২য় পর্ব
তিনরাত পর মৃত্যু হয় বুঢঢা মেজরের। ফলবাগানের এক প্রত্যন্ত কোণে কবর হয় তার।
এটি মার্চের শুরু ঘটনা। পরবর্তী তিন মাস ধরে নানাবিধ গোপন আলোচনা ও কর্ম প্রবাহের জোয়ার বয় পশুদের মাঝে। মেজরের আহ্বানে উদ্বেলিত অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান পশুদের সামনে আলোকিত আগামী সময়ের হাতছানি। এই বিপ্লবের সূত্রপাত কখন ঘটবে- জানা নেই। নিজের জীবদ্দশায় এমনি এক বিপ্লবের অংশীদার হবে কেউ, সেটি মনে করারও কিছু ঘটেনি এ অবধি। তারপরও নিজদেরকে প্রস্তুত করা কর্তব্য হিসেবে সবাই মেনে নেয়। সবচাইতে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে শুকররা বাকীদের দলভুক্ত ও সঙ্ঘবদ্ধ করার দায়িত্বে। সেই সূত্রে নেপোলিয়ন ও তুষারবল নামে দু'টি শুকর বেশ পরিচিত হয়ে উঠে সবার মাঝে। দু'জনকে মোটাতাজা করে বাজারে বিক্রির জন্যে বড় করছিল জোনস। তাদের একজন গাঁট্টাগোট্টা চেহারার নেপোলিয়ন। বার্কশায়ারের অভিজাত শ্রেণীর সেই একমাত্র শুয়োর। বক্তা হিসেবে খুব চৌকশ না হলেও নিজের মত প্রতিষ্ঠায় অবিচল সে। তুষারবল নেপোলিয়নের চাইতে অনেকটা ছটফটে স্বভাবের হলেও ভালো বক্তা হিসেবে পরিচিত। যদিও সে অভিজ্ঞতায় নেপোলিয়নের চাইতে অনেক পিছিয়ে, তারপরও নতুন নতুন পরিকল্পনার জাল বিস্তারে তুষারবলের জুড়ি নেই কেউ। খামারের বাকী পুরুষ শুয়োরেরা একটু নিচু শ্রেণীর হলেও তাদের মাঝে চাপাবাজ নামে একজন বেশ পরিচিতি পায় সবার মাঝে। তার গোলগাল চেহারা, গলার আওয়াজ তীক্ষ্ণ। চোখের চাউনির ভাষায় মনে হয় এক্ষুণি চোখ টিপে কিছু বলবে। বক্তা হিসেবে পারদর্শী সে। কোনো কঠিন বিষয়ে আলোচনা করার সময় তার স্বভাব হল, নিজের পেছনের অংশ উপরে তুলে বারবার ডানদিকে ও বাঁদিকে লাফানো। সেইসাথে লেজ উপরে তুলে নড়াচড়া করা। এসব ভঙ্গীর কারণে তার বক্তব্যকে অনেক সময়েই বেশ যৌক্তিক মনে হত। তবে ওর সম্পর্কে বাকীদের মন্তব্য, সে কালোকে সাদা করায় ওস্তাদ!
এই তিনজন মিলে মেজরের দেয়া বক্তৃতার অবলম্বনে একটি পরিপূর্ণ চিন্তাধারার প্রবর্তন করে। তারা এর নাম দেয়, পশুতন্ত্র। জোনস ঘুমনোর পর ঘনঘন গোপন মিটিং ডাকে তারা। সেসব মিটিংএ সবাইকে পশুতন্ত্রের বাকী ধারাগুলো বুঝিয়ে দেয়া হল। শুরুতে অনেক আজেবাজে মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হয় ওদের। কেউ কেউ জোনসকে তাদের প্রভু মেনে প্রভুভক্তির ধুয়ো তোলে। কেউ কেউ বলল, "জোনস অন্নদাতা। সে না থাকলে উপোষেই মারা যাব!" কয়েকজন বলে, "আমাদের মৃত্যুর পর কী ঘটবে, তা নিয়ে ভাবার কি দরকার? " বা "যদি বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী, তাহলে আমরা কিছু করি বা না করি, তাতে কিছু যায় আসে কি!" এ ধরণের চিন্তাধারা যে পশুতন্ত্রের পরিপন্থী, সেটি বোঝাতে গল-ধর্ম হয় শুকরগুলো। সবচাইতে বোকার মতো প্রশ্ন করে মলি, "বিপ্লবের পর কি বেশী করে চিনি খেতে পাবো?"
