খুকী তোমাদের কিচ্ছু বোঝে না মা'--
ছ সাত বছরের নিনি কে ওর পিপি শিখিয়েছিল বাসে ট্রামে উঠতে গেলে দুই কনুই দুপাশে বাগিয়ে ধরে বেশ গুঁতাতে গুঁতাতে উঠতে হয়। ফলে ফাঁকা ট্রাম বাসেও নিনি তাই করত। ওর তৎকালীন উচ্চতার কারণে এই গুঁতোগুলো কখনওই দাঁড়ান ভদ্রলোক মহিলাদের হাঁটুর খুব একটা ওপরে পৌঁছাত না, শুধু একদিন ছাড়া। সেদিন এক 'কাকু' ওকে ট্রেনে উঠতে সাহায্য করার চেষ্টা করতেই নিনির কনুইয়ের এক গুঁতো ভদ্রলোকের উপচীয়মান ভুঁড়ির নীচের দিকে। ভদ্রলোক একেবারে "আঁক" করে উঠেছেন। বেচারা! ভাবতে পারেন নি ঐটুকু মেয়ে অমন সদ্য শিং গজান ছাগলছানার মত গুঁতিয়ে দেবে। আশেপাশের লোকজন, কেউ মজা পেলেন, কেউ বিরক্ত, আর ওর মা চুড়ান্ত অপ্রস্তুত। পিপি, মানে ওর ছোটপিসী ছিলেন মধ্য চল্লিশের এক মহিলা। তা নিনি এই পদ্ধতির সুফল বুঝতে শুরু করে আট ন বছর বয়স থেকেই। আট বছরে বাবা মারা যাওয়ার পরপরই তো মা নিনি আর নানা কে নিয়ে চলে গেল কোন্নগরে, আর পিপি থেকে গেল কলকাতায়। মাঝে মাঝেই কলকাতায় আসা লোকাল ট্রেনে চেপে। সবসময় তো লেডিস কম্পার্টমেন্ট অবধি পৌঁছন যায় না। নিনি অবশ্যি লেডিস, জেনারেল নির্বিশেষে ঐভাবেই ডাইনে, বাঁয়ে কনুই চালিয়ে উঠত। আর মাঝেমধ্যেই দেখত প্রবল আগ্রহে সাহায্য করতে এগিয়ে আসা হাতেরা সিঁটিয়ে সরে যেত। একদিন এরকমই এক সাহায্যকারী, ধবধবে সাদা শার্ট পরা এক ভদ্রলোক ওকে বললেন 'তুমি ভারী ডেঁপো মেয়ে বুঝলে? এই বয়সেই পেকে একেবারে ঝিক্কুস হয়ে গেছ!' নিনি তো প্রবল অবাক। সে কি কথা! ও তো কিচ্ছু বলে নি। বড়দের কথার মধ্যে কথা বললে মা বলেন 'পাকামী কোরো না', কিন্তু এখানে সেসব কিছুই নয়। ওর কিরকম যেন একটা খারাপ লাগতে থাকে। একটু একটু রাগ আর খানিকটা খানিকটা খারাপলাগা। তখনও অপমানবোধের সঠিক ধারণা তৈরী হয় নি কিনা, নিনি তাই সিটে বসে আপনমনে দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে। মা দেখতে পেয়ে বলেন 'যে যা খুশী বলুক তুই ঐভাবেই ওঠানামা করিস, তবে ফাঁকা থাকলে অত গুঁতাস না'। তারপরে স্বগোতোক্তি করেন 'তুই বড় তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাচ্ছিস। ছোড়দি বড় ভালা জিনিষটা শিখাইসিল।' নিনি বোঝে তার মানে বড়দের বোধহয় অমনি গুঁতিয়েই ট্রেনে ফেনে উঠতে হয়। ঐ ভদ্রলোক তারমানে ওকে ছোট দেখে আর বড়দের মত ব্যবহার করতে দেখেই ঐ কথাটা বললেন। মা'কে জিগ্যেস করতেই এক ঝামটা, 'অত বকবক্ করিস কেন? বোস জানালার ধারে চুপ করে।' আবার স্বগতোক্তি 'এই তো শুরু'।
