দু’দিন পর কোন এক বিষন্ন ভোরে জাহাজ থামল লারনাকায়। আমার ডিউটি ছিলনা তখন, ক্লান্ত শরীরে নিজের কেবিনে ঘুমে মগ্ন। জাহাজের দড়ি টানার ঘড়ঘড় আওয়াজ, এই সাত সকালেও বন্দরের ব্যাস্ততা, আর অন্য খালাসীদের হাকডাকে ঘুম ভাঙল। দ্রুত বাইরে এসে দাঁড়ালাম। সামান্য ঝিরঝিরে বৃষ্টি লারনাকার আকাশ থেকে ঝড়ে পড়ছে মাটিতে, সমুদ্রের নোনা জলে, আমার মাথায়, চুলে, শরীরে।শিরশিরিয়ে উঠলো শরীর। তবে শীতে নয়, নতুন জীবনের রোমাঞ্চে। জাহাজী জীবনে এই প্রথম পাড়িপথ শেষের সমুদ্র বন্দর।
সমুদ্র পারের এক অপুর্ব সুন্দর শহর লারনাকা। সাজানো বাড়ীঘরের সাথে মানুষগুলোকেও সুন্দর মনে হলো।এথেন্সে তিনদিন আগে নিজের জীবনের ভাবনা নিয়ে এতোটা ব্যাস্ত ছিলাম যে, একরোপোলিস ছাড়া আর কোন দিকেই চোখ মেলে তাকানোর মতো সুস্থির হতে পারিনি।এখানে এসে তা ই করলাম।তবে বাঙ্গালী যেখানেই যায় না কেনো, রাজনীতির কথা প্রতিবারই ভাবে।তাই সাইপ্রাস নিয়ে গ্রীস আর তুরস্কের টানাহেচড়া ইতিহাস কাশ্মীর সমস্যার কথা মনে পড়িয়ে দিল। দু'দেশের নিয়ন্ত্রণে দুটো অংশ। লারনাকা গ্রীস-নিয়ন্ত্রিত অংশের রাজধানী। খ্রিষ্টপুর্ব তেরোশ শতাব্দীতে এই শহর প্রতিষ্ঠা করা হয়। খ্রীষ্টজন্মেরও আগের বিখ্যাত চিন্তাবিদ সেনন এই শহরেরই বাস করতেন। তখন এ শহরের নাম ছিল কিটিয়ন।
এর মাঝেই কিছুটা পরিবর্তন এসেছে আমার কাজের ধারায়। যান্ত্রিক বিষয়গুলো নিয়ে আমার জানাশোনা আছে বলে মেশিনঘরে কাজ দেয়া হলো। দুপুর বারোটা থেকে বিকেল চারটে ও রাত বারোটা থেকে সকাল চারটে অবধি কাজের সময়। এ সময়টায় মেশিনরুমে থাকা ও মেশিনের তেলেজলে তদারকি আমার প্রধান দ্বায়িত্ব। একজন ইনজিনীয়ারও একই সময়ে দ্বায়িত্বে থাকবেন। তবে তার সময় কাটে অফিসার্স রুমে ঘুমিয়ে বসেই।দরকারে একবার দুবার নীচে নেমে আসেন কিছুটা হাকডাকের মাঝে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের লোভে।
সকালে নাস্তা ছেড়ে বন্ধুকে সাথে নিয়ে শহরের কেন্দ্রে ছুটলাম। সামান্য ঘুরে এক কফিশপে বসলাম দুজনে। এই কফিশপেই প্রেমিক প্রেমিকার প্রকাশ্য ভালোবাসা আর চুম্বন চোখে পড়ল। লজ্জা পেলাম, অবাকও হলাম বেশ।তবে আরো কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ানোর পর একই দৃশ্য বারবার চোখে পড়ায় সে লজ্জা আর অবাকবোধটুকু কেটে যেতে দেরী হলোনা। পুরোনো ঐতিহ্যের বাহারে ছড়ানো ছিটানো শহর এই লারনাকা। আমরা যা দেখি, সবই নতুন আমাদের চোখে।আরো অনেক ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে হলেও জাহাজে ফিরে আসতে হলো তাড়াতাড়ি।আমরা তো ট্যুরিস্ট নই, এখন খেটে খাওয়া মানুষ।আমাদের হাতে দ্বায়িত্ব আর মাথায় বস।আমাদের ঘুরে বেড়ানোর সময় কোথায়!