তুষারবল দৃঢ় আওয়াজে বলে, "না, খামারে চিনি বানানোর কি পদ্ধতি, জানা নেই আমাদের। তাছাড়া চিনির দরকার কি তোমার? খইল আর খড় যতো চাও, ততোই পাবে।"
"বিপ্লবের পরও কি গলায় ফিতে পড়তে পারবো?"
তুষারবল মলির দিকে তাকিয়ে বলে, "কমরেড, এই ফিতে যে দাসত্বের প্রতীক, তাও জান না? রঙিন ফিতের চাইতে যে স্বাধীনতা মূল্যবান, শোননি কখনও?"
তুষারবলের কথা বাইরে বাইরে মেনে নিলেও মলির গলার স্বরে অবিশ্বাস লেপটে থাকে। কিন্তু এরচেয়ে বড় সমস্যা জোনসের পোষা কাক মোসেস। তার বানানো গুজব প্রতিহত করতে গলদঘর্ম হতে হল শুয়োরগুলোকে। জোনসের নয়নের মণি এই মোসেস, গুপ্তচরবৃত্তি আর বকবকানোতে ওস্তাদ, পাশাপাশি বক্তা হিসেবেও খুব দক্ষ। তার দাবী, সে মিছরির পাহাড় ঘেরা একটি রহস্যময় জায়গার কথা জানে। মৃত্যুর পর পশুদের গন্তব্যস্থল নাকি সেখানেই। আকাশেই কাছাকাছি, সামনের মেঘ গুচ্ছ থেকে সামান্য দূরেই নাকি জায়গাটি। ওখানে প্রতিটি দিনই রোববার, মাঠে সারাক্ষণই সবুজের সমারোহ। পাহাড়ের গায়ে লাগানো আংটায় ঝুলছে চিনির গোল্লা আর তেলেভাজা পিঠা। চাপাবাজ ও অলস বলে মোসেসকে ঘৃণা করে সবাই, কিন্তু তার মিছরি আর পাহাড়ের গল্প অনেকেই বিশ্বাস করে। এরকম পাহাড়ের যে কোনো অস্তিত্ব নেই, তাদেরকে এই বিশ্বাসে টানতে অনেক ঘাম ঝরাতে হয় শুয়োরদেরকে।
তাদের সবচাইতে বিশ্বাসযোগ্য শিষ্য হল বক্সার আর সর্ষেফুল, দুই গাড়ী টানা ঘোড়া। তাদের নিজস্ব চিন্তা ক্ষমতা খুবই সীমিত। কিন্তু একবার শিক্ষক হিসেবে মেনে নেবার তাদের কাছে শুয়োরদের প্রতিটি কথাই যেন বেদবাক্য। সরল যুক্তির মাধ্যমে বাকী পশুদেরকেও তাদের বিশ্বাসের আওতায় আনার চেষ্টা চালায় তারা। গোপন মিটিঙে তাদের উপস্থিতি অপরিহার্য ও "ইংল্যান্ডের পশুরা" গানটিতে তাদেরই আওয়াজ সবার উপরে।
কিন্তু এই বিপ্লব বা অভ্যুত্থান এতো দ্রুত ও এত সহজে ঘটবে, যা কেউ কখনো ভাবতে পারেনি। খামার মালিক হিসেবে জোনস বেশ কঠোর চরিত্রের হলেও অন্যদিকে তেমনি কর্মঠ। কিন্তু গত কদিন ধরেই নানা দুর্ভাগ্যের শিকার সে। তারপর 'গোদের উপর বিষফোড়ার মতো' একটি মামলাতেও হারতে হয় তাকে। আর এসব কারণেই মদের উপর আসক্তিও বেড়ে যায় তার। মাঝে মাঝে রান্নাঘরে একটি ইজিচেয়ারে বসে অলস দিন কাটায়। হাতে মদের গ্লাস ও খবরের কাগজ। কখনো সখনো রুটির টুকরো মদে ভিজিয়ে খাওয়ায় পোষা কাক মোসেসকে। তার কামলাগুলোও অসৎ আর অলস। মাঠ ভর্তি আগাছা, বাড়ির ছাদও ভঙ্গুর। পশুদেরকে খাবার দেবারও নেই কেউ।
