খিঁলগাওয়ের ওভারব্রিজটি কয়েকটি বাঁক নিয়ে উঁচুতে ওঠে আবার নেমে মিশেছে আরেকটি রাস্তায়। সবচেয়ে উঁচু যে অংশটি, সেখান থেকে নীচোর রাস্তাটি অনেকটাই নীচে। মানুষজনকে খুব ছোট ছোট মনে হয়। অগুনতি রিক্সা আর স্কুটারের পাশাপাশি বেশ বড়সড় বাস আর ট্রাকও চলে সে রাস্তায়। আত্মহত্যার বেশ উপযুক্ত স্থানই বটে! উপর থেকে একবার লাফিয়ে পড়লেই সাথে সাথেই মরণ। তারপর যদি একটি বাস কিংবা ট্রাক এসে গায়ের উপর পড়ে, তাহলে কিছু ছড়ানো ছিটানো মাংসপিন্ড ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাবার কথা নয়। এমন নিশ্চিত একটি জায়গা থাকা সত্বেও আজ অবধি এখান থেকে লাফিয়ে পড়েনি কেউ, এটাই আশ্চর্য।
শহরে বেশ কয়েকটি আত্মহত্যার স্পট রয়েছে। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাদ, হোটেল ইলিশিয়াম, টুইন টাওয়ার আর বড় বড় এপার্টমেন্ট হাউজ। কোন কোন জায়গায় ছাদে ওঠার সিঁড়ি বন্ধ করে দেয়া হলেও মরণকামী লোকজন ঠিকই ছাদে ওঠে যায়। কিভাবে যায় বলা মুস্কিল। মরণের বাতাস গায়ে লাগলে, ঠেকানোর সাধ্যি কার! তাই দু’চারদিন পরপরই এসব জায়গা থেকে নীচে লাফিয়ে আত্মহত্যার খবর শোনা যায়। পত্রিকাতে উঠলেও শহরের লোকজনের কাছে গা সওয়া হয়ে গিয়েছে এসব আত্মহত্যার খবর। এরা একবার চোখ বুলিয়েই অন্য খবরের দিকে নজর দেয়।
কিন্তু একজন লোক এসব নানা পরিচিত সুবিধা থাকা সত্বেও ওভারব্রিজটিই বেছে নিলো। কোন এক বৃষ্টিভেজা আধো অন্ধকার বিকেলে ব্রীজের পায়ে হাঁটার রান্তাটি বেয়ে বেয়ে সবচেয়ে উঁচু অংশটিতে এসে দাঁড়ালো। কাছাকাছি নেই কেউ। অনেকটা দুরে এক টোকাই একটি বস্তা গায়ে জড়িয়ে ব্রীজের রেলিংএর পাশে গুটিশুটি হয়ে বসে। সে এই আত্মহত্যাকামী লোকটির দিকে একবার তাকালোও না।
লোকটি কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভাবলো কে জানে! হয়তো চারপাশের মানুষজন, পরিবেশ, শহর, প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিদায় নিল মনে মনে। তারপর শক্ত মুখ করে আস্তে আস্তে রেলিং বেয়ে উঠতে শুরু করলো। হাঁটুর কাছাকাছি বেশ কাঁপুনি অনুভব করলেও নজর দিল না সেদিকে। রেলিংএর উপরে ওঠার আগের মূহুর্তে একটি গলার আওয়াজ শুনে থামতে বাধ্য হলো সে।
- এই যে! তুমি এখানে কি করো?
চমকে এদিক ওদিক তাকালো লোকটি। কয়েক গজ দূরেই ধুসর পোষাক পড়া আরেকজন লোকের অবয়ব নজরে পড়লো তার। আকাশ, মেঘ, ব্রীজ আর বৃষ্টির রঙএর সাথে মিশে একাকার হয়ে আছে বলে আগে দেখতে পায়নি। বাঁধা পেয়ে বেশ বিরক্ত হলো সে। শালার জীবনের প্রতি পদে পদে বাঁধা, এখন মরতে গিয়েও বাঁধা!
- আমি কি করি, বা না করি, তাতে তোমার কি দরকার?
- দরকার আছে বলেই তো জিজ্ঞেস করছি। নইলে করতাম নাকি?
- দরকার-টরকার ছেড়ে এখন ভাগো, নইলে...
-
বলেই বিরক্তিতে মারমুখী হয়ে উঠলো লোকটি। রেলিং থেকে নেমে এগিয়ে গেল দ্বিতীয়জনের দিকে। দ্বিতীয়জন তা টের পেলেও একটুও নড়লো না। হাত ইশারা করে থামানোর চেষ্টাও করলো না। প্রথমজনের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
- মারবে নাকি?
- মারবো কি, এক্ষুনি যদি না ভাগো, তাহলে মেরেই ফেলব তোমাকে।
- আমি তো মরতেই এসেছি। মারো, মেরে ফেলে দাও নীচে!
