কাঠফাটা রোদে দর দর করে ঘামতে ঘামতে বাড়ী ফিরলেন মাজেজুল আলম। রাস্তার ময়লা, মানুষ, ড্রেন, খানাখন্দ পেরিয়ে একটা পথ হাঁটতে দম বেরিয়ে যায়। তারপরও আসা যাওয়ার ভাড়া মিলিয়ে বাসভাড়ার সাত টাকা বাঁচানো এই দুর্দিনে খুব দরকার। বাড়ীর কাছাকাছি এসে আর পা চলতে চাইছিল না। কোনক্রমে টেনে হিঁচড়ে বাকী পথটুকু পার কললেন। দরদর করে ঘাম বেয়ে পড়ছে মাথা আর শরীর বেয়ে। বউ সামিনা বেগম একটি পাখা আর এক গ্লাস পানি নিয়ে দৌড়ে এলেন। পাখার বাতাসে একটু ঠান্ডা হয়ে পানিটুকু মুখে দিয়ে একটু দম ফিরে পেলেন মাজেজুল আলম।
- বাসে ভীড় ছিল বেশী? জানতে চাইলেন সামিনা।
- হ্যা! সংক্ষেপে উত্তর দিলেন মাজেজ।
- সেজন্যে দেরী হলো?
- হ্যা, একটা বাসে উঠতে পারিনি।
- এত কষ্ট! একটা রিকশা করে চলে আসতে?
কোন উত্তর দিলেন না মাজেজ। বুক ফেড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইছিল। সেটাও চেপে রাখলেন। দশ বছরের ছেলে মৃদুল আর মেয়ে সাত বছরের মালা একটু দুরে দাড়িয়ে বাবার দিকে তাকিয়েছিল। বাবার এই অবস্থা দেখে কাছে আসতেও সাহস পাচ্ছিল না। একটু সুস্থির হয়ে এদের দিকে ইশারা করতেই বাবার দিকে এগিয়ে এলো তারা। এই গরমের মাঝেও ওদের শরীরের উত্তাপে আত্মার ভেতরে এক শীতল শান্তি অনুভব করলেন মাজেজুল আলম।
খাবার ঘরে গিয়ে দেখেন, খাবার আগে থেকেই সাজিয়ে রেখেছেন সামিনা। পেটে জলন্ত ক্ষিদে। তাই দ্রুত মুখহাত ধুয়েই খেতে বসলেন।
খাবার মুখে তুলেই চেহারা বিকৃত করলেন মাজেজ। নুনে, ঝালে একাকার! সামিনা ঝাল ভালবাসলেও বাবা ও ছেলে মেয়ে কেউই ঝাল খেতে চায়না। তাই এবাড়ীতে কম ঝালেই রান্না হয় সচরাচর। আজ ও এমন করলো কেন? মেজাজ খারাপ করে মুখের দিকে তাকাতেই মুখ নামিয়ে ফেললেন সামিনা। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টিতে এমন কিছু দেখলেন, যে চুপ করে যেতে বাধ্য হলেন মাজেজ। রোজকারের চেয়ে প্রায় অর্ধেক ভাত খেয়ে হাত ধুয়ে উঠে গেলেন খাওয়া ছেড়ে।
রাতে ঘুমোতে গিয়ে মশারী তুলে বিছানায় ঢুকে দেখেন অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছেন সামিনা। ছেলে মেয়ে তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। খুব আস্তে, আদরে স্ত্রীর পিঠে হাত রাখলেন মাজেজ। শরীরটা কেঁপে উঠলো যেন। কাঁদছে কি সামিনা? স্ত্রীকে নিজের দিকে ঘোরাতে আকর্ষন করলেন মাজেজ। সামিনা কোন বাঁধা না দিয়ে ঘুরলেন স্বামীর দিকে। কিন্তু হাত দুঁটোয় চোখ ঢাকা। সামিনা কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
- সামিনা সোনা, সামিনা সোনা, তোমার কি হয়েছে? তোমার চোখে জল কেন? অতি আদরে স্ত্রীকে জড়িয়ে বললেন মাজেজ।
উত্তরে আরো জোরে কেঁদে উঠলেন সামিনা। কান্নার দমকে কেঁপে উঠল তার বাড়ন্ত শরীর। আবার আদরে সামিনা সোনা বলে ডেকে ডেকে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন মাজেজ। এতে মনে হলো কিছুটা শান্ত হলেন সামিনা।
- আজ তুমি ভাল করে খেতে পারোনি। নুন, ঝাল এতো বেশী ছিল! বলেই আবার কেঁদে উঠলেন সামিনা।
- তাতে কি হয়েছে? এজন্যে কি কেউ কাঁদে নাকি সামিনা সোনা, লক্ষী বউ আমার। কাল ঠিক করে রাঁধলেই তো হলো। বলেই স্ত্রীকে ঘন করে কাছে টানলেন মাজেজ।
কিন্তু শরীর শক্ত করে দুরেই রইলেন সামিনা। আবারও টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়লো চোখের কোল বেয়ে। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন,
- কালও রান্না এমনই হবে। নুন, ঝাল বেশী।
- কেন? একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন মাজেজে।
- ঘরে যথেষ্ট চাল নেই। মাস খরচের টাকাও শেষ। বাকী এক সপ্তাহ চলবে কি করে জানিনা। নুন, ঝাল বেশী দিলে ছেলেমেয়েরা আমরা সবাই একটু কম খাই। তাতে যদি এ সপ্তাহটা চলে!
