হারবার্ট সিনেমাটির ভিসিডি কেনার মাত্র কয়েকদিন আগেই আমি জানতে পেরেছিলাম যে নবারুণ ভট্টাচার্যের রচিত এই উপন্যাসের উপর সুমন মুখোপাধ্যায় একটি ছবি তৈরি করেছেন । এছাড়া ছবিটি সম্পর্কে আমার কাছে আর কোনো তথ্য ছিল না ।
ছবিটি দেখার পরে অনেকটাই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম । বাংলা ভাষায় এই রকমের ছবি আগে কখনও দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না । থিয়েটার জগতের এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব সুমন মুখোপাধ্যায় তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবিতেই যে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখলেন তা মনে রাখার মতো । তবে ছবিটি বাংলা ভাষায় নির্মিত আরো অনেক সমান্তরাল ছবির মতো ছিল ফ্লপ ।
এর কারণ কি সুমন মুখোপাধ্যায়ের নাম চিত্রপরিচালক হিসাবে মানুষের কাছে অজানা ছিল বলে নাকি ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে শুভাশিষ মুখোপাধ্যায় যাঁর স্টার ভ্যালু কম । এখন তো বাংলা সমান্তরাল সিনেমাতেও বড় বড় স্টারদের নামনো হয় লোক টানার জন্য যেখানে আমাদের এখানের অনেক নামহীন অভিনেতাই তার থেকে ভাল অভিনয় করতে সক্ষম ।
কিছুদিন আগে ফেলিনির লা স্ট্রাডা ছবি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছিলাম কিছু কিছু মানুষ থাকে যারা কেনই বা জন্মায় আর কেনই বা মরে যায় সে নিয়ে কারো মাথাব্যথা থাকে না । হারবার্ট সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র হারবার্ট সরকার এই রকম একটি চরিত্র । তার জীবনটা হতে পারত খুবই উঁচুদরের তার বাবা ছিল একজন সেলিব্রিটি চিত্রপরিচালক যার স্বভাবতই নায়িকাদের সঙ্গে ফস্টি নস্টি করার প্রবণতা ছিল । কিন্তু শুটিং-এ গিয়ে সে বেঘোরে প্রাণ দিল । এরকিছুদিন পরেই তার মা কাপড় মেলতে গিয়ে ছাদে কারেন্ট খেয়ে মারা গেল । এর পর হারবার্ট জ্যাঠা জেঠিমার সংসারে লাঠি ঝ্যাঁটা খেয়ে বড় হতে লাগল । শেষ পর্যন্ত সে হয়ে উঠল একজন প্রেত বিশেষজ্ঞ । এরপর যুক্তিবাদী সমিতির হুমকি পেয়ে সে আত্মহত্যা করে ।
সিনেমাটিতে প্রচুর রূপক দৃশ্য ও ভাবনা আছে । উত্তর কলকাতার সরু গলি আর উঁচুনিচু বাড়ির ল্যান্ডস্কেপ পুরনো বনেদী বাড়ির একতলার অন্ধকার ঘর সবই এক অদ্ভুত পরিবেশ রচনা করে । জানলার ভিতর দিয়ে দেখা কাস্তে হাতুড়ি তারা, মৃত বাবা মার মুভি ক্যামেরার পিছনে দাঁড়িয়ে ছেলের কীর্তিকলাপ দেখা সবই কিছু ইঙ্গিত হিসাবে আমাদের চোখে ধরা পড়ে ।
