বন্ধুরা, আমাদের জীবনের এই অসহনীয় অবস্থার জন্যে একমাত্র এই মানুষ-প্রাণীদের একচ্ছত্র আধিপত্যই দায়ী। এদের দুর করতে পারলেই তোমাদের নিজস্ব পরিশ্রমের ফসল তোমাদেরই। এক রাতের মাঝে আমরা স্বাধীন ও সম্পদশালী হতে পারি। কী করতে হবে আমাদের? এই মানুষজাতীয় প্রাণীকে দুর করাই হতে হবে আমাদের প্রতিটি দিন ও রাতের একমাত্র ভাবনা। এজন্যে শারীরিক ও মানসিক- দু’ভাবেই কাজ করে যেতে হবে। তাই তোমাদের কাছে আমার এই আহ্বান বন্ধুরা: বিপ্লব! একমাত্র বিপ্লবই আমাদের মুক্তির পথ। কখন এই বিপ্লবের আগুন জ্বলবে, জানি না এখনও। কিন্তু যে খড়ের গাদায় বসে আছি, সেটি যেমন সত্য, তেমনই সত্য যে একদিন ন্যায়বিচারের জয় হবে। এই স্বল্পকালীন জীবনে সেদিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হবে তোমাদের। সবচেয়ে বড় কথা, আমার এই ডাক তোমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিও, যাতে তারা যতদিন না বিজয় আমাদের, ততদিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে।
মনে রেখো বন্ধুরা, কোনো পরিস্থিতিতেই আমাদের এই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওয়া চলবে না। কোনো যুক্তিই যেন পথচ্যুত না করতে পারে আমাদের। কেউ যদি বলে, মানুষ ও পশুর একই লক্ষ্য, একজনের মঙ্গল আরেকজনেরও মঙ্গল, মানবে না কক্ষনোই। এসব যুক্তি ভিত্তিহীন মিথ্যা! নিজের স্বার্থ ছাড়া অন্য কারোর স্বার্থ কখনোই দেখেনা মানুষ। আরেকটি কথা, পশুদের মাঝে পুরো একাত্মটা ও সৌহাদ্র বজায় থাকতে হবে। সব পশুরা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু আর প্রতিটি মানুষ তাদের শত্রু।“
ঠিক সেই মুহূর্তে বিকট এক চেঁচামেচি শোনা যায়। বুঢঢা মেজরের বক্তৃতার সময় কয়েকটি মোটাসোটা ইঁদুর তাদের গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে তার কথা শুনছে বসে বসে। হঠাৎ কুকুরগুলো তাদের দিকে লক্ষ্য স্থির করায় ভযে তড়িঘড়ি নিজেদের গর্তে ঢুকে পড়ে তারা। ঘটনাটি দেখে সবাইকে শান্ত করার জন্যে সামনের একটি পা তোলে বুঢঢা মেজর।
বলে, “বন্ধুগন! এ বিষয়েও আমাদের আলোচনা করা দরকার। বন্য প্রাণী, যেমন ইঁদুর, খরগোস- ওরা আমাদের বন্ধু না শত্রু? আমাদের মাঝে ভোটাভোটি হোক! আমি সভার সবাইকে প্রশ্ন করছি, ইঁদুর কি আমাদের বন্ধু? ”
সাথে সাথেই ভোট গ্রহণ শুরু হল ও বিপুল ভোটাধিক্যে ইঁদুরদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা হল। বিপক্ষে ভোট পড়লো মাত্র চারটি। তিন কুকুর ও এক বিড়ালের। কিন্তু পরে দেখা গেলো, প্রস্তাবের পক্ষে ও বিপক্ষে, দুদিকেই ভোট দিয়েছে তারা।
“বেশী আর বলার নেই আমার। শুধুমাত্র এ কথাই পরিষ্কার করে বলতে চাই যে, মানুষ ও তাদের কর্মকাণ্ডকে শত্রুকর্ম হিসেবে দেখা প্রতিটি পশুর কর্তব্য। দু'পেয়েরা আমাদের শত্রু। চারপেয়ে ও যাদের পাখা আছে, তারা আমাদের বন্ধু। আরেকটি কথা মনে রেখো, মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমরা যেন তাদেরই মতো না হই। তাদেরকে পরাজিত করেও আমরা যেন তাদের খারাপ স্বভাব ও বদ অভ্যাসগুলো গ্রহণ না করি। কোনো পশু যেন কোনো মানুষের ঘরে না থাকে! তারা যেন কোনো পোশাক না পরে ও কোনো বিছানায় না ঘুমায়! মদ, সিগারেট আর ব্যবসা পশুদের জন্যে একেবারেই নিষিদ্ধ। মানুষদের দুর্বলতা আমরা যেন কোনোভাবেই গ্রহণ না করি। শক্তিশালী বা দুর্বল নির্বিশেষে আমরা পশুরা সবাই ভাইভাই। কোনো পশু যেন কখনোই অন্য পশুকে হত্যা না করে। পশুরা সবাই সমান!