ক্লাস ফোরের নিনি দৌড়াচ্ছে, নিনি দৌড়াচ্ছে, খুব দৌড়াচ্ছে স্কুলের মাঠে। সামনেই স্পোর্ট্স। ওর খুব ইচ্ছে রিলে রেসে নাম দেয়, খুব একটা ভাল দৌড়াতে পারে না বলে বাকীরা ওকে রাখতে চাইছে না। তা দিদিমনি বলেছেন ও যদি সবিতা আর রিমার সাথে সমানে সমানে দৌড়াতে পারে তবেই ওকে নাম দিতে দেবেন। ওদের স্কুলের মাঠের মধ্যে দিয়ে একটা সরু পায়ে চলা পথ আছে। স্কুলের কোন গেট বা বাউন্ডারী ওয়াল না থাকায় লোকে ওখান দিয়ে শর্টকাট মারে। দুটো ছেলে যাচ্ছিল সাইকেল নিয়ে। তাদের গতি বেশ ধীর হয়ে যায়, আহা মেয়েরা দৌড়াচ্ছে, হঠাৎ ধাক্কা লেগে যায় যদি!! নিনি একেবারে সবিতার সাথে সাথে পৌঁছেছে। বেজায় ফুর্তি প্রাণে, এবারে আর দিদিমনি বাদ দেবে না দল থেকে। দৌড়ে দৌড়েই ফিরছে, হাঁপাচ্ছে, কানে এল 'এই যে ব্যাটারী তোমার আসল ব্যটারী জ্বলবে কবে?' পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে নিনি দেখে একটা কালো সিড়িঙ্গে মত ছেলে, দাঁতগুলো একেবারে গাঢ় হলুদ, বের করে হাসছে। কিছু বোঝার আগেই ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল 'তুমি কে? দাঁত মাজ না কেন?' কপ করে মুখ বন্ধ করে হলুদদন্তী ও তার সঙ্গী সাইকেল নিয়ে ধাঁ। এদিকে আরেক ক্যাচাল--- এবারে দিদিমনিকে কৈফিয়ৎ দাও কেন 'ছেলেদের সাথে কথা' বলছিলে? তাদের তুমি চেনো কিনা? মহা ঝামেলা! সারাদিন কানের মধ্যে মশার ভনভনের মতই বিনবিন্ করতে থাকে "ব্যাটারী .... ব্যাটারী......." নিনির চোখে একজোড়া নার্ভ নেই, তাই ওর চোখের মণিটা কখনও স্থির হয় না, ফলে চোখের ফোকাল লেনথও কখনও স্থির হয় না, কয়েক মিলিমিটারের তফাৎ হয়। অসুখটার নাম নাকি 'মিস্ট্যাগমাস', কিছুতে সারার নয়। ফলে নিনি ফার্স্ট বেঞ্চে না বসলে বোর্ড দেখতে পায় না, যদিও ওর চশমা আছে। ও যখন কেজি-টুতে পড়ত তখন থেকেই ক্লাস নাইন টেনের দিদিরা কেউ কেউ ওর চোখের জন্য ওকে "ব্যাটারী" বলে ক্ষেপাত। তখন থেকেই এই শব্দটা শুনলে ওর মনে হয় ওরও যদি শামুকের মত একটা খোলা থাকত আর ও তার মধ্যে হাত পা গুটিয়ে ঢুকে যেতে পারত! আজ কিন্তু নিনির মনে হয়, ও আরেকটা শামুককে দেখেছে। প্রথমে একটু একটু , পরে বেশ ফুর্তি হতে থাকে। নিনি দাদুর খুচরো পয়সার বাক্স থেকে একটা ১০ পয়সা নিয়ে বিকেলবেলা খেলতে গিয়ে হজমীগুলি খায় চেটে চেটে। কপ্ করে মুখ বন্ধ করে পালানোর দৃশ্যটা ভাবে--- জিভ বের করে হাত চাটে --- চকাস চকাস--- বেশ হয়েছে বেশ হয়েছে।
