একটা গোটা বছর চলে গেল, সচলে কিচ্ছুটি লিখিনি| আগে তাও মাসে একটা করে লিখতাম, সেটা কমে এলো বছরে একটা, তাও হয় না| এখানে একটা বিরস মুখের ইমোজি দেওয়াই যেত, কিন্তু থাক --- কী হবে! যা হয় নি, হয় নি| ২০১৫য পড়া বই নিয়ে, লেখককে নিয়ে লেখার আহ্বানটা দেখে অবশেষে লিখেই ফেললাম| আগের কয়েকটা বছরের তুলনায় ২০১৫ তে পড়া হয়েছে প্রচুর| কাজেই লিখতে গেলে তিন চারখানা ব্লগ লিখে ফেলাই যায়| আপাতত বেশী ভ্যানতাড়া না করে একটা অন্তত লিখেই ফেলি|
"ড্যাঞ্চীনামা' দিয়ে পরিমল ভট্টাচার্য্য পড়া শুরু করেছি ২০১২তে, কিন্তু এই লেখককে নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম ২০১৫তেই| যে দুটো বই চেটেপুটে পড়েছি --
১) "শাংগ্রিলার খোঁজেঃ- হিমালয়ে গুপ্তচারণার তিন শতক"
২) "দার্জিলিং ঃ- স্মৃতি সমাজ ইতিহাস"
প্রথমে 'শাংগ্রিলার খোঁজে' থেকে একটা ছোট্ট গল্প বলি কেমন?
সেটা ১৮৭৯ সাল, উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ততদিনে ব্রিটিশ মানচিত্রে উঠে এসেছে, অগম্য, অনাবিষ্কৃত বলতে প্রায় আর কিছুই নেই৷ তিব্বত তখনও বিদেশীদের জন্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, হিমালয়ের আড়ালে রহস্যের দেশ৷ সে রহস্য যেমন তার অধিবাসীদের আচার ব্যবহার, পোশাক ইত্যাদি নিয়ে, তেমনি তার বিচিত্র দুর্গম ভূপ্রকৃতি নিয়েও বটে৷ বিদেশী নিষিদ্ধ হলেও বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও ভিক্ষুকদের জন্য গিরিপথের প্রহরা ছিল শিথিল, পাহাড়ী জনজাতি অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে রাতে আশ্রয়লাভ ছিল সহজ৷ উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে ব্রিটিশ সরকার এই তথ্যটি ব্যবহার করে লামার ছ্দ্মবেশে গুপ্তচর পাঠাতে শুরু করে তিব্বতে৷ তাদের নাম দেওয়া হয় 'পন্ডিত'৷ পাহাড়ী মানুষদের মধ্য থেকেই বেছে নেওয়া হত পন্ডিতদের৷ এদের কাজ ছিল তিব্বতের ভূপ্রকৃতির পুঙ্খানুপুঙ্খ জরিপ ও জনজীবন সম্পর্কে তথ্যসংগ্রহ৷ এজন্য সার্ভে বিভাগ থেকে তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হত৷ সন্ন্যাসীর ভেকের মধ্যে লুকানো থাকত জরিপের সরঞ্জাম, লাঠির আগায় কম্পাস, প্রার্থনাদন্ডের ভেতরে কাগজ পেনসিল, জপমালায় ১০৮টির বদলে ১০০টি পুঁতি৷ চলার পথে পদক্ষেপ গুণে জপমালায় হিসেব রাখত তারা৷ অনেকসময় ধরা পড়ার ভয়ে কাগজ পেনসিলও দেওয়া হত না, জরিপের খুঁটিনাটি তথ্য ছন্দে গেঁথে বৌদ্ধ মন্ত্রের মত করে আউড়ে চলত এই পন্ডিতরা৷ এইভাবে গুপ্তচরদের নোট আর জবানবন্দী থেকে একটু একটু করে ভরে উঠছিল মানচিত্রের সেই অজানা সাদা অঞ্চলটি৷ ধন্দ ছিল কেবল একটি নদী নিয়ে৷ পশ্চিম তিব্বতের সাং প্রদেশে ২৪০০০ ফুট উঁচুতে উত্সারিত হয়েছে সাংপো নদ, এরপর পূর্ববাহিনী হয়ে চলেছে হিমালয়ের একটি ভাঁজ বরাবর৷ মানচিত্রে হিমালয়ের যে ভাঁজগুলোকে দেখে মনে হয় যেন গিলে করা কাপড়ের মত, আসলে সেগুলো পনেরো বিশ হাজার ফুট গভীরতার এক একটি উপত্যকা৷ তারই ভেতর দিয়ে প্রায় একহাজার মাইল প্রবাহিত হওয়ার পর সাংপো ঢুকে পড়েছে এক অগম্য উপত্যকায়, হারিয়ে যাচ্ছে দুর্গম গিরিশিরার জটে, দুশো মাইলেরও কম দূরত্বে নেমে আসছে ন'হাজার ফুট৷ আচমকা দক্ষিণে বাঁক নিয়ে প্রবেশ করছে ভারতের সমতলে৷ তখন তার নাম ব্রহ্মপুত্র৷ গোটা হিমালয়ে তো বটেই, সারা বিশ্বেই এমন আর একটিও নদী নেই যেটি এইরকম খাড়া ঢাল বেয়ে এই পরিমাণ জলরাশি নিয়ে আছড়ে নেমেছে সমতলে৷
