সপ্নপূরীর গোপন রাজ্য: আলহামরা, গ্রানাডা, স্পেন

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: রবি, ১৩/০৭/২০০৮ - ৪:৪১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এই সিরিজের বাকী লিংক:

অতল জলের আহব্বান
জিব্রালটার
তানজিয়ার্স, মরক্কো
কর্ডোবা
আলহামরা প্রাসাদের ভেতরের প্রথম ঘরটার ভেতরে এসে যখন দাঁড়ালাম, বাকরুদ্ধ হওয়া ছাড়া কোন পথ রইল না। জাগতিক সীমারেখার বাইরে যে রূপ, যে রূপের অবস্থান কোন এক সপ্নপূরীর গোপন কোঠরে, তার সামনে আমার মতো অতি সাধারণের বাকরুদ্ধ হওয়া ছাড়া আর কি পথ থাকতে পারে? মনে হলো ঐশ্বরিক কোন আশীর্বাদের প্রভাবে গোপন কোন তালা খুলে প্রবেশ করেছি কোন এক নিষিদ্ধ স্বর্গে। এমন হয়েছিল আমার ভেনিসে যাবার পর, তাজমহল দেখার পর। এবার গ্রানাডায় আল হামরা প্রাসাদের প্রবেশের পরও তার কোন অন্যথা হলো না। সীমাহীন সৌন্দর্য, যা চোখ ধাঁধায় না, বরং এক নিবিড়তার বাঁধনে আবদ্ধ করে। এতো নিপূন, সুচারু শিল্পকর্ম, যা জাকজমকে ভারগ্রস্থ করে না, বরং এক অবর্ণনীয় মমতার বাঁধনে আবদ্ধ করে দশর্ককে। এমনটি আর কোথাও দেখিনি। হয়তো পৈত্রিক সুত্রে প্রাপ্ত নিজের ধর্ম, যা পালন করি বললে বাড়াবাড়ি বলা হবে, সেই মমতার লুকোনো কারণ হতে পারে। কিন্তু যে বিস্ময়, যে মমতা আমি অন্য ধর্মীয় দর্শকদের চোখে মুখে দেখেছি, তা ভুলি কি করে? পাশাপাশি কষ্ট আর বেদনাও অনুভব করেছি বুকের ভেতরে। যে মুসলিমদের শিল্পকর্ম দেখার জন্যে এখানে এসে ভীড় জমায় হাজার হাজার মানুষ, বিশ্বের মানচিত্র ও রাজনীতিতে তারা আজ এতোটা কোনঠাসা। স্পেনে মুসলমানরা শুধুমাত্র প্রাসাদ, দূর্গ আর শিল্পকর্মই রেখে যায়নি, রেখে গেছে আধ্যাতিকতার এর নিদারূন নিদর্শন। সব ধর্মের মানুষেরই পাশাপাশি বাসে কোন সমস্যা দেখেনি মুসলিম শাসক। তারপরও নিজেদের ভেতরের বিবিদের কারণেই তাদেরকে স্পেন থেকে বিদায় নিতে হলো। „দখলদারীদের রাজত্ব যতো সুখেরই হোক না কেন, বেশীদিন টিকে থাকে না“, এটা হয়তো এ বক্তব্যেরই প্রমাণ।

১০৩১ সালে মুসলিমদের একটি দল, যাদেরকে বেরবেন বলা হতো, তাদের নেতা জাবি ইবনে সিরি, কর্ডোবায় মুসলিম খেলাফতকে নি:শ্চিহ্ন করে শহরটি দখল করে নেন। আশেপাশের আরো কিছু বড়বড় শহর দখল করে তারা নিজেদের সম্রাজ্য বিস্তারিত করে। ১২২১ সালে সে সময়ে শাসক ইবন্ আল আহমদ, যিনি আল হামার (লাল) বলে পরিচিত, তার রাজধানী জেন থেকে গ্রানাডায় সরিয়ে এনে সেখানে তার রাজপ্রাসাদ স্থাপন করেন। ইবন্ আল আহমেদ ও তার উত্তরসুরীদের রাজত্বের সময়কে „নাসরিদিয় খেলাফত” বলা হয়। তাঁর নির্দেশেই পাহাড়ের গায়ে আলহামরা প্রাসাদ ও দুর্গ, শহর, শিক্ষালয়, প্রশাসনিক ভবন তৈরীর কাজ শুরু করা হয়। শহর ও শহরের প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা, দুর্গের কাজ শেষ হয় ১৪০০ শতাব্দীতে।শহরের সুবিধার জন্যে খলিফাদের প্রাসাদ আলহামরার কাছকাছি প্রশাসনিক ভবনগুলোকেও সরিয়ে আনা হয়। ১৪৯২ অবধি বিস্তারিত ছিল তাদের রাজত্বকাল। তারপর ক্যাথলিকদের আক্রমনে নিজেদের সামরিক দূর্বলতাকে স্বীকার করে বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেন তখনকার খলিফা। সে কারণেই হয়তো এই সসময়েও অমুল্য স্থাপত্য শিল্প অক্ষত থাকে। পরবর্তী ক্যাথলিক রাজারাও আলহামরা প্রাসাদের পাশেই তাদের নিজস্ব প্রাসাদ স্থাপন করে সেখানেই বাস ও রাজত্ব করেন। সেকারণে দুর্গ ও অন্যান্য ভবনগুলো বিভিন্নভাবে ধ্বংস হলেও প্রাসাদটি অক্ষত থেকে যায়।