জুন মাস, সোনালী রঙ লেগেছে খড়ের গায়ে। এখন কেটে শুকোনোর পালা। কোনো এক ধর্মীয় দিনের আগে শনিবারের সন্ধ্যায় উইলিংডনের 'লাল সিংহ' নামের একটি শুঁড়িখানায় বসে ইচ্ছেমত মদ টানে জোনস। এতোই মাতাল সে, রোববার দুপুরের আগে বাড়ী ফিরতে পারে না। তার কামলারা কাক ডাকা ভোরে দুধ দোয়ার কাজ শেষ করেই চলে যায় খরগোস শিকারে। পশুদেরকে খাবার দেবার কথা মনেও হয় না তাদের। জোনস বাড়ী ফিরেই খবরের কাগজটি মুখের উপর ফেলে ঘুমিয়ে পড়ে বসার ঘরের সোফায়। সন্ধ্যা অবধিও কোনো খাবার জোটে না পশুদের। একসময় অসহ্য হয় ক্ষুধা। একটি গরু শিঙের আঘাতে ওদের খাবার ঘরের দরজা খুলে ফেলতেই সবাই ঢুকে খাওয়া শুরু করে। ঘুম ভেঙ্গে যায় জোনসের ও চারজন কামলা ডেকে চাবুক দোলাতে দোলাতে ঢুকে ইচ্ছামতো পেটাতে শুরু করে পশুদের। ক্ষুধার্ত পশুদের ধৈর্য্যশক্তির বাইরে চলে যায় তাদের এই অত্যাচার। কোনো পূর্বপরিকল্পনা না থাকলেও ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের অত্যাচারীদের উপর। চারদিক থেকে শিলাবৃষ্টির মতো লাথি আর আঘাতে দিশেহারা তখন জোনস আর তার কামলারা। পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না আর। পশুদের এই আচারের সাথে একেবারেই পরিচিত নয় তারা। যাদেরকে ইচ্ছেমত পিটিয়ে অত্যাচারে জর্জরিত করে অভ্যস্ত তাদেরই এই হঠাৎ বিক্ষোভে ভয়ে দিশেহারা হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মাঝেই প্রতিরোধের সব চেষ্টাকে বিসর্জন দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালায় গাড়ী টানার পথ ধরে। খামার ছেড়ে বড় রাস্তায় ওঠা অবধি পশুরা বিজয়ের আনন্দে চেঁচাতে চেঁচাতে ছোটে ওদের পিছু পিছু।
তার বউ শোবার ঘরের জানলা থেকে পুরো ঘটনা দেখতে পায়। দ্রুত একটি ব্যাগে জরুরী কাপড় চোপড় গুছিয়েই অন্য এক পথে পালায় খামার ছেড়ে। মোসেস তার কড়িকাঠ থেকে লাফিয়ে কা কা করতে করতে ছোটে তার পেছনে পেছনে। ততক্ষণে পশু দল জোনস ও তার সঙ্গীদের বড়রাস্তা অবধি তাড়া করে ফিরে আসে খামারে। পাঁচটি আড়াআড়ি কাঠে শক্তভাবে বন্ধ করে খামারের শিক-বাধানো গেট। তাদের সফল বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে এভাবেই। জোনস সদলবলে বিতাড়িত ও পশুরাই এখন মালিক এই খামারের।
চলবে………
মন্তব্য
চলুক।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
জর্জ অরওয়েল এর 'অ্যানিম্যাল ফার্ম' বইটার নাম অনেক শুনেছি। কিন্তু কখনো পড়া হয়নি। সচলায়তনে আমি আজকেই প্রথম। শুরুতেই আমার চোখে পড়ল এই লেখাটা। দ্বিতীয় পর্ব দেখে খুঁজে চলে গেলাম প্রথম পর্বে । সেটা শেষ করে এই পর্বটাও পড়লাম। ভালই লাগলো। খুব সরল আর সহজবোধ্য অনুবাদ। আর অনুবাদ সাহিত্যে এটাই খুব দরকার। চালিয়ে যান তীরন্দাজ।
