আমি যে বহুতল ভবনে থাকি তার পাঁচটা লিফটের একটায় উঠতে গেলে বীজগণিত জানা লাগে। সূত্র y= (x+1)। Y হল যে তলায় পৌঁছাবেন, আর x হল যে তলার বাটনে চাপ দেবেন। আপনি ভাবছেন এ আবার কি হেঁয়ালি, যে তলা চাপব সেই তলাতেই তো লিফট থামবে। এতো সহজ নয়, এই লিফটের সূত্র আলাদা। দুই এ টিপলে তিনতলায় থামবে, বিশ এ টিপলে একুশ। সুতরাং মনে করি আপনি যাবেন ২৩ তলায়, অর্থাৎ y = 23। কিন্তু সূত্র অনুযায়ী আমরা জানি y = (x+1), সুতরাং (x+1) =23 বা x = 22। অর্থাৎ লিফটে চাপতে হবে বাইশ। হুঁ হুঁ, অংক জানতে হয়।
আমার ছাত্রজীবন কেটেছে দুর্বিষহ যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে। পিতামাতা উভয়েই শিক্ষক, আমি কোনদিন বাসায় গিয়ে বলতে পারিনাই যে টিচার আমাকে নাম্বার দেয়নাই। তারা দুজনেই হাঁ হাঁ করে ঝাঁপিয়ে পড়তেন আমার উপর, টিচার নাম্বার দিবেনা ক্যানো হ্যাঁ? তুমি কিছু লিখতে পারোনাই তাই নাম্বার পাওনাই ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনারা সকলেই জানেন ক্লাস টেস্টের খাতা অভিভাবককে দিয়ে সাইন করিয়ে আনাটা ফরমালিটি মাত্র, অভিভাবক মাত্রেই উচিৎ চুপচাপ সই করে খাতা আবার ছেলেমেয়েকে ফিরিয়ে দেয়া। আমার পিতা তা না করে পুরা ছয়পাতা কষা অংক পড়তেন, তারপরে সই করতে করতে গম্ভীর স্বরে বলতেন, “পনেরোতে তিন দিল কেন বুঝলামনা, শুণ্য দেওয়া উচিৎ ছিল। সরল অঙ্কের উত্তর দুইশ পঁচাশি বাই সাতশ আঠাশ কিভাবে হয়।” পাষন্ড পৃথিবীর নির্মমতায় বালক সত্যপীরের চোখে তখন পানি।
ঢাকা শহরে হোটেলগুলি একটি অলিখিত রুটিন মাফিক চলে। ভোরবেলা পাঁচটার দিকে সবাই হঠাত ঝাঁপ খুলে রুটি বেলতে বসে যায়। হালকা সবজি রান্না চলে পিছনে, সামনে বিশাল ব্যাসের ফ্ল্যাট কড়াইতে পাশাপাশি ভাজা হয় পরোটা আর ডিম। বেশুমার পরোটা ভাজি ডিম সবজি আগের রাতের মাংসের তরকারি উড়ে যায় মিনিটে মিনিটে। দশটা বাজে। এইবার সকলে শুরু করে গণ সিঙ্গাড়া ভাজা। আচমকা দোকানের সামনে ঝুড়ি উপচে সঙ্গাড়া সমুচা হাজির হয়। রামপুরার আবুল হোটেল অথবা নীলক্ষেতের চিপা দোকান, সায়েদাবাদ অথবা মীরপুর যেখানেই থাকুন দুপুর এগারোটায় হোটেলে গেলেই দেখবেন ঝুড়িভর্তি সিঙ্গাড়া ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আপনার দিকে। এই সিঙ্গাড়ারা সকাল দশটার আগে অনুপস্থিত। এদের জন্ম দশটায় মৃত্যু একটায়। স্বল্পস্থায়ী একটি অর্থপূর্ণ জীবন।
থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় বান্দরবান গিয়েছিলাম। ট্রেকিং। রুমা বাজার থেকে কেওকারাডং তাজিনডং হয়ে থানচি। এরপরে থানচি থেকে চান্দের গাড়িতে বান্দরবান শহর। রুমা বাজারে আর্মি কমান্ডার ছিলেন সেকেন্ড লেফটেনান্ট ইফতিখার। আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়ার, ফৌজদারহাট ক্যাডেটের। চিনতামনা কিন্তু গিয়ে কথা বলার পরে মেলা পরিচিত লোক পাওয়া গেল। তার সাথে ঝিরি দেখতে গেলাম, সে এক কান্ড। ওখানে আর্মি সোলজারের নিরস্ত্র ঘুরাফিরা নিষেধ, তাই তিনি আর এক সৈন্য নৌকায় উঠলেন একে ফর্টি সেভেন বা ওইরকম কিছু সহ। নৌকায় উঠেই কমান্ডার ঠ্যাং ছড়িয়ে ঘুম, পাশে আমি যেমন বই নিয়ে ঘুমাই সেইরকম তার পাশে অটোমেটিক অস্ত্র।
বাংলাদেশে বাস ড্রাইভার (এবং ট্রাক ড্রাইভার) কে ডাকা হয় ওস্তাদ। ওস্তাদ অর্থাৎ দক্ষ, সুনিপুন, পটু। কোন একটি বিষয়ে অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী। চলাচলের প্রায় অনুপযুক্ত কিছু যানবাহন নিয়ে ঢাকাসহ সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টনের রাস্তায় এরা যে ধুন্দুমার কান্ড লাগিয়ে দেয় এতে তাদের ওস্তাদ না ডেকে উপায় নেই।
মগবাজারে কোন এক জায়গায় টিউলিপ বলে এক সেলুন ছিল। ওইখানে আব্বা আমাদের তিন ভাইকে চুল কাটাতে নিয়ে যেতেন যখন আমি একবারে ল্যাদাবাচ্চা। মনে আছে ওরা প্রতিবার ছোট একটা রঙিন কার্ড দিত, একপিঠে দোকানের নামধাম অন্যপিঠে ক্যালেন্ডার। আমাদের তিন ভাইতে তুমুল ফাইট চলতো ঐ মহামূল্যবান কার্ড নিয়ে। তখন স্কুলে যেতাম একটা স্টীলের পেনসিলবক্স নিয়ে, উপরে সুপারম্যানের ছবি আর হিম্যানের স্টিকারওয়ালা। ঐ পেনসিলবক্সের ভিতর জায়গা হত কার্ডের। কোনদিন ক্যালেন্ডার দিনতারিখ দেখার জন্য ব্যবহার করেছি বলে মনে পড়েনা, দিন-তারিখ দেখার তেমন দরকারও হতনা। শুধু মাথায় থাকতো স্কুল বৃহস্পতিবার হাফ আর শুক্রবার পুরো ছুটি। ওইটে জানার জন্যে বালকের ক্যালেন্ডার প্রয়োজন নেই।
ভালমন্দ বাছবিচার না করে বই পড়ার বাতিক আমার ছোট বেলা থেকেই। অবশ্য এই বাতিক এখানে সবারই কম বেশি আছে জানি, নাহলে সচলায়তনে ডুবে থাকতে পারত না। ভালমন্দ বিচার না করার কারনে এক দিকে ওইসব(!) বই যেমন গোগ্রাসে গিলেছি, তেমনি ক্লাসিক বইগুলোও। ক্লাসিকের ক্ষেত্রে আমার যা হয়, পড়া শেষে তিন চার দিন তা আমার মাথায় হাঁটু গেড়ে বসে থাকে। ওই কয়দিন আমি অন্য কোন ব...