আলহামরা স্থাপনের কাজ একবারে শেষ করা হয়নি। তিনশো বছর ধরে বিভিন্ন পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মাঝে এই হৃদয়গ্রাহী সাজে সাজানো হয় একে। একে শুধুমাত্র একটি প্রাসাদ বললে খুব কম বলা হবে। আলহামরায় আলো, আঁধার, বাতাস, জল, নির্জনতার এক সুষম ও শৈল্পিক মিলনমেলার এক পরিপূর্ন জগত সাজানো হয়েছে প্রাসাদের প্রতিটি ঘরে ঘরে। প্রতিটি ঘরে ঘরেই মর্মরের অতি সুক্ষ কাজ, আর এর মাঝে আধো আলো, আধো আঁধারের খেলা, বাইরে ফুল, গাছ, ফোয়ারা, রোদ আর ছায়া নিজের শরীরে স্পর্শ আর অনুভূতির মতোই জীবন্ত। আলহামরা মানব জগতের আত্মিক শৈল্পিক মননের জাগতিক উদাহরণ।



মন্তব্য

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

দারুন
অসাধারণ ...
যখন চোট ছিলাম তখন টিভিতে গ্রানাডার উপর একটা সিরিয়াল দেখাতো। তখন থেকেই সুপ্ত বাসনা স্পেনে একবার বেড়াতে যেতেই হবে। এসব মুসলিম ঐতিহ্য দেখে আসতেই হবে। ঘুমন্ত সেই বাসনা আবার প্রবলভাবে জেগে উঠল আপনার লেখা পড়ে।
নাহ্‌, এবার আমি বদ্ধপরিকর, যেতেই হবে গ্রানাডায়।

--------------------------------------------------------

পলাশ দত্ত এর ছবি

এইসব ভ্রমণকাহিনীর কোনো সঙকলন কি বেরুবে?

==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু

তীরন্দাজ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। আপাতত: তেমন কোন পরিকল্পনা নেই। সামনে অন্য একটি পরিকল্পনা (ছোটগল্প সংকলণ) রয়েছে। সেটা ভালোয় ভালোয় শেষ হলে ভেবে দেখব।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

শেখ জলিল এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। আপাতত: তেমন কোন পরিকল্পনা নেই। সামনে অন্য একটি পরিকল্পনা (ছোটগল্প সংকলণ) রয়েছে। সেটা ভালোয় ভালোয় শেষ হলে ভেবে দেখব।
..সঠিক সিদ্ধান্ত। পরে ভ্রমণকাহিনী হাতে নেয়া যেতে পারে। আপনার মনোমুগ্ধকর বর্ণনা আর দারুণ সব ছবি..

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

তীরন্দাজ এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি জলিল ভাই!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

তীরন্দাজের তোলা ছবির তখন প্রশংসা করা হয়নাই।
আপনি ছবিও কিন্তু বেশ তুলেন ভাইয়া।
খুব ভাল লেগেছে ছবিগুলো দেখে।
ছবি তোলারও চর্চা চলুক লেখার পাশাপাশি।

--------------------------------------------------------

তীরন্দাজ এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ছবি তেমন একটা ভেবে চিন্তে তুলি না। তারপরও আপনার ভালো লেগেছে, তাই খুশী হলাম খুব। আপনার গ্রানাডা বেড়ানোর পরিকল্পনা যেন সফল হয়, সেই কামনা করি। সত্যিই ভালো লাগবে বেশ।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

মুজিব মেহদী এর ছবি

গ্রেট।
আপনার চোখ দিয়েই দেখে নিলাম।

................................................................
সবকিছু নষ্টদের অধিকারে গেছে

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী

তীরন্দাজ এর ছবি

বাংলাদেশে এলে আবার নিশ্চয়ই দেখা হবে আপনার সাথে। ধন্যবাদ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

ভালো হচ্ছে। সবশেষে একটি pdf ফাইল হলে আরো ভালো হবে।

____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

তীরন্দাজ এর ছবি

ধন্যবাদ! তবে পিডিএফ ফাইলটি করার আগে কিছু বাংলা সিনেমার ডায়লগ ঝেড়ে দেবো কি না ভাবছি!

**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

কীর্তিনাশা এর ছবি

ভালো লাগলো তীরুদা।
-------------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

তীরন্দাজ এর ছবি

ধন্যবাদ কীর্তিনাশা ভাই!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।