কলকাতা বইমেলা শুরু তো হয়েছে সেই কোনকালে, আমাদের ছোট্টবেলায়| আমার আসলে বলা উচিৎ সেই যখন সবার গোলাভরা ধান আর পুকুরভরা মাছ ছিল, মানে ছোটবেলার কথা বলতে গেলে আমার মত প্রাচীনার যেমন করে বলা উচিৎ আর কি| তবে সত্যিই তো আর ঐসব কিছু ছিলটিল না, তাই বরঙ বলি, ছোট্টবেলায় যখন আনন্দমেলা আর শুকতারা দুইই বেশ আনন্দ করে পড়তাম, আর পড়ে দিব্বি ভালও লাগত, সেইসময় কোনও একটা বছর হঠাৎই শুনলাম বইমেলার কথা| কলকাতা ময়দানে হয়, তাতে শুধু বইয়েরই দোকান থাকে আর সব দোকানে অনেক অনেক বই থাকে| তা, ময়দান আমি খুব চিনি বাপু| আরও ছোটবেলায় ছোটপিসির সাথে আর এক আধবার বাবা মায়ের সাথেও ময়দানে গেছি| ট্রামে করে যেতাম আমরা, ভিক্টোরিয়া ছাড়িয়ে গিয়ে নামতাম| রাস্তার ধারে মস্ত মস্ত গাছ ছিল আর একটা নালামত| ঐ নালাটা পেরোলেই ময়দানের ঘাস; সবুজ গালিচার মত| কত ল্বড় বড় ছেলেরা ফুটবল কিম্বা হকি খেলত, তারচেয়ে একটু ছোট ছেলেরা দৌড়াদৌড়ি করে নানারকম খেলা খেলত, কোথাও বা আবার অল্প কয়েকজন বসে গল্প করছে, বিকেলের দিকে ঐ ঘাস থেকে কেমন একটা গন্ধ বেরোত, খুব মন কেমন করত ঐ গন্ধটা পেলেই| তখন জানতাম না ওটা আসলে একাকীত্বের গন্ধ|
যাগ্গে বলছিলাম আসলে বইমেলার কথা| সেই ময়দানে শীত পড়লেই নানারকম মেলাটেলা শুরু হয়ে যায়| বইমেলাও নাকি সেখানেই হয়| ক্লাস সেভেন না এইটে পড়ার সময় যখন এই বইমেলার কথা শুনলাম, আমি আর আমার ভাই তো মহা উত্তেজিত| রাজরাজেশ্বরী বা শকুন্তলা-কালীপুজোর মেলার মত নয়, এ একেবারে অন্যরকম মেলা যে| ক্লাস টেনে 'বইমেলা' নিয়ে রচনাও লিখতে হল| কিন্তু মেলা দেখা -- হায় সে তখনও দেরী আছে| আমাদের সেই ছোট্ট মফস্বল থেকে বইমেলা যেতে গেলে ট্রেনে চড়ে হাওড়া স্টেশানে এসে, আবার বাসে বা ট্রামে চড়ে ময়দান অবধি যেতে হয়| হ্যাঁ তখনও হাওড়া ব্রীজের ওপরে দিয়ে ট্রাম চলা বন্ধ হয় নি| দিব্বি ঠংঠং করে ঘন্টা বাজিয়ে হেলেদুলে চলত আর মাঝে মধ্যে একটা ট্রাম খারাপ হয়ে গেলে ঐ লাইনে পরপর ট্রাম দাঁড়িয়ে যেত, বাস, ট্যাক্সিরা সমানে গালিগালাজ করে যেত| তখনকার কলকাতায় আরও সব অদ্ভুত ব্যপারস্যপার হত, যেমন দুইরকমের দোতলা বাস চলত, অটোরিকশা বলে কিছু ছিল না| তা এত কান্ড করে আমাদের দুজনকে বইমেলা নিয়ে যেতে মা কিছুতেই রাজী হত না| বলত আমরা বড্ড অবাধ্য, কোথায় কোন স্টলে গিয়ে বসে থাকব 'বই মুখে' নিয়ে, মা খুঁজে পাবে না--- সে ভারী ঝামেলা হবে| আমরা প্রথ্ম বইমেলা গেলাম, যেবার আমি উচ্চমাধ্যমিক দিলাম| বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি টানাটানির সংসারে মা আসলে আমাদের ইচ্ছেমত বই কিনে দিতে পারবে না, নিজেও কিনতে পারবে না বলেই এতদিন ঐসব কারণ দেখিয়ে গেছে| এমনিতে আমরা দুজনেই জন্মদিন বা কোন কোনও বছর এমনকি পুজোতেও জামাকাপড়ের বদলে একটা বইয়ের তালিকা ধরিয়ে দিতাম| কাজেই