পুণে শহরে জলাভাব বরাবরই। সেই কবে ব্রিটিশরা এসে খড়গওয়াসলা বাঁধ ও জলাধার বানিয়েছিল, সেই জলাধারই বহুবছর পুণের মানুষজনকে গৃহস্থালীর কাজকর্ম ও খাবার জলের যোগান দিয়ে গেছে। তারপর আস্তে আস্তে এলো পানশেত, পওনা, মুলশি, কাসারসাই ইত্যাদি জলাধারগুলো। যতবেশী জায়গা জুড়ে তোলা জল নল বেয়ে ঘরে ঘরে পৌঁছাতে লাগল ততই মানুষের থেকে দূরে সরতে লাগল মুঠাই, নীরা, মুলা নদীরা।
আর আমাদের দেশে মানুষের যেমন স্বভাব, যে জায়গাটাই সরাসরি কাজে লাগে না সেখানেই চাট্টি জঞ্জাল ফেলে ভরাতে থাকে। এমনি করেই ভরে উঠতে থাকে নদীখাতগুলো। কমে যেতে থাকে জলধারণের ক্ষমতা। সারাবছর জল যোগানোর জন্য জলাধারগুলো ভরসা করে মরশুমি বৃষ্টিপাতের উপর। যে বছর খুব ভাল বৃষ্টি হয়, সেপ্টেম্বরের শেষ, অক্টোবরের শুরুতেও কিছু কিছু বৃষ্টি হয় তাহলে পরের বছর ফেব্রুয়ারী বা এমনকি মার্চের অর্ধেক অবধিও সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে বলে আশা করা যায়। ২০১৪ থেকে সোসাইটিগুলোতে বৃষ্টিরজল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা বাধ্যতামূলক। না করলে বিল্ডার স্থানীয় পৌরসভা থেকে ক্লিয়ারেন্স পাবে না। কোন মস্ত বিল্ডারের সাথে মিউনিসিপালিটির টেবিলের তলার নীবিড় যোগাযোগের কারণে দুই একটা ক্যাম্পাস বৃষ্টিজল সংরক্ষণের একটা লোকদেখানো ব্যবস্থা করেই ফ্ল্যাট হস্তান্তরের ছাড়পত্র পায় বটে, তবে বেশিরভাগ সোসাইটিই স্বেচ্ছায় হোক বা চাপে পড়ে, মোটামুটি যথোপযুক্ত ব্যবস্থাই করে নিচ্ছে ২০১৬ থেকে।
.
২০১৫তে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম থাকায় ২০১৬তে এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকেই আমাদের সোসাইটিতে মিউনিসিপালিটির জল আসা কমতে থাকে, কারণ কাসারসাই লেকে জলের লেভেল নেমে যাওয়া। আমাদের সোসাইটির ফ্ল্যাট হস্তান্তর হয়েছে ২০১২তে, ফলে তাতে বৃষ্টিরজল সংরক্ষণের ব্যবস্থা তো নেইই, এমনকি গভীর নলকূপও নেই। একই বিল্ডারের ঠিক পাশের ক্লাস্টারেই অবশ্য এই দুইই আছে, আরো আছে পয়ঃপ্রণালীর জল পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার ব্যবস্থাও। ফলে পাশের ক্লাস্টারে যখন ছুটকো এক আধদিন জলের সমস্যা হচ্ছিল, তখন আমাদের ক্লাস্টারে সকালে ৪ ঘন্টা করে জল দেওয়া হচ্ছিল, ব্যসস সেই দিয়েই বাকী ২০ ঘন্টার সমস্ত কাজকর্ম করতে হবে। ফলে আশেপাশে অন্তত ৫ টা দোকান গজিয়ে গেল ২০ লিটার থেকে ১০০ লিটার অবধি ধারণক্ষমতার ড্রাম বিক্রি করবার। সেবার বর্ষা শুরু হয় ৩রা জুলাই থেকে। ততদিন অবধি ওইভাবেই চালাতে হয়েছে। ২০১৬ মানে ‘আচ্ছে দিন’ বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। আর এই আচ্ছে দিনের মুখে চুনকালি দিতেই বোধহয় মহারাষ্ট্রে কিসানরা পরপর আত্মহত্যা করছে, লাতুর বা মারাঠাওয়াড়ার উপর দিয়ে যাওয়া দূরপাল্লার ট্রেনগুলো হঠাৎ হঠাৎ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে মাঠের মাঝখানে আর কোথা থেকে পিলপিল করে একপাল মেয়ে আর বাচ্চা নানা আকারের ড্রাম, বালতি, কলসি নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ে বাথরুম থেকে জল ভরে নিয়ে নেমে যাচ্ছে, ওরা নেমে গেলে ট্রেন আপনা আপনি যেমন দাঁড়িয়েছিল তেমনি চলতে শুরু করে দিচ্ছে। স্থানীয় সংবাদপত্রে লেখালেখি, সমালোচনা আর তার চেয়েও বেশী করে হোয়াটস্যাপে ছবিসহ মেসেজ চালাচালি। সেই প্রথম বড় করে লেখালেখি হল দ্রুত নগরায়ণের ফলে মহারাষ্ট্রে বড় গাছের সংখ্যা কমে গেছে ভয়ানকভাবে। ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে লক্ষ্যণীয়ভাবে।
.
