সকাল থেকেই খিঁচড়ে আছে মেজাজ। রাতেও ভালো ঘুম হয়নি। পাশের বাড়ীর যুগলের ঝগড়া তুঙ্গে উঠেছিল গতরাতে। মাঝে মাঝে একটু থেমে থেমে প্রায় সারা রাত ধরেই চললো । বাবা মায়ের এই ঝগড়ার মাঝে ছোট বাচ্চাটি কেঁদে উঠলো বারবার। ভোরের দিকে থামলো। আপোষে নাকি ক্লান্তিতে, তা বলতে পারবো না। মরুকগে! আমার কি? ঘুম হলোনা, এ নিয়েই বিরক্তি আমার। আজ সকালেই কর্তাদের সাথে জরুরী মিটিং অফিসে। সেখানে ভালোভাবে নিজেকে না প্রকাশ করতে পারলে উপরে ওঠার সিঁড়ি খুঁজেই পাবোনা। এমন একটি রাতের পর এখন বসে বসে হাই তোলা ছাড়া কোন পথ রইল না।
এই একঘেয়ে বৃষ্টির মাঝে এখন বেরোই কি করে? ওদের ঝগড়া থামার প্রায় সাথে সাথে বৃষ্টি শুরু হলো রাতে। তা টের পেলেও এতো জোর বৃষ্টির আভাস পাইনি। এখন ঘড়ির কাটা সাতটার ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। এখনো থামার কোন জো নেই। গায়ের চাদরটি সরিয়ে বিছানা ছেড়ে দাঁড়াতেই কেমন যেনো কেঁপে উঠলো শরীরটা। সারারাত না ঘুমোলে এমনই হয়! মনে মনে অভিসম্পাত দিলাম ঝগড়াটে দম্পতিকে। হতভাগার দল! বিয়ে করবি, গন্ডায় গন্ডায় ডিম পাড়বি, আবার ঝগড়াও করবি সারা রাত ধরে!
ডিম ভাজি আর টোষ্ট সাজিয়ে রেখেছিল বুয়া টেবিলে।খেয়ে কাপড় চোপড় পরে যখন বাইরে বেরিয়ে এলাম, তখনো কিছুটা কমেছে বৃষ্টি। কিন্তু জল আর কাঁদায় থকথকে রাস্তা। পাশের ড্রেন থেকেও উপচে পড়ছে পানি। এমনি এক দিনে রিক্সাওয়ালাদেরও পোয়া বারো! কোথাও যেতে চায়না। এমনকি কথা বলতেও যেনো কষ্ট হয় ওদের! যেতে রাজী হলেও আকাশচুম্বী দাম হেঁকে বসে। মাঝে মাঝে মনে হয় একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিই গালে।
যা ভেবেছিলাম, তা ই হলো। পাঁচজন রিক্সাওয়ালা জুবুথুবু হয়ে বসেছিল হুডের আড়ালে।যাওয়া তো দূরের কথা, আমাকে পাত্তাই দিলনা। খুব কষ্টে যেনো মাথা নাড়লো। মেজাজ আরো খারাপ হলো আরো। কষিয়ে একজনকে চড় লাগাতে যাচ্ছিলাম প্রায়, দেখি একটু দূরে দাড়িয়ে আছে একটি। মেজাজ সামলে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। রিক্সাওয়ালা চালকের আসনে বসে আমাকে দেখেই একটি গামছা দিয়ে পেছনে ঝুঁকে আরোহীর সিটটি মুছে দিল। কোন কথা না বলে উঠে বসলাম সেখানে। তারপর গন্তব্যস্থল বললাম। দরদাম ঠিক না করেই সে প্যাডেলে চাপ দিল রিক্সাওয়ালা।
বড় রাস্তার মোড়ে এসেই দেখি চারদিক থৈথৈ করছে জলে। হাটু অবধি পানিতে ডুবে আছে রাস্তা। এরই মাঝে জল ছিটিয়ে চলছে যানবাহন। আমার রিক্সাটিও সে জলের মাঝে নেমে গেলো। নোংরা ছিটে যাতে গায়ে না লাগে, সেজন্যে পলিথিনের কভারটি ভালো করে জড়িয়ে নিলাম শরীরে। কিন্তু সেটির গায়েও লেগে আছে কাঁদা। হাত দিতেই গা ঘিন ঘিন করে। মনে মনে অভিসম্পাত দিলাম রিক্সাওয়ালা শ্রেনীর এই জীবগুলোকে। একটু পরিস্কার রাখলে কি ক্ষতি হয় ওদের! এরই মাঝে একটি বাস আমাদেরকে ভিজিয়ে চলে গেলো পাশ ঘেসে। পলিথিনে নিজেকে কিছুটা বাঁচাতে পারলেও রিক্সাওয়ালা পুরো ভিজে গেলো। সেদিকে তাকিয়ে বিশ্রী এক গালি দিয়ে কোমর থেকে গামছাটি খুলে মাথা আর মুখ মুছে নিল সে। তারপর আবার চাপ দিল প্যাডেলে।