মেলায় গেলে যে আমাদের কি অবস্থা হবে, সেই ভেবেই আর কি| সেই সময়ই কিছু একটা পে কমিশনের সুপারিশে আমার মা স্কুল থেকে অনেকগুলো টাকা হ্ঠাৎ পেয়ে যায়| ফলে আমাদের বইমেলা অভিযান| ইতিমধ্যে অবশ্য কলকাতা শহরে দুটো বইমেলা শুরু হয়েছে| একটা ডিসেম্বার মাসে সরকারি বইমেলা আরেকটা জানুয়ারীর শেষ বুধবারে শুরু হওয়া পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের বইমেলা| আমরা গেলাম এই দ্বিতীয়টায়, রবীন্দ্র সদনের সামনের ময়দানে|
সে এক হইহই কান্ড রইরই ব্যপার| তার আগে আমরা কক্ষণো অত বই আর বইয়ের দোকান একসাথে দেখিনি| আর সেইসাথে প্রচুর লোক আর --- আর --- কি আশ্চর্য্য! রাজরাজেশ্বরীতলার মেলার মতই এখানেও কত গয়নার দোকান, ব্যাগের দোকান| আনন্দমেলার সুবাদে আনন্দ পাবলিশার্সের নাম জান, পছন্দের অনেক বইও সেখানে| কিন্তু সেখানে ঢুকতে গেলে লাইন দিতে হবে, এখনকার মত অত্ত বড় নয়, তবে মোটামুটি জনা কুড়ির পেছনে তো বটেই| দেব সাহিত্য কুতীর, দে'জ আর শৈব্যাও মন দিয়ে ঘুরে ফিরে দেখতে হবে| এখন ভাবলে বেশ মজা লাগে, এইসব দোকানে এখন আর একদম ফাঁকা দেখলেও ঢুকি না, অথচ সেই প্রথমবারে কেবলই ঘড়ির দিকে তাকানো আর এই দোকানগুলোতে যতটা পারা যায় তাড়াতাড়ি দেখে নেওয়া| দরকার হলে লোককে গুঁতিয়ে গাঁতিয়ে একদম শেল্ফের কাছে চলে যাওয়া| আমাদের আবার সন্ধ্যের আগেই ওখান থেকে বেরোতে হবে, হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে ফিরতে হবে তো| সেই প্রথম বইমেলায় আমি নারায়্ন সান্যালের অনেক বই কিনেছিলাম, তখন আমি গোগ্রাসে গিলছি 'বিশ্বাসঘাতক', 'হংসেশ্বরী', 'অজন্তা অপরূপা', 'বকুলতলা পি এল ক্যাম্প', পাষন্ড পন্ডিত'| নারায়ন সান্যাল আর ড্যফনে দ্যু ম্যরিয়ার তখন আমার প্রিয়তম লেখক| ভাইয়ের প্রথম পছন্দ বাংলা টিনটিন আর তারপরেই ব্যোমকেশ| দু ভাইবোনের ঐ শাকের ক্ষেতে পড়া দশা দেখে মা আর নিজের পছন্দের বই কিনে উঠতে পারল না| অনেক পরে, মা যখন রিটায়ার করল, তখন ফেয়ারওয়েলে পাওয়া বই দেখে জানলাম মা'র বড় শখ ছিল প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা রবীন্দ্রনাথের জীবনীগ্রন্থ ক'খানির| কি নির্মম ঔদাসিন্যে উপেক্ষা করেছিলাম মা'র পছন্দ অপছন্দ| জানার চেষ্টাও করিনি মা কিছু কিনতে চায় কিনা, অথচ আমি তখন নেহাৎ ছোটও নই|
এরপরে একবার আমরা তিনজনে মিলে সরকারি মেলাটাতেও গিয়েছিলাম ডিসেম্বর মাসে| সেই মেলায় বেশী লোক টোক হত না, আর অনেক দোকানের সামনে বেঞ্চি পাতা থাকত| অনেকে দোকান থেকে বই নিয়ে সেখানে বসে বসেই পড়ত| কেউ কিছু বলত না| তবে এই প্রথা মনে হয় খুব বেশীদিন চলে নি, কারণ কলেজ ছাড়ার পরে যখন আমি একলা একলাই যেতাম, তখন আর সেইসব বেঞ্চিও দেখি নি, পড়ুয়াদেরও না| এর কিছুদিন পরে সরকারী মেলাটা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়| ইতিমধ্যে