বাখারাখের রাভি, মূল: হাইনরিখ হাইনে, জার্মান থেকে অনুবাদ: তীরন্দাজ

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: শুক্র, ১৪/০৩/২০০৮ - ১২:৫৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রাইন গাওয়ের নীচের অংশে নদীপারের সে বন্য, উদ্দাম ভাব আর নেই। সেখানে পাহাড়, বড় বড় পাথরের চাই আর দুর্গের ধংসস্তুপ, তাদেরই কোন এক হারিয়ে যাওয়া রহস্যময় উন্মাদনা নিয়ে আজও বিরাজমান। এসবের কাছাকাছি কোন এক অন্ধকারচ্ছন্ন এলাকায়, লোমহর্ষক উপাখ্যান এর মতো দাঁড়িয়ে প্রাচীন শহর বাখারাখ।

শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীর কিন্তু এক সময় এতোটা ভংগুর ও শ্যাওলা পড়া ছিলোনা। এখন এর অগুনতি ফাটলে বাতাসের শীশ বাজে, পাহাড়াস্তম্ভে ছোট ছোট পাখির অবাধ বিচরণ। ভাঙ্গা তোরণ দিয়ে যে গলি গুলো চোখে পড়ে, সেগুলো এখন নিতান্তই শ্রীহীন। এখন শুধুমাত্র শিশুদের চিৎকার ও মহিলাদের কুৎসিত ঝগড়াতেই এর নিস্তব্ধতা ভাঙ্গে। আগে এমন ছিলোনা। তখন প্রাচীরটা ছিলো তার অহংকার ও শক্তির, গলিগুলো ছিলো স্বাধীন ও মূক্ত জীবন, ক্ষমতা আর উজ্জলতা, আনন্দ ও কষ্ট, ভালোবাসা আর ঘৃনার স্বাক্ষর।

ওথানকার শাসনকর্তা থাকতেন উঁচু এক দুর্গে এবং তার পোষা ঈগলের মতোই তিনি মাঝেমাঝে নীচের দিকে তাকাতেন, কখনো- স্বেচ্ছায়, কখনো- যখন তাঁকে কেউ ডাকতো। ধর্মের কাজ চলতো অন্ধকারে ও সে ধর্মের উদ্দেশ্য ছিলো আত্মাকে আরো অন্ধকারচ্ছন্ন করা। শহরের বিভিন্ন সমাজের মধ্যে ছিলো ইহুদীদের ছোট্ট একটা সমাজ। তাদের কোন ক্ষমতা তো ছিলইনা বরং তারা ছিল সার্বিক নাগরিক অধিকার থেকে ক্রমশ:ই বঞ্চিত। রোমান শাসনের সময় থেকেই তারা বাখারাখে বসতি শুরু করে এবং পরে যখন ইহুদীদের উপর অত্যাচার বেশী তীব্র হয়, আরও অনেক বিতাড়িত ধর্মানুসারীদেরকে আশ্রয় দেয়।