ন'হাজার ফুট উঁচু তিব্বতের উপত্যকা থেকে মাত্র দুশো মাইলের মধ্যে আসামের সমতলে নেমে আসছে এই নদী, ব্রহ্মপুত্র নাকি সাংপো, কী করে সম্ভব এটা? তবে কি মাঝখানে একটি জলপ্রপাত আছে, যা নায়াগ্রা বা ভিক্টোরিয়া ফলসের থেকেও প্রকান্ড ও বিপুল? নাকি একের পর এক ঝর্ণা, যা নামিয়ে এনেছে নদীকে সমতলে? সাংপোই ব্রহ্মপুত্র কিনা সেই নিয়ে ধন্দ বহুকালের৷ কোনো ভুগোলবিদ মনে করতেন পূর্ববাহিনী সাংপো বর্মায় প্রবেশ করে ইয়ারডি হয়েছে, কেউ কেউ আবার মনে করতেন ব্রহ্মপুত্র আর ইয়ারডিকে যুক্ত করেছে সুবনসিঁড়ি৷ এই অঞ্চলের আরও দুটি প্রধান নদী দিবাং আর লোহিত বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে৷ ১৭৬৫ সালে ভারতের প্রথম সার্ভেয়ার জেনারেল জেমস রেনেল ব্রহ্মপুত্রের খাত বরাবর জরিপ করার পর লিখেছিলেন ব্রহ্মপুত্রই যে সাংপো সেটি অনুমান করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে৷ কিন্তু রেনেলের অনুমানের পর একশো বছরেরও বেশী পার হয়ে গেলেও সেটিকে প্রমাণ করা সম্ভব হয় নি৷ উজানপথে ব্রহ্মপুত্রের উৎস খোঁজার চেষ্টা হয় বেশ কয়েকবারই, কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়৷ এতে দুটি জিনিষ প্রমাণ হয়৷
১) ওপথে প্রমাণ করা সম্ভব নয়৷ আর
২) এটি কোনও শ্বেতাঙ্গর পক্ষে সম্ভব নয়৷
রেনেলের অনুমানকে প্রথম প্রামান্য করে তোলেন যে লোকটি, বুড়ো ইতিহাস তার নামটা ভুলেছে এক্কেবারে৷ দার্জিলিঙের দর্জি সেই কিন্টুপ-এর গল্পই শোনাবো এবারে৷
কিন্টুপ, বছর তিরিশ বয়সের, ছোটখাট খুব সাদামাটা চেহারার এক স্থানীয় মানুষ, সদ্য নগরপত্তনের খবর পেয়ে নেপাল সিকিম থেকে ভাগ্যের চাকা ফেরানোর খোঁজে দার্জিলিঙে আসা অনেকের মধ্যে একজন৷ গুন্ডরি বাজারে (পরে যা চকবাজার নামে বিখ্যাত হয়) এক দর্জির দোকানে সেলাইয়ের কাজ করত কিন্টুপ৷ নিমা শেরিং ওরফে নেম পন্ডিত্ নামে এক গুপ্তচরের সহকারী হয়ে গোপনে একবার তিব্বত ঘুরে এসেছে সে, ফলে এই ধরণের অভিযানের আবশ্যিক যোগ্যতা অর্থাত্ বুদ্ধি, কষ্টসহিষ্ণুতা আর বিশ্বস্ততার প্রমাণও দিয়েছে৷ সাংপো-ব্রহ্মপুত্র রহস্য অনুসন্ধানে সার্ভে অব ইন্ডিয়ার দার্জিলিং শাখার প্রধান লেফটেন্যান্ট হেনরি হার্মান বেছে নিলেন কিন্টুপকেই৷ জরিপের যন্ত্রপাতির ব্যবহার শিখেছে সে নেম সিং এর সহকারী হয়েই, আর আছে তার এক আশ্চর্য্য স্মৃতিশক্তি৷ দুর্গম পাহাড়, অরণ্যের ভেতর গিয়ে সেখানকার টোপোগ্রাফী রিলিফ ম্যাপের মত মাথার ভেতর খোদাই করে নিতে পারত সে, মূলত: তার এই গুণটির জন্যই হার্মান সাহেব কিন্টুপকে বেছে নিয়েছিলেন৷ অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় তালিম চলার সময় দার্জিলিং আসে এক চীনা লামা৷ তিব্বত যাওয়ার ছাড়পত্র ছিল তার কাছে, লেখাপড়াও কিছু জানত এই লামা৷ ফলে ঠিক হয় কিন্টুপ যাবে এই লামার ভৃত্য হিসেবে, ছাড়পত্রের বলে তিব্বতের যে কোনও অংশে গিয়ে জরিপ চালাতে পারবে কিন্টুপ আর নিরক্ষর কিন্টুপকে জরিপের তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করতে সাহায্য করবে লামা৷ সেপ্টেম্বরের এক কুয়াশাঢাকা দিনে দার্জিলিং থেকে তিব্বতের পথে যাত্রা শুরু হল পন্ডিত কিন্টুপের৷ কার্ট রোডের নীচে বুচারবস্তিতে তার ছোট্ট কাঠের বাসায় অনির্দিষ্টকালের জন্য অপেক্ষায় রইল তার স্ত্রী, দুই পুত্র ও সদ্যোজাত কন্যা, গুপ্তচরবিধির নিয়ম মেনে তারা কেউ জানল না কোথায় যাচ্ছে কিন্টুপ, কবেই বা ফিরবে৷ জানল না জীবদ্দশায় তার স্ত্রীর সাথে কিন্টুপের আর দেখা হবে না কোনওদিনই৷