গিল্ডের মেলাটা উঠে এসেছে পার্ক স্ট্রীটের উল্টোদিকে আর্মি অধিকৃত ময়দানের অংশে| সে মেলা আকারে প্রকারে বিশালতর হয়েছে| এতদিনে আমিও বেশ স্বাধীন হয়েছি| সন্ধ্যের আগে ঘরে ফেরার অনুশাসন বেশ হালকা, এদিকে কম্পিউটার শেখার খরচ চালাতে বেশ কিছু টিউশনিও করি সকাল বিকেল, ফলে টেনেটুনে খান কয়েক বই কেনাই যায়| পার্ক স্ট্রীটের এই মেলাতে আসতে শুরু করেছে বই ছাড়াও হরেকরকমবা জিনিষপত্র| কাঠের কানের দুল, চুড়ি, পোড়ামাটির গয়নাগাঁটি, চালের ওপরে নাম লেখানোর লোক, পোর্ট্রেট আঁকিয়ে, চিত্রশিল্পী, নানারকম ব্যাগ, ক্যালেন্ডার, ঘর সাজানোর টুকিটাকি জিনিষপত্র, বাঁকুড়ার ঘোড়া এমনকি নানারকম ছবি আঁকা টি-শার্ট অথবা কুর্তাও| আর খাবারদাবারের কথা আর কি বলি! পিঠেপুলি পাটিসাপ্টা, খিচুড়ি-আলুর দম-পায়েস, পকোড়া, তেলেভাজা, চপ কাটলেট, বিরিয়ানি-চাঁপ সব সব সব| এই ব্ছরগুলোয় মেলায় গেলে অন্তত একদিন বেনফিশের 'ফিশ বাটারফ্রাই' (ব্যাটার ফ্রাই) খেতামই| কি ভাল যে লাগত তখন| অথচ এখন ঐ পাশ দিয়ে গড়িয়ে আসা তেল দেখলেই কেমন গা গুলায়| সেই হাওড়া গিয়ে ট্রেন ধরতে হবে বলে তখনও সাড়ে ছটা'র মধ্যে মেলা থেকে বেরিয়ে আসতাম| আর তারপরে সে কি জ্যাম! কি জ্যাম! হাঁটতে হাঁটতে প্রায় তিন চার স্টপেজ পিছিয়ে গিয়ে একটা বাসে হয়ত বসার জায়গা পেলাম --- তারপর অন্তত এক থেকে সওয়া ঘন্টা বাসে চুপটি করে বসে থাকা| বাস তিন চার পা এগোয় তো আরো পনেরো কুড়ি মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে| এমনি করে কোনোমতে চাঁদপাল ঘাট বা ফেয়ারলি প্লেস অবধি পৌঁছতে পারলেই নেমে লঞ্চে ওঠা| গঙ্গায় তো আর জ্যাম হয় না, তাই মিনিট দশ পনেরোর মধ্যে হাওড়া স্টেশান| শেওড়াফুলি লোকাল কিম্বা গ্যালপিং ব্যান্ডেল লোকালে ওঠা, যাতে ভীড় একটু কম থাকে, দুই একটা বই একটু নেড়েচেড়ে দেখা যায়| তখন লোকাল ট্রেনের কামরায় টিউব লাইট থাকত না, ফলে ক্ষীণদৃষ্টির আমি সন্ধ্যের পর আর ট্রেনে বই পড়তে পারতাম না|
এরপর অনেক অনেক বছর বইমেলা সেই পার্ক স্ট্রীটের উল্টোদিকেই হত| নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় আমি ঐ ময়দানের উল্টোদিকের একটা অফিস বাড়ির ১২ তলায় চাকরী করতাম| সেইসময় অন্তত তিন থেকে চারদিন নানা ছুতোয় বইমেলায় যেতাম| সেই কোম্পানি ছিল কম্পিউটার শেখানোর একটা চিটিং, অ্যাল থুড়ি; টীচিং ইনস্টিটিউট| তখন তারাও দোকান দিত বইমেলায়| আরও দিত কিছু এফ এম চ্যানেল, প্রায় সবকটা সংবাদপত্র| ময়দানের ঐ অংশে একটা সরু লম্বাটে ঝিল ছিল| আর ছিল ধুলো ---- ওরে বাবারে সে কি ভয়ানক ধুলো --- মেলার ভেতর, পাশের পার্কিঙ লট তো বটেই ওপাশে লিন্ডসে, এপাশে জীবনদীপ পর্যন্ত বাতাসে ঝুলে থাকত ধুলোর চাদর| প্রেমিক প্রেমিকার জড়ানো আঙুলের ফাঁকে ঢুকে আসে ধুলো, ধুলো সাপটে মাছভাজা খায়, ধুলো জড়ায় সম্বলপুরীর