অতল জলের আহব্বান, সূচনা: রোটা, স্পেন

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: রবি, ২৯/০৬/২০০৮ - ৭:৩৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জাহাজ এগিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ডানপাশে জিব্রাল্টার,বাঁয়ে আফ্রিকার উপকূল। তীরন্দাজ সেই জাহাজের এক খেটে খাওয়া নাবিক। আনদালুসিয়াআনদালুসিয়াদুপুর বারোটা থেকে বিকেল চারটে ও রাত বারোটা থেকে ভোর চারটে অবধি জাহাজের খোলে মেশিনরুমে ইন্জিনের গর্জন আর তেল কালিতে সময় বিবর্ণ। বিকেল পাঁচটা প্রায়। বেশ উত্তাল ভুমধ্যসাগর। আকাশ পরিস্কার, অথচ বাতাসের জোরালো তান্ডব। কিছুক্ষণের মাঝেই জিব্রালটার প্রণালী পেরিয়ে আটলান্টিকে পড়বে জাহাজ। তারপর বাঁদিকে ঘুরে আরো প্রায় কুড়ি দিনের পথ নাইজেরিয়া।

প্রনালীতে ঢুকেই পাহাড় সমান ঢেউয়ের কবলে পড়লাম। সামনে থেকে জাহাজের চেয়েও উঁচু উঁচু ঢেউ এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। ডেকের উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে আমাদেরকে ভিজিয়ে। কিছু আকড়ে না থাকলে জলের স্রোতে ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনা। ক্যাপ্টেনের নির্দেশ ডেক ছেড়ে ভেতরে চলে এলাম। সব দরজা, জানলা বন্ধ করে দেয়া হলো।আধ ঘন্টা এভাবে চলার পর, আটলান্টিকে পড়লাম আমরা। আটলান্টিক কি কারণে তখন এক নদীর মতো শান্ত।

অবর্ননীয় অনুভুতির স্পর্শ নিজের ভেতরে দুই পাশের দেশ দুটোর দিকে তাকিয়ে। বাঁয়ে আফ্রিকা ও ডানে জিব্রাল্টার পাহাড়। নিজে মাটির মানুষ, আর এখন মাসের পর মাস জলে ভাসতে ভাসতে প্রাণান্তকর অবস্থা। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, এখন নিজে জাহাজে। হয়তো কোনদিন সুযোগ আসবে জীবনে, তখন জিব্রালটারে স্থলে বসে জাহাজ দেখবো প্রণালীর ঢেউ কেটে পেরুতে। সেজন্যেই আমাদের এই স্পেন ভ্রমণ। ১৪ ই জুন মিউনিখ থেকে ইরেবিয়ার বিমানে চড়ে মাদ্রিদ, সেখানে দেড় ঘন্টা যাত্রাবিরতির পর মালাগা। মালাগায় গাড়ী ভাড়া করে রাখা আছে। দুই সপ্তাহের এই ভ্রমনে আমাদেরকে সঙ্গ দেবে এই গাড়ী। সেই গাড়ী নিয়ে মালাগা থেকে ২৬০ কিলোমিটার দূরের আটলান্টিকের তীরের শহর রোটায়। সমুদ্র থেকে দু মিনিট হাঁটা পথের দূরত্বে একটি বাংলো ভাড়া করা আছে। সেটাই হবে আমাদের দুসপ্তাহের আবাসস্থল। তারপর জিব্রালটারে আমার সপ্ন পূরণের পর দক্ষিন স্পেন ঘুরে ঘুরে দেখা, সুযোগ হলে জাহাজে চড়ে প্রনালী পেরিয়ে মরক্কোর শহর টাঙ্গাতেও বেড়ানোর একদিনের পরিকল্পনা রয়েছে।

সেভাবেই রওয়ানা হলাম আমরা। সময়মতোই এসে নামলাম মালাগা বিমান বন্দরে। কিন্তু যে দূর্ভোগে আমার এতোদিনের বিদেশ জীবন ও তার সাথে সম্পর্কিত বিমান ভ্রমণে কখনও পড়িনি, তাতেই আক্রান্ত হলাম। আমাদের স্যুটকেস এসে পৌঁছুল না মালাগায়। বাংলাদেশের ঢাকা বিমান বন্দরে স্যুটকেস বেল্টে যে অরাজকতা, তার মঝেও প্রতিবারই খুঁজে পেয়েছি নিজের মালামাল। মালাগাতে এসে এটাই ঘটলো। তবে ভরসা পেলাম এই ভেবে যে, আমরা একা নই, আমাদের মতো অনেকের কপালেই একই দূর্ভোগ ঘটেছে। অভিযোগ বুথে লম্বা লাইন পেরিয়ে জানানোর পর, ওরা জানালো বিকেলে আরেকটি ফ্লাইট আসছে মাদ্রিদ থেকে, ওটায় আসার সমূহ সম্ভাবনা। এলে পাঠিয়ে দেয়া হবে আমাদের ডেরাতে। দুটো ছোট হাতব্যাগ ছিল সাথে। সেগুলো সম্বল করেই মুখ চুন করে রওয়ানা হলাম রোটার দিকে। পকেট পিসিতে নেভিগেশানে স্পেন রাস্তাগুলো ইনসল্টল করে রেখেছিলাম আগেই। তার উপর ভরসা করে গাড়ী চালালাম। এর মাঝে আরেকটা সমস্যা দেখা দিল। আমাদের বাসস্থানের বাড়ীওয়ালা একটি ফোননম্বর দিয়েছিল ইমেইলে। রোটাতে পৌঁছেই তাকে ফোন করার কথা। সেই নম্বর ভুলে বাড়ীতে রেখে এসেছে বউ। এখন কি করি? ওর সাথে যোগাযোগ না হলে চাবিটি পাবো কোথায়?