এবার থমকে দাঁড়ালো লোকটি। তাকালো অন্যজনের দিকে। বৃষ্টিতে ভিজে আছে শরীর। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, উস্কো খুস্কো চুল। চোখের তারায় জীবনের প্রতি স্পষ্ট বিতৃষ্ণা থাকলেও বেশ শান্ত মনে হলো তাকে। চেহারা দেখে মনেও হলোনা, মিথ্যে বলছে। তাই আবার জিজ্ঞেস করলো প্রথমজন,
- তুমিও মরতে এসেছ?
- হ্য।
- তাহলে তো ভালোই। এক, দুই, তিন বলে একসাথে লাফিয়ে পড়ি দু’জনে। ভালোই হবে, ভয় লাগবে না বেশী।
- না! অনেকদিন ধরে প্ল্যান করেছি, সবার আগে প্রথম আমিই এই ব্রীজ থেকে লাফিয়ে পড়বো। নাম ছাপা হবে পত্রিকায়। আমি আজ একাই মরবো। তুমি কাল বা কয়েকদিন পরে মরো।
- দু’জনে একসাথে মরলে ক্ষতি কি?
- পত্রিকায় কারো নামই লিখবে না। শুধু লিখবে, ব্রিজ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছে দু’জন মানুষ।
- কিন্তু আমাকেও আজই মরতেই হবে। জানো, তোমাকে গায়ে হাত তুলতে গেলেও আসলে খুব ভীতু আমি। পরপর চারদিন এসে ফিরে গিয়েছি। আজ ফিরতে চাইনা আর। তাহলে আর মরাই হবে না আমার।
- আমিও তিনমাস ধরে প্ল্যান করেছি। ধার দেনা শোধ করেছি, ছেলেমেয়েদের জন্যে ইনস্যুরেন্স করেছি। উইল করেছি।
- আমিও শেষ চিঠিটি লিখে পাঠিয়ে দিয়েছি। বাবা-মায়ের হাতে সে চিঠি এতোক্ষণে হয়তো পড়েই গিয়েছে। আজ না মরতে পারলে সন্মান নিয়েই টানটানি!
- আমাকেও আজই মরতে হবে। তিন বছর আগে এই দিনে বউ মরেছে। আর আমিও গুনে গুনে এই দিনেই মরবো বলে ঠিক করে রেখেছি।
- তোমাকে ভালোবাসতো তোমার বউ?
- অবশ্যই, সেজন্যেই তো এজীবন আর ভালো লাগেনা আমার।
- তোমাকে তো কেউ না কেউ ভালোবেসেছে। আমার তো ভালোবাসার কেউ ছিলই না।
- তাতে কি? আমি আজই মরতে চাই!
- আমিও আজই মরতে চাই।
এভাবেই ওদের তর্কবিতর্ক তুঙ্গে উঠলো। দুজনেই মরতে চায় আজ। কেউ কারো গায়ে হাত না তুললেও ছাড় দিতে রাজী হলোনা কেউ। এদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে চারদিক। দূরের টোকাইএর চেহারা আবছা হতে হতে দেখাই যাচ্ছে না আর। এবার একটা সমঝেতায় আসতে চাইলো দ্বিতীয় লোকটি। বললো,
- ঠিক আছে। পয়সা ছুড়ি, যে জিতবে, সেই মরবে আজ। রাজী তুমি?
- হ্যা, রাজী।
- হারলে কিন্তু সাথে সাথেই বিদেয় হবে তুমি।
- হ্যা, হবো। তুমি হারলে কথা দাও, মরার আগে যেনো তোমার মুখ না দেখি!
- ঠিক আছে।
দ্বিতীয়জন একটি পাঁচ টাকার মূদ্রা বের করলো পকেট থেকে। উপরের দিকে ঘুরিয়ে ছুড়ে মেরেই আবার হাতে তালুতে লুফে নিল। এক হাতের তালু আরেক হাতের তালুতে চেপে রেখে বললো,
- বলো, এবার তুমি কি চাও, নম্বর না পাতা?