কুচিতে, আঁচলে, জিনস আর কুর্তায় ধুলো হাঁটে টগবগ করে, কবির দাড়ি আর অনাম্নী অঙ্গনার এলোখোঁপায় হিলিবিলি কাটে ধুলো, ধুলো চলে যায় বনগাঁ, বসিরহাট আর বর্ধমানে --- ধুলো চলে যায় মশাগ্রাম, বারুইপুর আর শ্যামনগরে| এমনকি যেবার বইমেলায় আগুন লাগল ---- বইপোড়া ছাইও ধুলোয় সওয়ার হয়ে ছড়িয়ে গেল দিগ্বিদিকে| সেইসময় বইমেলায় ঢুকতে হত প্রবেশমূল্য দিয়ে| টিকিটের লাইন চলে যেত অনেকটা লম্বা-আ-আ-আ| বুদ্ধিমান লোকজন আগে থেকে সীজন টিকিট কেটে রাখত কিছু বছর পর থেকে শুরু হল কিছু কিছু মেট্রো স্টেশানে টিকিট দেওয়া| সেই বইমেলা কেবল বাড়তেই লাগল, বাড়তেই লাগল| তাতে প্রকাশক আর লিটল ম্যাগাজিন ছাড়াও অজস্র বইয়ের দোকান, মানে যারা প্রকাশনার সাথে কোনোভাবেই যুক্ত নন, তেমন সব বইয়ের দোকান এল| মেলার মধ্যে একটা বড় অংশ জুড়ে রকমারি কম্পিউটার শেখানোর সংস্থা দোকান দিল| এরা যে ঠিক কেন বইমেলায় জায়গা পেত, তা শুধুমাত্র গিল্ড ছাড়া কেউ কোনোদিন বোঝেও নি, আর গিল্ড কাউকে বোঝানোর কোনো চেষ্টাও করে নি| আস্তে আস্তে শুরু হয়ে গেল একটা দুটো করে প্রাইভেট টিভি চ্যানেলেরও দোকান দেওয়া, অষ্টপ্রহর গাঁক গাঁক করে মাইক বাজিয়ে এরা কি জানি কিসব অনুষ্ঠান ক্রত আর প্রচুর মানুষ লাইন দিয়ে তাতে অংশগ্রহণও করত| কিন্তু ঐ যে সুখের দিন চিরকাল থাকে না ----- গিল্ডেরও রইল না| ময়দানের পরিবেশ রক্ষার্থে সুভাষ দত্ত নামে এক ভীষণ জেদি ভদ্রলোক ওখান থেকে বইমেলা সরানোর জন্য উঠেপড়ে লাগলেন, কয়েক বছরের চেষ্টায় সরিয়েও ফেললেন| মাঝে যতরকমের কুনাট্য হওয়া সম্ভব, সবই হল| কিন্তু শেষমেষ বইমেলা স্থান পেল বাইপাসের ধারে সথায়ে মেলাপ্রাঙ্গন 'মিলনমেলা'য়|
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারী ভাল| গতবছর ওঁরা লাল গদিওয়ালা সোফা পেতে রেখেছিলেন স্টলের সামনে, এবারে সেগুলো ভেতরে, কিন্তু বাইরে বেশ কিছু সবুজ রঙের ফাইবারের চেয়ার| ক্লান্ত মা একগাদা প্যাকেট নিয়ে বসে আছেন, ছেলে মেয়েরা একেকজন একেক স্টলে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে --- ফোয়ারার পাশে উঁচু ধাপে কয়েক বন্ধু বসে আগে লালমাটি যাওয়া উচিৎ না আগে দে'জ এ ঢোকা উচিৎ তাই নিয়ে প্রবল গজল্লা ---- এক ষাটোর্ধ ভদ্রমহিলা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের স্টলে বই কিনতে কিনতে বাংলাদেশের স্টলটা কোথায় জিজ্ঞাসা করেন --- স্টলের লোক দুজন অসহায়ভাবে জানান এবারে গিল্ড এখনও ম্যাপ দিয়ে যায় নি ---- তাঁকে বাঙলাদেশ প্যাভিলিয়নের সামনে পৌঁছে দেওয়ায় ভারী তৃপ্ত হয়ে বলেন 'আমি দুদিন ধরে খুঁজছি, কেউ বলতে পারে নি| আপনি একজন দারুণ মহিলা, আপনি যেন সমস্ত পছন্দমত বই খুঁজে পান' ---- ক্কি ক্কান্ড! আমার এই রাজ্য, এই শহর কি এতটাই অসভ্য অভদ্র হয়ে গেছে যে স্বাভাবিক সৌজন্যবোধেও লোককে একটু সাহায্য