আমার মূল্যবান পা, মূল: হাইনরিখ ব্যোল, জার্মান থেকে অনুবাদ: তীরন্দাজ

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: বুধ, ১৪/১১/২০০৭ - ১১:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তাঁরা আমাকে একটি সুযোগ দিয়েছেন। একটি চিঠি পাঠিয়ে অফিসে আসতে বলেছেন। আমি অফিসে গেলাম। অফিসে লোকজন বেশ ভদ্র। আমার নম্বরের কার্ডটি নিলেন ও বল্লেন,
‘হুম’!
‘হুম’! আমিও একই উত্তর দিলাম।
‘কোন পা’? জানতে চাইলেন সরকারী কর্মচারী।
‘ডান পা।‘
‘পুরোটা’?
‘পুরোটা’।
‘হুম’। আওয়াজ করলেন কর্মচারী। কিছু কাগজ ঘাটলেন, আমাকে বসার অনুমতি দিলেন।
অনেক খুঁজেপেতে অবশেষে এমন নথি পেলেন, মনে হলো এতোক্ষনে সঠিকটিই পেয়েছেন। তারপর বললেন,
‘আমার মনে হয়, পেয়েছি, পেয়েছি! আপনার জন্যে এটাই ভাল হবে। ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। রিপাবলিক প্লেসের এক টয়লেটে জুতো পরিস্কার করা। কেমন হয়’?
‘আমি জুতা পরিস্কার করতে জানিনা। আমার ময়লা জুতো অনেকবারই অনেকের চোখে পড়েছে’।
‘শিখে নেবেন’। বললেন উনি। ‘সবই শিখে নেয়া যায়। একজন জার্মানকে সব জানতে হয়। প্রয়েজনে বিনে পয়সায় কোন স্কুলেও যেতে পারেন’।
‘হুম’! বললাম আমি।
‘তাহলে ঠিক আছে’?
‘না’, আমার দরকার নেই। আমি আরো বেশী পেনশন চাই’।
‘আপনি একটা পাগল’। বললেন তিনি নরম ও বন্ধুত্বপূর্ণ স্বরে।
‘আমি পাগল নই, কেউ আমাকে আমার পা ফিরিয়ে দিতে পারবে না। আমি সিগারেট পর্যন্ত বেঁচতে পারি না। তাতেই আমার সমস্যা হয়।

লোকটি তারঁ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আরেকটু ভাল করে দম নিলেন। ‘জনাব’ বলেই শুরু করলেন, ‘আপনার পা যে জঘন্য দামী পা, তা আমিও বুঝতে পারছি। আপনার বয়েস মাত্র উনত্রিশ, হার্টের অবস্থা ভাল,শরীর পুরোপুরি সুস্থ, শুধুমাত্র একটি পা নেই। প্রায় সত্তুর বছর বাঁচবেন। এবার হিসেব করুন! প্রতিমাসে সত্তুর মার্ক, বছরে বারোবার। অর্থাৎ একচল্লিশ গুন বারো গুন সত্তুর। হিসেব করুন, সুদের কথা বাদই থাক! আপনার পা’টিই যে একমাত্র পা, তা ভাববেন না! আর আপনিই একমাত্র নন, যিনি অনেকদিন বাঁচবেন। তারপর আবার পেনশন বাড়াতে চাইছেন। মাপ করবেন, আপনি আসলেই পাগল’!

‘জনাব’! উত্তর দিলাম আমি। নিজেও চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ভাল করে দম নিলাম। ‘আমার মনে হচ্ছে আপনি আমার পা’টিকে বেশ সস্তা বলেই ভাবছেন। আমার পায়ের দাম আরো অনেক বেশী। ভীষন মূল্যবান পা আমার। তাছাড়া আমার হার্টই শুধু নয়, মগজেও পুরোপুরি সুস্থ। এবার তাহলে শুনুন’।
‘আমার এত ফালতু সময় নেই’।
‘শুনুন, আমার পা অনেকের জীবন বাঁচিয়েছে, যারা বেশ ভালো পেনশন পাচ্ছেন’।

