নিজেদের ভাগ্যকে বিশ্বাসই করতে পারে না পশুরা। প্রথম কাজ হিসেবে খামারের পুরো সীমানা লাফিয়ে লাফিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। হয়তো কোথাও কোনো মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে! তারপর ঘৃণিত জোনসের রাজত্বের শেষ চিহ্নগুলোকে দুর করতে ফিরে আসে খামারের মূল বাড়িতে। ততক্ষণে খোঁয়াড়ের শেষের ঘরের দরজা ভাঙ্গা হয়েছে। পশুদের নাকের আংটা, গলার দড়ি, মুখ বন্ধ করে রাখার মুখোশ, কুকুর বাঁধার শিকল, সে ভয়ঙ্কর ছুরি, যা দিয়ে জোনস শুয়োর ও ভেড়াকে বন্ধ্যা করতো, ছুড়ে ফেলে কুয়োর অন্ধকারে। ঘোড়ার লাগাম, বলগা, ছড়ি, চাবুক পোড়ায় উঠোনের জ্বলন্ত আগুনে। চাবুকগুলোকে পুড়তে দেখে আনন্দে লাফায় সবাই। যে রঙিন ফিতেয় হাটবারে কেশর, কান, লেজ ও মাথায় জড়িয়ে সাজানো হতো ঘোড়াকে, সেগুলোও আগুনে ছুড়ে ফেলে তুষারবল।
তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলে সে, "এই ফিতেগুলোও পোশাক হিসেবে মানব সমাজেরই এক প্রতীকী চিহ্ন। সব পশুকেই উলঙ্গ থাকতে হবে।" গরমের সময় মাছির উপদ্রব থেকে রক্ষা পাবার জন্যে কানের উপর একটি টুপি লাগতো ক্লোভার। তুষারবলের কথা শুনে সে সেটিও ছুড়ে ফেলে আগুনে।
যেসব বস্তু জোনসের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারে, মুহূর্তের মাঝেই সেসব নিঃশ্চিহ্ন করে পশুরা। তারপর নেপোলিয়ান সবাইকে নিয়ে যায় পশুদের খাবার ঘরে। প্রতিদিনের চাইতে দ্বিগুণ খাবার দেয় প্রত্যেককে। কুকুরগুলো পায় দুটি করে মাংসের টুকরো। খাবার শেষে সবাই মিলে পর পর সাতবার "ইংল্যান্ডের পশু" গাওয়ার পর ঘুমোতে যায় সবাই। এত আরামে তারা আগে কখনোই ঘুমোতে পারেনি।
কিন্তু প্রতিদিনের অভ্যাস-মতো কাক ডাকা ভোরেই জেগে উঠে সবাই। আগের দিনের ঘটনাপ্রবাহ মনে পড়তেই একসাথে মিলে ক্ষেতের দিকে রওয়ানা হয়। ছোঠখাট একটি ক্ষেত পেরিয়ে যাবার পর গোলগাল উঁচু একটি চুড়া। চুড়ার উপর থেকে খামারের প্রায় পুরোটাই দেখা যায়। সবাই মিলে উপরে উঠে সকালের উজ্জ্বল আলোতে পুরো খামার এলাকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। এই পুরো খামারের মালিক ওরা নিজেরাই! এই চুড়া থেকে যতদূর চোখ পড়ে, এরাই তার মালিক! আনন্দের উত্তেজনায় ইতস্তত দৌড়াদৌড়ি ও লাফালাফি শুরু করে সবাই মিলে। সকালে শিশিরে গা ভিজিয়ে সুস্বাদু কচি ঘাস চিবোয় কয়েকজন। কালো সোঁদা মাটির গন্ধ শুঁকে শিহরিত হয়। তারপর পুরো খামার, ফলবাগান, পুকুর, ঝোঁপঝাপ খুঁটিয়ে দেখার সময় এক অব্যক্ত গর্বে ভরে উঠে ওদের বুক। এসবের অনেক কিছুই তারা আগে কখনও দেখতে পায়নি আর এখনও অবিশ্বাস্য যে, সবকিছুর মালিক এখন ওরাই।
তারপর সবাই একসাথে ফিরে আসে খামারের বাসস্থানে। জোনসের বাড়ির দরজার সামনে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে তারা। এই বাড়িও এখন ওদেরই দখলে। তারপরও ভেতরে ঢুকতে শঙ্কিত সবাই। সামান্য পরে নেপোলিয়ন আর তুষারবল কাঁধের ধাক্কায় দরজা খুলতেই ধীরে ধীরে একে একে ভেতরে ঢুকে সবাই। এত সাবধানে, যাতে কোনভাবেই কিছু উলটপালট না হয়।