শান্তিনগরের মোড়ে দেখি আরো গভীর জল। গাড়ীগুলো কোনভাবে চলতে পারলেও, রিক্সাওয়ালারা নেমে টানতে বাধ্য হলো। কিন্তু আমার রিক্সাওয়ালা নামলো না। সে তার সিটে বসেই জলের সাথে চালিয়ে গেলো যুদ্ধ। ঘড়ির দিকে তাকালাম। এভাবে শামুকের গতিতে চললে নির্ঘাত দেরী হয়ে যাবে মিটিংএ! বললাম, „নবাবের মতো না বসে বসে, একটু নেমে টানো না মিয়া“! রিক্সাওয়ালা মাথা ঘুরিয়ে কঠিন, বিরস চেহারায় আমার দিকে তাকালো একবার। তারপর কিছু না বলে আপ্রানে প্যাডেলে চাপ দিতে শুরু করলো। তাতে গতি অতি সামান্য বাড়লেও আমি আর কিছু বলার সাহস পেলাম না। এখানেই যদি নামিয়ে দেয়, তখনো আরো বেশী ঝক্কি!
অবশেষে কাকড়াইলের মোড়ে অফিসের সামনে এসে থামলো রিক্সা। রাস্তায় জল থাকলেও লাফিয়ে অফিসের সিঁড়িতে উঠতে পারলাম। রিক্সাওয়ালা কপালের ঘাম মুখে রিক্সা থেকে নেমে আমার দিকে এগিয়ে এলো ভাড়া আদায়ের জন্যে। তার আসার ভঙ্গীতেই একটি বিষয় টের পেয়ে নিজেই যেনো স্থবির হয়ে গেলাম। তার ডান পায়ে পাতাটি নেই, গোড়া থেকেই কাটা!এক পায়েই এই জলের মাঝে চালিয়ে এনেছে রিক্সা!
ভাড়া মিটিয়ে দেবার পর খোঁড়াতে খোঁড়াতে রিক্সাওয়ালা এগিয়ে গেলো তার রিক্সার দিকে। সীটে উঠে প্যাডেল চেপে আবার নেমে গেলো রাস্তার জলের মাঝে। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঢুকলাম অফিসে।মিটিংএ পৌঁছাতে মিনিট পাঁচেক দেরী হলেও কোন অসুবিধা হলোনা। শুনলাম, বস নিজেই কোথাও আটকে আছেন গাড়ীতে। জলের কারণে নাকি দেরী হচ্ছে এগুতে। অপেক্ষা করতে করতে বেশ ভার ভার মনে হলো ভেতরটা। রিক্সাওয়ার কারণে? কি জানি! হতে পারে বা নাও পারে! এমনি এক বৃষ্টিভেজা দিনে অকারণেই বিষন্ন থাকে মন!
মন্তব্য
বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
ভালো লাগলো।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
অনেক ধন্যবাদ! হ্যা সংগ্রামই বটে।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
রোজকার লড়াই, চলছে চলবে
------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
রোজকার শোষনও চলে যাবে একই উন্মাদনায়! অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
এই রিকশাওয়ালার সংগ্রামের কাছে কতো তুচ্ছ আমাদের জীবন।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
একেবারে ঠিক বলেছেন তানবীরা। ভালো থাকবেন।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
এ ভেবেই আমরা নিজের সীমাবদ্ধতায় স্বান্তনা নেই হয়তো। অসাধারন লেখা
হ্যা, শুধুমাত্র স্বান্তনাই খুঁজি। কিন্তু এতোই মেরুদন্ডহীন এই গল্পের 'আমি' চরিত্র যে, রিক্সাওয়ালার কারণেই তার মন খারাপ, সেটাও সরলভাবে স্বীকার করতে সাহস পায়না। তাই বৃষ্টিভেজা দিনের আশ্রয় নেয়!