মা কদিন ধরে সবার সাথে খেতে বসছে না৷ এমনিতে নিনিরা আলাদা রান্না করে, আলাদা বাজার করে৷ দাদু যখন বাজারে যায়, মা এসে ব্যাগ আর টাকা দিয়ে বলে দেয় কী কী আনতে হবে৷ দাদু এনে নিনিদের রান্নাঘরের সামনে নামিয়ে দেয়৷ কিন্তু খেতে বসার সময় থালা নিয়ে এসে দাদুদের দালানে বসে খাওয়া হয়৷ দাদু, ছোটমামা, ছোটদি যখন খেতে বসে, মা নিনি আর নানার খাবার বেড়ে নিয়ে আসে৷ নানাকে খাইয়ে দেয়৷ পরে যখন দিদা আর বড়মামীমা খেতে বসে, তখন মা'কে ডাক দেয়, মা নিজেরটা নিয়ে এসে বসে৷কিন্তু পরশু থেকে মা তো বসছে না ---- অন্য কোথায়ও বসে তো খাচ্ছে না৷ নিনি আর না পেরে জিগ্যেস করে ফ্যালে 'মা খাবে না?' দিদা বলে 'না তর মায়ের অম্বুবাচি চলতাসে'৷ সে আবার কী? আর না খেয়ে মা থাকবে কী করে? এইবারে দিদা খুব বিরক্ত হন৷ এতবড় ধিঙ্গি মেয়ে অম্বুবাচি জানে না! কিন্তু জানার পর নিনি আরও আরও অবাক হয়৷ বাবা নেই বলে মা এই কদিন ভাত খাবে না! স্রেফ দুধ ফল খেয়ে থাকবে!! মা তো ফল খেতে একদম ভালবাসে না৷ আর এইকদিনই বা কেনো? এখন তো বাবার জন্মদিনও নয়, মৃত্যুদিনও না৷ তাহলে? তা, প্রশ্নের উত্তর না জানা থাকলেই বড়রা ছোটদের পিঠে ধুমধুমাধুম ক'ঘা দিয়ে দেয়, এ নিনি আগেই জানত৷ তফাৎ হল, এইবারে প্রশ্নগুলো দিদাকে করা হলেও পিট্টিগুলো মা'ই দিল৷ 'দশ বছর বয়স হল, ধিঙ্গি মেয়ে কোনও আক্কেল নেই--- হাড় ভাজাভাজা করে ফেলল এক্কেরে! এত মুখরা মেয়ের জন্য ঘরে বাইরে মুখ দেখাবার উপায় নেই!!'
পরে, অনে-এ-এ-ক পরে নিনি অবশ্য মা'র এই 'অম্বুবাচি' করা বন্ধ করাতে পেরেছিল৷ তখন আর ওরা দাদুদের দালানে খেতে যায় না, তখন নিনির মা অনেক কষ্টে 'নিজের বাড়ী' বানাতে শুরু করেছে৷মা'র কোনওদিনই আতপচাল সহ্য হত না, অনবরত হজমের গন্ডগোল হত, নিনি একবার কোমর বেঁধে তর্কে নেমে এবং নিজেরাও আতপচাল খাবে, একাদশী অম্বুবাচি করবে --- এরকম সব দাবীদাওয়া করে মা'কে সিদ্ধ চাল খাওয়া আবার ধরায়, একাদশী অম্বুবাচি করা ছাড়ায়৷ কিন্তু কিছুতেই আর মাছ খাওয়া ধরাতে পারে নি, পারে নি আবার রঙীন শাড়ি পরাতেও, রঙীন ব্লাউজ অবধি ফেরৎ আনাতেই শেষ৷
