সিরিজের অন্য লেখার লিংক:
অতল জলের আহব্বান
জিব্রালটার
তানজিয়ার্স, মরক্কো
নদীর জল বাংলাদেশের নদীর জলের মতোই ঘোলা। শহরের বুক চিড়ে বয়ে চলেছে। তারই দুইপাশে গড়ে ইঠেছে কর্ডোবা। শহরের পুরোনো এলাকায় নদীর এপার ওপার যোগাযোগের জন্যে রয়েছে রোমানদের তৈরী পুরোনো একটি সেতু।গাড়ী চলাচলের জন্যে বন্ধ, শুধুমাত্র হাঁটাপথেই এপার ওপার সম্ভব।
আমরা যেখানে গাড়ী পার্ক করলাম, সেখান থেকে হেঁটে সেতুর কাছে পৌঁছলাম। প্রচন্ড গরম, পয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ ডিগ্রীর মতো হবে। মনে হয় যেন গরমে পুড়ছে শরীরের চামড়া। তারপরও বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কম থাকায় সে গরম বাংলাদেশের গরমের চেয়ে অনেক সহনীয়।
সেতুর গোডাতেই একটি মিউজিয়াম।কর্ডোবার ইসলামী ঐতিহ্যকে দর্শনার্থীদের কাছে তুলের ধরার জন্যে মিউজিয়ামের বিভিন্ন ছোট ছোট ঘরে বিভিন্ন প্রাচীন নিদর্শন, ছবি ও মডেল ও মুর্তি সাজিয়ে রাখা হয়েছে।প্রত্যেককেই একটি করে ইয়ারয়োন দেয়া হয়েছে। প্রতিটি ঘরে ঢুকে বোতাম টিপলেই পছন্দসই ভাষায় সে ঘরের বিষয়বস্তুর বর্ণনা শোনা যায়। সেই সাথে ইসলামের বিভিন্ন দিক। ইসলাম সম্পর্কে এত সুন্দর, শান্তির দিক নির্দেশনা, আধ্যাতিক বর্ণনা আর কোথাও শুনেছি কিনা, মনে পড়লো না। যে ইসলামের নিদর্শন, যে আধ্যাতিকতা ও বৈজ্ঞানিক প্রগতির শিখরে উঠেছিল সে সময়ের কর্ডোবা, তথা স্পেন, তা ভাবলে এই প্রশংসা ও স্তুতি সে সময়ের মুসলিম শাসকদের যথাযোগ্যভাবেই প্রাপ্য।
নদীর ওপারে গড়ে উঠেছে পুরোনো কর্ডোবা। সবার উপরে মাথা উচু করে আছে আলজামা মসজিদের মিনার। এখন সেখানে আজানের বদলে ক্যথিড্রালের ঘন্টা বাজে। এই আলজামা মসজিদ ক্যথিড্রাল দেখার জন্যেই প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ভীড় জমায় কর্ডোবায়।
খলিফা আমির আবদুর রহমান ৭৮৫ খ্রীষ্টাব্দে এই মসজিদের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন। তারপর আরো বিভিন্ন খলিফার খেলাফতের আমলে একে কলেবরে আরো বৃদ্ধি করা হয়। পশ্চিমের ইউরোপের এ খেলাফতের সাথে পুবের বাগদাদের খেলাফতের এক প্রতিযোগিতা এই মসজিদকে বারবার বাড়ানোর কারণ হিসেবে ধরা হয়। ভেতরে ঢোকার পরপরই ভেতরের আলো আঁধারের খেলার সাথে অভ্যস্ত করে নিতে হয় চোখ। যখন মসজিদ হিসেবে এই বিশাল সৃষ্টিকর্ম ব্যবহার করা হতো, তখন ভেতরে আলো ঢোকার বিশেষ ব্যাবস্থা ছিল। স্পেনকে মুসলমানের কাছ থেকে পূনরুদ্ধারের পর যেসব খ্রীষ্টান জমিদাররের পরিবাররা সহায়তা করেছিল এই যুদ্ধে, তাদের সন্মানে মসজিদের ভেতরে চারপাশে ব্যাক্তিগত উপাসনালয় স্থাপন করা হয়।তাতে আলো ঢোকার ব্যবস্থাটি ব্যাহত হয়।
১৬০০ শতাব্দীতে রাজা দ্বিতীয় কার্ল এই মসজিদের মাঝামাঝি এলাকায় ক্যথিড্রাল তৈরী করার আদেশ দেন। কর্ডোবাবাসী ও শহরের বিশিষ্ট লোকদের প্রতিবাদ কোন কাজে আসে নি। ক্যথিড্রাল তৈরীর কাজ শেষ হবার পর পরিদর্শনে এসে রাজা নিজেই বলেন, এখানে এমন একটি স্থাপনা গড়া হলো, যা যে কোন স্থানেই গড়া সম্ভব। কিন্তু তার বিনিময়ে ধ্বংস করা হলো এমনি এক অনন্য অসাধারন স্থাপত্যশিল্প, যার সৃষ্টি একবারই সম্ভব হয়েছিল।