এবার গতরাতের স্বপ্নের কথা শোনাতে চাই তোমাদের। স্বপ্নের অর্থ বুঝিয়ে বলার ক্ষমতা আমার নেই। শুধুমাত্র একথাই বলতে চাই যে, মানুষদের পৃথিবী থেকে তাড়ানোর পর যে সুসময় আমাদের আসবে, আমার স্বপ্ন সেটিই দেখাতে চেয়েছে। পাশাপাশি এই স্বপ্ন বিস্তৃত এক পুরনো কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। বহু বছর আগে, যখন আমার বয়েস একেবারেই কম, আমার মা ও তার সঙ্গীরা একটি প্রাচীন গান গাইত মনের আনন্দে। শুধুমাত্র গানটির তিনটি কলি ও সুর জানা থাকলেও গাইতে কোনো সমস্যা হতো না তাদের। আমার নিজেরও সে সুরটি জানা থাকলেও ভুলে গিয়েছিলাম এতদিনে। গতকাল স্বপ্নের মাঝে সে সুরটিই ফিরে পেয়েছি আবার। আমার বিশ্বাস, একসময় প্রতিটি পশুই এই গানটি গাইতে জানতো ও এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতো। এই গানটিই তোমাদের শোনাতে চাইছি আমি। বয়েস হয়েছে, গলার স্বরও ভালো নয় আমার। তবে এটুকু বলতে পারি, একবার শেখার পর গানটি আমার চেয়েও ভালো গাইবে তোমরা। গানটির নাম "ইংল্যান্ডের পশু"।“
জাগো, ইংল্যান্ডের পশুসব , জাগো রে জাগো
জাগো, আয়ারল্যান্ডের পশুসব, জাগো রে জাগো
জগতের সব পশু জাগোরে জাগো,
জাগো জাগো ।
মানব-অত্যাচারে, ভীম বজ্র হানি,
শোনো সোনালী দিনের নব মথিত বাণী,
শোনো মথিত বাণী,
শাসক শোষক মানুষ, তার বিনাশের দিন.
ওরে ওই আগত, জাগো জাগো।
নব ভিত্তি পরে, নব মুক্তি নিশান আজ উত্থিত রে,
নব ভিত্তি পরে,
শোন মানুষ প্রাণী, শোন অত্যাচারী,
মোরা সর্বহারা, আজ ছিঁড়ব দড়ি!
আজ টুটবে বেড়ি!