এবার আমাদের সম্পর্কে কিছু বলি।দু’জনই সদ্য ভার্সিটি শেষ করে বেরিয়েছি। জাহাজে সঙ্গী আমার এক বন্ধুর বড় ভাই। দর্শনে পড়াশোনা শেষ করার সাথে সাথে সাংবাদিকতাও করেছেন। দেশ থেকে বেরিয়েছিলাম আরো দুই বন্ধু মিলিয়ে চারজন। উদ্দেশ্য, নিজের স্বাধীনতা, দেশ দেখা ও আরো বিদ্যাধর হওয়া। তার প্রস্তুতিতে জাহাজে এই খালাসীগিরি। এ অবধি আসতে অনেক চড়াই উৎরাই পেরোতে হয়েছে। ইস্তাম্বুলে আসার পর আর্থিক কারনে আলাদা হয়েছি। একজন কে বাসভাড়া দিয়ে জাহাজে যোগ দিতে গ্রীসে পাঠিয়েছি আগেই, আরেকজন ইস্তান্বুল থেকে তখনকার শাহ্ এর দেশ ইরানে ফিরে গিয়েছে কাজের আশায়। আমরা দু'জন ইস্তাম্বুলে হাড়ভাঙ্গা খাটুনী পর বাসভাড়া জোগাড় করে অবশেষে এখানে। খালাসীর কাজে যতটুকু রসদ জমাতে পারবো, পরে ঢালবো পড়াশোনার পেছনে।
জাহাজ সম্পর্কেও কিছু বলা দরকার। আগেই বলেছি, ছাব্বিশ বছরের পুরানো জাহাজ এই বাক্কিস। তিনটি জেনারেটরের দুটোই প্রায় সবসময় বিকল। মেশিন পাণীয় হিসেবে ডিজেল ছাড়া কিছু নেয়না।বার্ধক্য জনিত কারনে প্রায়ই নানা ধরণের অসুস্থতা দেখা মেশিনের শরীরে।আমরা নিজেরাও তার সাথে ধুঁকে ধুঁকে তাকে যতোটা সম্ভব সচল রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা চালাই। মাল তোলা ও খালাসের জন্যে বাষ্পচালিত ক্রেন রয়েছে। তবে আধুনিক বন্দরগুলোতে বন্দরেরই ইলেকট্রিক ক্রেন ব্যাবহার করা হয়। নিজেদের এই ক্রেন ব্যাবহার করা অনেকটা গরুরগাড়ী টানার মতোই। কাহিনী বর্ননায় এর কথা পরে আসবে। জাহাজে সব মিলিয়ে বাইশজন ত্রু। এদের মাঝে সাতজন অফিসার। এদের ছ'জনই গ্রীক, একজন ইথিওপিয়ান। সাধারন খেটে খাওয়াদের মাঝে আমরা দু'জন বাংলাদেশী বাদে অন্যরা সোমালিয়া, ইজিপ্ট, নাইজেরিয়া ও ঘানার লোক।
লারনাকায় পোর্টের ক্রেন দিয়েই দ্রুত সিমেন্ট তোলা হল। কাল সকালেই আমাদের রওয়ানা হতে হবে গ্রীসের পেরিয়াস সমুদ্র বন্দরে।ঢেউএর দোলুনীর কথা ভাবলেই চোখের পলকে জ্বর আসে শরীরে। কাজের সময়তো বটেই, বিছানায় শোবার পরও মনে হয়, পৃথিবীটা দুলতে দুলতে চেপে বসছে মাথায়। নিজেকে মৃগীরোগী পাইলটের মতো মনে হয়।অবস্থা খারাপ দেখে অভিজ্ঞ নাবিকরা দুধ চিনি ছাড়া কালো কফি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। পরামর্শ শুনে কেঁচোর মতো করে ফেললাম চেহারাটা। এমনিতেই গ্রীক কফি বেশ কড়া। দুধ চিনি বাদে তো বিষময় এর স্বাদ! তারপরেও চালাতে হবে। কিন্তু অতিরিক্ত খারাপ দিনের পর সামনের ভাল দিনের আশাতেই বেঁচে থাকে মানুষ।সে ভরসাতেই রাত বারোটায় আবার ঢুকলাম মেশিনরুমে।
মন্তব্য
হা হা, চমৎকার ! চালিয়ে যান খালাসী সাহেব। আমরাও আপনার সাথে ঘুরতে থাকি।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
আসুন, ঘুরি!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
নাহ্... সিদ্ধান্ত পাক্কা... তীরুদা... আমারে একটা খালাসীর চাকরি জোগাড় কইরা দেন তো... জাহাজে জাহাজে বন্দরে বন্দরে ঘুরে ঘুরে কাজ করে বেড়াই...