মুসলমান শাসনের সময়টকে কর্ডোবার স্বর্ণযুগ হিসেবে আখ্যা দেয়া যেতে পারে। শুধমাত্র ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক সাফল্যের ক্ষেত্রেই নয়, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসাশাস্ত্রেও এগিয়ে যায় এই শহর। সেচের ব্যবস্থা বৈপ্লবিক উন্নতি সাধন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও মূল্যবান বইপত্রের পাঠাগার তৈরী করা হয়। ছাত্রদের বিনাবেতনে পড়শোনার বন্দোবস্ত করা হয়।সে সময় এক মিলিয়ন অধিবাসীর শহর কর্ডোরা পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহর।
এই স্বর্ণযুগের ধ্বংসও ঘটে মুসলমানদের নিজেদের কলহবিবাদের কারণে। চরমপন্থীর দল ১০১০ সালে কর্ডোবার কাছের শহর মেদিনা। নিজেদের মাঝে বিবাদ গৃহযুদ্ধের আকার নিলে, ১০১৩ সালে পতন ঘটে কর্ডোবার। পাশের শহর সেবিলার কাছে এই শহরের অবস্থান দূর্বল হয়ে পড়ে। ১২৩৩ সালে দ্বিতীয় ফার্ডিনান্ড কর্ডোবাকে খ্রীষ্টানদের জন্যে দখল করে নেন। একে কেন্দ্র হিসেবে ব্যাবহার করেই পরে স্পেনের বাকী শহরগুলোও খ্রীষ্টানদের দখলে নিয়ে আসা হয়।
মন্তব্য
হায়রে কলহ...ছবিগুলা দুর্দান্ত লাগলো। সাথে ইতিহাসটাও। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল
আপনাকেও ধন্যবাদ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
অনেক কিছু জানলাম।ছবিগুলো অনেক স্পস্ট ছিল। ভাল লাগলো...
এই আপাত সরল ইতিহাসের প্রচারক কারা? কোন পক্ষ? এইসব জানতে সাধ হইতেছে... স্পেনে মুসলমানদের ইতিহাস কি এতটাই সরল ছিলো আসলে? নাকি পর্যটকদের মনোরঞ্জনে ইতিহাসের এই সরলীকরন? বই পত্র ঘাঁটতে পারলে ভালো হইতো... কিন্তু বাড়ি বদলের পরে এখনো বইগুলা গোছানো হয় নাই... সিরিজ চলুক... একসময় হয়তো কিছু প্রশ্ন তৈরি করতে পারবো...
ধন্যবাদ...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নজরুল, মুসলিমরা তো দখলদারী শক্তি ছিল স্পেনে। সুতরাং খুজলে ওদের নেতিবাচক কর্মকান্ডেরও অনেক প্রমাণ পাওয়া যাবে নি:সন্দেহে।
আমি একটি ভ্রমন কাহিনীর জন্যে যতটুকু ইতিহাস দরকার, তাতেই অলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। তবে তারা যে মধ্যযুগের খ্রীষ্টান শাসকদের চেয়ে সফল ও সুশাসক ছিল, তা প্রমাণিতভাবেই সত্য।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
আমি সেই কথাই বলতেছিলাম... আপনি তো ইতিহাস লেখতেছেন না... লিখতেছেন ভ্রমন... আপনার কথা এক্কেবারে ঠিকাছে... কিন্তু আমি জানতে চাইতেছিলাম... আপনার বর্ণিত ইতিহাস কি তারা সরকারীভাবে প্রচার করতেছে কি না? নাকি সোর্স ভিন্ন?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
মানুষের ইতিহাস খুব সুখের নয়। অথচ মানুষের মাথায় এত্ত সুন্দর সৃষ্টিও আছে! শেষের ছবিটা আর একটু ক্লোজাপ করতে পারলে ভাল হতো।
মুসলিম ধনীরা এখন পশ্চিমি আর্কিটেক্ট দিয়ে প্রসাদ বানায়! কোথায় গেল সেদিনের মুসলিমরা!