ওরে সর্বশেষের এই সংগ্রাম মাঝ,
নিজ নিজ অধিকার খুঁজে দাড়া পশু আজ
এই মানব বিরোধী এই সংহতি রে,
করে নিখিল পশুর শির সমুদ্ধত,
জাগো জাগো।
এই শৃঙ্খল সনাতন কসাই খামার,
মূল সর্বনাশে মোরা ভাঙ্গিব এবার,
ভেদী মানব কারা,
এসো সর্বহারা,
পশু রহিবে আর কারো পদানত।
জাগো জাগো।
জাগো, ইংল্যান্ডের পশুসব , জাগো রে জাগো
জাগো, আয়ারল্যান্ডের পশুসব, জাগো রে জাগো
জগতের পশুসব জাগোরে জাগো,
জাগো জাগো ।
সামান্য গলা ঝেড়ে গাইতে শুরু করে মেজর। গলার আওয়াজ সামান্য ফ্যাসফেসে হলেও গায়ক হিসেবে মন্দ নয় সে। এমনকি গানটির সুরও উদ্বেলিত করে সবাইকে।
সমস্ত পশুদের মাঝে অপার এক উত্তেজনার সঞ্চার করে মেজরের গান। তার গাওয়া শেষ করার আগেই সবাই গাইতে শুরু করে তার সাথে। এমনকি কম বুদ্ধির পশুরাও সুর ও কয়েকটি কলি চটপট শিখে ফেলে। যারা বুদ্ধিমান পশু, যেমন শুকর ও কুকুর, তারা কয়েক মিনিটের মাঝেই পুরো গানটি মুখস্থ করে ফেলে। অবশেষে, কয়েকবার অনুশীলনের পরই "ইংল্যান্ডের পশু" সমস্ত পশুদের মাঝে অবিশ্বাস্য এক একাত্মতার বীজ ছড়িয়ে দেয়। গরুরা হাম্বা হাম্বা, কুকুরের ঘেউ ঘেউ, ভেড়ার পালের ম্যা ম্যা, ঘোড়াদের হ্রেষাধ্বনি এমনকি হাসেরাও প্যাক প্যাক করে সুর তুলে। এত বেশী আনন্দ পায় যে, সবাই মিলে পর পর পাঁচবার গেয়ে ফেলে গানটি। কোনো বাঁধা না পেলে হয়তো তার সারারাতটি গাইতে থাকতো।
দুর্ভাগ্যক্রমে এই গোলমালে ঘুম ভেঙ্গে যায় জোনসের। ভাবে শেয়াল পড়েছে খামারে। ঘরের কোণে ঠেস দিয়ে দাঁড় করা ছররা বন্দুকটি নিয়ে জানলা খুলে অন্ধকারে গুলি ছোড়ে একরাশ। খামারের দেয়ালের গায়ে ইতস্তত ছিদ্র করে তার বন্দুকের গুলি ও পশুদের সমাবেশের সমাপ্তিও ঘটে সেখানেই। প্রত্যেকেই তড়িঘড়ি করে তাদের নিজদের ঘুমের স্থানে ছোটে। পাখিরা তাদের আড়কাঠে ও পশুরা খড়ের গাদায়। মুহূর্তের মাঝেই পুরো খামারবাড়ি পুরোপুরি নিঃশব্দ।
চলবে ...
মন্তব্য
কিছু যায়গায় খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হল। হয়ত সেটা প্রত্যক্ষ অনুবাদের জন্য হতে পারে। আপনি "জর্জ অরওয়েল" কি লিখতে চেয়েছিলেন সেটা না লিখে আপনি পড়ার সময় কিভাবে কল্পনা করেছিলেন সেটা লিখলে পাঠকের আকর্ষন বাড়তে পারে।
নামটা "পশুদের খামার" কেন যানি আকৃষ্ট করে নাই আমাকে, "অ্যানিম্যাল ফার্ম" হলে মানানসই হত। আমার মতে কোন অনুবাদের নাম মূল বইয়ের নামেই হওয়া উচিৎ।
--বেচারাথেরিয়াম
হয়তো হতে পারে। সময় নিয়ে ভালো দেখার সুযোগ কম। নাম বিষয়ে আমার অন্য মত। যে জার্মান অনুবাদ আগে করেছি, সেগুলোর নাম অনুবাদ না করলো কি চলতো? অন্য নাম মাথায় আসেনি, ভেবে দেখব। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
--------------------------------------------------------------------------------
ধন্যবাদ জানাই।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
অনুবাদ ভাল লাগছে সব। ওয়েলকামবেক।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
ধন্যবাদ জানাই।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
চমৎকার
..................................................................
#Banshibir.
অনেক ধন্যবাদ সতজপীর।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
আমার অন্যতম প্রিয় বই হচ্ছে 'অ্যানিমেল ফার্ম', তাই এত প্রিয় বই কেউ একজন অনুবাদ করছে দেখে বেশ লাগলো। অনুবাদ বেশ ভালোই লাগছে।
- নির্মোহ ভাবনা
তবে বাংলায় আগে অনুবাদ হয়েছে শুনে কিছুটা হতাশ্ তবে চালিয়ে যাব। ধন্যবাদ জানাই আপনাকে।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
ভাল লাগছে
ধন্যবাদ জানাই ধুসর জলছবি।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
বইটা বহু আগে পড়েছিলাম। বাংলাতেই। নাম এ্যানিমেল ফার্ম...
বইটার সবচে অদ্ভুত হচ্ছে মেজর নামের শুওরটা। যার চরিত্রের ভেতরে মার্ক্স লেনিন স্টালিন থেকে ইয়েলেৎসিন পর্যন্ত বৈশিষ্ট্যগুলো পাওয়া যায়....