কিন্টুপের অভিযানের জন্য সময় ধরা হয়েছিল আনুমানিক চার মাস। সেইমত ব্রিটিশ সরকার তার পরিবারের জন্য এককালীন কিছু অর্থ বরাদ্দ করে। ওদের রাহাখরচ হিসেবে সঙ্গে দেওয়া হয় একশ টাকা, কিছু বিনিময়যোগ্য রূপার মুদ্রা আর সার্ভের সরঞ্জাম। রুট ঠিক হয় তিব্বতে প্রবেশ করে চেতাং থেকে দুর্গম গিরিখাত ধরে সাংপোর গতিপথ অনুসরণ করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার দিকে যতদূর সম্ভব যাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু মুশকিল হল চীনা লামাকে নিয়ে। এর না ছিল এই দুর্গম পথে যাবার মত শারিরীক সামর্থ্য, না ইচ্ছে বা বিশ্বস্ততা। লামা এই সফরকে নেহাৎই ইংরেজ সরকারের বদান্যতায় পাওয়া খেয়াল খুশীতে প্রমোদসফর বলে মনে করেছিল। ফলে ইংরেজ শাসনের সীমানা পেরিয়ে তিব্বতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে লামার আসল রূপ বেরিয়ে পড়ে। কিন্টুপের সাথে সে প্রকৃতই ভৃত্যের মত ব্যবহার শুরু করে, টাকা ওড়াতে শুরু করে নেশা ও বিলাসব্যসনে। চেতাং উপত্যকা পেরিয়ে লোপা উপজাতি অধ্যুষিত এক গ্রামের মোড়লপত্নীর সাথে প্রণয়ে জড়িয়ে পড়ে কাটিয়ে দিল বেশ কয়েক মাস। সেই গিরিখাত তখনও অনেক দূরে।
যদিবা রওনা হল তারা, সাংপোর পাড় ধরে এগিয়ে যেতে যেতে পথ ক্রমশঃ দুর্গম হয়ে উঠতে লাগল, দুধারের খাড়া পাহাড় ক্রমশ খাদের দুইদিক দিয়ে ঠেসে ঘেঁষে আসতে লাগল আর ঘন দূর্ভেদ্য হয়ে উঠতে লাগল জঙ্গল। এদিকে পাথেয়ও ততদিনে প্রায় শেষ। সাংপোর খাড়া পাড়ে থঙ্কিয়ুক নামে এক বসতিতে গাঁওবুড়োর বাড়ীতে কিন্টুপকে বলে লামা, লোপা গ্রামের মোড়লপত্নীর জন্য বড়ই ব্যকুল হয়ে পড়েছে সে, দুটি রাত সেখানে কাটিয়েই আবার ফিরে অভিযানে যোগ দেবে সে। চলে যায় লামা, সঙ্গে টাকাকড়ি না থাকায় কিন্টুপের স্থান হয় যবক্ষেতের ধারে ঘাসপাতায় ভেড়ার খোঁয়াড়ে, দুবেলা দুমুঠো আহারের বদলে নদী থেকে জল টেনে আনতে হয়, জঙ্গল থেকে কেটে আনতে হয় বোঝা বোঝা কাঠ। পাহাড়ের ঢালে থাকে থাকে বসতি, তার ওপরে ঘন ফার ও রডোডেনড্রনের বন, তার ওপর থেকে উঁকি দেয় ধবধবে সাদা বরফের চুড়া। অনেক নীচে দিয়ে ইয়ারলুং সাংপো নুড়ি পাথরে ধাক্কা খেয়ে কলস্বরে বয়ে চলার সময় যেন অবিরাম ডেকে যায় কিন্টুপকে। অস্থির হয়ে ওঠে কিন্টুপ। গাঁওবুড়োর কাছে গিয়ে বলে আমার প্রভু কবে ফিরবেন তা তো জানি না, তবে আমাকে এবার সামনে এগিয়ে যেতেই হবে। সেকথা শুনে উচ্চৈঃস্বরে হেসে ওঠে গাঁওবুড়ো, হাসতে হাসতেই জানায় কিন্টুপ কোথাও যেতে পারবে না, গাঁওবুড়োর কাছে কিন্টুপকে পঞ্চাশ টাকায় বিক্রী করে লামা ফিরে গেছে তার আপন দেশে। কিন্টুপ এখন এই গাঁওবুড়োর ক্রীতদাস। বুড়ো ইতিহাস আপনমনে পাতা উল্টায় দিনরাতের, কেটে যায় এক .. দুই ... তিন ... চার ... পাঁচ মাস।
পাঁচমাস পরে একদিন দূরের জঙ্গলে কাঠ কাটতে যাবার অছিলায় পালায় কিন্টুপ৷ গভীর জ্ঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ের গা আঁকড়ে সাংপোর খাত বরাবর পথ কেটে কেটে চলে কিন্টুপ, জপমালায় পদক্ষেপ গুনে, কম্পাসে দিকনির্ণয় করে, মাথার ভেতরে প্রতিটা বাঁক, ঝর্ণা, খাদ, পাথর, বালুতট, ভূপ্রকৃতির মানচিত্র ছবির মত এঁকে নিতে নিতে এগিয়ে চলে দিনের পর দিন৷ কখনো কোনও পশুপালকদের অস্থায়ী আস্তানায় রাত্রি কাটায় কখনও বা কোনও উঁচু গাছের ডালে৷ পশুপালকদের আস্তানায় তবু পেটে দেবার মত কিছু জোটে, কিন্তু যেসব