এবার নড়েচড়ে বসল মহারাষ্ট্র সরকার। আশু সমাধান হিসেবে লাতুর, বিদর্ভ, মারাঠাওয়াড়ায় জলের ট্রেন পাঠাতে শুরু করল। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রাজ্য বনদপ্তর ঘোষণা করল ‘গ্রিন মহারাষ্ট্র মিশন’ – সারা রাজ্য জুড়ে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ এর মধ্যে ৫০ কোটি গাছ লাগানোর পরিকল্পনা, প্রতি বছর জুলাই মাসকে ‘বন মহোৎসব’ মাস হিসেবে ঘোষণা, পাহাড়গুলিকে সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা এবং পাহাড়ে আর কোনরকম কংক্রীট-নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হবে না এই ঘোষণা ইত্যাদি। এখানে প্রসঙ্গত বলে রাখি আমি বর্তমানে যে আবাসনে থাকি সেই অঞ্চল ২০০৮ সালে ছোট ছোট ঘাসজমি,ঝোপজঙ্গল, গ্রামে ভরা পাহাড়ি অঞ্চল ছিল। ২০০৮-০৯ তে রাতের দিকে নিয়মিত ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটিয়ে বুলডোজার দিয়ে জমি সমান করা চলত, আবাসন নির্মাণের উদ্দেশ্যে। যাই হোক সরকার এই ৫০ কোটি গাছ লাগানোর লক্ষে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকেও ডাক দেয়। ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি’ পালনের জন্য ভালহারে ট্যাক্স ছাড় পাওয়া যায়, ফলে কর্পোরেট সংস্থাগুলোও অনেকেই এগিয়ে এলো। আমার কোম্পানিতে সবুজায়নের একটা উদ্যোগ ২০১১-১২ থেকেই ছিল, অফিসে উইন্ডমিল বসানো হয়েছে বিকল্প বিদ্যুতের আশায় সেই ২০০৯-১০ এই। তাতে রিসেপশান এলাকার সমস্ত আলো পাখা, গেটের পাশের সুরক্ষাকর্মীদের কেবিনের আলো পাখার ৭৫ শতাংশ চলে, বাকী ২৫ শতাংশের জন্য জেনারেটার বা রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের উপর নির্ভর।
.