বলেই আরো জোরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন সামিনা। ছেলে মেয়েরাও সে কান্না শুনে জেগে উঠলো। জড়িয়ে ধরলো মা কে । শুধুমাত্র নির্বাক মাজেজুল হক মশারীর ফাঁক দিয়ে উপরের কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মন্তব্য
এর চাইতে বড় বাস্তবতা বাংলাদেশে আর হ্য়না এখন!!
আমি সামিনার নুন ঝালের আধিক্য টের পাচ্ছি আমার জিভে!!
তারিক স্বপন
মাজেজুল হকের মতো আমিও নির্বাক হয়ে গেলাম। তাই শুধু রেটিং দিলাম।
---------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
খুশী হলাম খুব!ধন্যবাদ!
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
গল্প বলার ধরনটি আপনার চমত্কার। এই গল্পটিও বড়োই মর্মস্পর্শী। লিখতে থাকুন।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
কী যে করি! আবার ফোন করেছিল মাদাম ত্যুসোর মিউজিয়াম থেকে...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
২০০% সহমত।
আপনি নিজেও একজন খুবই ভাল লেখক! আপনার প্রশংসা পেয়ে অবশ্যই আনন্দিত।
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
খুব মর্মস্পর্শী হয়েছে গল্পটা।দারুন লাগলো তীরন্দাজ ভাই।জায়গামত তীর ছুড়েছেন।
--------------------------------------------------------
শেষ কথা যা হোলো না...বুঝে নিও নিছক কল্পনা...
---------------------------------------------------------------------------
কারও শেষ হয় নির্বাসনের জীবন । কারও হয় না । আমি কিন্তু পুষে রাখি দুঃসহ দেশহীনতা । মাঝে মাঝে শুধু কষ্টের কথা গুলো জড়ো করে কাউকে শোনাই, ভূমিকা ছাড়াই -- তসলিমা নাসরিন
দারুণ গল্প।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
খুবই ভালো লাগল, আর কষ্ট লাগল
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
ধন্যবাদ! আমাদের মাঝে অনেকেরই কষ্টের মাঝে দিন কাটে। মাঝে মাঝে একটু অনুভব করলে ক্ষতি কি?
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
কোনও ক্ষতি নাই । আপনি এরকম ভালো আরো লিখতে থাকেন
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
চমৎকার লাগলো অণুগল্পটা। সময়োপযোগী উপলব্ধি। দুর্ভিক্ষ না শুরু হয়ে যায় এদেশে। আমরা অবশ্য রাজার হালেই আছি। নিজেকেই মাঝে মাঝে ঘৃণা করতে ইচ্ছা হয়।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
অসাধারণ হয়ছে।
....................................
বনের বেঞ্চিতে ওম শান্তি!
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
কী নির্মম!
কিছুটা বিগত সময়েও মনে হতো এসব কেবলই ফিকশন, আর এখন সব বাস্তব হতে যাচ্ছে। আমরাই কুশীলব!
নাট্যকারেরা আড়ালে মুচকি হাসছে---
কষ্ট লাগলো।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
আহা-এমন করে যদি আমি লিখতে পারতাম।
কাহিনী এবং বলার ভংগীটি দুর্দান্ত। এ-প্লাস।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
ধন্যবাদ আপনাকে!
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
খুব ভালো লাগলো । আরো লিখুন ।
হায়.. এখন এটাই বাস্তব!
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
নতুন মন্তব্য করুন