দিন গাছের ডালে রাত কাটাতে হয় সেসব দিনে খাদ্য বলতেও ঐ গাছের পাতা বা কন্দ বা ফল জুটলে তো খুবই ভাল, আর পানীয় ঐ নদীর কনকনে জল৷ এমনিভাবে চলতে চলতে এক জায়গায় এসে সে আবিষ্কার করে একটি ঝর্ণা, যার গায়ে অজস্র জলকণায় তৈরী মেঘের ওড়নায় ফুটে আছে একটি মস্ত রামধনু৷ আর একটু এগিয়ে নদীপাড়ে ভিজে বালির ওপরে মানুষের পায়ের ছাপ দেখে, না থেমে এগিয়ে যেতে যেতে একদিন সে গিয়ে পৌঁছায় উঁচু পাহাড়ে ঘেরা এক সবুজ উপত্যকায, নীচে বয়ে চলেছে সাংপো আর খাড়া পাহাড়ের গায়ে ঠিক যেন পদ্মফুলের পাপড়ির আকৃতি নিয়ে ফুটে আছে একটি মঠ৷ প্রাণপণে পাহাড় বেয়ে হাঁচোড়্পাঁচোড় করে উঠে মঠের প্রাঙ্গণে অসীম ক্লান্তিতে লুটিয়ে পড়ে কিন্টুপ৷ আর তক্ষুণি তাকে ধরে এসে থঙ্কিয়ুক গ্রামের মোড়লের প্রতিনিধিরা, পলাতক ক্রীতদাস কিন্টুপকে ধরার জন্য তারা আগে থেকেই এসে অপেক্ষা করছিল৷ শ্রান্ত ক্লান্ত কিন্টুপের হতাশ মুখ দেখে মঠের প্রধান লামার দয়া হয়, পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে কিন্টুপকে ছাড়িয়ে নেন প্রধান লামা, তবে একট শর্তে; পঞ্চাশ টাকা উসুল না হওয়া পর্যন্ত তাকে শ্রমদান করতে হবে ঐ মঠে।
শুরু হয় কিন্টুপের নতুন দাসত্ব জীবন, তবে থঙ্কিয়ুকের মত হাড়ভাঙা পরিশ্রম নয়; লামাদের ফাইফরমাস খাটা, উপাসনাঘরের মেঝে পরিস্কার করা আর সপ্তাহে একদিন নীচের বসতি থেকে প্রয়োজনীয় আনাজপাতি, মশলা ইত্যাদি বয়ে আনতে হয়। কিন্টুপ জানতে পারে খাড়া পাহাড়ের গায়ে প্রায় ঝুলে থাকা এই মঠের নাম 'পেমাকোচুং মঠ' , কয়েক হাজার ফুট নীচে হিমবাহে পুষ্ট অসংখ্য জলধারায় ধৌত চিরসবুজ পবিত্র বৌদ্ধভুমি 'পেমাকো উপত্যকা' , খরস্রোতা সাংপো এখানে এসে অনেক ধীরগতিতে বইছে, নদীপাড়ে শান্ত ছোট্ট জনবসতি। পেমাকো থেকে ধাপে ধাপে ভেঙে চুরচুর হয়ে সাংপো ঢুকে পড়েছে গভীর অরণ্যে ঢাকা খাতের ভেতরে। কুয়াশাবিহীন দিনে মঠের অলিন্দ থেকে রূপোর পাতের মত চিকচিকে সাংপোর দেখা মেলে, বাতাসে ভেসে আসে ঈগলের ডাক। উপাসনা মন্দিরে অতিকায় বুদ্ধমুর্তির নিমীলিত চোখের দিকে তাকিয়ে হাতের জপমালা ঘুরিয়ে একমনে প্রার্থনা করে চলে কিন্টুপ, অনেক অনেক নীচ থেকে ভেসে আসে জলের কলধ্বনি। বুড়ো ইতিহাস আপমনে উল্টে গিয়েছে আরো কত মাসের পাতা, বর্ষা চলে গিয়ে এসে গেছে শীত।
.... বুড়ো ইতিহাস আপমনে উল্টে যায় আরো কত মাসের পাতা, বর্ষা চলে গিয়ে আসে শীত; প্রধান লামার কাছে গিয়ে তীর্থযাত্রার জন্য কিছুদিনের ছুটি চায় কিন্টুপ, মঞ্জুরও হয় তার প্রার্থনা। সাংপোর খাত ধরে আবার এগিয়ে চলে কিন্টুপ, কখনও বোল্ডার থেকে বোল্ডারে লাফিয়ে, কখনও বা খাড়া পাথরের ওপর দিয়ে বুনো হরিণের চলার চিহ্ন দেখে দেখে। আবারও ক্রমশঃ দুর্গম হয়ে উঠতে থাকে পথ, আকাশে উঠে যাওয়া গিরিখাতের গায়ে জমাট রডোডেনড্রনের দুষ্প্রবেশ্য ঝোপ, উপরদিকে বার্চের ডাল থেকে অজস্র লতা নেমে জড়িয়ে মড়িয়ে দিনেরবেলায়ও রাতের মতই আঁধার করে রেখেছে। বন্যপ্রাণীর ডাক নেই, স্নো-ফেজেন্টের কাকলী নেই, কেবল একের পর এক র্যা পিড ভেঙে বয়ে চলা সাংপোর একটানা কানফাটানো গর্জন। টানা এগারোদিন চলার পর খাতের একটি বাঁকে এসে কিন্টুপ দেখে নদীর পাড় ঘেঁষে একটুকরো ঘাসজমি, তার ওপরে শ'দুয়েক ফুট উঁচুতে পাথরের খাঁজে গুহার মত একটি ফাটল। ওখানেই থামে কিন্টুপ। তিনদিন উদয়াস্ত খেটে রডোডেনড্রনের ডাল কেটে কেটে পাঁচশোটি এক ফুট লম্বা কাঠের দন্ড তৈরী করে সে। তারপর সেগুলি টেনে তুলে ঐ গুহার মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে মঠে ফিরে আসে।