আপনাকে ধন্যবাদ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
বৃষ্টিভেজারাতে আমি শাওনের সুগন্ধ পাই ...
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
ধন্যবাদ কবি শাহীন!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
চমৎকার লেখা!
অনেক শুভকামনা।
আপনার জন্যেও অনেক শুভকামনা। আপনি খুব ভালো কবিতা লিখেন।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
চমৎকার লেখা
মনটা খারাপ করে দিলেন ভাই।
-----------------------------------------------------------------------------
আমি বৃষ্টি চাই অবিরত মেঘ, তবুও সমূদ্র ছোবনা
মরুর আকাশে রোদ হব শুধু ছায়া হবনা ।।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
অনেধ ধন্যবাদ ভাই। আপনি তো ভালো, এই গল্পের আমি তো মন খারাপ করারও সাহস পায়না।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
তীরুদা যথারীতি ভাল লাগল
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
আপনি আমার গল্প সবসময়েই পড়েনা। আপনাকে দেখলেই ভালো লাগে খুব!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
গল্পটা এত্ত জ্যান্ত!
---------------------------------------------
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে৷'
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
খুব খুশী হলাম আপনার মন্তব্যে। অনেক ধন্যবাদ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
রনদীপম বসু'র প্যাডেল-এর সাথে অনেকটাই মিল আছে।
প্যাডেল পড়তে পারেন প্রতিদিনের গল্প ডাউনলোড করে (প্রথম পাতায় লিঙ্ক পাবেন)।
খুব ভাল লাগল তীরুদা।
প্যাডেল পড়লাম। বেশ কাকতালীয়! কোন এক বুষ্টির দিনে এমনি এক বিক্সাচালকের সওয়ারী ঠিকই হয়েছিলাম!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
বৃষ্টিভেজা সকাল, জলকাদায় মাখামাখি রাস্তা, রিক্সাওয়ালার অনিচ্ছুক মাথানাড়া, সবকিছু পরিচিত চেনাদৃশ্য।
যখন দেখলাম "তার ডান পায়ে পাতাটি নেই, গোড়া থেকেই কাটা" - স্তম্ভিত, লজ্জিত হলাম আপনার সাথে সাথেই।
মন ভার করে দেয়া গল্প।
অনেক ধন্যবাদ ভাই!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
এরই নাম জীবন!
মনটা খারাপ হয়ে গেল তীরুদা। তবে সেটাই প্রমাণ করে লেখাটা কতটা ভাল হয়েছে।
ভালো থাকবেন।
ধন্যবাদ ভাই! আপনিও ভালো থাকবেন।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
তীরু'দার এ গল্পটা অন্যরকম লাগলো।
একটা প্রশ্ন, দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকেও এরকম দেশের গল্প সাবলীলভাবে কী করে লিখেন!
এরকম প্রশ্ন অন্য একটি গল্প নিয়ে আগেও করেছিলেন একজন। অনেক বছর ধরে বাইরে থাকলেও, টান রয়েছে, যোগাযোগও আছে বেশ গভীরভাবেই। মনের দিক থেকে যারা কাছাকাছি, তাদের সাথে কোন দূরত্ব অনুভব করি না। হয়তো তারই প্রতিফলন ঘটে লেখালেখির মাঝে।
আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এমনি এক রিক্সায় কোন এক বৃষ্টির দিনে সত্যিই চড়েছিলাম। তবে বলা বাহুল, এই গল্পের 'আমি' যেরকম দানব, আমি সেরকম ছিলাম না। হলে গল্পটি লিখতেও পারতাম না।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
অনেক গল্পে (আপনারও) অনেক ভাবনার স্বাধীনতা থাকে। আমার
ভাবনার সীমা থালার কিনাড়া অতিক্রম করতে পারে না বলেই সে সব গল্প পরে খুব বেশী কিছু ভাবতে পারি না।
এ গল্পে কিছুই ভাবতে হয়নি, আপনার পাশেই রিক্সায় বসেছিলাম আমি। খুব ভাল একটা গল্প শোনালেন, আমাকে আপনার পাশে বসিয়ে।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
মজাই তো, মিউনিখে বসে একসাথে রিক্সা চড়া....! আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
Lina Fardows
মন ছুঁয়ে গেল লেখাটা
Lina Fardows
নতুন মন্তব্য করুন