নেভিগেশান আমাদের বিকেল ৬টায় সেই বাড়ীর সামনে এসে দাঁড় করালো। তিনতলায় তিনটি এপার্টমেন্ট পাশাপাশি। তার একটি আমাদের জন্যে নির্ধারিত। তিনটাতেই কলিং বেল বাজালাম। আশা, যে কোন একটির ভাড়াটের কাছে হয়তো বাড়ীওয়ালার ঠিকানা, বা টেলিফোন নম্বর পেতে পারি। কোথাও কোন মানুষের খবর নেই। মন খারাপ করে নেমে এলাম নিচে। মনে হলো, আজ রাতটি কোন হোটেলেই কাটাতে হবে। ক্লান্তি ও ক্ষিদেয় সমস্ত শরীর আচ্ছন্ন। লাগেজের বিড়ম্বনায় সময় সল্পতার কারণে, কোথায় খাবার সময়ও পাইনি। রাস্তাঘাট খালি। ইউরোপীয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়ানশীপ চলছে। আজ সুইডেনের সাথে স্পেনের খেলা। সবাই টেলিভিশনের সামনে হন্যে হয়ে। সেখানে আমাদের সাহায্য করবে কে? আর কে ই বা জানবে আমাদের বাড়ীওলার ঠিকানা। হঠাৎ দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বউ হাসিমুখে আলাপ করছে এক স্প্যানিশ মহিলার সাথে। আমিও দৌড়ে গেলাম। বাড়ীওয়ালার স্ত্রী রোজা আমাদের খোঁজে এসেছে। ধরে প্রাণ ফিরে এলো।

আজ ১৫.৬.২০০৮। বিকেল তিনটে। এখন অবধি মালামাল পাইনি। ইবেরিয়াতে ফোন করার পর জানালো, লাগেজ এসেছে মালাগাতে। আমাদের এখানে পাঠানো হবে দ্রূতই। কিন্তু ওদের কথার উপর ভরসা করতে পারছি না। একেকজন একেক কথা বলে। প্রয়োজনীয় পোষাকআসাকও নেই।

সকালের নাস্তার জন্যে সমুদ্রের তীরের এক রেষ্টুরেন্টে শুধুমাত্র কফি পেলাম। তাতেই কিছুটা সামাল দিয়ে আরেকটু শহরের দিকে এগিয়ে পেলাম আরেকটি রেষ্টুরেন্টে। সেখানে স্যান্ডউইচ ও কফিতে আরেকবার নাস্তা করা হলো। সামনেই বীচে যাবার প্রধান পথ। সেটা পেরিয়ে সবাই সমুদ্রের দিকে ছুটছে। সবার হাতে নীল সাদা স্ট্রাইপের ছাতা কারো কারো হাতে নীল সাদা ট্রাইপের ভাঁজ করা চেয়ার। সব ট্রাইপ নীল আর সাদা। পার্থক্য, কোন কোন স্ট্রাইপ চওড়া আর কোন কোন স্ট্রাইপ সরু। বেশ অবাক লাগলো।

এরই মাঝে রোটা শহর ও সমুদ্রতট ঘুরে দেখলাম। শনি ও রবিবার ছুটি থাকাতে সমুদ্রস্নান করতে অনেক লোকের ভীড় এখানে। সমুদ্রতট অবিশ্বাস্য সুন্দর। মিহি সাদা বালি চিকচিক করে চোখের সামনে, একটু লালচে ছোপ। এর উপর আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের ঢেউ। স্নানার্থীদের অনেক ভীড়। কেউ ঝাপাচ্ছে ঢেউ এর সাথে, কেউবা রোদ পোহাচ্ছে আরামে, কেউ বা সামনের রেষ্টুরেন্টে বসে আরামে চুমক দিচ্ছে কফির কাপে বা বিয়ারের গ্লাসে। বিচের চেহারা অনেকটা আমাদের বাংলাদেশের কক্সবাজারের কাছাকাছি। পরিবেশ বেশ ভাল। ভ্রমনেচ্ছুদের জন্যে বাঙলো সাজানো সমুদ্র পাড়ে। আশে পাশে সুন্দর সুন্দর ক্যাঁফে, সামুদ্রিক মাছের রেস্তেঁরা। বিভিন্ন মাছের মেনু। জবরজঙ ভাব নেই কোথাও। সাধারণ, কিন্তু রুচীশীল। এসব দেখে মালামাল নিয়ে ঝামেলার কষ্ট কাটাতে পেরেছি কিছুটা। নাতিশীতোষ্ন আবহাওয়া শান্তির প্রলেপ বোলাচ্ছে শরীরে।

