“ সামনে আর পাকা রাস্তা নেই। এখান থেকে পায়ে হেটে যেতে হবে। ” মেজর ফয়সল কবির বলল।
গাড়ি থেকে বের হলাম আমি। তার আগে অস্ত্রভর্তি ব্যাগটা পরীক্ষা করে নিলাম।
“ মেজর সুরঞ্জন। ” ফয়সলের কণ্ঠ শুনে তাকালাম ওর দিকে। একটা সিগারেট অফার করছে ও। “ এখনই টেনে নাও। রাতে আর ধরাতে পারবে না। বানশিগুলো দেখে ফেলবে। ”
পিছন থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল মেজর ইশতিয়াক,“কোন বানশি আসলে জাস্ট উড়াইয়া দিব। আমাকে চিনে না।”
জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় সটান দাঁড়িয়ে, দুই হাত শরীরের দুই পাশে উল্লম্ব ভাবে ঝুলিয়ে, পতাকার দিকে মুখ করে গাইতে হয়। জাতীয় সঙ্গীত চলার সময় দাঁত খিঁচিয়ে হাসতে হয় না, হাত পা নাড়তে হয় না, ক্যামেরা দেখলে ছ্যাবলার মতো লাফাতে হয় না।
এ শুধু আইনের শিক্ষা নয়, এ শিক্ষা স্কুলেও দেওয়া হয়। কাণ্ডজ্ঞানের কথা বাদই দিলাম।
"ভুলে যা" "ভুলে যা" "ভুলে যা" বললেই কি কিছু ভোলা যায়? কোন্ বহুদূরের পাহাড়ের চূড়ার উৎস থেকে উৎপন্ন হয়ে, কত মাঠবন পার হয়ে, কোন্ সুখ-উঠানের পাশ দিয়ে কলকলিয়ে, কোন্ দুখ-পাথরের গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বয়ে যেতে থাকা ছলাৎছল নদীকে কি উৎসে ফিরে যা বললেই সে ফিরতে পারে?
কি এক সময় ছিল!
কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত, পাগল করা সময়।
সেই সময় খালি মনে হত কেউ আমাকে পাত্তা দেয় না। কেউ আমার কথা শোনে না। রাস্তায় বের হলে মনে হত আমার দিকেই যেন সবাই বিদ্রূপ সহকারে তাকিয়ে আছে।
একলা দুপুরে গলার কাছে কান্না এসে আটকে থাকত গুটলি পাকিয়ে। কি যেন করতে ইচ্ছে হত! কোথায় যেন ছুটে যেতে ইচ্ছে হত। চিৎকার করে সব্বাইকে বলতে ইচ্ছে হত “আমি কিন্তু ভালো নেই, আমি পালিয়ে যাব কিন্তু!”
পাখির গানের কোনো, জানামতে, স্বরলিপি নাই
তবু কোনোদিন সেইসব গান বেসুরো লাগেনি
সুরেই লেগেছে কিনা ভ্রুক্ষেপ করেনি কোনো পাখি
শুনেছে কেবল আহা বলেছে যা আকুল হৃদয়
দোয়েল পাখির শিসে থামে নাই কোকিলের কুহু
বকের সাধনা তবু ভাঙে নাই শালিখের সুরে
ফুলেরা মানেনি রীতি “কী উপায়ে ফুল হ’তে হয়”
কারো কোনো কথা মেনে হয় নাই পদ্ম সুনীল
ঘাসফুল মানে নাই বীজগণিতের কোনো ধারা
সংকোচে ফুলেদের ভালোবাসা বকেয়া থাকেনি
মার্চ মাস এলেই টিভিতে মুক্তিযোদ্ধা কিংবা শহীদ পরিবারের স্বজনদেরকে ডেকে ডেকে ১৯৭১ এর স্মৃতি বলতে বলা হয়। ঘুরে ফিরে কিছু মানুষের কাহিনীই আমরা বারে বারে শুনি। কিন্তু শুধু তারাই কেন শোনাবেন? একাত্তরে এদেশে মারা গেছে ৩০ লক্ষ মানুষ, আমাদের তো ৩০ লক্ষ গল্প থাকার কথা। অন্তত ৩০ লক্ষ সাহসিকতার গল্প। সে সময় বাঙালি ছিলো সাড়ে সাত কোটি, তত কোটি গল্প কি আমরা শুনেছি?
১।
সন্ধ্যের দিকে প্রচণ্ড ক্লান্তি অনুভব করেন কামরুল হাসান। সকালে থেকে চলছে এই কবিতা পাঠের আসর। ফয়েজ আহমেদ তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসেন। বুঝতে পারেন পটুয়া মহা ক্লান্ত। একটি কাজেই পটুয়ার কখনো ক্লান্তি আসে না, আঁকা আঁকি। আশেপাশে যা কাগজ পাচ্ছেন পটুয়া সকাল থেকে সেখানে নানা আঁকিবুঁকি করে যাচ্ছেন। এখন কবি রবীন্দ্র গোপের ডায়েরীতে চলছে পটুয়ার আঁকা আঁকি। কিছুক্ষণ আঁকিবুঁকি করে হঠাৎ মনে হল পটুয়া কিছু একটাতে মন বসিয়েছেন। পটুয়ার মাঝে কেমন যেন একটা ঘোর লাগা ভাব। সারাদিন ধরে এত কবিতা শুনলেন কিন্তু এখন আর মনে করতে পারছেন না কি কবিতা শুনলেন। মাথার মধ্যে শুধু মোহাম্মদ রফিকের চারটি লাইন ঘুরপাক খাচ্ছে -
সব শালাকবি হবে, পিপীলিকা গোঁ ধরেছে উড়বেই, বন থেকে দাঁতাল শুওর, রাজ আসনে বসবেই।
মাঝে মাঝে ভালো লাগে না কিছুই, মাঝে মাঝে পালাতে ইচ্ছে করে। চেনা হাতঘড়ি, রোদচশমা কিংবা প্রিয় মানুষটিকেও অসহ্য মনে হয়। যেনো অন্যকোথাও যাবার কথা ছিল—
মৃত্যুমুখ অবধি ছড়ানো এ গাথা— এক অসম্ভব সেতু ছড়ানো চারপাশে। মেঘের মধ্যে উড়ছে আমাদের ঘরবাড়ি যাবতীয় ভালো লাগা। দ্যাখো, দু’হাতে চোখ ঢেকেও আমি তাকে থামাতে পারছি না! শিথিল স্বপ্নের মতো ঘুমন্ত আগুন থেকে বেরিয়ে সে বসে আছে নিষিদ্ধ করাতকলের পাশে।