ক্লাস সেভেনে নিনির ছোটমামার বিয়ে ঠিক হল৷ বাড়ীভর্তি কতসব আত্মীয়স্বজন এলো৷ সেই প্রথম নিনি দেখল ওর মায়েরও তিন তিনখানা নিজের মামা আছে৷ আরও যে কতসব কারা এলো, বাড়ীতে সকাল থেকেই হইহই শুরু হয়ে যায়৷ নিনির জন্য একটা পার্পল রঙের সিল্কের ফ্রক বানানো হয়েছে, পরে বরযাত্রী যাবে৷ নানার জন্য সিল্কের পাজামা পাঞ্জাবী৷ মা বরযাত্রী যাবে না, নাকি যেতে নেই অকল্যাণ হয়৷ এখন নিনি আর কিছু বলে না, শুধু একলা একলা মন খারাপ করে৷ মা বুঝতে পেরে বলে 'তোদের বিয়ে হলেও তো আমি বরণ করতে পারব না, তাহলে তোদের খারাপ হয় যদি'৷ নিনি এইবারে রেগে উঠে বলে 'আমি তাহলে বিয়েই করব না, আর নয়ত রেজিস্ট্রি বিয়ে করব'৷ মা এক্কেবারে হাঁ হয়ে যায় -- 'তুই জানিস রেজিস্ট্রি বিয়ে কী? কোত্থেকে জানলি?' নিনি চুপ৷ও যে লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়ীর সমস্ত পুজোসংখ্যা 'প্রসাদ', 'নবকল্লোল' পড়ে ফেলেছে সেটা তো আর বলা যায় না৷ ওগুলো 'বড়দের' বই, তাই ওদের পড়া মানা৷ অথচ ঐগুলোতে যে কি ভাল ভাল সব গল্প থাকে -----
বৌভাতের দিন দুপুরে নতুন ছোটমামীমা নতুন তাঁতের শাড়ি পরে, নতুন ড্রেসিংটেবিলের আয়নার সামনে বসে , নতুন একটা প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট ছিঁড়ে সন্না বের করে নিজের ভুরু চিমটিয়ে চিমটিয়ে তুলতে থাকে৷ নিনি একেবারে হাঁ হয়ে যায়, ছোটদি জিগ্যেস করে 'তুমি বুঝি নিজেই প্লাক কর?' ও তাহলে এইটাকে 'প্লাক করা' বলে৷ কিন্তু --- কিন্তু ব্যথা লাগে না? ছোটমামীমা বলে 'না না, আসলে বিয়ের গোলমালে করা হয় নি তাই একটু সমান করে নিচ্ছি৷' ছোটমামীমাকে মস্ত এক্সপার্ট মনে হয় নিনির৷ বিকেলে নিনি যখন সকলের মাঝখানে সগর্বে জানায় ছোটমামীমা নিজে নিজে ভুরু প্লাক করতে পারে, তখন উপস্থিত বড়রা সবাই হঠাৎ একদম চুপ হয়ে যায়৷ নিনি ভাবে ওরা বিশ্বাস করছেন, তাই জোর দিয়ে বলে 'দুপুরেই করছিল আমি দেখেছি তো'৷ এইবারে মেজমামাদাদু ভুরু কুঁচকে বলেন ' ঘরের বৌ -- না না এ তো ভাল নয়'৷ বড়মামীমা নিনির দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলেন 'তোর খেলা নেই, কেবল বড়দের মধ্যে বসে থাকিস কেন ডেঁপো মেয়ে কোথাকার৷' তারপর মেজমামাদাদুকে বলেন 'আহা দিল্লীতে বড় হয়েছে, ওখানে নিশ্চয় এইসব খুব চলে, এখানে থাকলে ওসব ঠিক হয়ে যাবেখনে৷' এইবার নানা একটা বোমা ফাটায়, হঠাৎ বলে ওঠে 'আমি দেখেছি মেজমামাদাদুও নিজে নিজে মাথার সমস্ত চুল খুলে ফেলতে পারে৷ দুপুরেই খুলে আঁচড়ে আবার লাগিয়ে নিল৷' মেজমামাদাদু বাদে বাকি বড়রা সবাই হইহই করে হেসে ওঠে৷ তবে 'হাসির ছেলেমেয়ে দুইডাই যে এক্কেরে ধানীলঙ্কা এক একটা' এইটা নিয়ে সব্বাই একমত হয়৷