করার চেষ্টা করে না --- নিজের জানা তথ্যটুকু অন্যকে জানায় না---- তাই একটা অতি সাধারণ ভদ্রতা দেখালেও লোকে এতটাই অবাক হয়! উচ্ছসিত হয়ে পড়ে! এত ব্যস্ততা, এত অসহিষ্ণুতা নিয়ে কোথায় যাবে তুমি কলকাতা? পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াই ছোট ছোট গলিগুলোয় --- আকুল হয়ে এক বয়স্ক দোকানী ডাকেন ' খুব ভাল ভাল বই আছে অন্তত একবার দেখে যান দিদি' ----- ফাঁকা স্টাল --- একা দোকানী-- অসহায় আর্তি --- ঢুকেই পড়ি ---- বাচ্চাদের সাধারণ জ্ঞান আর কিছু রান্নার বই ---- কিছু ধর্মীয় অনুষঙ্গের বইপত্তর ---- বেরিয়ে আসতে দেখে মরীয়া হয়ে বলেন 'কয়েকটা নিয়ে গেলে পারতেন, বাচ্চারা খুশী হত' --- মায়া হয় না, মুচকি হেসে বেরিয়ে আসি ---- আস্তে আস্তে সৌরশক্তি চালিত আলোগুলো জ্বলে ওঠে ---- আকাশের আলো তখনও মোছে নি --- লালচে কমলা একটা আভা লেগে আছে ----- এবারে মেলায় নাকি রোজই অনেক মন্ত্রী এসেছেন ---- আমি কাউকেই বিশেষ চিনিটিনি না ----- না লেখক গায়ক, না মন্ত্রী সান্ত্রী ---- ফলে আমার ঘোরায় কোন ব্যঘাত ঘটে না ---- নির্বিগ্নে ঘুরি আর ড্যাবড্যাব করে দেখি---- আমি দেখি সংবাদপত্র বা টিভি'র সাংবাদিকদের দেখে লিটল ম্যাগওয়ালাদের নালেঝোলে হয়ে যাওয়া --- এঁরা না কি আনন্দবাজারের বাজারীপনায় ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে নিজেরা লিটল ম্যাগ খুলে বসেছেন --- কিন্তু আবাপ'য় পত্রিকার নাম উল্লেখ করে একটা লাইন বেরোলে ফেসবুকে, অর্কুটে, এস এম এস পাঠিয়ে, মেল করে এঁরা যে উচ্ছাস প্রকাশ করেন, তাতে একটাই কথা মনে হয়; আবাপ খেলতে নেয় নি বলেই এনারা আলাদা দল বানিয়ে খেলার চেষ্টা করছেন --- লিটল ম্যাগ আন্দোলন ইত্যাদি 'সব ঝুট হ্যায়'| এরকম অন্তত চারটে ছোট পত্রিকার সম্পাদককে এই বিষয়ে জিগ্যেস করে কোনও সন্তোষজনক উত্তর পাই নি| আমি দেখি 'লেখক' তকমাপ্রত্যাশী কিছু লোক কিছু অক্ষর সাজিয়ে একটা দুটো বই ছাপিয়ে যা খুশী মিথ্যে কথা বলে, টুপিটাপা দিয়ে লোককে বইগুলো গছাবার মরীয়া চেষ্টা করে যাচ্ছে| এদের হ্যাংলামি দেখে করুণা আর ঘেন্না মেশানো একটা অনুভুতি হয়| আমি দেখি মেলায় ক্রমশ বেড়ে ওঠে ভীড় ----- আমি দেখি সহৃদয় পুলিশকর্মী এক বৃদ্ধাকে ধরে ধরে গাড়ীতে তুলে দেয় -- তাঁর স্বামী কিছু বলেন কর্মীটিকে --- তারপর চলে যান হুউশ করে --- আমিও আস্তে আস্তে বাইরের দিকে হাঁটা দিই ---- সঙ্গের বইগুলো তাড়া দিয়ে বলে চলো চলো শীগগির বাড়ি চলো ----- আমার দেখা হয় না ইন্দোদাদার বইয়ের উদ্বোধন -- আজও এই এত বছর পড়েও দেখা হয় না বইমেলা কেমন করে শেষ হয় --- শোনা হয় না শেষের দিনের সেই ঘন্টাধ্বনি ---- থাক কিছু জিনিষ নাহয় গল্পকথা হয়েই রইল|
আগামী বছর বাঙ্লাদেশ হবে থিম কান্ট্রি| আসবেন নাকি সচল বন্ধুরা কেউ? একসাথে ঝালমুড়ি খেতে খেতে ঘোরার জন্য?