সবচে’ বড় ইহুদী বিতারন শুরু হয় সেসময়ের যুদ্ধযাত্রার শুরুতে এবং ১৪০০ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে তা সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ধারন করে। তখনই প্লেগ আঘাত হানে মহামারী হয়ে। যদিও সেটা ছিল অন্যান্য বড় বিপর্যয়ের মতোই আরও একটা, কিন্তু সেজন্যেও দায়ী করা হতো ইহুদীদের। তারপর চাপানো হলো তাদের উপর, পুরো মধ্যযুগ থেকে গত শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত, কুৎসিত উপ্যাখ্যানের এর মতো শিশু হত্যার জঘন্য এক অপবাদ। তারা নাকি তাদের পাশা অনুষ্ঠানের সময় কোন এক খৃষ্টান শিশুকে ছুরিবিদ্ধ অবস্থায় রেখে দিয়ে অপেক্ষায় থাকতো, যতক্ষন না শিশুটির শরীর থেকে সমস্ত রক্ত নি:শ্বেষিত হতো। সে রক্ত নাকি ব্যবহার করা হতো তাদের নৈশকালীন উপাসনার জন্যে। ইহুদীরা, যারা ওদের ধর্ম, সম্পদ ও ঋণের খাতার কারনে ঘৃনিত ছিলো, এমনই একটা দিনে তাদের শত্রু দের পুরো হাতের মুঠোয়। শিশু হত্যা করা হয়েছে এমন একটা গুজবও তাদের ধ্বংস ও মৃত্যুর কারন হয়ে দাঁড়াতে পারতো। অনেক সময় শত্রুরা নিজেরাই কোন এক শিশুকে হত্যা করে ইহুদীদের বাড়ীতে লুকিয়ে রাখতো, পরে আক্রমন চালাতো সেই বাড়ীর প্রার্থনারত ইহুদীদের উপর, হত্যা করতো পরিবারের সবাইকে, লুঠ করতো সমস্ত ধন সম্পদ। সবচেয়ে অবাক ঘটনা ঘটতো মৃত শিশুটিকে নিয়ে। তাকে ধর্মীয়ভাবে পবিত্র ঘোষনা করা হতো ও গীর্জা থেকে কামান দাগানো হতো তার সম্মানে।

সেইন্ট ওর্য়েনার ছিলো তথাকথিত তেমনই এক পবিত্র মানব। তার সম্মানে তৈরী হয় জাঁকজমকপূর্ন এক তীর্থস্থান, যা এখন রাইন নদীর তীরে এক ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। তার গথিক নমুনার লম্বা, উচুঁ ধনুকের মতো বাকানো জানালা, সগর্বে দাড়ানো সুউচ্চ স্তম্ভ, পাথরের মনোরম কাজ, কোন এক সবুজ গ্রীষ্মকালীন দিনে যেকোনো পথিককে আকর্ষন করবে, যদি না তার উৎপত্তির ইতিহাস কারও জানা না থাকে। এধরনের তথাকথিত পবিত্রজনের জন্য ইহুদী নিধনের মধ্য দিয়ে আরও তিনটি চার্চের প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং তার একটি প্রতিষ্ঠিত বাখারাখে। কিন্তু তার পরের দুই শতাব্দী অবধি অজানা কোন এক কারনে ইহুদীরা এধরনের গণঘৃণা ও অত্যাচার থেকে মূক্ত থাকে যদিও একধরনের ভীতি ও শত্রুতা তাদেরকে সবসময়ই ঘিরে থাকতো।

কিন্তু বাইরের ঘৃনার চাপ তাদের উপর যতোই বাড়তো, ততোই আন্তরিক ও পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসী হতো তাদের সামগ্রিক সামাজিক জীবনযাত্রা। আরো গভীর হতো বাখারাখের ইহুদীদের ঈশ্বরের প্রতি ভয় ও ভক্তি। ঈশ্বরের প্রতি ক্রমবর্ধমান আনুগত্যের উদাহরণ হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন নিজেকে ওখানকার এক রাভি, যাকে রাভি আব্রাহাম বলে সবাই জানতো। রাভি আব্রাহাম যদিও বয়সে যুবক, তারপরও বিদ্বান হিসাবে তার খ্যাতি ছিলো বহুদূর অবধি বিস্তৃত। তার জন্ম এই শহরেই এবং তার বাবাও ছিলেন তারই মতো একজন রাভি। মৃত্যুকালে ছেলের প্রতি তার নির্দেশ ছিলো তারই পথ অনুসরন করা এবং বাখারাখ না ছাড়া, যদি না জীবনের প্রতি কোন হুমকি আসে। তার বাবা ছিলেন মানুষ হিসেবে দরিদ্র কিন্তু সবরকম শিক্ষায় শিক্ষিত। উত্তরাধিকারী হিসাবে ছেলের জন্য রেখে যান তার এই নির্দেশ ও দুস্প্রাপ্য বইপত্র সহ একটা আলমারী। তা সত্বেও রাভি আব্রাহাম ছিলেন একজন ধর্নাট্য ব্যাক্তি, বিবাহিত ছিলেন তার বাবার ভাতৃস্তম বন্ধুর একমাত্র কন্যার সাথে। তার শশুরের ছিলো একটা জুয়েলারীর ব্যবসা ও পরে রাভি আব্রাহাম নিজেই সেই সম্পত্তির উত্তারাধিকারী হন। মাঝে মাঝে সমাজে এমন কথাও ছড়িয়েছে যে তিনি আর্থিক কারণেই এ বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু সমাজের অনেক মহিলারাই এসব রটণার প্রতিবাদে পুরোনো কাহিনী জানতেন। তারা জানতেন, কেমন করে রাভি তার স্পেন ভ্রমনের আগেই সারার - যাকে সবাই সুন্দরী সারা হিসাবে জানতো, প্রেমে পড়ে ছিলেন। সারাকে সাত বছর রাভির স্পেন প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিলো।