কিছুদিন পরে বুদ্ধের জন্মতিথিতে লাসায় তীর্থদর্শনের উদ্দেশ্যে যাবার জন্য ফের ছুটির আবেদন জানায় কিন্টুপ। এবারও আবেদন মঞ্জুর হয়। লাসায় গিয়ে দার্জিলিঙের এক কম্বলের ব্যপারীকে খুঁজে বের করে তার মারফত দার্জিলিঙের নেম সিং'কে একটি বার্তা পাঠায় সে। বুদ্ধপূর্নিমার পর ন'টি চাঁদের মাস পার হলে অমাবস্যা থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিদিন পঞ্চাশটি করে বিশেষ চিহ্নিত কাঠের টুকরো সাংপোর স্রোতে ভাসানো হবে, নেম সিং যেন পত্রপাঠ এই বার্তা হার্মান সাহেবের কাছে পৌঁছে দেয়। এরপরে সে আবার মঠে ফিরে আসে।
আবার সেই শ্রমদান, সেই মাখনের প্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত বুদ্ধের চোখ, দূরাগত ঈগলের ডাক, অনেক নীচ থেকে ভেসে আসা সাংপোর ধ্বনি --- ইতিহাস আনমনে পাতা ওল্টায় দিনের, মাসের-- বর্ষা আসে পেমাকো উপত্যকায়। প্রধান লামার কাছে আবার তীর্থপরিক্রমার জন্য ছুটির আর্জি জানায় কিন্টুপ।
কিন্টুপের একনিষ্ঠ শ্রম আর ভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে প্রধান লামা তাকে এবার মুক্তি দেন, সাথে পাথেয় হিসেবে দেন শুকনো ভেড়ার মাংস, চীজ আর কয়েকটি তিব্বতী মুদ্রা| মঠের সকলের কাছে বিদায় নিয়ে কিন্টুপ ফিরে যায় সেই খাতের বাঁকের যে গুহায় ঐ কাঠের টুকরোগুলো রেখেছিল| ইতিমধ্যে বর্ষায় প্রকৃতি হয়ে উঠেছে আরও দুর্গম, ঘাসজমিটি ডুবে গিয়ে জল উঠে এসেছে প্রায় গুহার মুখে| প্রতিটি কাঠের দন্ডে ব্রিটিশ সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সীল মেরে মেরে নির্দিষ্ট দিন থেকে দশদিন ধরে প্রতিদিন পঞ্চাশটি করে কাঠের দন্ড ভাসিয়ে দেয় সে সাংপোর জলে| কিন্টুপ যেখান থেকে কাঠগুলো ভাসিয়েছিল তারপরেই তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে সাংপো ঢুকে পড়েছে পঁচিশ হাজার ফুটেরও বেশী উঁচু নামচে বারোয়া আর গ্যালা পেরি শৃঙ্গের মাঝে গভীর খাতের ভেতরে প্রায় পঞ্চাশ মাইল| ঐ পঞ্চাশ মাইল গিরিখাতে প্রথম মানুষের পায়ের চিহ্ণ পড়তে আরো একশো বছরেরও বেশী সময় লাগবে| ২০০২ সালে একদল ইউরোপীয় অভিযাত্রী কায়াক বেয়ে প্রথম পার হবে সেই গিরিখাত| ততদিনে অবশ্য প্রযুক্তির সাহায্যে নিখুঁতভাবে আঁকা হয়ে গেছে ইয়ারলুং সাংপোর পথ, সাংপোই যে ভারতের সমভূমিতে ঢুকে ব্রহ্মপুত্র নাম নিয়েছে সে নিয়ে সন্দেহের আর কোনোই অবকাশ নেই| কিন্তু তার আগে কিন্টুপ বর্ণিত রামধনু গায়ে জড়ানো এক আশ্চর্য্য ঝর্ণার খোঁজে ঘুরেছে অনেক অভিযাত্রী|
পূর্ব্বঘোষণামতই ঐ কঠিন দুর্গম গিরিখাত ধরে এগিয়েছিল কিন্টুপ, কখনও কোনও আদিম জনজাতির গ্রামে আশ্রয় নিয়ে, কখনও বা গাছের ডালে রাত কাটিয়ে এগিয়ে এসেছিল ঐ গিরিখাতের শেষ অবধি, কিন্তু শেষ অংশটুকু আর আসতে পারে নি অবোর জনজাতির জঙ্গী পাহারা এড়িয়ে| ফলে অনেক ঘুরে ভুটান হয়ে দার্জিলিং ফেরত আসে সে| ইতিমধ্যে কেটে গিয়েছে চার চারটে বছর, দার্জিলিং হয়ে উঠেছে এক জমজমাট শহর, চালু হয়েছে টয়ট্রেন| সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া অচেনা শহরে ফেরত এসে কিন্টুপ জানতে পারে তার স্ত্রী ও শিশুকন্যাটি মারা গিয়েছে কবেই, ছেলেদের সিকিমে নিয়ে গেছে এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়, মারা গিয়েছে নেম সিং, হার্মান সায়েব দেশে ফিরে গিয়েছে কবেই| কম্বল ব্যবসায়ীর