ক্লাস নাইনের নিনি জানে হয় ব্যাগ নয় খাতাবই দিয়ে বুক ঢেকে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হয়। দিদা বলে, মা বলে, ছবির মা বলে----সবসময় ঢিলা জামা পরতে হয়----স্কুলের নীপবীথি দিদিমনি ইলাকে বলেন 'এমন অসভ্যের মত শাড়ী পর কেন? এখানে কি প্রেম করতে এসেছ যে আঁচল অমন সরু করে প্লিট করেছ?' ইলা অপমানে মুখ নীচু করে থাকে। ইলার এটা তৃতীয় বছর ক্লাস নাইনে। নিনির সাথে ওরা বিশেষ কথা বলে না। 'ভাল মেয়ে' বলে ব্যঙ্গ করে। নিনির প্রাণের বন্ধু মিমির সাথে কিন্তু ইলার বেশ ভাব আছে। নিনি পরে শোনে মিমিকে নাকি ইলা বলেছে 'তোকে তো ভারী মিষ্টি দেখতে, ফীগারও ভীষণ ভাল। নিনি তো ফর্সা, দেখতেও ভাল, তোদের দিকেই তো সব ছেলেরা তাকাবে। রাস্তায় আসি যাই, আমাকে তো দেখতেও ভাল না, গায়ের রঙও কাল, বুকটা অন্তত একটু বোঝা না গেলে ছেলেরা তাকাবে কেন বল?" নিনি আর মিমি এই নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেও সিদ্ধান্তে আসতে পারে না "ছেলেদের তাকানো" ব্যপারটা ভাল না খারাপ। ওরা জানে, শুনেছে ছেলেরা তাকানো আর ছেলেদের দিকে তাকানো দুটোই খুব খারাপ। কিন্তু তাহলে ইলা অমন বিষণ্ন আর চিন্তিত কেন? ওর দিকে যদি কেউ না তাকায় তাহলে তো সমস্যার অর্ধেকই রইল না। আলোচনা করতে করতেই মিমি বলে 'জানিস মাস্টারপাড়ার একটা ছেলে আমাদের পেছন পেছন এসে একদিন আমাদের বাড়ীটা চিনে গেছে। তারপর থেকে রোজ বিকেলে সামনে দিয়ে বার ৪-৫ তাকাতে তাকাতে যায়"। নিনি তো হাঁ। বলিস কি কাকীমা টের পায় নি? মিমি বলে "নাঃ" তারপরে চুপি চুপি বলে "ছেলেটাকে ভারী মায়াবী দেখতে আর খুব শান্ত" বলতে বলতে মিমি একটু লালচে হয়ে যায়।
"ওলো তোর সাধের বাঁশি, বনপলাশী, দেখনহাসি, ডেমোক্রেসি যাবে ভেসে'------
নিনি গোপালবাবুর কোচিঙে অঙ্ক করতে গেছে। সেখানেই ক্লাস টেনের দেবী আর পম্পা আসে। দুজনে ভীষণ বন্ধু। কেউ কাউকে ছেড়ে থাকে না, ক্লাসেও বসে পাশাপাশি। কথা হচ্ছে বড় হয়ে কে কি করবে? কৃষ্ণার সাফ কথা, বিয়ে করব ব্যাস। সঙ্গে সঙ্গে পম্পার কৌতুহল 'কাকে করবি রে?' কৃষ্ণা একটু বিরক্ত 'তা কি জানি? যার সাথে হবে'। পম্পার স্পষ্ট উত্তর 'কেন আমি তো দেবীকে করব।' নিনির মনে হয় হঠাৎ সামনে একটা মস্ত আয়না ভেঙ্গে পড়ল। নিনি অবাক হয়ে দেবী আর পম্পার দিকে হাঁ হয়ে তাকায়। এ আবার কি কথা! নিজের অগোচরেই দেবীকে একবার খুঁটিয়ে নজর করে --- সত্যি মেয়েতো? ভাঙ্গা আয়নার কাঁচের টুকরোগুলো কুড়োবার আগেই মাস্টারমশাই এসে পড়েছেন, অঙ্ক শুরু কর। ভাবনারা মাথায় কেবলি হিজিবিজি আঁকে, তাহলে ও-ও ইচ্ছে করলে মিমিকে বিয়ে করতে পারে? মিমি ও