‘কারণটি বলছি। আমি সামনে সারিতে পড়ে ছিলাম। আমার দ্বায়িত্ব ছিল শত্রু এলে অন্যদেরকে সতর্ক করা, যাতে তারা পালাতে পারে। পেছনের বাহিনী ছিল বাক্সপ্যাটরা বাঁধাছাদা নিয়ে ব্যাস্ত। এতো তাড়াতাড়ি পালাতে চায়নি, আবার দেরীও করতে চায়নি। প্রথমে ছিলাম আমরা দু’জন। কিন্তু আমার সঙ্গীকে তারা গুলি করে খতম করে দিল। তার জন্যে কোন খরচ নেই। যদিও সে বিবাহিত ছিল, তার বউ সুস্থ ও কাজ করে জীবন চালাতে পারে। আপনার ভয় পাবার কোন কারণ নেই। এখানে খরচের খাতা একেবারেই শুন্য বললেই চলে। মাত্র চার সপ্তাহ ধরে সৈনিক ছিল সে ও তার পেছনে একটি পোষ্টকার্ড আর সামান্য মোটা রুটি ছাড়া কিছুই খরচ হয়নি। কিন্তু আমি পড়ে রইলাম ঠান্ডায় একা একা ও ভয়ে কাতর। আমিও পালাতে চেয়েছিলাম, আর যখনই পালাতে চাইলাম ....’।

‘আমার সময় খুবই সংক্ষিপ্ত’, বলেই ভদ্রলোক পেন্সিলটি খোঁজাখুজি শুরু করলেন।

‘না, আমার কথাটি আগে শুনে নিন। আসল কথা আসছে এখনই। আমি যখনই পালাতে চাইলাম, তখনই পায়ের ব্যাপারটা আসলো। ভাবলাম, পড়েই যখন থাকতে হচ্ছে, তাহলে অন্যদেরকে ওয়ারলেসে জানিয়েও দিতে পারি এবং করলামও তাই। তারা সবাই পালালো দলে দলে। প্রথম পালালো ‘ডিভিশন’, এরপর ‘রেজিমেন্ট’ ও তারপর ‘ব্যটেলিয়ান’। এভাবেই সুশৃঙ্খলভাবে একের পর এক। কিন্তু বুঝতে পারছেন বোকামোটি হলো কোথায়? ওরা আমাকে সাথে নিতে ভুলে গেল। ওদের এত বেশী তাড়াহুড়ো ছিল। সত্যিই গাধার মতো কাহিনী বটে, আমার পা’টি যদি হারাতে না হতো, মরতো সবাই। জেনারেল, কর্নেল, মেজর একজন একজন করে সবাই ও তাদেরকে আপনার কোন পেনশন দিতে হতো না। এবার হিসেব করে দেখুন, আমার পায়ের দাম কতো। জেনারেলের বয়েস বাহান্ন বছর, কর্নেলের আটচল্লিশ আর মেজরের বয়েস হলো পঞ্চাশ। প্রত্যেকেই মাথা থেকে পা অবধি পুরোপুরি সুস্থ। আর সেনাবাহিনীর যে নিয়মকানুনের জীবন, হিনডেনবুর্গের মতো কমপক্ষে আশি বছর বাঁচবেন ওরা। এবার হিসেব করুন! মনে করুন গড়ে আরো তিরিশ বছর বাঁচবেন ওরা, তাহলে একশো ষাট গুন বারো গুন ত্রিশ, ঠিক আছে? এবার আমার পা ভয়ংকর দামী একটা পা হয়ে গেলনা। আমার কল্পনাক্ষমতার ভেতরে সবচেয়ে দামী পা। ঠিক বলিনি’?

‘আপানার মাথা খারাপ’! বললেন লোকটি।
‘না’! প্রতিবাদ করলাম আমি। ‘আমার মাথা খারাপ না। আপনার খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু আমি মনের দিক থেকে তেমনি সুস্থ, যেমনি মাথায়ও। দু:খের কথা এই যে, পা এর ঘটনাটি ঘটার দুই মিনিট আগে আমাকে গুলি করে মারা হলোনা। তাহলে অনেক টাকা বাঁচানো যেতো’।

‘আপনি কি চাকুরিটা নিচ্ছেন’? জিজ্ঞেস করলেন লোকটি।
‘না’, বলেই বেরিয়ে এলাম আমি।

(এই অনুবাদটি অন্য ব্লগে দিয়েছিলাম। কেউ কেউ হয়তো পড়েছেন। যারা পড়েননি, তাদের জন্যে এখানে দিলাম।)


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

ছো্ট্ট একটা মন্তব্য করি-- দুর্দান্ত অনুবাদ হয়েছে।

??? এর ছবি

হাইনরিশ ব্যোল পড়েছিলাম বাংলায়, মূল জার্মান থেকে অনুবাদ করেছিলেন ওপার বাংলার কেউ। গল্পটা পড়ে নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়-এর একটা গল্প ছিল কুকুর নিয়ে, মনে পড়ে গেল। অতি মনোরম গল্প, ভাল অনুবাদ।
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

চমৎকার লেগেছে!!!

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

ফারলিন এর ছবি

প্রান্জ্ঞল অনুবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।