হাতে পাঠানো কিন্টুপের চিঠিটা খুলে পড়াই হয় নি, সাংপোয় ভাসিয়ে দেওয়া কাঠের দন্ডগুলো, যা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করতে পারত সাংপোই ব্রহ্মপুত্র, তা উদ্ধার করার কোনও উপায়ই নেই আর| নদীর স্রোতে ভেসে সেগুলো কোথায় কোন দেশে চলে গেছে কে-ই বা খবর রাখে তার| এমনকি গোটা অভিযানের গল্প শোনার, শুনে বিশ্বাস করার মত একজন লোকও নেই আর দার্জিলিঙে| বহু বছর বাদে আবার খোঁজ পড়ে কিন্টুপের, মর্যাদা পায় তার অভিযান| কিন্তু সে অন্য গল্প| এখানে উহ্য থাক সে গল্প, শুধু এইটুকু বলি বৃদ্ধবয়সেও কিন্টুপ নিখুঁত বর্ননা দেয় তার যাত্রাপথের, পথের প্রতিটি চড়াই, উৎরাই, বাঁক, গিরিখাত, যা চমকে দিয়েছিল ক্যাপ্টেন এরিক বেইলিকে| বেইলি ঐ গিরিখাতের শেষ পর্যন্ত যেতে পারে নি, কিন্তু বাকী আংশটুকুর বর্ননা তার দেখা যাত্রাপথের সাথে প্রায় হুবহু মিলে যায়|
কিন্টুপের গল্পের ফাঁকে ফাঁকে লেখক বুনে গেছেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত চীন ও তিব্বতের টানাপোড়েনের ইতিহাস| নেড়েচেড়ে দেখেছেন'শাংগ্রিলা' নামক মিথটিকে, বলেছেন শরৎচন্দ্র দাসের কথা| তিব্বতী ভাষায় সুপন্ডিত শরতচন্দ্র দাসও তিব্বতে গেছিলেন 'পন্ডিত'এর বেশেই| তিনি সেখানে দীর্ঘকাল কটিয়ে দেশে ফিরে রচনা করেছেন বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ| শরতচন্দ্র দাসের জীবনীও কম কৌতুহলোদ্দেপক নয়| পরিমলের লেখা থেকেই প্রথম জানতে পারি রিঞ্চেন তেনোয়ার কথা, তাশিলুঙ্ফোর কথা| এই বইয়ের সাথে মিলেমিশে গেছে 'দার্জিলিং' বইটি অনেক জায়গাতেই|
"দার্জিলিং' বইটির প্রকাশ 'শাংগ্রিলা---'র আগে| লেখক দার্জিলিঙ কলেজে শিক্ষকতার জন্য নয়ের দশকের গোড়ায় সেখানে গিয়ে লেখক অনুভব করেন সায়েবদের নষ্টালজিয়া আর বাঙালির রোমান্সের আড়ালে চাপা পড়ে আছে বিভিন্ন জনজাতির মানুষের সুখ দুখ বেদনায় জীবনযাপনের এক আশ্চর্য্য নকশীকাঁথা| সেখানে তখন গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের আগুন সবে নিভেছে| দুই দশক বাদে ফের উত্তপ্ত পাহাড় মুখোমুখী হয়েছে সেই অমোঘ প্রশ্নের -- শৈলরানী তুমি কার? উত্তরের খোঁজে লেখক ঘুরে বেরিয়েছেন স্মৃতিকথা আর ইতিহাসের পাতলিগলিতে| নিঃসঙ্গ প্ল্যান্টারের ডায়রী থেকে পাইসহোটেলের মেনুবোর্ড, রাগী গ্তরুণের ব্লগ থেকে প্রাচীন কবরের এপিটাফ --- তিলতিল করে তুলে এনেছেন দার্জিলিঙের পথেঘাটে ছড়ানো সময়ের চিহ্ন, জীবনের জলছবি| কাতার দিয়ে এসেছে বিচিত্র মানুষেরা, হারানো উপজাতির সন্ধানে আসা ব্রিতিশ তরুণী, এক লিম্বু বৃদ্ধা ও তাঁর রক গায়ক প্রপৌত্র, রকবাজারের পোর্টার, চা বাগানের কামিন, কঞ্চনজঙ্ঘা ছবির ভিখারী বালকের ডপলগ্যাঙ্গার --- আর এসেছে প্রকৃতি, দার্জিলিঙের কুখ্যাত কুয়াশা, ডাইনোসর যুগের সালামান্ডারের জীবনচক্র, দুষ্প্রাপ্য পাখীর ডানার রং, ঝোরার শব্দ, বর্ষাশেষের প্রথম মেঘভাঙা আলো ------ এক অদ্ভুত নতুন লিখনরীতি, যেন কেউ আপনমনে কাহিনী বলে যাচ্ছেন, গলার স্বর ছুঁয়ে যাচ্ছে আনন্দ, বিষাদ, রোমাঞ্চের তানগুলি --- কোনও তাড়া নেই, কোনও আলগা চাকচিক্যও নেই -- শুনলে শোনো না শুনলে না-ই| পরিমল ভট্টাচার্য্যের লেখা ঝিমধরা নেশার মত|
(কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ- লেখক পরিমল ভট্টাচার্য্য -- গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো স্টাইলে লেখায় সরাসরি বই থেকে বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করেছি|)|