স্পেনের কথা উঠলেই নিন্দুকরা আরেকটি গুজবে বাঁকা হাসতো। যদিও রাভি আব্রাহাম যথেষ্ঠ উচ্চাকাঙ্খা নিয়েই ইহুদী ধর্মের শিক্ষা নিয়েছেন, তারপরেও তার পাশাপাশি শিখেছেন খৃষ্ট ধর্মের নিয়মকানুন ও সর্বধর্মীয় মূক্তচিন্তা। এর পেছনে ছিলো স্পেনের ইহুদীরা, যাদের শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে অনেক উচুঁতে অবস্থান। কিন্তু নিন্দুকেরা নিজেরাই এই গুজবের সত্যতা সম্পর্কে সন্দিহান হলো, যখন তারা দেখতে পেলো স্পেন প্রত্যাবর্তনের পর রাভির পুরোপুরি সচ্ছ ও নিয়মানুবর্তিত জীবন। প্রত্যেকটা ধর্মীয় আচার বিচার পালন করতেন তিনি খুব সাবধানী নিষ্ঠার সাথে। প্রতি সোমবার ও বৃহ:স্পতিবার ছিলো তার উপাসনার দিন। শুধুমাত্র সাবাত বা অন্যান্য উৎসবের দিনগুলোতে তার জন্য মাংস ও মদ বরাদ্দ ছিলো। দিনগুলো কাটতো তার উপাসনা ও পড়াশোনায় ও ছাত্রদেরকে দেয়া ধর্মীয় শিক্ষায়। রাতে তার দৃষ্টি ছিলো আকাশের তারা বা সুন্দরী সারার চোখের দিকে। যদিও তাদের কোন সন্তান সন্ততি ছিলোনা, তারপরেও তাদের সময় ছিলো গতিশীল ও জীবনের উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত।

ইহুদী উপাসনালয়ের পাশে তার বাড়ীর সবচেয়ে বড় কামরাটা ছিলো তার সমাজের লোকদের ব্যবহারের জন্যে উন্মুক্ত। কোনরকম বাঁধাধরা নিয়ম ছাড়াই আসা যাওয়া ছিলো ওখানে সবার। কেউ হয়তো ওখানেই দ্রুত তার প্রার্থনার কাজ সারতো অথবা নতুন কোন ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারতো। কোন সমস্যায় সম্ভাব্য সমাধান খোঁজার জায়গা ছিলো ওখানেই। সাবাতের সকালে উপাসনালয়ে যখন সাপ্তাহিক ধর্মপাঠ চলতো, ওখানেই খেলাধুলা করতো বাচ্চারা। বিবাহ বা আন্তষ্টিক্রিয়ায় জমা হতো ওখানেই সবাই। মতপার্ধক্য ও তার সমাধান হতো ওখানেই, ওখানেই পেতো সবাই গরম চিমনির উষ্ণতা এবং ক্ষুধার্তরা সাজানো খাবার।