ছবিটির গল্প শুধু অনুসরণ করলে ছবিটিকে বুঝে নিতে অসুবিধা হবে । অনেক কথাই এখানে বলা হয়েছে পরোক্ষ ভাবে । সত্তরের দশকের নকশাল আন্দোলন ছবিটির অন্যতম প্রেক্ষাপট । সেই আন্দোলনের চেতনা যে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি যেকোন মূহুর্তেই তা আবার ফেটে পড়তে পারে তা বোঝানো হয়েছে । ছবিটির পিছনে গভীর রাজনৈতিক বক্তব্য আছে। ছবিটি কখনই একমাত্রিক বা লিনিয়ার নয় । বরং বহুমাত্রিক সময়ের তিনটি আলাদা আলাদা স্তর কে পাশাপাশি ধরা হয়েছে । এবং এই কাজটি পরিচালক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে করেছেন । আলো-ছায়া উঁচুনিচু সবই এখানে প্রতীক । হারবার্টের কৈশোর এবং যৌবন, বর্তমান হারবার্ট এবং তার আত্মহত্যা করার পর আপাত রহস্য এবং পুলিশের তদন্ত সবই পাশাপাশি দেখানো হয়েছে ।
সুমন মুখোপাধ্যায় যে বহু নামকরা চিত্র পরিচালকের কাজ থেকে প্রভাবিত হয়েছেন তা সহজেই বোঝা যায় । ফেলিনির প্রভাব তাঁর কাজে ভালোই পড়েছে । ছাদের উপরে কিশোর হারবার্টের হস্তমৈথুন করার দৃশ্যটি দেখে ফেলিনির অ্যমারকর্ড ছবিটির কথা মনে পড়ে যায় । কিন্তু একথা স্বীকার করতেই হবে যে প্রভাবিত হয়েও তিনি চিত্রপরিচালক হিসাবে নিজের একটি জায়গা গঠন করতে সক্ষম হয়েছেন । ছবিটিতে বেশ কিছু গালাগালি রয়েছে যা কিছু মানুষের অস্বস্তির কারণ হতে পারে । কিন্তু আমার মনে হয়ে সিনেমাটিতে এগুলি ছাড়া চরিত্রগুলিকে পুরোপুরি বোঝানো যেত না ।
দৃশ্যনির্মান সম্পাদনা সংলাপ ক্যামেরা এবং পরিচালনা সবই অসাধারণ । ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও মনে রাখার মত । হারবার্ট এর চরিত্রে শুভাশিষ মুখোপাধ্যায় এছাড়া লিলি চক্রবর্তী, সব্যসাচী চক্রবর্তী, ব্রাত্য বসু, সবাই ভালো অভিনয় করেছেন । তবে কিছু কিছু জায়গায় অভিনয় একটু লাউড । মনে হয় পরিচালক ইচ্ছাকৃত ভাবেই এটা করেছেন । অথবা থিয়েটার অভিনয়ের লাউডনেস এই ছবিতেও একটু এসে ঢুকেছে ।
ছবিটি দেখার পর নবারুণ ভট্টাচার্যের মূল উপন্যাসটি পড়ার ইচ্ছা খুব বেড়ে গেল । মূল উপন্যাসটি সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার প্রাপ্ত । বিজন ভট্টাচার্য এবং মহাশ্বেতা দেবীর সুযোগ্য সন্তান নবারুন নিজেও কতটা প্রতিভাশালী লেখক তার বোঝার জন্য বইটি পড়তেই হবে ।
যাঁরা একটু অন্য ধরণের সিনেমা দেখতে ভালবাসেন তাঁদের দেখতেই হবে এই ছবি । ভারতে মোজার বায়ার কম্পানি এই ছবির ভিসিডি বের করেছে । দুটি সিডির সিনেমার দাম মাত্র তিরিশ টাকা ।
মন্তব্য
নবারুণ ভট্টাচার্যের 'হারবার্ট' উপন্যাসটি সম্পর্কে অনেক শুনেছি। অথচ বইটা এখনো সংগ্রহ করে উঠতে পারলাম না। এখন অভাববোধটা তো আরো বাড়িয়ে দিলেন!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
এটার লিনক ও থাক।
গুরুচন্ডা৯-তে হারবার্ট নিয়ে আলোচনা।
সোমুদা,
তোমার লিংক ঠিক করে দিলাম।
কিন্তু তোমার কাহিনি কি? পোস্ট-টোস্ট কর না ক্যান এইখানে? মন্তব্যেও দেখা নাই!
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
সিনেমাটা খানিক আগে দেখা শেষ করলাম। গুগ্লাতে গিয়ে দেখি সচলে হারবার্ট নিয়ে আলোচনা আছে।
মহাশ্বেতা দেবীর ছেলে নবারুণ ভট্টাচার্যের 'হারবার্ট বইটা পড়ার খুব ইচ্ছে হচ্ছে।
-------------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
নতুন মন্তব্য করুন