প্রজাপতি উড়ছে। ঘরময়, এদিক সেদিক, হাওয়ার শরীর বেয়ে।। একবার বসলো ভাঙ্গা আয়নার সামনে পড়ে থাকা চিরুনীর গায়ে। তারপর সেখান থেকে উড়ে বসলো বিছানার উপরে সযত্নে শুইয়ে রাখা অনেক দিনের পুরানো পুতুলটির গায়ে। মতিমহলের আড়ং থেকে মেয়ের জন্যে কিনে এনেছিলেন বাবা। পুতুলটির মাথায়, মুখে, নিজের শরীরের নরম আদর জানিয়ে বারান্দায় উড়ে এলো প্রজাপতি। দাওয়ায় বনে আছেন বাবা শুন্য দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে। চৈতের খরদাহ। প্রকৃতি আগুনের লোলিহান শিখা হয়ে কোন এক বিধ্বংসী ধ্যনে মগ্ন। আর পাশের কামরায় এক কিশোরীর রোগাক্রান্ত ক্লিষ্ট চেহারা। এবার উড়ে উড়ে বাবার মাথায় বসলো প্রজাপতি। তক্ষুনি ঘর থেকে আলুথালু বেশে বেরিয়ে এলেন মা।
- ওগো, আমার মেয়েকে সুস্থ করে দাও, পায়ে পড়ি তোমার!
কোন উত্তর না দিয়ে শুন্যেদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন বাবা। বুকের ছাউনীর গহনে যে আগুন, চৈতের মাটিফাটা খরদাহ ও সে আগুনের কাছে ম্লান।
- একবার রহিম মোল্লার কাছে যাও, টাকা ধার নাও। মেয়েকে বাঁচাতে এটুকু করতে পারবে না? কেমন বাপ তুমি? বলেই আবার আচলে চোখ ঢাকলেন না।
- ওর কাছে চাইলে তো দেবেই। কিন্তু চড়া সুদ। আর ভিটেমাটি সব বন্ধক দিতে হবে। শোধ না করতে পারলে তো পথে বসবো ছেলেমেয়ে নিয়ে।
- তা বসলে বসবো। আগে আমার মেয়েকে বাচাও। শহরের হাসপাতালে ভর্তি করাও।
বলেই বাবার পায়ের উপর পড়লেন দু:খীনি মা। আদরের বউকে পায়ের কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে অসুস্থ মেয়ের বিছানার কাছে বসিয়ে ছাতাটি হাতে নিয়ে রহিম মোল্লার বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলেন বাবা। বাইরে তখন চৈতের আগুনঝরা রোদ। রহিম মোল্লা নতুন শিকারে রক্তের তাজা গন্ধ পেয়ে লোলুপ পিশাচ। ওদের মাঝে কি কথা হলো, তা জানতে পেল না প্রজাপতি। রহিম মোল্লার নি:চ্ছিদ্র পাহাড়া পেরিয়ে সেখানে প্রবেশের সাধ্য প্রজাপতিরও নেই।
একদিন এলেন বড় ডাক্তার। মেয়েকে শহরের বড় হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। দু’মাস হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে এলো মেয়ে। মায়ের মুখে হাসি ফুটলেও কোন এক অজানা শঙ্কায় মলেন সে হাসিতে বিষন্নতাই বেশী। প্রজাপতি আগের মতোই প্রতিদিন এদিক সেদিক উপর নীচ ঢেউ মতো উড়ে উড়ে অনেক ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে রইল।
ঘরময় উড়ছে প্রজাপতি। এখান থেকে সেখানে, বাতাসে দোল খেতে খেতে, ছন্দে ছন্দে। একবার উঁচুতে, আরেকবার অজানা ঢেউএর দোলায় একটু নীচুতে, বাতাসের শরীর ভালবেসে। প্রজাপতির পাখায়, শরীরে হাজারো রঙে সাজানো সপ্নের আঁকিবুকি। সে সপ্ন এক কিশোরীর আজন্ম লালিত তুলিতে আঁকা প্রতিদিনের সুরে গানে। প্রজাপতি উড়ে আলতো শরীরে বসল দু:খিনি মায়ের কাঁধে। তার কাধে হেলান দিয়ে বসে থাকা কিশোরীর চোখে স্ফটিকের মতো জল, কিন্তু বুকের ভেতরে আষাঢ়ের অঝোর কান্না।
- বাবাকে আরেকবার বুঝিয়ে থামাও মা!
মায়ের চোখেও কান্না, বিষাদের কালো নিচ্ছিদ্র দেয়ালে অক্ষমতার চিত্রকল্প। মেয়ের মুখের দিকে বিষাদ মোড়ানো দৃষ্টি রেখে আরো ব্যাথাতুর হলো মন।
- মা গো মা, কিছু বল মা! আবার অবুঝ আকুতি মেয়ের।
মা শাড়ীর আঁচলে চোখ মুছলেন। মেয়ের ঘন কালো এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন পরম মমতায়।
- তোর বাবার তো আর কোন পথ নেই মা।
- কেন নেই! রহিম মোল্লার সাথে বিয়ে কেন দিতে হবে?
- দিতে হবে মা! রহিম মোল্লা ধারের টাকা ফেরত চেয়েছে। বিয়ে না দিলে বাড়ীঘর সব নীলামে চড়াবে। তোদের সবাইকে নিয়ে তো পথে বসবো আমরা।
- এজন্যে তোমরা আমাকে এই বুড়ো বদমাসের সাথে বিয়ে দেবে?