প্লিজ তীরুদা... দেন না... ঘরে বইসা থাকতে থাকতে আর ভাল্লাগে না... উফ্...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
এইডা কি কন! বৌ, পোলাপান ফালাইয়া কৈ যাইবেন!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
আহা... এমন জীবন পেলে আর কি চাই...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
দুর্দান্ত ! কিন্তু এত ছোট কলেবরের ইন্সটলমেন্ট কেন ?
আরো লিখুন তীরন্দাজ'দা। দ্রুত পরের পর্বে অপেক্ষায় রইলাম।
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
চলুক...
ঠিকাছে। তা এই ঘটনাগুলো কতদিন আগেকার, তীর ভাই?
প্রায় তিরিশ বছর আগের কাহিনী প্রেমিক ভাই।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
পড়তে চাই।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
ঈর্ষান্বিত ।
আহ , কী চমৎকার জীবন ।
কী চমৎকার দেখাদেখি ।
এখন ভাবতে গেলে নিজের কাছেও চমৎকার মনে হয়। তখন নিগুঢ় বাস্তবতার সামনে একেবারেই চমৎকার মনে হয়নি।
তবে পরে কোনদিন ভাল সময়ের সুদৃঢ় মাটিতে দাঁড়িয়ে এই যুদ্ধের সময়টিকে চমৎকার মনে হবে, সে প্রত্যাশা নিজের কাছেও ছিল।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
ভালো লাগছে, তীরন্দাজ ভাই অবশ্যই চলবে
------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
ধারাবাহিকটা খুবই ভালো লাগছে। আরো কিছু ছবি যোগ করলে পুরোপুরি তৃপ্তি হতো।
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
ছবি পাবো কোথায়! ক্যামেরাই তো ছিলনা। জীবন আর জীবিকার যুদ্ধে এসব নিয়ে ভাবার কোন অবকাশ ছিল কি? যদিও ভ্রমনকাহিনী বলে আখ্যা দিয়েছি আমার এ লেখাকে, তখন কি আর এ সময়টাকে ভ্রমন হিসেবে ভাবতে পেরেছি!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
কি চমৎকার বৈচিত্রময় জীবন আপনার! লিখুন আরো। তবে পোস্টগুলো বেশি ছোট মনে হচ্ছে।
খুব ভাল লাগছে তীরুদা। পর্বগুলো আরো বড় হতে পারতো!
**********************
কাঁশ বনের বাঘ
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
ধন্যবাদ। এর পরের পর্বটিও ছেটই হবে। তারপর দেখি, লেখার ধারা পাল্টানো যায় কি না।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
বর্নাঢ্য জীবন, উপচানো অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার ।
-------------------------------------
সমুহ শোকেরা এলো ঝাঁক বেঁধে;
বিদায় জুবায়ের ভাই...
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
কী চমৎকার জীবন!
চালিয়ে যান.....................
পড়ছি। চালিয়ে যান।
আমার চোখে ভাসছে প্রাচীন সমুদ্র আর ছাব্বিশ বছরের পুরানো জাহাজ বাক্কিস। পৃথিবীটা দুলতে দুলতে আমার মাথায়ও চেপে বসেছে। জীবনানন্দীয় ঘোরের মধ্যে আছি।
____________________________
বন্ধুত্ব মানেই তুমি বিচ্ছেদের চুক্তি মেনে নিলে
[আবু হাসান শাহরিয়ার]
____________________________
বন্ধুত্ব মানেই তুমি বিচ্ছেদের চুক্তি মেনে নিলে
[আবু হাসান শাহরিয়ার]
রাতে শরীর খারাপ লাগছিল। তারপর এই পোষ্টটি দেবার পর পরই ভয়ংকর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর! ঈদ আমার ভালোই কাটলো এবার! তবে আজ ভালো আছি অনেকটা।
আপনারা অনেকে মন্তব্য করেছেন। উত্তর করতে পারিনি বলে দু:খিত।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
তীরুদা, আপনার এই সিরিজে স্বতস্ফুর্ত গতি চলে এসেছে। এখন আর কারও কথা কানে নেবেন না। লেখা ছোট হোক, বড় হোক, যা ইচ্ছে হোক লিখে যান। দুর্দান্ত হচ্ছে।
ওয়েবসাইট | ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল
অসাধারণ!!!
--------------------------------------------------
যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
হিংসা হইতেছে আপনাকে... আপনার দূর্দান্ত ভ্রমণের অভিজ্ঞতার জন্য। তবে দিনগুলো তো কষ্টকর ও ছিল।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
নতুন মন্তব্য করুন