তা আমাদের অফিসের সবুজায়নের গ্রুপটার সাথে আমি জড়িত সেই ২০১৪-১৫ থেকেই। মাসে একটা মিটিং হয়, আলো পাখা এসি ইত্যাদির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের উপর গম্ভীর প্রবন্ধ লেখে কেউ কেউ, কিন্তু গাছ টাছ লাগানোর কথা বললে সবাই থমকে যায়। কারণ দুটো, এক, টাকা কোত্থেকে আসবে? দুই কার এত সময় যে লাগাতার গাছপালা নিয়ে কাজ করবে! ২০১৬র মে’ মাসের শেষদিকে এক রোদ্দুরে ঝলসানো দিনে এই গ্রিন মার্শাল গ্রুপের সঞ্চালক আমাকে ফোন করে বললেন মুখ্যমন্ত্রীর আহবানে সাড়া দিয়ে আমাদের কোম্পানি স্থির করেছে খরাপ্রবণ অঞ্চলে ১০,০০০ গাছ লাগাবে। হঠাৎ করে এই এত গাছ লাগানোর মত পরিকাঠামো তো একটা আইটি কোম্পানির নেই, আমাদের মাদার গ্রুপ যে গাড়ি কোম্পানিটি তাদেরও নেই। অতএব আমরা ‘নাম ফাউন্ডেশান’ নামক একটি এন জি ও সংস্থার সাথে গাঁটছড়া বেঁধে কাজ করব। তা এই পুরো কাজটায় আমি নেতৃত্ব দিতে পারব কী? প্রথমে শুনে তো যাকে বলে ‘ফিলিং মেহ!’ নাহয় একটু গাছটাছ লাগাবার কথা জিগ্যেস টিগ্যেসই করেছি, তাই বলে একেবারে দশ হাজার গাছ, তাও সেই কোন মারাঠাওয়াড়ার ধারেকাছে গিয়ে লাগাতে হবে!? এ ক্ষি অত্যাচার! ইতিমধ্যে উনি বলে দিয়েছেন এই ‘নাম ফাউন্ডেশান’টি অভিনেতা নানা পাটেকরের তৈরী। যে সব কিসান আত্মহত্যা করেছেন নানা তাঁদের পরিবারের জীবিকানির্বাহ ও পুনর্বাসনের জন্য কাজ করেন জানতাম, দেখাই যাক না – এরকম বড়স্কেলে কাজ করার একটা অভিজ্ঞতা তো হবে ভেবে রাজী হয়ে গেলাম। যেই না রাজী হওয়া অমনি বলেন বেশ তাহলে এই শুক্রবারই আহমদনগর চলে যাও, গিয়ে স্পট দেখে এসো, আমি কর্পোরেট সার্ভিসকে বলে গাড়ির ব্যবস্থা করছি। অগত্যা। সেদিন এক মঙ্গলবার, মাঝে দুদিন। তাড়াতাড়ি গিয়ে আমার রিপোর্টিঙ ম্যানেজারকে বললাম ‘দেখো তুমি তো আমাকে বিজনেস ইউনিটের বাইরে গিয়েও কাজ করতে, বৃহত্তর কোম্পানিতে সংযুক্ত হতে বলেছিলে, তা আমি এইটে নিলাম’। সে বেচারা সব শুনে কেমন ভেবলে গিয়ে বলল না না যাও যাও, এ তো পুণ্যির কাজ, এস্ক্যালেশান হলে আমি সামলে নেবোখন।
.
অতঃপর বাকী দুইদিনে জানলাম আহমদনগর জেলায় দুটো জায়গা স্থির হয়েছে, প্রথম হল আহমদনগর আর্মি ক্যান্টনমেন্ট আর দ্বিতীয় হল সেখান থেকে প্রায় ৭০-৭২ কিলোমিটার দূরে হাইওয়ে থেকে বেশ খানিকটা ভেতরে গোগলগাঁও। জায়গা বেছেছে নাম ফাউন্ডেশান, চারাগাছ সরবরাহ করবে ওরাই, চারাগাছের পাশের বেড়াও ওরাই দেবে আর পরবর্তী ৩ বছর দেখভালও ওরাই করবে। আমরা শুধু টাকা যোগাব, (কোম্পানির তরফে ৪৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছে বনসৃজন খাতে ) আর চারাগাছ রোপণ করব (সব নয়, একদিনে যতটা হবে) আর পরবর্তী ৩ বছরে প্রতি তিনমাস অন্তর একবার করে পরিদর্শন করব। এইসময়ই জানলাম চারাগাছকে হিন্দিতে বলে ‘পোদা’ (কিরকম বিশ্রিমত শুনতে)। কোম্পানির CSR ভার্টিকালের ‘বিজয় ওয়াভরে’ আমার সাথে যাবে প্রাথমিক পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে। পুণে থেকে প্রায় ৭-৮ ঘন্টার দূরত্ব কাজেই ভোর ৭ টায় আমরা রওনা দেব শুক্রবার। প্রথমে আর্মি ক্যান্ট, পরে গোগলগাঁও।
(পরে আবার)