আপনার কথা ঠিক। আমার কাছে পুরো কাহিনীই বাস্তব অর্থবহ। ভালো থকবেন লীলেন। সামনের ফেব্রুয়ারিতে দেখা হবে।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
আগে পড়ি নি। আপনার অনুবাদ দিয়েই পড়বো ভাবছি। ভালো হচ্ছে। এবারের পর্ব আরো বেশি সাবলীল হয়েছে।
সমাজতন্ত্রের বিভিন্ন রেটরিক দেখতে পাচ্ছি বুড়া মেজরের ভাষ্যে। মানুষরা এখানে "রক্তচোষা" পুঁজিপতি বণিক আর পশুরা প্রোলিতারিয়েত, ছোট জমিওয়ালা কৃষক, ক্ষেতমজুর, তাই না?
প্রথম পর্বে মেজরের বাণী -
এর সাথে মার্ক্সের "জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির দাবিনামা"র ৯ নম্বর দাবির পরে বলা নিচের বাণীটি তুলনীয় -
মেজর যখন বলে -
তখন মার্ক্সের এলিয়েনেশন তত্ত্ব আর এঙ্গেল্সের The Principles of Communism এর নিম্নোক্ত বাণীর কথা মনে পড়ে -
সমগ্র পুঁজিপতি বণিকশ্রেণীকে (এখানে মানুষকে) শত্রুশ্রেণী হিসেবে দেখাটা সমাজতন্ত্রের স্বাভাবিক ভাষ্যের অংশ। সার্বিকভাবে ব্যবসার উপরেই এক ধরনের ঘৃণা কাজ করে। এ জন্যে বলছে
সুদের ব্যাপারে যেমন আক্রোশ যুগযুগ ধরে intelligentsia (যুগে যুগে কবি, সাহিত্যিক, ধর্মীয় গুরু, দার্শনিক, একালের বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠি) দেখিয়ে আসছে।
মদ হারামের কথা বলায় মোহাম্মদের কথাও মনে পড়ে গেলো।
কিছু অমিলও আছে। এখানে পশুরা যতোটা না প্রোলিতারিয়েত, তার চেয়ে বেশি হলো দাস। মার্ক্স প্রোলিতারিয়েত ও দাসের মধ্যে পার্থক্য করেছিলেন। দাস বাধ্যতামূলক শ্রম দেয়, প্রোলিতারিয়েত তার কারখানা বাছাইয়ে মুক্ত।
আরেকটা অমিল হলো, মেজর শুকরটা এখানে প্রোলিতারিয়েতদেরই একজন। সে প্রোলিতারিয়েতদের একজন হিসেবে বিপ্লবের পরিকল্পনা, দার্শনিক ভিত্তি তৈরি করছে। সে নিজের হয়ে বলছে। মার্ক্স নিজে বুর্জোয়া সমাজের অংশে থেকে প্রোলিতারিয়েতের হয়ে তত্ত্ব দেয়ার চেষ্টা করছেন। ইউনূসের মতো নবির আসনে থেকে দারিদ্র বিমোচনের ছায়া তৈরি করছেন। এইসব তত্ত্ব প্রোলিতারিয়েতের কাছে এলিয়েন। এখানে প্রোলিতারিয়েত বরাবরের মতোই বুর্জোয়া তত্ত্বের ক্রীড়নক। অনেকে বলতে পারেন, তত্ত্ব কোথা থেকে আসছে তাতে কী আসে যায়। তবে প্রোলিতারিয়েতের ঘরে এই তত্ত্ব উৎপন্ন হবার উদাহরণ দেখলে কিছুটা হলেও মানা যেতো।
চালিয়ে যান।
তীরু'দা!
ম্যালাদিন পর আপনাকে দেখেই মন ভালো হয়ে গেলো।
কেমন আছেন?
আর অ্যানিমেল ফার্ম...? বসে পড়লাম
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
১ যাতে তারা যতদিন না বিজয় আমাদের, ততদিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে।
২পশুদের মাঝে পুরো একাত্মটা
৩ পশু রহিবে আর কারো পদানত।
৪ কোনো বাঁধা না পেলে হয়তো তার সারারাতটি গাইতে থাকতো।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
নতুন মন্তব্য করুন