, ডেকচির বাষ্পীয় শিস
শিশিরের কীর্তিকলাপ প্রপাতের স্বর হয়ে ঝরে,
তোমার গলায় বেজে ওঠে তালগাছের উৎফুল্লতা।
হালকা নীল দেয়ালটি, গ্রামীণ ডাকপিওনের মত
গেয়ে-ওঠা টেলিগ্রাম হাতে, পাথরের ওপর ঝুঁকে কথা বলে,
আর ওই ওখানে, দুটো ডুমুর গাছের সবুজ ধ্বনিময়তার মাঝখানে,
নিঃশব্দে হেঁটে যান হোমার।
এখানে নেই নাগরিক ধ্বনি, নেই কান্না,
সমুদ্রের নোনা ঢেউয়ে ঝলকায় মুহূর্ত,
হলদে আকরিকের তীব্রতায়, মধুর সোনালী জৌলুসে,
ঝঞ্ঝার বিক্ষোভ যার বরফি পাথুরে কেলাসকে
ভাঙতে পারেনি এতটুকু
সূর্যালোক, আগুনের শব্দে বেজে ওঠে চড়চড়,
মৌমাছির মত গুনগুন করে,
ব্যস্ত রাখে নিপুণ আঙুল, সবুজ পাতায় ঢেকে নেয় মুখ,
গাছের তামাম উচ্চতায় শিস দেয় ঝিলমিলে, ফিসফিসে রূপকথা।
আগুনের ক্ষুধা আর আঁচ নিয়ে, সামান্য পাতায়,
আমার অস্থি যে তোমার, প্রিয়তমা,
মহিষী আমার; তোমার মাথায় দখিনা বনের পাতা,
সুগন্ধী ঘাস-মুকুট পরাই; মাটির বোনা দোপাটি ফুল,
সবুজ সম্মান, তোমারই প্রাপ্য।
তোমাকে যে ভালবাসে, সে পুরুষের মত, তুমিও এসেছ
বনভূমি-আপরিসর থেকে। যে মাটি এনেছি আমরা দুজন,
তার ঘ্রাণ আমাদের রক্তে। আমরা দুটি লোকজ মানুষ
নগরে পথ হাঁটি বিভ্রান্ত ধাঁধায়, পৌঁছনোর আগেই বন্ধ না হয় যেন হাট।
ভালোবেসেছি তোমায় বহুবার, দেখার আগেই,
মনে পড়েনি তবু একবারও, চিনিনি তো চাহনি তোমার,
কে বা খোঁজে নীলকণ্ঠ ফুল ঝাঁ ঝাঁ দুপুরের রোদে?
গমের সুগন্ধের মত অধরা প্রেম ছিলে তাই।
অথবা আবছায়া ছিলে যেন জুনের ভরা জোছনায়
সুদূর আঙ্গলে, ধরে ছিলে পানপাত্র ঠোঁটের কোনায়,
তোমারই ইঙ্গিত খুঁজি আমি নারীদের ভীড়ে,
আন্দোলিত রমণীর দুরন্ত প্রবাহ, চুলের খোঁপায়,
আধবোঁজা পলক, ফেনীল ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া
হালকা পায়ের ভেতর।
হঠাৎ যেন খুঁজে পাই তোমার আয়তাকার নখ,
টুকটুকে চেরির মত, গতিময়
তোমারই মত এলোমেলো মোহনীয় চুল
সমুদ্রের জলে জ্বলতে থাকা তোমার গনগনে অবয়ব
আমার কোনো শেষ বার নেই, নেই চির প্রতিশ্রুতি;
বালির ওপর জয় তার পায়ের ছাপ ফেলে রেখে গেছে।
আমি এক দরিদ্র মানুষ, যে মানুষকে ভালবাসতে চায়।
তোমাকে চিনিনা, অথচ ভালবাসি,
কাঁটার উপহার দিইনা কখনো, বেচিনা তার ধার।
কেউ হয়ত জানতেও পারে, আমার হাতে তৈরী মুকুট
তোমার আগে যদি আমার মৃত্যু হয়
অথবা আমার আগে তোমার দেহান্তর,
তবু যেন আমরা বেদনার সীমানা না বাড়াই
কারণ বেঁচে থাকার মত বিপুল আর তো কিছু নেই।
গমের ভেতর লুকোনো ধুলি, আর বালির ভেতর সূক্ষ্মতর বালি
আমাদের উড়িয়ে নেয়। মুহূর্তের ঝিরঝিরে স্রোত, বেঘোর বাতাস
আমাদের বীজের মতন বাহিত করে,