(যিনি লেখাটির নামকরণ করেছেন [নামটা খুব পছন্দ হওয়ায় সামান্য পরিবর্তন করে আত্মস্থ কল্লাম)] তিনিই অনবরৎ ঘ্যান ঘ্যান করার সময় বুদ্ধি দিয়েছেন অল্প একটু লিখে হাওয়া হয়ে যেতে। অতএব হে সচলগণ পরের পর্ব আসতে অনেএক দেরী হলে বিচলিত হবেন না)
মন্তব্য
কী গাছ রোপণ করলেন? আর কোন গাছ রোপণ করা থেকে কেনই বা বিরত থাকলেন? পরের পর্বে বিস্তারিত জানতে চাই।
পোদারোপণ শব্দটা লিখতে গেস্লাম, বুচ্ছেন? শেষ মুহূর্তে মনে হলো, থাক।
অত বিস্তারিত বলতে পারব কিনা জানি না, কারণ প্রথম বছর সরকারি গাইডলাইন পৌঁছায় নি। মোটামুটি আন্দাজে আন্দাজে।
সে আর কি বলব! ছেলেপুলেরা একজন অন্যকে বলছে 'উধার তু আয়েঙ্গে না ইয়ার পোদে লাগানেকে লিয়ে?' , 'আপ বেফিকর রহো ম্যা'ম দস পন্দরা পোদে ম্যায় খুদ হি লাগাদেঙ্গে'
ইত্যাদি ইত্যাদি।
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
অপেক্ষাই রইলাম, গাছ নির্বাচনের ব্যাপারটা জানান তো, এই জায়গায়তেই কোম্পানিগুলো হেদিয়ে মরে উল্টাপালটা গাছ লাগিয়ে, তবে পরিমল ভট্টাচার্যের নিয়মগিরি পাহাড় ও বন রক্ষা নিয়ে লেখা 'সত্যি রূপকথা' পড়ে ভারতের নানা স্থানে গ্রাম উদ্যোগে গড়ে ওঠা বন নিয়ে দারুণ সব তথ্য পেয়েছি। জানাবো পরে।
গাছ লাগিয়ে যান, সেই গাছে যখন পাখিরা আসবে, দেখতে আসব।
facebook
এখানে সরকারি গাইডলাইন এলো গতবছরের মাঝামাঝি। আর মাঝে একবছরের টাকা 'স্বচ্ছতা অভিযান'এ খেয়ে গেল। অই হোক তাও মহরাষ্ট্রের নিরীখে যা আছে লিখে দেব।
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
১. শহর ও গ্রামাঞ্চলে আবর্জনা ফেলার জন্য এবং পরিশোধনের জন্য জাতীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা থাকা উচিত। শহরের আবর্জনা গ্রামে ফেললে বা গ্রামের আবর্জনা খালে ফেললে সমস্যার সমাধান হয় না। শিল্পকারখানার বর্জ্য নদীতে ঢেলে দেয়া প্রথম শ্রেণীর অপরাধ। এগুলো বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে আবর্জনার গর্তে বাস করতে হবে।
২. সারা দুনিয়াতেই বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যাপারটিতে জোর দেয়া উচিত, বিশেষত এই উপমহাদেশে। আরও যা করতে হবে তা হচ্ছে সরকারী পর্যায় ছাড়া আর সকল পর্যায়ে গভীর নলকূপ বসানো বন্ধ করা। ভূপৃষ্ঠস্থ জল (surface water) ব্যবহার বাড়িয়ে ভূনিম্নস্থ জলের ব্যবহার কমাতে হবে।
৩. যে কোন কাজে যখন কোন এনজিও সান্ধায় তখন ঐ কাজের ফলাফল নিয়ে আর আশা থাকে না। তারা এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে যখন তাদের সহযোগিতা নেয়াটাকেই উত্তম বলে মনে হয়। তাদের কাজে ঢাকঢোল বেশি বাজে, ১০ টাকার কাজ করতে নানা প্রকার ভুংভাং যোগ করে ৯০ টাকা খরচ করে।
৪. ট্যাক্সো সুবিধা পাবার জন্য কর্পোরেটরা সিএসআর-এর নামে যা কিছু করে সেগুলোর ভবিষ্যতের ব্যাপারে তারা মোটেই ভাবিত থাকে না। তাদের যাবতীয় চিন্তা থাকে যা কিছু করা হলো তাতে ট্যাক্সো সুবিধা কতটুকু পাওয়া যাবে।
৫. চারাগাছের হিন্দী নাম “पौधा” (পৌধা)। উচ্চারণের কালে মহাপ্রাণ বর্ণ অল্পপ্রাণ বর্ণের ন্যায় উচ্চারণ করলে অনেক ক্ষেত্রেই বিপত্তি হতে পারে। (উচ্চারণ বিভ্রাট প্রসঙ্গে বাকআচার্য্য নরেন বিশ্বাস বলেছিলেন, “ডাক্তারবাবু যদি ‘নাড়ি’ টিপে ধরার বদলে ‘নারী’ টিপে ধরতে চান তাহলে তো সমূহ বিপদ”!)