বিকেল সাড়ে ছয়টার দিকে স্যুটকেসগুলো পেলাম। এক স্প্যানিশ ভদ্রলোক এসে পৌঁছে দিয়ে গেলেন বাড়ীতে। আমরা যেন হাতে চাঁদ পেলাম। অবশেষে পুরোনো কাপড়চোপড় পাল্টে নতুন কিছু পরা গেল। সামনে অনেক ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা। জিব্রাল্টার, সেবিলিয়া, কর্ডোবা, গ্রানাডা ও আশেপাশের বিভিন্ন শহর ও দর্শনীয় জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে। প্রতিটি অভিজ্ঞতা নিয়েই লিখব ভেবেই এই সূ্চনাটুকু করলাম।


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

চমৎকার ।
নাবিক জীবন নিয়ে আপনার একটা পুরনো লেখা ছিল । ঐ লেখাটা খুব প্রিয় আমার ।

সচলায়তনে আবার পোষ্ট করুন ।
নতুন পাঠকদের ভালো লাগবে ।
-------------------------------------
বালক জেনেছে কতোটা পথ গেলে ফেরার পথ নেই,
-ছিলো না কোন কালে;

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

তীরন্দাজ এর ছবি

ধন্যবাদ হাসান মোরশেদ!

গতাকাল মাত্র স্পেন থেকে ফিরে এলাম। এই ভ্রমনের অভিজ্ঞতা নিয়ে বেশ ক'টি লেখা দেবার ইচ্ছে আছে। সেগুলো শেষ করে নাবিক জীবনের লেখাগুলো দেবো।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

পুতুল এর ছবি

জব্বর হইছে সূচনা! শুভ তো ছবি আর বর্ণনা দেখে এখনই যাওয়ার জন্য লাফাচ্ছে!
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার ভ্রমণ শুভ হোক। অভিজ্ঞতার সাবলীল বর্ণনা পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।

~ ফেরারী ফেরদৌস

রায়হান আবীর এর ছবি

ভালো হইছে... চলুক

---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍জার্মানীবাসী আপনি যেদিন স্পেন ভ্রমণের বর্ণনা দিলেন, ঠিক সেদিনই জার্মানীকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হলো স্পেন! চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর?

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

তীরন্দাজ এর ছবি

জার্মান ফুটবল দলকে একেবারেই পছন্দ করি না। ওদের অতি বেশী অহংকার। স্পেনের জয়ে খুব খুশী হয়েছি। সে সময়টাতে স্পেনে থাকতে পারলে আরো খুশী হতাম।

সেমি ফাইনাল অবধি স্প্যানিশদের সাথে যথেষ্ট আনন্দ করেছি। ফাইনালে করতে পারলে আরো ভালো লাগতো।

আপনাকে ধন্যবাদ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

কীর্তিনাশা এর ছবি

অপেক্ষায় রইলাম।
----------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

কীর্তিনাশা এর ছবি

আমিও খুব খুশি হয়েছি স্পেন জেতায়। আপনার জমজমাট ভ্রমন কাহিনীর বাকিটুকুর অপেক্ষায় রইলাম।

--------------------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

তীরুদা... আপনি যে নাবিক তা জানতাম না... আমার ছোটবেলায় অসংখ্য কিছু হতে চাওয়ার ভেতরে নাবিকও ছিলো... সেই ইচ্ছার জোরে স্যালুট।
লেখাটা ভালো লাগছে... ঈর্ষাও... ঘুরাঘুরির ইচ্ছা আমার ব্যাপক... কিন্তু সাধ্য কম... আপনাদের লেখা পড়ে স্বাদ মেটাই...
ভালো থাকবেন... আপনার ভ্রমন আনন্দময় হউক...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তীরন্দাজ এর ছবি

নজরুল। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। অনেক আগে নাবিক ছিলাম এক বছরের জন্যে। অনেকটা সে স্মৃতিচারণের জন্যেই স্পেন যাত্রা।

ভ্রমন শেষে ফিরে এসেছি আপন ডেরায়। লেখাগুলো একটি একটি করে দিচ্ছি।

ঘুরাঘুরির পেছেনেই ব্যায় করেছি সব। সেজন্যে পার্থিব কিছুই করে উঠতে পারিনি। ভাল থাকবেন। কামনা করি, একদিন আপনিও আপনার ঘুরাঘুরির সাধ পূরণ করতে পারবেন। ভাল থাকবেন।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

নজমুল আলবাব এর ছবি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।