তাছাড়া রাভির পাশেপাশে থাকতো তাদের বিভিন্ন আত্মীয়স্বজন ও তাদের সন্তান সন্ততি, তার ও তার স্ত্রীর অনুসারীরা। এসব অনুসারী ও আত্মীয়রা রাভিকেই পরিবারের কর্তা হিসেবে জানতো ও আনুষ্ঠানিক দিনগুলোতে ওখানেই তাদের ভোজনপর্ব সারতো। এ ধরনের আত্মীয় স্বজন পরিবেশিত ভোজন উৎসব চলতো বিশেষ করে বছরের বিশেষ একটা দিনে। এ দিনেই পালন হতো তথাকথিত পাশা উতসব, যার সুন্দর ঐতিহ্যবাহী মূল্য অপরিসীম।

এমনই এক পাশা উৎসবের সান্ধ্যকালীন অংশে তাদের বাড়ীর সে বড় কামরায় বসে রাভি তার আত্মীয় পরিজন, ছাত্রছাত্রী ও অন্যান্য অতিথি পরিবেষ্টিত অবস্থায়। কামরাটা আজ সাধারণ অবস্থায় আসবাবপত্রে যতোটা ভরপুর থাকার কথা, তার চেয়ে কিছুটা কম। টেবিলে পাতা প্রায় মাটি পর্যন্ত লম্বা সোনালী ঝালর ঝোলানো রঙিন কাজ করা সিল্কের টেবিলক্লথ। তার উপর সাজানো এ উৎসবের ঐতিহ্যবাহী খাবার-দাবার সহ প্লেট ও উঁচু পানপাত্র। পানপাত্রের গায়ে আঁকা সৌন্দর্যের চিহ্ন হিসেবে ধর্মীয় নেতাদের প্রতিকৃতি। পুরুষদের পরনে কালো লম্বা কোট, কালো টুপি ও সাদা গলাবন্ধ। মেয়েদের পরনে সুন্দর ঝলমলে দামী স্কার্ট, গলায় সোনা ও মনিমূক্তাখচিত হার । রূপোর তৈরী সাবাতের বিশেষ বাতি থেকে ঝরছে যুবক ও বৃদ্ধদের সন্তুষ্ট চেহারার উপর ঐশ্বর্গিক আলো। মেরুন রংয়ের বালিশে সাজানো সবচেয়ে সুন্দর মখমলের সোফায় বসে আগাডে থেকে পড়ে পড়ে গাইছিলেন রাভি ও সম্মিলিত সবাই তার প্রত্যুত্তর করছিলো নির্দিষ্ট জায়গাগুলোতে। রাভির পরনেও উতসবের কালো পোষাক। তার অভিজাত গাম্ভীর্য আজ অন্যান্য দিনের চেয়েও কিছুটা নমনীয়। বাদামী দাড়ির ভিতর দিয়ে মূখে একধরনের মৃদু হাসি। গাঁথাগুলো পড়ার সময় একধরনের আত্মিক জ্ঞান ও অনুভবে আপ্লুত হচ্ছিলো তার চোখ দুটো। তার পাশে বসা একই সুন্দর সোফাতে সুন্দরী সারার আপ্লুত চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ তারই স্বামীর চোখের দিকে। মাঝেমাঝেই তার দৃষ্টি যেতো সামনের আগাডার দিকে। সোনা ও রেশমের সুন্দর কাপড় দিয়ে বাধানো এই পুস্তকটি। এটা তার দাদার সময়ে উত্তারাধিকার সূত্রে পাওয়া। ভেতরে ছিলো সুন্দর ও রঙিন ছবি, যেগুলো সে তার বালিকা বয়সে খুব মজা করেই দেখতো। ছবিগুলো প্রকাশ করতো ব্যাবিলনের অনেক টুকরো ঐতিহাসিক ঘটনা। কেমন করে আব্রাহাম তার বাবার পাথরের চাই কেমন করে হাতুরীর এক ঘায়ে দু টুকরা করলেন বা কেমন করে ফেরেশতারা মোসেস এর কাছে আসতেন, যখন মিজিকে হত্যা করলেন তিনি। কেমন জাকঁজমকভাবে ফারাও তার সিংহাসনে বসে থাকতেন যখন ব্যাঙগুলো তাকে টেবিলেও বিরক্ত করতো। কেমন করে তিনি ডুবে মরলেন যখন ঈশ্বরের কৃপা পেয়ে ইসরাঈলের শিশুরা সাবধানে লোহিত সাগরের উপর দিয়ে হেটে গেলো। কেমন করে ভেড়া, গরু ও মহিষ গুলো সিনাই পর্বতে দাঁড়িয়ে ছিলো। কেমন করে মহান রাজা ডেভিড হারফে বাজাতেন ও জেরুজালেম তার চূড়া ও গীর্জার মিনার সহ সূর্যের আলোতে উজ্জল হতো।

শুধুমাত্র দ্বিতীয় গ্লাসটি পূর্ণ করা হয়েছে, লোকজনের কথাবার্তা ও চেহারা যখন আরো বেশী উজ্জল, তখন রাভি একটা ইষ্টারের রুটি হাতে নিলেন ও আগাডে থেকে পড়লেন "দেখো, এটা হচ্ছে সেই খাদ্য যা আমাদের পিতা, পিতামহরা মিশরে গ্রহণ করেছেন। কেউ যদি ক্ষুধার্ত হয়ে থাকো, এসো খাও আমাদের সাথে। কারও যদি মনে কোন কষ্ট থাকে, তাহলে এসো ও আমাদের সাথে পাশা অনুষ্ঠানের আনন্দ উপভোগ করো। এ অনুষ্ঠান পালন করছি আমরা এ বছর এখানে, কিন্তু আগামী বছর পালন করবো ইসরাইলে। এবার পালন করছি কৃতদাস হিসেবে, কিন্তু আগামীতে করবো মুক্তমানুষ হিসেবে। ”

ঠিক সেই মুহুর্তে দরজা খুলে গেলো ও ঘরে ঢুকলো আকারে লম্বা চওড়া কিন্তু চেহারায় মলিন দু’জন লোক। ওদের পরনে ছিলো চওড়া ও লম্বা কোট। ওদের একজন বললো, "তোমাদের উপর ঈশ্বরের শান্তি বর্ষিত হোক! আমরা একই ধর্মের পর্যটক ও অনুমতি চাইছি পাশা অনুষ্ঠান তোমাদের সাথে পালন করার। ” রাভি দ্রুত আন্তরিকতায় বললেন, "তোমাদের উপরেও শান্তি বর্ষিত হোক। এসো, আসন গ্রহন করো আমার পাশে। ”

দুজন এসে একই টেবিলে বসলো ও রাভি আবার পাঠ শুরু করলেন। সম্মিলিত পাঠের সময় মাঝেমাঝে তিনি তার স্ত্রীর দিকে সকৌতুকে তাকাচ্ছিলেন। হয়তো সে কথাটি মনে করে, যখন কোন এক ইহুদী পরিবারপ্রধান এক সন্ধ্যায় নিজেকে রাজা মনে করে তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, ” আনন্দ করো রাণী আমার !”

সারা তার কথা মনোযোগে তার দিকে তাকিয়ে শুনছিলেন। হঠাৎ দেখলেন, তাঁর স্বামীর চেহারা কোন ভয়াবহ দৃষ্টির কারণে কেমন যেন বিকৃত হয়ে উঠলো। তাঁর ঠোট ও গাল থেকে সরে গেলো সমস্ত রক্ত। চোখদুটো যেন বরফের টুকরোর মতো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইলো গর্ত ছেড়ে। আবার পরমুহুর্তেই যেন তিনি কেমন করে আগের সেই সৌম্য ও আনন্দিতভাবে ফিরে গেলেন, তার ঠোট ও গালে যেন আবার রক্ত ফিরে এলো। তার চোখের দৃষ্টিতে যেন আরও বেশী প্রাণ ফিরে এলো কোন এক অদ্ভুত নতুন আনন্দে। সারা এতোটা ভয় পেলেন, যা জীবনে কখনো পাননি। একধরনের ভীতির শিহরন বয়ে গেলো তার ভিতরে। যতোটা না তার স্বামীর স্ববির ঘৃনাভরা দৃষ্টির কারণে তার চেয়ে বেশী তাঁর পরমুহুর্তের পরির্বতনে। রাভি তার কানের দুল এক কান থেকে অন্য কানে বদলা বদলি করছিলেন ও নিজের দাড়ি নিয়ে অযথাই নাড়াচাড়া করছিলেন। আগাডের কাহিনীতে মিশরীয় প্লেগের বর্ণনার সময়ে তর্জনী বারবার মদ ভর্তি গ্লাসে ডুবাতে হয় এবং পরে সেটা মাটিতে ছিটাতে হয়। তিনি সেই লাল মদ বাচ্চা মেয়েদের গায়ে ছিটাচ্ছিলেন। এ নিয়ে ওরা ওদের গলাবন্ধনী ময়লা হবার অভিযোগ করলো ও তাতে হাসাহাসিও হলো। তার স্বামীর এধরনের অদ্ভুত রসিকতা সারার জন্যে ক্রমশই রহস্য ও ভয়ের কারণ হয়ে দাড়ালো। একধরনের অজানা শংকায় কেপে উঠলেন তিনি। অথচ সামনে দেখতে পেলেন রঙিন আলোয় ঝলমলে এদিক সেদিক দুলন্ত মানুষগুলো। পাতলা পাশা রুটি খুঁটে খুঁটে খাচ্ছেন তারা, মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন, আলাপ করছেন একজন আরেকজনের সাথে,অথবা গান করছেন বেশ জোরেসোরেই। সবার ভিতর তিনি আনন্দই দেখতে পেলেন।

রাতের খাবারের সময় হলো। প্রত্যেকেই উঠে দাঁড়ালো হাত ধোয়ার জন্যে। সুন্দরী সারা সোনার মূর্তিখচিত রূপার পাত্র এগিয়ে দিচ্ছেন জল ঢালার জন্যে। যখনই তিনি রাভির কাছে আসলেন, রাভি অর্থপূর্ন তাকালেন দৃষ্টিতে তার দিকে ও বাইরে ইশারা করলেন। সুন্দরী সারা কোন বাক্য ব্যায় না করে অনুসরণ করলেন তার স্বামীকে। রাভি দ্রুত চেপে ধরলেন স্ত্রীর হাত ও প্রায় টেনে হিচড়ে নিয়ে গেলেন দ্রুত দরজার বাইরে ও তারপর রাইন নদীর পাশ ঘেষে যে বড়রাস্তাটা বিংগেনের দিকে গিয়েছে, সে রাস্তায়। সুন্দরী সারার ডানহাতে তখনও সে পাত্রটি ও বা’হাত রাভির হাতের মুঠোয়। সারা তাঁর স্বামীর হাতের কম্পন ও বরফের মতো শীতলতা টের পেলেও কোন কথা বলে অনুসরণ করলেন তাঁকে। হয়তো নিজস্ব অভ্যাসবশত:ই বা এমনও হতে পারে যে ভয়ে তাঁর মুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সনেক দূর্গের নীচের অংশে, লোরাখ এর উল্টো দিকে, নিদাররাইন গ্রামের কাছাকাছি একটা পাহাড়ের চুড়ো রাইন নদীর পাশ ঘেসে উপরে উঠেছে ধনুকের মতো। রাভি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে সে পাহাড়ে উঠলেন সন্তর্পনে এদিক ওদিক তাকিয়ে ও দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন আকাশের তারার দিকে। মৃত্যুভয়ে কম্পিত সারা তাঁর পাশে দাঁড়ালেন ও চাঁদের আলোয় স্বামীর বিবর্ণ মুখের দিকে তাকালেন। সে মুখের কম্পনে ছিল কষ্ট, ভীতি, দুর্ভাবনা ও ক্রোধ। কিন্তু যখন রাভি তাঁর হাত থেকে পাত্রটি ছিনিয়ে নিয়ে রাইন নদীতে ছুড়ে ফেললেন, তখন তিনি আর চুপ থাকতে পারলেন না ও স্বামীর পায়ে লুটিয়ে ঘটনার ব্যখ্যা জানতে চাইলেন। রাভি, কথা বলায় প্রায় অক্ষম, প্রথমে শুধুমাত্র তাঁর ঠোঁট দুঠো নাড়তে পারলেন। অবশেষে অনেক চেষ্টায় বললেন, “মৃত্যুদূত কি দেখতে পাচ্ছ তুমি ? সে এখন বাখারার উপর ঘুরছে। কিন্তু আমরা তার তরবারীর কবল থেকে পালাতে পেরেছি। ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ।“ কম্পিত কন্ঠে তিনি আরো বললেন, কতোটা আনন্দিত মনে তিনি আগাডা থেকে গান করছিলেন ও হঠাৎ করেই টেবিলের নীচের দিকে তাঁর চোখ যায়। দেখতে পান সেখানে এক শিশুর রক্তাক্ত মরদেহ। “ তখনই আমি বুঝলাম, আমাদের দু’জন নতুন অতিথি আমাদের সমাজের কেউ নয়। বরং এরা হচ্ছে সেই পিশাচ, যারা আমাদের বাড়ীতে এই মরদেহ পাচারের দ্বায়িত্বে ছিল, যাতে আমাদেরকে শিশু হত্যার অপবাদে লুন্ঠন, অত্যাচার ও নিধন করা যায়। ওদের এই অপকর্ম যে টের পেয়েছি, তা বুঝতে দিইনি। দিলে আমাদের সবার ধ্বংসকে ত্বরান্মিত করতাম। শুধুমাত্র এই চাতুর্যের কারণেই নিজেদেরকে রক্ষা করতে পেরেছি। ভয় পেয়োনা, আমাদের আত্মীয়রাও রক্ষা পেয়ে যাবেন। ওদের নজর আমার দিকেই ছিল। আমি ওদের হাত থেকে পালিয়েছি, ওরা এখন আমার সম্পদ ও সোনা রূপা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে। চল সারা, আমরা অন্য কোন দেশে চলে যাই এবং আমাদের সব দুর্ভাগ্যকে পেছনে ফেলেই। সেজন্যেই আমি আমাদের শেষ সম্পদ- রূপার পাত্রটি নদীতে ফেলে দিয়েছি। আমাদের পিতা-পিতামহদের ঈশ্বর নিশ্চয়ই আমাদের ছেড়ে যাবেন না। চল নীচে নামি। উইলহেলম্ তার ডিঙ্গি নিয়ে অপেক্ষা করছে। আমাদেরকে রাইন নদী বেয়ে উজানে পৌঁছে দেবে সে। “


মন্তব্য

রাকিব হাসনাত সুমন এর ছবি

একটু কঠিন লাগলো...এই যা...

তীরন্দাজ এর ছবি

মাঝে মাঝে কঠিন ছাড়া কোন উপায় থাকে না...!

**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

সুমন চৌধুরী এর ছবি

ভালো লাগলো বরাবরের মতো।



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

শাহীন হাসান এর ছবি

....................................
বনের বেঞ্চিতে ওম শান্তি!

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

সাইফ তাহসিন এর ছবি

অজানা ছিল কতকিছু, আরো কত কিছু জানার বাকি, এমন কিছু নিয়ে লিখার জন্যে ধন্যবাদ তীরুদা
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।