৬. যেভাবেই হোক, গাছ লাগিয়েছেন সেটা ভালো ব্যাপার। ইউক্যালিপ্টাস, অ্যাকেশিয়া ধরনের গাছ না হলেই হলো। ফলের গাছ হলে আরও ভালো। আপনাদের লাগানো গাছের ১০% বেঁচে থাকলেও বছর কুড়ি পরে এর সুফল মিলবে।
বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে উদ্বৃত্ত পানি মাটির ওপরে বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায় না। যদি মাটির নিচে অগভীর সিক্ত শিলাস্তরে (অ্যাকুইফার) সংরক্ষণ করা যেতো, বিশেষ করে যেসব জায়গায় শুষ্ক মৌসুমে পানির টান পড়ে, তাহলে হয়তো খরচও কম পড়তো।
বন্যা বা বৃষ্টির জল দীর্ঘিদিন সংরক্ষণ করতে না পারার কারণ জল উবে যাওয়া (evaporation)। জলকে আবদ্ধ পাত্রে রাখতে পারলে বা ঢেকে রাখতে পারলে অথবা দৈনন্দিন ব্যবহার্য জলের ক্ষেত্রে বর্ষা ও তৎপরবর্তী মওসুমে বন্যা/বৃষ্টির জলের ব্যবহার বাড়ালে সমস্যাটার ভালো সমাধান করা যায়। বৃষ্টির জল ঠিকভাবে ধরতে পারলে অল্প একটু ট্রিটমেন্টে বোতলবন্দী করা সম্ভব।
ভূনিম্নস্থ অগভীর সিক্ত শিলাস্তরে বন্যা/বৃষ্টির জল পাঠানোটা একটু কঠিন এবং ব্যয়সাপেক্ষ। এই ক্ষেত্রে চাপ প্রয়োগে জল পাঠানোর জন্য কিছুটা তেল পোড়াতে হয়, এবং উদ্যোগটা ছোট মাপের হলে পোষায় না। একটু বড় মাপের উদ্যোগ নিতে গেলে হয় সরকারের দ্বারস্থ হতে হয় অথবা টাকার গন্ধে গন্ধে মেরুবৃত্ত বা তার কাছাকাছি অঞ্চলের এনজিওগুলো এসে হাজির হয়। সরকারী উদ্যোগে কাজ হতে গেলে 'ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা যায়' আর এনজিওরা কাজ নিলে বন্যা/বৃষ্টির জল ভূনিম্নস্থ অগভীর সিক্ত শিলাস্তরে পৌঁছাক আর না পৌঁছাক ঐ অঞ্চলের মানুষের হাড়ের ভেতরের মজ্জা আর ভূনিম্নস্থ 'বৈদূর্য বলয়ে'র গলিত ধাতু তাদের অ্যাকাউন্টে পৌঁছে যাবে।
মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক ইত্যাদি রাজ্যগুলোতে এখন বেশ কয়েক বছর হল গার্বেজ সেগ্রিগেশান, কালেকশান ও রিউজ রিসাইকলের ব্যপার শুরু হয়েছে। পুণেতে যেমন নতুন সবকটি হাউসিঙেই ওয়েট গার্বেজ নিজেদের প্রসেস করে কম্পোস্ট বানাতে হয়। তাতেই বাগানের সার হয়ে যায়। ড্রাই গার্বেজ কালেকশান ও রিসাইকলের রীতিমত বাজার তৈরী হয়েছে।
এন জি ও নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা একেবারে খারাপ না। বেশ কয়েকটাকে জানি যারা সত্যিই বেশ ভাল কাজ করে।