মন্তব্য
মেলার এমন বর্ণনাই দিলেন যে শেষমেষ মেলায় যাওয়ার সাধটাই উবে যায় ! হা হা হা !!
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
কেন? উবে গেল কেন? এইটা তো আমার দেখা মেলা, আপনারটা একদম অন্যরকম বা কিছুটা অন্যরকম হতেই পারে, তাই না?
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
দারুণ বর্ণনা! অনেক কিছু মিলে গেলো। আমাদের মেলাগুলো এমনই, এমন না হলেই বরং অচেনা মনে হতো।
ঠিক আমাদের মেলাগুলো এমন না হলেই অচেনা লাগত হয়ত| বইমেলা ছাড়া চর্মশিল্পমেলা, হস্তশিল্পমেলা ইত্যাদিও সামান্য একটু আধটু এদিক ওদিক
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
১
কেন?
২
ছোটকাগুজেদের বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষনের সাথে একমত।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
আনন্দ আজকাল অনেক ছোট ছোট শহরে নিএজেদের দোকান করেছে, তাই ওদের বই সহজলভ্য| দে'জ এর বইও এমনিতেই প্রচুর এদিক ওদিক পাওয়া যায়| এছাড়া দে'জ এ ফোন করে অর্ডার দিলে নিজেদের ছাড়াও অন্যান্য পাবলিশারদের বই ও বাড়িতে দিয়ে পয়সাকড়ি গুণে নিয়ে চলে যায়| ভাল ছাড়ও দেয়| এদের বইয়ের তালিকা সহজলভ্য, তাই পছন্দ করে আনিয়ে নিলেই হল|
কিন্তু 'অবভাস', 'থীমা', 'লালমাটি', 'তালপাতা' ইত্যাদির বই বইমেলায় না দেখে রাখলে অন্যসময় কেনাটা , বা কিনব কিনা সিদ্ধান্ত নেওয়াও অনেকসময় মুশকিল হয়ে পড়ে|
তাইজন্য আর ঐসব দোকানে ঢুকতে ইচ্ছে হয় না|
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
(গুড়)
facebook
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
বই মেলার বর্ণনা পড়ে রণদীপমদার মত করে বলতে হচ্ছে, বইমেলায় ঘুরার আগ্রহ হাওয়া হয়ে গেল
কিন্তু কেন বলুন তো? ভীড় তো সর্বত্রই থাকে|
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
১। নিজের মতো করে বইমেলায় পৌঁছানোর গল্পটাই একটা আস্ত গল্প। ওটাকে আরেকটু বিস্তারিত করে লেখাটা বাড়াতে পারতেন।
২। সরকারী বইমেলার উৎপাতটা বাংলাদেশে এখনো আছে। আপনার এর হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন জেনে ভালো লাগলো।
৩। বইমেলাতে বইবহির্ভূত অন্যদের উৎপাত ঢাকাতেও আছে, তবে আগের তুলনায় কম। এগুলোকে সব বইমেলা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা দরকার।
৪।
- চমৎকার কাব্য।
৫। "ভালো বই আছে" বলে ডাকাডাকি করা ফেরিওয়ালা, লিটল ম্যাগ আন্দোলন আর "লেখক" তকমা প্রত্যাশীদের নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণের সাথে চরমভাবে সহমত।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
১) নাহ্ আর বেশী বাড়ালে ছিঁড়ে যাবে|
২) মুক্তি ঠিক পাই নি, এখন সরকার গিল্ডের মেলাটায় যতটা পারে দখল নে| যেমন 'জাগো বাংলা' সবচেয়ে ভাল জায়গায় স্টল পায় ইত্যাদি
৩) ধন্যবাদ
৪) হুমমম
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
নতুন মন্তব্য করুন