তো ওর খুব বন্ধু। মিমি স্কুলে না গেলে ওরও যেতে ইচ্ছে করে না তো। ভাবতে ভাবতে কিরকম শীত শীত করতে থাকে, কি যেন, কিরকম যেন --- নাঃ এরকম হয় না। তাহলে আরো কাউকে কাউকে দেখা যেত না? আচ্ছা গত সপ্তাহে সেই যে দেখল মামাবাড়ীর টিভিতে 'পথে হল দেরী'--- আর সেটা তো বেশ ভালও লেগেছিল, কিন্তু সেইরকম তো ঠি---ক ভাল লাগছে না ভাবতে এটা----নাঃ। বিয়ে ভাবতে গেলে ঐ সিনেমাটার মত, অথবা ওরকম আরো যে সব সিনেমা আছে সেরকমই বেশ লাগে। কিন্তু উত্তমকুমারকে একটু কেমন যেন--- দূর অত চোখে কাজল দেওয়া লোক মোট্টে ভাল লাগে না। তার থেকে বেশ 'সোনার কেল্লা'র ফেলুদার মতন কেউ হলে---দূর পম্পার কথাটা বোঝাও গেল না, তেমন ভালও লাগছে না।
ব্রাসেলসের পোর্তে দ্য নামুর মেট্রো স্টেশনের সামনে ঠিক রাস্তা পেরোতে যাবার মুহূর্তে 'ওয়াক' সিগনাল অফ হয়ে গেল। যাঃ এখন দাঁড়াও কিছুক্ষণ। এইরে !আবার নিনির সামনে ভেঙ্গে পড়ে একটা আয়না। সামনে দাঁড়ানো দুটো মেয়ে গলা জড়িয়ে ধরে প্রাণপণে চুমু খাচ্ছে। নিনি জীবনে দেখে নি এ দৃশ্য। ভাল করে দেখতে থাকে নিনি, মন দিয়ে লক্ষ্য করে দুজনকে। পাশ থেকে মানস ওর কনুই ধরে হ্যাঁচকা টান মারে, 'চল চল এখানে এসব খুব কমন। অমন হাঁ করে তাকিয়ে থাকিস না'। তারপর তো নিনি দেখতেই থাকে, দেখতেই থাকে। যত দেখে তত মনে হয় বছরখানেক আগে দেবীর সাথে দেখা হওয়ার কথাটা। কিরকম একটা ভেঙ্গে পড়া বিষন্ন ভাব ছিল ওর মধ্যে। ওকে পম্পার কথা জিগ্যেস করায় খুব কষ্ট করে হেসে বলেছিল 'শ্বশুরবাড়ীতে। খুব ভাল আছে'। দেশে ফিরে পূজাসংখ্যা 'আনন্দবাজার' পড়তে গিয়ে আবার চমক। তিলোত্তমার 'চাঁদের গায়ে চাঁদ' পড়ে মনে হয় তবে তো সেদিন দেবী খুব অদ্ভুত কিছু বলে নি আর দেবীরা নেহাৎ কমও নয়।
"চক্ষুকর্ণ দুটি পাখায় ঢাকা"----
নীরাদিদিমনির ছেলে নাকি ভীষণ পড়ায় ভাল। কোলকাতার হিন্দু স্কুলে পড়ে। সে নাকী আবার খুব পন্ডিতও। নিনিকে তো মা কিছুতেই হিন্দী সিনেমা দেখতে দেয় না, নাকি ভীষণ খারাপ। কাল টিভিতে একটা খুব মজার সিনেমা হচ্ছিল "কামচোর"। নিনি দেখেছে সেজমামার কথায় মা আপত্তি করে নি তো, তাই। পরেরদিন মা স্কুল থেকে এসে একটু দ্বিধাগ্রস্ত। সেজমামার সাথে কথা বলবে কি বলবে না করছে। মাত্র ১৫ দিনের জন্য আসা দাদা , তাকে কি বলাটা ঠিক হবে? ভাবতে ভাবতে বলেই ফেলে
' দেখ সেজদা ----- কালকের সিনেমাটা , টিভিতে যেটা ছিল, নাকি বড্ড বাজে। '
'সেকি রে জুঁই ? কেডা কইল?'
'এই নীরাদি কইতাসিলেন--- '
'ক্যারে? কি হইসে?'