- পাতা।
বলেই চরম উত্তেজনায় প্রথমজন এগিয়ে এলো দ্বিতীয়জনের দিকে। এই উত্তেজনা দ্বিতীয়জনের ভেতরেও সংক্রামিত হলো। এই পাতা ও নম্বরের ভেতরেই আজ তাদের জীবন মরণের সিদ্ধান্ত লুকোনো। সারা জীবনের সমস্ত কর্মের, সব হিসেবের সমাপ্তি আজই। জীবন আর মরণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দু’জনেরই শরীর কাঁপতে থাকলো উত্তেজনায়। এই ভেজা দিনেও শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলে গলা।
একটি ট্রাক চলে গেলো ওদের পাশ দিয়ে ভেপুতে বিকট আওয়াজ করে। দূর থেকে বস্তা গায়ের টোকাইটি যে হঠাৎ দাঁড়ালো, দেখতে পেলোনা কেউ। দাঁড়াতেই দেখা গেল, টোকাই নয়, বরং পরিণত বয়েসের একজন মানুষই বসেছিল সেখানে। সে মানুষটি এগিয়ে এলো ব্রীজের উঁচু অংশে, প্রথম ও দ্বিতীয়জনের কাছাকাছি। কাছে আসার পর ওরা তাকিয়ে কিছু বোঝার আগেই ব্রীজের রেলিংএ উঠে নীচের ব্যাস্ত রাস্তায় লাফিয়ে পড়লো সে। গায়ের বস্তাটি পড়ে রইল ফুটপাথে।
মন্তব্য
লটারী করতে থাকা মানুষ দুজনের মতো আমিও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলুম। চমত্কার! গল্পটা যে এভাবে শেষ হবে তা ধরতেই পারিনি।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। খুব খুশী হলাম ভাই!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
চমৎকার গল্প।
..এবার বইমেলায় বই বেরুচ্ছে কি তীরন্দাজ ভাই?
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
অনেক ধন্যবাদ জলিল ভাই। এক সমস্যায় পড়ে দেশে আসতে পারছি না সময়মতো। তাই হয়তো এবার কোন বই বের করা হবে না। তবে বেঁচে থাকলে অবশ্যই সামনেরবার বের করবো।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
দুর্দান্ত ফিনিশিং! খুবই ভাল লাগল।
আপনার অন্য শরীর বইটা খুঁজছি, বাংলাবাজার গিয়েছিলাম ওরা বলল পুরান যে কপি ছিল সব শেষ, নতুন করে প্রকাশ করা হয় নি, আপনি এখন একটা ব্যবস্থা করেন কিভাবে বইটা পাই।
------------------------------
'এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি ?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। শাজাহান চাকলাদার (৮৩১১০১৪) নামে ঢাকায় আমার এই বন্ধুকে ফোন করুন, অবশ্যই পাবেন।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
তীরুদা আপনি আসলেই ফিনিশিং এর ব্যাপারে বস । অনেকদিন পর লিখলেন গল্প কিন্তু দারুন
*********************************************************
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
আপনার মন্তব্যগুলো সবসময় ভালো লাগে। ধন্যবাদ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
খুব ভালো লাগলো পড়ে
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
ধন্যবাদ আপনাকে রানা মেহের!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
শেষটা বেশ ভালো লাগলো! তবে ...... আপনার অন্যান্য গল্পগুলোর বর্ণনা ভঙ্গি আরেকটু ঠাস-বুনোটের হয় কিন্তু
এটা হচ্ছে কাজে বসে কাজ ফাঁকি দিয়ে গল্প লেখার শাস্তি। তবে গঠনমূলক সমালোচনার জন্যে অনেক ধন্যবাদ। একটি প্লট মাথায় ঢুকলে লেখার লোভে শরীর কাঁপা শুরু হয়, আর তাতেই এই অবস্থা! পরে ঠিক করে নেব।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
অনেক দিন পর তীরুদার গল্প পড়লাম।
এবং খুব ভালো লাগলো। শেষের চমকটা সেরকম
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
খুব ভালো লাগলো আপনার স্বতস্ফুর্ত প্রশংসায়। ধন্যবাদ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
ভালো লাগলো পড়ে।
...........................
Every Picture Tells a Story
ধন্যবাদ মুস্তাফিজ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
ধাক্কা লাগল শেষে এসে। দারুন গল্প তীরু'দা। আগামী বইমেলায় আপনার বইয়ের জন্য অপেক্ষা করব।
অনেক ধন্যবাদ! দেখি এবার বই বের করা হয় কি না!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
দারুণ!
অনেক টার্ন-ট্যুইস্ট, অনেকই চমকে দেয়া।
প'ড়ে বেশ লাগলো তীরুদা'। তবে, অ্যাতো উঁচু (আমার অফিস ১১ তলায়) থেকে প'ড়েও মরলাম না কেন বুঝলাম না! ;-(
কী সুন্দর ক'রে কতো মানুষ ম'রে যায়! আমি কেন পারি না?!
০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"
___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"
যার চতুর্পাশে সবই যায় আর আসে, তার মরণ কি এতো সহজে হয়! ২২ তলা থেকে লাফ দিলেও হবে না।
তবে টেষ্ট করার দরকার নেই.....! ভালো থাকবেন!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন আপনিও।
০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"
___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি
কী ভয়াবহ এক বিষয়! তবে গল্পটি যথারীতি অনবদ্য।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
একলা পথে চলা আমার করবো রমণীয়...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
নতুন মন্তব্য করুন