সি এস আর খাতে পাওয়া টাকা দিয়েই আমাদের কোম্পানি প্রায় ৫০টা জিলা পরিষদের স্কুলকে দত্তক নিয়েছে। সেখানে ছেলেমেয়েদের বইখাতা, স্কুলব্যাগ, মিড ডে মিল সবকিছুই দেয়। ঐ ৫০টা স্কুলের আন্ডারপ্রিভিলেজড বাচ্চা যেটুকু যা পাচ্ছে সেগুলো সরকারে ভরসায় থাকলে তারা প্রায়ই পেত না। যেমন সেশান শুরু হয় এপ্রিলের মাঝামাঝি, আর বই আসে কোনোবার সেপ্টেম্বর কোনোবার ওক্টোবর। তা কোম্পানি দত্তক নেওয়য় এইটা নিয়মিত হয়েছে। এপ্রিলের শেষেই এরা বই পেয়ে যাচ্ছে।
আমাদের ২০১৬তে লাগানো গাছের সার্ভাভইবাল রেট ৬৮-৭০% মত। গত বছর অবধি ৭২% ছিল, এবছরের প্রচন্ড খরায় আর মৌসুমীবায়ুর অনেক দেরীতে ঢোকায় বেশ কিছু গাছ মরেছে, কিছু লোকে জ্বালানী হিসেবে কেটে নিয়ে গেছে।
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
গারবেজ সেগ্রেগেশান, কালেকশন, রিইউজ, রিসাইকেলের ব্যাপারে যা বললেন সেটা আশাপ্রদ। বস্তুত বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও জাতীয় বাজেটে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আসা উচিত - সব দেশেই। তবে তারও আগে দরকার জনসচেতনতা আর জনশিক্ষা। কী করতে হবে সেটা ঘরে ঘরে গিয়ে জনে জনে শেখাতে হবে, সব রকম মিডিয়ায় বলতে বলতে মানুষের মগজে গেঁথে দিতে হবে। ভবিষ্যতে ময়লার ভাগাড়ে বাস করতে না চাইলে এর বিকল্প নেই।
সিন্দাবাদের একটা গল্পে আছে না যেখানে এক রাক্ষস লোকজনকে ধরে এনে নারকোল মাখা ভাত খাওয়ায়। এভাবে ভাত খেতে খেতে যারা একটু নাদুসনুদুস হয় অমনি রাক্ষসটা তাদেরকে শিক কাবাব বানিয়ে খেয়ে ফেলে। আমার অভিজ্ঞতায় এনজিওদেরকে সিন্দাবাদের ঐ রাক্ষসের মতো মনে হয়।
সিআরএস-এর টাকায় কাজের কাজ কিছু যে হয় না তা নয়। তবে বেশিরভাগ কোম্পানি এই ব্যাপারে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা করে না বলে অনেক ভালো উদ্যোগ শেষে শূন্য ফলাফল নিয়ে আসে। তাছাড়া টপ ম্যানেজমেন্টের মধ্যে কারো দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক ঊচ্চাভিলাষ থাকলে এই প্রকার উদ্যোগ তাদের ভবিষ্যতের নির্বাচনী প্রচারণায় পর্যবসিত হয়। শেষ বিচারে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কোন না কোন উপায়ে শোষনটা করবেই - একটু কম বা বেশি অথবা একটু আগে বা পরে।
রোদে পুড়ে, জলে ডুবে, মড়কে মরে, ঝড়ে ভেঙে যতো না গাছ মরে তার চেয়ে ঢেড় বেশি গাছ লোকে জ্বালানী বানানোর জন্য কেটে বা ভেঙে নিয়ে যায়। পাহারা দেবার ব্যবস্থা না থাকলে একটা আস্ত বন উজাড় হতে সময় লাগে না। আমাদের হা করা মুখ অনেক বড়, পেট তারচেয়ে অনেক বড়। আমরা সবকিছু খেয়ে হজম করে ফেলতে পারি।
এমন একটা চমৎকার উদ্যোগের সাথে যুক্ত হয়েছেন, আন্তরিক অভিনন্দন!