'এই ওঁর ছেলে কইসে যে সিনেমার নাম হয় "কামচোর" হেই সিনেমা দেখনডাই এক------"
৩-৪ সেকেন্ড সমস্ত ঘর চুপ। আর তারপরই সেজমামার ঘর ফাটিয়ে হাসি, তার সাথে বাবাকে হাসতে দেখে মনিও হাসতে শুরু করল। মা তো প্রথমে অবাক, তারপরই দুই ভুঁরুর মাঝে ৩ টে ভাঁজ। এই রে মা রেগে যাচ্ছে। সেজমামা তার মধ্যেই বলে উফ তোরা যে কবে একটু একটু হিন্দী বুঝবি! আরে কাম শুনিস নাই? কাজকাম সেই কাম, হিন্দীতে কাজরে কাম কয়। কিন্তু নিনি এখনও অথৈ জলে। কাম মানে যে কাজ ও-ও জানে, কিন্তু ........ হঠাৎই ওর জ্ঞানচক্ষু উদয় হয়--- আরে তাই তো এটা তার মানে সংস্কৃত কাম, মানে ঐ পন্ডিত ছেলে যা ভেবেছে। সত্যি তো পন্ডিত বলে কথা! হিন্দীর মধ্যে বাংলা, তার মধ্যে সংস্কৃত খুঁজে বার করবে আর নাক শিঁটকাবে আর মুখ বেঁকাবে , তবে না পণ্ডিত। বড় হয়ে এই ছেলে বাংলার প্রফেসার হয়। নিনির খুব কৌতুহল, এই ছেলে বাংলা সাহিত্যের সেই "কচুয়া ধরত যব হাসিয়া" জাতীয় লাইন পড়তে এবং পড়াতে গিয়ে কি ভাবে, আর কি বলে?
নিনির মনে আসে নীপবীথি দিদিমনির কথা। ওঁর কিন্তু কোন সিনেমা বা কোথায়ও ব্যবহৃত কোন শব্দ নিয়ে এমন ভয়ংকর আপত্তি ছিল না। অথচ উনিই মেয়েদের সামান্য কারণেও বিদ্রুপ করতে পারলে ভারী খুশী হতেন। বাপ্স্ উনি যদি জানতেন নিনি আমস্টার্ডামে কিরকম সব মিউজিয়াম দিব্বি ঘুরে ঘুরে দেখেছে -- আর -- এই সমস্ত। আচ্ছা কাউকে প্রেম বা সাজপোষাক বিষয়ে বিদ্রুপ করার সময় ওনঁর মুখটা কিরকম উজ্জ্বল হয়ে যেত কেন? বেশ রেলিশ করে করে বলতেন কিন্তু। আর যে মেয়েটিকে বলতেন সে যত লজ্জা পেত, অপমানিত বোধ করত ততই আরো খুশী খুশী হয়ে উঠতেন। নীরাদিদিমনি কিন্তু এমনিতে বেশ ভাল লোক। মাধ্যমিক পাশ করে সব্বাই প্রণাম করছে দেখে অঙ্কে কম্পার্টমেন্টাল পাওয়া নমিতাও কি ভেবে যেন প্রণাম করে ফেলল। আর অমনি নীরাদিদিমনির স্বতঃস্ফুর্ত উচ্ছাস - খুব খুশী হয়েছি ভীষণ খুশী হয়েছি। অথচ ওঁর সামনে রিমা একবার রবীন্দ্রনাথের আম খেতে গিয়ে দাড়িতে আমের রস লেগে যবার মজার গল্প বলে ফেলেছিল --- উরিবাবারে সে কি কুরুক্ষেত্তর কান্ড! আর কি উদ্দাম বকুনি!! বেচারী রিমা ভেবেই পায় নি, রবীন্দ্রনাথ আম খেতেন না, নাকি অত বড় দাড়িতে রস লাগত না?
এই লেখাটার একটা পুঁচকে সংস্করণ বছর ছয়েক আগে অন্যত্র বেরিয়েছিল৷ তখনই ইচ্ছে ছিল পরিমার্জন ও পরিবর্ধনের৷ এখন চারিদিকে অনেককিছু দেখতে দেখতে ইচ্ছে হল সেই ভেলভেলে মেয়েটা, মেয়েগুলোর গল্পগুলো লিখেই ফেলা যাক৷ অন্য ভেলভেলে মেয়েগুলো পড়েটরে যদি একটু ভরসা পায় যে এদিক ওদিক ভুলচুক করে, কখনও অপমানিত হয়ে, কখনও অপমান করে টুকটুক করে এগিয়ে যেতে থাকলে ব্যাপারটা তেমন খারাপ হয় না৷
চলবে (বোধহয়)
মন্তব্য
একটানে পড়ে ফেলার মত গল্প।
কিন্তু...