মন্তব্য
বই থেকে তুলে আনা অংশগুলো কোটমার্কের ভেতরে দিয়ে দিতে পারেন কিন্তু।
খুবই ইন্টারেস্টিং বই বলে মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ দুটো বইই বেশ ইন্টারেস্টিং।
কোটেশান মার্ক দেওয়া --- এহে ঐখানেই কবি কেঁদেছেন ভেউ ভেউ করে। কেস হল পড়ার সময় টুকটাক নোট রেখেছিলাম, সবটাই যে হুবহু কপি তা নয়, তবে অজ্ঞাতেই ওঁর ভাষা সম্ভবতঃ অনেকটাই চলে এসেছে। এবার কোট করতে গেলে আবার বই খুলে পাতা ধরে ধরে ম্যাচ করাতে হবে। সে ভারী পরিশ্রমের কাজ। তাই কৃতজ্ঞতা স্বীকার
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
পরিমল ভট্টাচার্য্যের নাম আগে কখনো শুনিনি । দুটো বইয়ের অংশ বিশেষ শুনে মনে হচ্ছে অ্যাডভেঞ্চার আর উত্তেজনায় ঠাসা । খোঁজ করে দেখতে হচ্ছে ।
লেখালেখি ফিরে আসুক আগের রেটে ।
মামুনুর রশীদ
==============================
হাজারো মানুষের ভিড়ে আমি মানুষেরেই খুঁজে ফিরি
না খুব জমজমাট অ্যাডভেঞ্চার বলতে যা বুঝি, সেভাবে লেখা নয়।
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
দুর্দান্ত গ্রন্থালোচনা! বইদুটো পড়া নেই তাই বলতে পারবো না সেগুলো কতটুকু ইন্টারেস্টিং, তবে আপনার আলোচনা বেশ সুস্বাদু হয়েছে।
এবার কিছু আজাইরা কথা বলি।
কিন্টুপের গল্প যেটুকু শুনলাম সেটাকে ইতিহাসের চেয়ে গল্পই বেশি মনে হয়েছে। পরিমল ভট্টাচার্য্য বইগুলোকে কি ফিকশন বলছেন, নাকি ইতিহাস? কিন্টুপের এই জানবাজি খাটুনির পেছনে মটিভেটিং ফ্যাক্টরটা কী? কলাম্বাস বা ভাস্কো-দা-গামা’র মতো কোন ফ্যাক্টর তো এখানে থাকার কথা না।
তিব্বত নিয়ে ব্রিটিশদের কাজকারবার ও কথাবার্তা কখনো অদ্ভূত, কখনো বিরক্তিকর। তিব্বত দুনিয়ার বাইরের কোন জায়গা না। তিব্বতের সাথে আধুনিক চীনের অন্যান্য অংশের বা মধ্য এশিয়ার যোগাযোগ অনাদিকাল থেকে ছিল। হান পর্যটক বা ধর্মগুরু-সন্ন্যাসীদের কথা বাদ দিলেও খোদ ইউরোপীয় পর্যটকরাও তিব্বতে যাতায়ত করেছেন দ্বাদশ শতক থেকে। সেখানে ঊনবিংশ শতকে এসে ব্রিটিশদের তিব্বতকে এমন ‘নিষিদ্ধ দেশ’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা বিরক্তিকর। ব্রিটিশরা যেটা বলে না সেটা হচ্ছে তিব্বতে আগ্রাসণ চালানোর ক্ষেত্রে তিব্বতীদের প্রতিরোধের কথা। নয়তো তিব্বতীদের কে, কবে, কোন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল আর ব্রিটিশ লুটেরারা সেটা ভালো ছেলের মতো মেনে নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সার্ভে চালিয়েছে এই গল্প বিশ্বাসযোগ্য নয়।
‘সাহেব’দের, বিশেষত বিলেতীদের ধারণা (এবং তাদের লেখাতেও তার প্রমাণ মেলে), তারা যখন কোন জায়গায় প্রথম পা রাখলো তখন থেকে ঐ জায়গা দুনিয়ার অন্তর্ভূক্ত হলো। তাদের আগে লক্ষ বছর ধরে সেখানে মানুষ থাকলেও সেটা তারা গোনাগুনতিতে ধরে না। ইয়ারলুং-সাংপো নদীর গতিপথ আর তিব্বত নিয়ে বিলেতী সাহেবরা সেই কাজটি করেছে। অথচ সপ্তদশ শতকে পর্তুগীজ জেস্যুইটদের বানানো তিব্বতের ম্যাপও আছে।