মায়ের মুখে কোন উত্তর জোগালো না। টপ টপ করে অশ্রু ঝরে পড়লো মেয়ের মসৃণ কাঁধে। মায়ের কান্না দেখে এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো অভিমানী মেয়ে।
সানাই বাজছে বৃষ্টিধারার মতো। প্রজাপতি উড়ে নেচে বেড়াচ্ছে সে সানাইএর তালে তালে। রহিম মোল্লার মনের ভেতরের কুৎসিত আনন্দ তার শেরওয়ানীর চমক ছাপিয়ে পুরোনো, পঁচা তেলের মতো গলে পড়ছে এদিক সেদিক। গ্রামের মাতবর মোল্লাদের পানের পিকের দুর্গন্ধে বাতাসও শীসের মতো ভারী। এর মাঝে চলছে ধর্মকথা আর ধর্মলোচনা বাজারী বেশ্যার মতো। মাতবর মোল্লাদের ও তাদের চামচাদের ফোকলা দাঁতের অশ্লীল হাসিতে আলোও যেন তার শ্লীলতা হারিয়ে নগ্ন।
অশ্লীলতার এতো বেশী কাছাকাছি, তাই নি:শ্বাস ভারী হয়ে এলো প্রজাপতির। রংধনু রঙ্গে আঁকা পাখাগুলোর শরীরে জেকে বসলো কোন এক দাঁতালো শুয়োর। বেহালার করুন কান্না হাজারো দৈত্যের অট্টহাসি হয়ে একসময় স্তব্ধ হয়ে গেল। একসময় এলিয়ে পড়ল প্রজাপতি, নিথর হয়ে পড়ে রইল মাটিতে।
বিয়ের রাতেই তিন বউ থাকা সত্বেও প্রথমবারের মতো বিপত্নিক হলো রহিম মোল্লা।
মন্তব্য
বরাবরের মতোই দুর্দান্ত। গল্পের শেষে একটি বিশেষ মোচড় দিয়ে পাঠককে স্তম্ভিত করে দেয়ার ক্ষমতা আপনি অর্জন করে ফেলেছেন।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
নিজেকে জয় করার অর্থ বিজয় না পরাজয়?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
অনেক ধন্যবাদ সন্ন্যাসী!
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
আপনার গল্প আগে খুব একটা পড়া হয়নি। এটা পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আগেরগুলোও পড়তে হবে।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
পড়লে খুবই খুশী হবো।
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
কী আর বলব?
অন্যরকম ভালোলাগা আর কষ্টে মনটা ভরে গেল।
আপনাকে স্যালুট।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
আপনি তো ২টা গল্প লিখে ফেলেছেন!
শেষ লাইনটা বাদে ১টা; আর সেটা সহ আরেকটা!
অসাধারণ হয়েছে!
___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
দারুন! লেখার ধরণ খুবই সুন্দর, ভাষাও খুব বলিষ্ঠ। খুব ভালো লাগল।
অতন্দ্র প্রহরী
কষ্টময় এক বোধ তৈরী করে দিলেন বুকের ভেতরে।
চমৎকার !
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
বেজে গেলো পরাণের বেহালায় ।
একসময় এলিয়ে পড়ল প্রজাপতি, নিথর হয়ে পড়ে রইল মাটিতে।
.... প্রজাপতির মরণ হলে নিসর্গেরও কষ্ট হয় ...
অসাধারণ!
....................................
বনের বেঞ্চিতে ওম শান্তি!
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
অসম্ভব রকম ভাল গল্প!
জয়তু তীরুদা।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটি লাইনও নেই যা নিয়ে কোন কথা বলা যায়। জানা গল্প অনেক অনেক অসাধারণ করে লিখেছেন আপনি।
ক্যামেলিয়া আলম
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
- আরেকটা 'তীরুদা ডেলিক্যাসী'!
মোল্লা বাড়িতে যেখানে গ্রামের মাতবর আর কাঠমোল্লারা বসে ধর্মের কথা কপচাচ্ছে সেখানে সাঁনাই কিংবা বেহালার সুর একটু অবাঞ্ছিত মনে হয় আমার কাছে। কিন্তু-
সেটা হতে পারে প্রজাপতির হৃদয়ের ভেতরের কোনো জমে থাকা ক্ষোভ-কান্না!
সব ছাপিয়ে, গল্পে পাঠক হিসেবে মুগ্ধ এবং রেটিংএর শেষ পর্যায়ের ব্যবহার করে দিলাম।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
অনেক অনেক ধন্যবাদ ধুসর!
আসলে রহিম মোল্লার নাম রেখেছিলাম প্রথমে রহিম আখন্দ। পরে পাল্টে মোল্লা করেছি।
ওকে গ্রামের এক ধনী, চরিত্রহীন সুবিধাবাদী হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলাম। মোল্লা হিসেবে দেখাতে চাইনি, পরে নাম পরিবর্তন করে নিজই ধরা খেয়ে গেলাম।
আপনি সানাইকে রূপক হিসেবে দেখেছেন, এটাও ভাল। তাতে বাঁচিয়ে দিলেন আমাকে। ধন্যবাদ!
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
চরম!!
শেষে এসে একটা ধাক্কা মতন লাগলো।
---------------------------
থাকে শুধু অন্ধকার,মুখোমুখি বসিবার...
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
নতুন মন্তব্য করুন