আসলেই গল্প?
অনেক ধন্যবাদ|
এটা তো ব্লগরব্লগর|
আরে আপনার আমার চারপাশে কত যে কাহিনী া যায় প্রতিদিন, স্রেফ চেপে ধরে লিখে দিলেই গল্প ট্যাগের মধ্যে চলে আসে আর কি| -) আপনার চেনাশোনা নিনি মিমিদের জিগ্যেস করে দেখুন, এইসব গল্পই শুনতে পাবেন
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
চলুক
ধন্যবাদ
কিন্তু আপনার নিকটার মানে কী?
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
ভালো লাগসে।
কিন্তু এটা গল্প কি?
আচ্ছা, এই মেয়েটা ভেলভেলেটা....এর কোনো পরের লাইন আছে? এর উৎস ই বা কোথায়? জানালে খুশি হতাম।আমাকে ছোটবেলায় এর সাথে কয়েক লাইন জুড়ে দিয়ে যা ক্ষেপাতো...
এই মেয়েটা ভেলভেলেটা/ আমাদের বাড়ি যাবি?/ একটা করে পয়সা দিব/ বিক্কু (বিস্কিট) কিনে খাবি ।
আমি এটা ছোট বেলায় শুনেছিলাম
অনেক ধন্যবাদ|
এটা তো ব্লগরব্লগর|
আরে আপনার আমার চারপাশে কত যে গল্প দেখা যায় প্রতিদিন, স্রেফ চেপে ধরে লিখে দিলেই গল্প ট্যাগের মধ্যে চলে আসে আর কি| -)
আমি আর একটাও শুনেছি|
এই মেয়েটা ভেলভেলেটা আমাদের বাড়ি যাবি
খইবাতাসা ছড়িয়ে দেব, কুড়িয়ে কুড়িয়ে খাবি
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
চলুক তবে। গল্পের গাঁথুনি অসাধারণ।
অনেক ধন্যবাদ|
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
খুব ভাল লাগলো। গল্পটা কেমন গড়গড়িয়ে চলে গেল। নিজেকে খুঁজে পেলাম। ছোট বেলায় আমার নাম ছিল 'ক্যাসেট প্লেয়ার।' নানু বাড়িতে আমি ছিলাম প্রথম বাচ্চা এবং অনেক দিন পর্যন্ত একমাত্র ছোট মানুষ। তো ছোট মানুষ, কিছু বুঝি না, সবাই আমার সামনেই সব গল্প করত। আর আমি নাকি মামা- খালা সবার মাঝখানে বসে গল্প শুনতাম এবং সব রেকর্ড করতাম। পরে সময় মত সেগুলো বের করতাম।
অনেক বাচ্চাই অমনি হয় তো|
ধন্যবাদ
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
চলুক... তবে একটু দ্রুত
অনেক ধন্যবাদ|
নিশ্চয় চেষ্টা করব|
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
কী যে সুন্দর। চলতেই হবে
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
আরে রানা!
কোথায় ছিলে(ন) ওস্তাদ? এতদিন কোথায় ছিলে(ন)?
না না সত্যি অনেকদিন বাদে দেখলাম|
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
খুব ভালো লাগলো
ধন্যবাদ
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
খুবইই ভাল লাগল। এইসব ভেলভেলে মেয়েদের গল্পের কোন শেষ নেই। ছেলেরা যা খুশি বলুক বা করুক ( "পরিণতমনষ্ক" হতে এদের সময় লাগে, আমার ধারণা) কিন্তু সবচেয়ে খারাপ লাগে যখন মেয়েরা মেয়েদের নিয়ে কটুক্তি করে। নিজের ভাল পাগলও বোঝে, কিন্তু এই মেয়ে জাতটা বোঝেনা
নতুন মন্তব্য করুন