অদ্ভূত সুন্দর! ইতিহাস, বর্ণনা, ছবি সব মিলিয়ে অনবদ্য।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
পুতুল। আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ। গ্রানাডার আল হামরার ছবিগুলো একটু ক্লোজআপ করে দেওয়ার চেষ্টা করবো।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
ইতিহাস জিনিসটা বরাবরই প্রিয়। সিরিজের মত হলে আসলেই ভাল হয়। হায়রে কত কিছুই যে জানি না । কি কি জানি না এইটাও জানি না। ভাল লাগলো।
দৃশা
গ্রানাডাতে পড়তে যাচ্ছি। গ্রানাডাতে গেলে প্লিজ লিখবেন।
গ্রানাডাতেও গিয়েছিলাম। আল হামরা নিয়ে অবশ্যই লিখবো, খুব তাড়াতাড়িই। আপনার গ্রানাডা যাত্রার জন্যে শুভকামনা রইলো।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
আল হামরা তে ভার্চুয়াল ট্যুর দিয়েছি, কিন্তু মনটা ভরল না।
আপনার লেখা দিয়া মন ভরবে আশা রাখি।
লেখাটা কেমন সংক্ষিপ্ত সংক্ষিপ্ত মনে হলো কেনো? আমি তো কখনো কর্ডোবা যাইনি। তবু এইরকম মনে হবে কেনো? নাকি ভালো লেখার এইই গুণ যে তা পড়া শেষেও শেষ হয় না?
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
ধন্যবাদ! সময়াভাবে নিজেই হয়তো সংক্ষিপ্ত করে ফেললাম!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
দারুন লাগল লেখা আর ছবি, তীরুদা সিরিজ করেন
-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
ধন্যবাদ! আপনার পরামর্শমতো সিরিজ করার জন্যে আগের লেখাগুলোর লিংকও দিয়ে দিলাম।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
মনমাতানো ছবির টানেই সিরিজটাতে চোখ বুলাই। কিন্তু বর্ণনা পুরোপুরি পড়ি নাই বলে মন্তব্য করা হয় না।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
ধন্যবাদ তীরুদা। ছবি গুলো ভালো লাগলো। আর লেখা সে তো আগে থেকেই অনবদ্য। চলুক...................
------------------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
ভ্রমন তো আমরা অনেকেই করি । কিন্তু আপনি অন্য রকম পর্যটক । ভ্রমন করেন ও করান ।
ভালো থাকবেন ভাই ।
---------------------------------------------------------
পৃথিবীর সব সীমান্ত আমায় বিরক্ত করে। আমার বিশ্রী লাগে যে, আমি কিছুই জানিনা...
---------------------------------------------------------------------------
কারও শেষ হয় নির্বাসনের জীবন । কারও হয় না । আমি কিন্তু পুষে রাখি দুঃসহ দেশহীনতা । মাঝে মাঝে শুধু কষ্টের কথা গুলো জড়ো করে কাউকে শোনাই, ভূমিকা ছাড়াই -- তসলিমা নাসরিন
তীরন্দাজ, আপনার লেখাগুলো ভাল-লাগছে ....
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
ভাল লাগলো আপনার সংক্ষিপ্ত ট্রাভেলগ। পরেরটায় স্থানীয় লোকজনের ভাবনাগুলো পেলে আনন্দটা বাড়বে।
কর্ডোভা-র ইতিহাস রক্তেরও ইতিহাস। মুসলিম পরাজয়ের সঙ্গে এখানে নেমে আসে বিরাট হত্যাযজ্ঞ। একদিক থেকে ইউরোপে রেঁনেসার বীজ বয়ে আনে কিন্তু আরব থেকে বিতাড়িত মুসলিমরাই। তারা ইতালির দ্বীপগুলোতে স্কুল খোলে আর স্পেনে নিয়ে আসে উন্নত নাগরিক জীবন।
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
অনেক ধন্যবাদ ওয়াসিফ। মনে হচ্ছে একটু বেশী সংক্ষিপ্তই করে ফেললাম।
স্থানীয় লোকদের ভাবনা নিয়ে কিছু বলা বেশ কঠিন। স্প্যানিশ ভাষাটিই তো জানিনা। তবে উত্তরের থেকে দক্ষিনের লোকজন মানসিকভাবে খোলামেলা হয়, তা টের পাওয়া যায়।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
নতুন মন্তব্য করুন