অফটপিকঃ
১। আমাদের বাসার ছাদে খানিকটা হাতুড়ে পদ্ধতিতে বৃষ্টির পানি ধরার একটা ব্যাবস্থা করে ট্যাঙ্ক ভর্তি করার ব্যাবস্থা করেছি। সারা বছরে মোটামুটি ৫০-৬০ দিন এই পানিতে আমাদের চলে যায়। ঠিকমত পূর্ব-পরিকল্পনা করা গেলে এরকম দিনের সংখ্যা অন্ততপক্ষে দ্বিগুণ করা সম্ভব বলে মনে হয়।
২। ঢাকা থেকে সড়কপথে উত্তরবংগ যাওয়ার পথে দেখলাম- মাঝে মাঝেই মহাসড়কের পাশে আঞ্চলিক ভাগার গড়ে উঠেছে। দুর্গন্ধ এবং দৃষ্টিপীড়ন মারাত্মক। এই উপদ্রব থেকে পরিত্রানের উপায় এখনই ভেবে বের করা দরকার।
১. বাসার ছাদের পাশাপাশি আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার রিজারভয়েরেও পানি ধরে রাখার উদ্যোগ নিন দেখবেন ২ মাস নয়, ৫/৬ মাস চলার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
২. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য পরিশোধনের জন্য জাতীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা না থাকলে এই সমস্যার সমাধান হবে না। ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহে যে বিপুল পরিমান ওয়াশিং, ডায়িং, প্রসেসিং, স্পিনিং ও টেক্সটাইল মিল আছে সেগুলোর কাছের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় জানালার কাচ তুলে দিয়ে গাড়ি ৬০ মাইল বেগে চালালেও দুর্গন্ধে নাড়িভুড়ি উলটে আসে।
যে কোন শহরে বৃষ্টির জল ধরলে কিচুটা পরিশোধন না করে ব্যবহার করা ঠিক নয়। শহুরে বৃষ্টিতে কিছু না কিছু কেমিক্যাল মিশেই থাকে। যেটা করতে পারেন বৃষ্টির জল ছাদ বা জানলার উপরের শেড থেকে সব পাইপের মাধ্যমে মাটির নীচে পাঠাতে পারেন। একটা বড়সড় ড্রাম নিয়ে তাতে বেশ অনেকগুলো গর্ত করে সেটা বাড়ির পাশের কোন মাটি ঘাসওলা অংশে প্রায় তিন কি চারশো ফুট গর্ত করে পুঁতে দিলেন আর তার মুখটা ধাকনা দিয়ে ঢেকে ঢকনায় গর্ত করে ঐ ছাদের পাইপ এনে জুড়ে দিলেন। এতে জল এসে ঐ ড্রামে জমা হবে আর গায়ের গর্ত দিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে মাটিতে মিশবে। ওয়াটার টেবল রিচার্জ হতে থাকবে।
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
ওয়াটার টেবল রিচার্জের যে পদ্ধতির কথা বললেন সেটা খুব সহজ নয়। এতে কনস্ট্রাকশন নেই এমন জায়গা লাগবে, বোরিং-এর খরচ আছে, রিচার্জ লাইন নিয়মিত পরিস্কার রাখার হ্যাপা আছে, গ্রাউন্ড ওয়াটারের লেভেল খুব বেশি নিচে না হলে অল্প সময়ে পানি উপচে পড়তে পারে, গ্রাউন্ড ওয়াটারের লেভেল কোন দিকে ইনক্লাইন্ড থাকলে রামের বৃষ্টির পানি শ্যামের অ্যাকুইফারে জমা হবে। যেখানকার মাটিতে আর্সেনিক আছে সেখানে পুরো প্রক্রিয়াটা মাঠে মারা যাবে। এরচেয়ে বৃষ্টির জল আধারে ধরে একটু পরিশোধন করে ব্যবহার করা ভালো। বৃষ্টির বাকি জল ভূপৃষ্ঠ থেকে চুঁইয়ে নিচে যাবেই - একটু সময় কেবল বেশি লাগবে। সারফেস ওয়াটার নির্ভরতা বাড়াতে পারলে অ্যাকুইফার পূর্ণ হবার সময়টা মিলবে।
বৃষ্টির পানিতে ক্যামিকেল মিশে থাকার সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে বেশ কিছুক্ষন বৃষ্টি হয়ে যাবার পর আমরা পানি সংরক্ষন করি, আর এই পানিটা পান করার কাজে ব্যবহার করি না। বাকীটা এলাহি ভরসা।
মন ভালো করা লেখা। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন