গতকাল এক জার্মান পত্রিকায় “ক্ষুধিতের বিপ্লব শুরু হতে আর দেরী নেই” শীর্ষক খবরটি পড়ে এই লেখাটি শুরু করছি। শিরোনামের পর এভাবে লেখা হয়েছে। “ইকুয়াডরের চাল, জার্মানীতে দই অথবা ফ্রান্সের রুটি, যাই হোক না কেন, সারা পৃথিবী জুড়ে খাদ্যদ্রব্যের দাম ক্রমাগত ও ভায়াবহ গতিতে বেড়ে চলেছে। কিন্তু সবচেয়ে বিপদে আছে গরীব রাষ্ট্রের গরীব নাগরিকরা। তাই বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সাহায্যসংস্থাগুলো দ্রুত বিশ্বব্যপী এই সমস্যার জন্যে বিশ্বোপযোগী সমাধান দাবী করছে।“
প্রকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবর্তন, জ্বালানী তেলের উর্ধমুখী দাম, চীন ও ভারতের নিজেদের বর্ধিত চাহিদা খাদ্যদ্রব্যের এর অবিরাম ও রেকর্ডপরিমাণ উর্ধগতিতে সবচেয়ে বেশী অবদান রেখেছে। হাইতিতে নুডলস এর দাম দ্বিগুন, মিশরে বেড়েছে রুটির ৩৫% ও ভোজ্যতেলের দাম ২৫% ।
পাশাপাশি দ্রুত উন্নতিশীল দেশগুলোতে, বিশেষ করে চীন ও ভারতে ভোজ্যপন্য ব্যাবহারের পরিমানও বেড়েছে অনেক। চীনে ১৯৮০ সাল থেকে মাথাপিছু মাংস খাওয়া বেড়েছে ১৫০ শতাংশ। সেখানে শুয়রের মাংসের দাম গতবছরে বেড়েছে ৫৮ শতাংশ।
এই অবধি পত্রিকার খবর ও তার সারাংশ। এসবের আলামত অনেকদিন যাবৎই চোখে পড়ছে। আমার স্ত্রী একটি কোম্পানীতে কাজ করে, যারা পাইকারী হারে চীন সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে জার্মানীতে অরগ্যানিক খাবারদাবার আমদানী করে। তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। গতবছর অবধিও চীন নিজ দেশের রপ্তানীকারকদের সাবসিডি দিয়ে উৎসাহিত করতো। ওদেরকে কোন ট্যক্স দিতে হতো না। এবছর সে সাবসিডি বন্ধ করেছে, নানা ধরণের ট্যক্স বসিয়ে পুরোনো রপ্তানীচুক্তিকে আরো বেশী কঠিন করতে চাইছে।
মোদ্দা কথা হচ্ছে এই যে, প্রতিটি দেশই এখন খাদ্যসংকটে ভুগছে। যাদের নেই, তারা তাদের ক্ষমতানুযায়ী আমদানী করে সে সংকট পূরণ করতে চাইছে, যাদের আছে, তারা তা রপ্তানী না করে সামনের দিনের জন্যে মজুদ রাখতে চাইছে। ফলে ধনী দেশের মানুষ কোনভাবে খেতে পারলেও, আমরা না খেয়ে বা আধপেটা থাকছি।
আমাদের দেশে চালের দাম এখন দ্বিগুনের চেয়েও বেশী। অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারন মানুষ। এই অবস্থাকে দুর্ভিক্ষ বলা যেতে পারে কি, এ নিয়ে বিতর্ক তৈরী হয়েছে। আমরা ভারত কে চালের দাম বাড়িয়েছে বলে অভিযুক্ত করি। এসব বিষয় ও তার কারণ নিয়ে একটু আলোকপাত করতে চাইছি। ভারতের দিকে আঙ্গুল তুলে ভারত বিদ্বেষীরা রাজনৈতিক উদ্দেস্য হাসিল করতে পারে বটে, তবে তাতে আসল সমস্যা ধারেকাছেও আসা হবে না। ভারত আমাদের কথা না ভেবে, তার নিজের নাগরিকদের কথাই ভাববে ও এটাই স্বাভাবিক। ভারত বিদ্বেষীরা ভারতের কাছে যা আশা করে, নিজেদের পরিমন্ডলে নিজেরাও তা পূরণ করতে সক্ষম নয়। এরা কোনদিনও নিজের সন্তানের পেটে আগে খাবার না দিয়ে অন্যকে সাহায্য করতে চাইবে না। আমি নিজেও তা করতে যাব না। তারপরও জানি যে, অন্যের আছে এধরণের দাবী বা প্রত্যাশার অধিকারও আমার নেই। ওরা তা জানে না, বা জানতে চায় না, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলই এদের কাছেই মুখ্য বলেই আঙ্গুল তুলে অন্যকে দোষারোপ করে। আমি ভারতপন্থীও, ভারতবিদ্বষীও নই, কারণ জানি, নিজেদের প্রয়োজনকে পাশ কাটিয়ে কেউ আমাদের জন্যে কিছুই করবে না ও এটাই স্বাভাবিক। কোন দেশই নিজের লাভ না দেখে অন্যের জন্যে কিছু করবে না। আমদের দেশ ধনী হলেও করতো না।
১) বাংলাদেশের বাজারদর নির্ধরিত হয় বড় ব্যাবসায়ী ও আড়তদারদের সিন্ডিকেটের হাতে। পাশাপাশি ব্যাবসায়িক সুবিধার আশায় এরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্বার্থও বহন করে। এরা জানে, তত্বাবধায়ক সরকার সাময়িক। এরা তাই সরবরাহ কমিয়ে বা বন্ধ করে দিয়ে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চাইছে।
২) সিডরের ক্ষতি।
৩) আন্তর্জাতিক খাদ্য পরিস্থিতি।
৪) সরকারের অযোগ্যতা।
এর পাশাপাশি আরেকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাইছি, যা আরো বেশী ভয়ংকর মনে হয়। ধনী ও উন্নত দেশগুলো ইদানীং “পরিবেশবাদের ধুয়ো তুলে” জৈব জ্বালানীর দিকে ঝুকছে। আলামত টের পাওয়া যাচ্ছে বেশ ভালভাবেই। জার্মানীতে যোগাযোগমন্ত্রী পেট্রোলে যাতে জৈব জ্বালানীর পরিমান ৫% এর বেশী না হয়, সে নির্দেশ দিয়েছেন। গরীব দেশের প্রতি অনুকম্পা তার কারণ নয়, কারণ কিছু পুরোনা মডেলের ইন্জিনের এই খাদ্য নাও হজম হতে পারে। অর্থাৎ জৈব জ্বালানী এখন আর পরিকল্পনা নয়, চরম বাস্তবতা। ৫% হলেও এখনই এখানকার গাড়ীতে মানুষের মুখের আহার কেড়ে জৈব জ্বালানী ঢোকানো হচ্ছে। বুশও গরীব রপ্তানীকারক দেশগুলোকে আখের চাষ করতে বাধ্য করাতে চাইছে, যাতে আমেরিকায় জ্বালনী তেলের অভাব না হয়।
সে সমস্ত দেশের সাধারণ চাষীদেরকে এ ধরণের চাষে বাধ্য করছে সে দেশের জমিদার শ্রেনীর ব্যাবসায়ীরা। অনেকটা আমাদের দেশে বৃটিশ ঔপনিবেশিক সময়ের কুখ্যাত “নীল চাষের” মতো। কী ভয়ংকর! মানুষের পেটের খাবার কেড়ে নিয়ে যন্ত্রের পেটে ঢোকানো! কিন্তু এটা সত্যি, সাইন্স ফিকশন বা বানোয়াট কোন কাহিনী হয়। আমাদের সত্যিই দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে এবার। এখন প্রবল চাপে নি:শ্বাস বন্ধ হতে বাকী।
কিন্তু করনীয় কি? আমার মতো চুনোপুটির কি বলার থাকতে পারে? শুধুই বলতে পারি আমাদের সমস্যার আরো কাছাকাছি আসার চেষ্টা করা উচিৎ। এখন তথাকথিত বিশ্বায়নের যুগে প্রতিবেশীর দিকে আঙ্গুল তুলে অভিসম্পাত বিদ্বেষ বাড়াতে পারবে বটে, কিন্তু লাভ হবেনা সামন্যও। যেখানে পৃথিবীর অনেক অংশে সীমানাই তুলে দেয়া হয়েছে, সেখানে আমরা প্রতিবেশীর সাথে বাস, ট্রেন যোগাযোগ বা করিডোর হলেই “সব নিয়ে গেল, মারলো রে, খাইল রে” বলে পাড়া মাত করি। পাড়া মাত করার দিন এখন শেষ। আমাদেরকে প্রসারিত দৃষ্টি নিয়ে আরো দুরে তাকাতে হবে। নিজেদের দেশে সাবধানতা, পরিকল্পনা কাজে লাগানোর পাশাপাশি দেশের বাইরেও আন্তর্জাতিক জনমত তৈরী করতে হবে। ইওরোপের সাধারণ মানুষের মাঝে অনেকে রয়েছেন তাদের সরকারে আগ্রাসী বানিজ্যক মনোভাবকে সমর্থন করেন না। তারা অনেকেই এখনই সোচ্চার। তাদের মাঝেও জনমত তৈরী করতে হবে, যাতে জৈব জ্বালানী উৎপাদন মানবিক কারণেই পুরো নিষিদ্ধ করা হয়। এরা বিশ্বায়ন বিশ্বায়ন বলে গলা ফাটায়, গরীব দেশগুলোর খাদ্য সমস্যাও যে বিশ্বায়নের একটি জরুরী অংশ, সেটা পরিস্কার বুঝিয়ে দিতে হবে বিশ্ববাসীকে। তা না হলে “ক্ষুধিতের বিপ্লব শুরু” করা না ছাড়া আর কোন পথ থাকবে না ক্ষুধিতের।
মন্তব্য
দুঃখের বিষয় যে একই জিনিস নিয়ে আমি অর্ধেকটা লিখে ফেলেছি। তা সেটা আমি নাহয় অন্য ব্লগে দিয়ে দেব।
যাহোক, আপনি যাই বলেন একমাত্র ওপেন ট্রেড ব্যাপারটার সমাধান করতে পারত। কিন্তু চিন আর ভারত আগেভাগে ঝাঁপ বন্ধ করে দেওয়ায় সমস্যাটা অনেকটাই বেড়ে গেছে। আমি তো ভারতের রপ্তানী বন্ধের পেছনে সামনের বছরের ভোট ছাড়া আর কোনো কারণ দেখছি না। লোকাল মার্কেটে চাল এখনও যথেষ্ট। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা দেখছেন যদি কোনোভাবে দাম একবার বেড়ে যায় তাহলে দাম কমানো খুবই কষ্টের। আর সেই বর্ধিত মূল্য নিশ্চয় জনগণ ব্যালট বক্সে ২০০৯ সালে চুকিয়ে দেবে ... সেজন্যই অতি সাবধানীর মত এই পদক্ষেপ।
আপনি বায়োডিসেল এর কথা লিখেছেন। আমিও পড়লাম এই একই কথা। কিন্তু বায়োডিসেল ঠিক কতটা ক্ষতি করছে উৎপাদনের সে বিষয়ে কোনো তথ্য আছে কি? আমি তো কোথাও পাচ্ছি না। ভারতে জাত্রোফা গাছ থেকে নিষ্কাশিত রস ডিসেলের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু এই গাছ এমন জায়গাতে জন্মায় যেখানে ধান হয় না। নিম্নমানের শস্য - যেমন বাজরা বা রাগির জায়গায় এই গাছ চাষ হচ্ছে। এতে একদিকে কিন্তু ভাল, কারণ এই অঞ্চলের চাষীদের আর কোনো অর্থকরী ফসল ফলানোর তো কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই চাষীদের লাভ ...
তাও বাংলাদেশের চাল উৎপাদনের পরিবেশ আছে, ইচ্ছা করলে আর একটু ভাগ্যের সহায়তা থাকলে পরের বছর সরকার নড়েচড়ে বসে ধান ভাল উৎপাদন করতেই পারে। সেক্ষেত্রে আর চাল আমদানী করতে হবে না। কিন্তু কি করবে যেখানে চাল আমদানী ছাড়া গতি নেই ... জর্ডন, তুরস্ক বা ফিলিপাইন্স?
---------------------------------
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
সেই পরিবেশটাও আস্তে আস্তে নাই হয়ে যাচ্ছে
দক্ষিণবঙ্গে ক্রমাগত চিংড়ির চাষ করে করে জমিগুলোকে প্রায় বন্ধ্যা কিংবা বিষাক্ত বানিয়ে ফেলা হয়েছে ফসলের জন্য
এখন অনেকের হাতেই টাকা আছে কিন্তু সেই টাকা দিযে কেনার মতো চাল নেই আশেপাশে কোথাও
আর বাংলাদেশের চিংড়ির বাজার এখন পড়তির দিকে। জমিগুলোও গেছে...
আমি লিখেছি বলে কি হয়েছে? আপনি আপনার লেখাটিও দিয়ে দিন এখানে। আলোচনার ক্ষেত্র আরো প্রসারিত হবে।
আমি বিষয়টিকে আরো বেশী আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখতে চাইছি। সারা পৃথিবী জুড়েই মজুদ রাখার একটি প্রবণতা চোখে পড়ছে। বড় বড় কোম্পানীগুলো অনেক লাভ সত্বেও খরচ কমানোর জন্যে লোক ছাটাই করছে। চীন, ভারত মজুদ থাকা সত্বেও রপ্তানী করতে চাইছে না। জানিনা এসব কিসের আলামত? সামনে কি বড় কোন বিপদ?
ভারতের বায়োডিজেলের কথা জানিনা। কিন্তু এটা যে একসময় গরীব দেশের জন্যে আরো বেশী ক্ষুধার কারণ হয়ে দাড়াবে, সে ভয় আমার রয়েছে।
আমাদের চালে স্বয়ংসম্পূর্ন হওয়া ছাড়া গতি নেই।
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
দেখুন আপনার বক্তব্যটা এক্কেবারে খাঁটি। কোল্ড ওয়ার পরবর্তী দুনিয়ায় সবাই নিজের স্বার্থটাই বেশী করে দেখছে। কমিউনিজমের "এক খামার" এর ধারণা যতই অবাস্তব হোক, একটা সময় অবধি অনেক দেশকে আদর্শের পথে রেখেছিল। এখন দেশ মজুদ করে পৃথিবী থেকে দাম শুষে নেবার জন্য, ছিয়াত্তর আর তেতাল্লিশের মন্বন্তরের মত গুদামে খাবার পচবে - ওদিকে লোকে না খেতে পেয়ে ঘটি-বাটি বেচে পয়সা দেবে। শুধু খাবারেই নয়, ওপেক একই ভাবে তেলের উৎপাদনও বাড়ায় নি।
---------------------------------
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
শুধুমাত্র চাল না, আমাদের অনেক কিছুতেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া জরুরী। তা না হলে ধনী দেশের হাতের ইশারাতেই চলতে হবে আমাদের।
তবে সামনে আরো বড় বিপদ আসছে, এটা সত্যি।
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
- খাঁটি কথা আরেকবার ...
---------------------------------
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
http://www.somewhereinblog.net/blog/dinmojurblog/28782895
লিংকটাতে ক্লিক করে দেখতে পারেন। জৈব জ্বালানী_র জ্বালা ভাল করে টের পাবেন।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
নতুন মন্তব্য করুন