সচলায়তনে স্বাগতম জানাই আপনাকে। চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব ভাল করার। জানি, বইটির অনুবাদ হয়েছে আগেও। তারপরও নিজের কাছেই কাজটি করতে ভাল লাগছে।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
দারুণ হচ্ছে।
ছোটবেলায় এই গল্প পড়তে পারলে ভালো হতো। আপনার এই অনুবাদটা বেশ চমৎকার লাগছে। বাংলাদেশের শিশুদের হাতে এই গল্প (বাংলায়) পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যদি যেতো, বা কমিক্স আকারে।
এখানে দেখুন, অ্যানিমেল ফার্ম একটু হলিউডি ঢঙে বানানো হয়েছে। খুব আহামরি কিছু হয় নি। সমাপ্তিটাও নাকি ভিন্ন। তবে গল্পটা বোঝার জন্যে খারাপ নয়।
চলুক!
অনেক ধন্যবাদ লিংকটির জন্যে। আমি আর আমার স্ত্রী মিলে গতকাল রাতেই দেখে নিয়েছি। কাহিনী অনেকটা পরিবর্তন করা হয়েছে। তারপরও ভাল লেগেছে খুবই। আজ রাতে আরেকবার দেখব।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
জোস
..................................................................
#Banshibir.
ধন্যবাদ!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
এখানে অ্যানিমেল ফার্মের সাথে কমিউনিজমের বিভিন্ন চরিত্রের তুলনা করা হয়েছে।
জোন্স - জার নিকোলাস
বুড়ো মেজর - কার্ল মার্ক্স
পশুতন্ত্র - কমিউনিজম
তুষারবল - লিঁয় ট্রটস্কি
নেপোলিয়ন - জোসেফ স্টালিন
শেষের বাক্যটা মজার -
"Stalin made Czar look like a nice guy"
আপনার তুলনা সঠিক। তবে আমি এতে শুধুমাত্র কমিউনিজম নয়, পাশাপাশি অন্যান্য রাষ্ট্রব্যবস্থারও চিত্র দেখতে পাই। আমাদের দেশের সাথে তুলনা করলে কেমন মনে হয়?
তবে কমিউনিজমের চিত্রটাই সবচেয়ে স্পষ্ট।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
সেবা প্রকাশনীর (সম্ভবত) অনুদিত অ্যানিমেল ফার্ম পড়েছিলাম বেশ আগে - অনুবাদটা অধুনা অনুবাদকদের কারো করা, ভালো লাগেনি। কিন্তু বইটাযে কত সুন্দর তা বুঝতে পারছি আপনার লেখায় - চলুক।
-অয়ন
অনেক অনেক ধন্যবাদ অয়ন। চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব ভাল করার।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
১ সেটি বোঝাতে গল-ধর্ম হয় শুকরগুলো।
২ আকাশেই কাছাকাছি,
৩ কিন্তু একবার শিক্ষক হিসেবে মেনে নেবার তাদের কাছে শুয়োরদের প্রতিটি কথাই যেন বেদবাক্য।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
নতুন মন্তব্য করুন