তিব্বতের সমস্যা হাজারোটা। দুর্গম ভূপ্রকৃতি, চরমভাবাপন্ন জলবায়ু, বাইরের দুনিয়াতে যাবার জন্য সমূদ্র না থাকা, সীমান্তের অর্ধাংশে হিমালয়ের দেয়াল থাকা, উদ্ভিদ ও শস্য বিরল ইত্যাদি। তাই জীবনধারণের জন্য তিব্বতীদের বাইরের দুনিয়ার ওপর নির্ভর না করে উপায় নেই। ফলে বাইরের শক্তিরা, বিশেষত পূর্বের জাতিগুলো, বার বার তিব্বতকে পদানত করতে পেরেছে। ব্রিটিশদের ধান্ধা ছিল ছিংদের হঠিয়ে তিব্বত দখল করা। একই উদ্দেশ্য রাশিয়ারও ছিল। দক্ষিণ ও পশ্চিমের অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে তিব্বতীদের কঠোরতার কারণ এটা। এই কঠোরতা উত্তর বা পূর্বের জাতিগুলোর সাথে দেখানো যায়নি। কারণ তাতে তিব্বতীদের রুটিরুজিতে হাত পড়তো। আজকের দুনিয়ায় সীমান্তরক্ষায় বিভিন্ন দেশ কাঁটাতারের বেড়া, সশস্ত্র সীমান্তরক্ষী, পাহারা কুকুর, দেয়ালসহ যেসব মারাত্মক ব্যবস্থা নেয় সেই তুলনায় তিব্বতীদের দেশরক্ষার ব্যাপারটি নস্যি।
ভারতে সত্যিকারের সার্ভে করার কৃতিত্বটা বিলেতী সাহেবদেরই বটে, তবে সেখানে ভারতীয়দের অবদান স্বীকার করতে সাহেবদের কলম সরতে চায় না। তিব্বত সার্ভের ব্যাপারে নৈন সিং রাবতের অবদান সাহেবরা কতটুকু স্বীকার করে?
গোর্খাল্যান্ডের আগুন কি নিভেছে? ‘আচ্ছে দিন আনেওয়ালা’রা তো গোর্খাল্যান্ড বানিয়ে ছাড়বে এমন কথা দিয়েছিল।
আপনার মন্তব্য পেয়ে দারুণ লাগল।
আরে কিন্টুপ বাস্তব চরিত্র। ম্যালা সায়েবরা কিন্টুপের কথা লিখেছে তাদের বইতে। পরিমলবাবু এই কিন্টুপের মুখ থেকে শুনে লেখা জার্নালটা পড়েওছেন দার্জিলিঙের এক দোকানে গিয়ে গিয়ে। তখন বোধহয় সেই জার্নালটার দাম ১৮ হাজার টাকার মত চেয়েছিল বৃদ্ধ দোকানদার। আর গোটা পৃথিবীতে দুই কপি অবশিষ্ট ঐ জার্নালের জানিয়েছিল। তবে ওনাকে রোজ এসে পড়তে অ্যালাও করেছিলেন বৃদ্ধ দোকানী।
এটা ঘটনা যে আমাদের অতীতে লিখে টিখে রাখার, ডকুমেন্টেশানের চল তেমন ছিল না। এদিকে সায়েবরা ডকুমেন্টেশানে খুবই দড়। ফলে যে লেখে সে নিজের নামেই লিখবে ..... সে তো খানিক হবেই।
গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন এই মুহূর্ত্তে খুব কিছু নয়। ঐ যে দিদি বলেন 'পাহাড় হাসছে'। ঘটনা হল উনি প্রয় প্রায়ই উত্তরবঙ্গে যান তো, কোনও মুখ্যমন্ত্রী এতবার যাচ্ছেন ... এটার একটা প্রভাব তো পড়েই লোকের মনে। আর আন্দোলন আন্দোলন খেললে তো ট্যুরিজমের বারো বেজে যাবে। তো তাতেও লাভ তো নেইই বরং খাওয়ার যোগাড় বন্ধ হয়ে যায়। এইসব নানা কারণে তেমন ঝামেলা নেই।
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
চমৎকার বই রিভিউ।
বই দুটি পড়ার ইচ্ছে রইলো। ঢাকায় পাবো কিনা জানিনা
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
অনেক ধন্যবাদ।
অবভাস - এর বই। পেলেই পড়ে ফেলুন।
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
কী চমৎকার রিভিউ দন্তময়ীদি!
আমার মনে হচ্ছেনা এই বই পড়া হবে। আপনিই মাঝে মাজে এখানে অথবা ফেইসবুকে বইয়ের অংশ টংশ তুলে দেবেন। :'(
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
নাঃ ওসব টোকা ফোকা হবে না। এই না বলে কতদিন ধরে চেষ্টা করে কেঁদে ককিয়ে লিখলাম।
থিঙ্কুসস
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
খুব পড়তে ইচ্ছে করছে, দেখি ওডিনের ভাণ্ডারে মেলে কিনা।
রিভিউ চলুক-
facebook
হ্যাঁ হ্যাঁ পড়ে ফেলুন একদম।
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
বইটা পড়বার জন্য মন অস্থির হয়ে উঠেছে। কোথায় পাওয়া যেতে পারে?
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
এইরে তা বলতে পারি না। আমি কলকাতা বইমেলায় কিনেছিলাম।
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
দুইটাই প্রিয় বইয়ের তালিকায় এখন!
facebook
'অপুর দেশ'টাও পড়বেন কিন্তু
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
নতুন মন্তব্য করুন