পা টিপে টিপে একটার পর একটা ঘর ঘুরে দেখে তারা। এমনভাবে ফিসফিসিয়ে কথা বলে নিজেদের মাঝে যে, মনে হয় অবিশ্বাস্য এই ঐশ্বর্যে আর জাঁকজমকের মুখোমুখি হয়ে অজানা ভয় জাপটে ধরেছে ওদেরকে। পালকের বিছানা, আয়না, নরম সোফা, বেলজিয়ামের কার্পেট আর বসার ঘরে চুল্লির উপরে রাণী ভিক্টোরিয়ার অঙ্কণচিত্র। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার পর হঠাৎ উধাও মলি! কয়েকজন উপরে ফিরে গিয়ে দেখে, মিসেস জোনসের শোবার ঘরের ড্রেসিং টেবিল থেকে একটি নীল ফিতে কাঁধে জড়িয়ে আয়নায় নিজেকে অস্থির বিস্ফারিত চোখে দেখছে বার বার। কয়েকজন মিলে ঝাঁকুনির দেবার পর সম্বিত ফিরে পায় সে। একসাথে ফিরে আসে নীচে। ভাড়ার ঘর ভর্তি শুকনো মাংসের টুকরো নিচে আনা হয় মাটিতে পুতে ফেলার জন্যে। বক্সারের পায়ের ক্ষুরের আঘাতে বিয়ারের পিপের গায়ে বিশাল এক ছিদ্র! তবে এর বাইরে আর কিছুই স্পর্শ করা হয়না। সমবেত সিদ্ধান্তে বাড়িটিকে মিউজিয়াম হিসেবে রাখা হয়। এটি কোনো পশুর বাসস্থান নয়, এই সিদ্ধান্তও নেয় সবাই মিলে।
সকালের নাস্তা সারার পর নেপোলিয়ন আর তুষারবলের ডাকে আবার জমায়েত হয় সবাই।
সবাইকে উদ্দেশ করে বলে তুষারবল, "বন্ধুগণ! সাড়ে সাতটা বাজে। সারা দিন পড়ে আমাদের সামনে। আজ ঘাস কাটার দিন। তবে তার আগে আরেকটি জরুরী কাজ শেষ করতে হবে আমাদের।"
নতুন খবর জানানো হয় সবাইকে। গত তিন মাসে পড়তে ও লিখতে শিখেছে শুয়োরেরা। আবর্জনার স্তূপে জোনসের ছেলেমেয়েদের একটি পুরনো রূপকথার বই পড়ে ছিল। সেটিই সহায় হয়েছে ওদের। নেপোলিয়নের নির্দেশে পাত্র ভর্তি সাদা আর কালো রঙ আনা হয়। সবাইকে নিয়ে নোপোলিয়ান আগে আগে চলে পাঁচটি আড়াআড়ি গড়া খামারের প্রধান ফটকে, বড় রাস্তার সামনা সামনিই। যেহেতু তুষারবল ভালো লিখতে শিখেছে, দায়িত্ব তার হাতেই বর্তায়। সামনের দুই পায়ে ব্রাশ ধরে সবচাইতে উঁচু খামে "পুরুষদের খামার" লাইনটি মুছে লিখে "পশু খামার"। আজ থেকে এটিই এই খামারের নাম। বাড়িতে ফেরার পর নেপোলিয়ন ও তুষারবলের নির্দেশে একটি মই আনা হয়। সেটি লাগানো হয় সব চাইতে বড় আস্তাবলের পেছনের দেয়ালে। গত তিন মাসে পশুতন্ত্রের সাতটি সংক্ষিপ্ত দফা স্থির করা হয়েছে, সে সব বুঝিয়ে বলা হয় সবাইকে। সে সাত দফা এবার লেখা হবে দেয়ালের গায়ে ও প্রতিটি পশুর জন্যে দফাগুলো পশুতান্ত্রিক আইন অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। মই বেয়ে উপরে ওঠা কোনো পশুর জন্যে একেবারেই সহজসাধ্য নয়। তারপরও ধীরে ধীরে কষ্টেসৃষ্টে মই আঁকড়ে উপরে উঠে তুষারবল। তার পেছনে কয়েকটি বাচ্চা শুয়োর রঙের পাত্রটি ধরার জন্যে থাকে। আলকাতরায় লেপা কালো দেয়ালে এত বড় বড় অক্ষরে লেখা হয় সাতটি দফা, যাতে তিরিশ মিটার দূর থেকেও ভালভাবে পড়া যায়।
এই সাতটি দফা হল,
১) যারা দুপায়ে চলাফেরা করে, তারা সবাই শত্রু।
২) যারা চারপায়ে চলাফেরা করে বা যাদের পাখা আছে, তারা সবাই বন্ধু।
৩) যে কোনো পোশাক প্রতিটি পশুর জন্যে নিষিদ্ধ।
৪) কোনো পশু যেন কোনো বিছানায় না ঘুমায়।
৫) মদ প্রতিটি পশুর জন্যে নিষিদ্ধ।
৬) এক পশু কখনোই যেন অন্য পশুকে হত্যা না করে।
৭) সব পশু সমান সমান।
বন্ধুর বদলে বান্ধু ও "ন" উল্টো করে লেখা হলেও দফাগুলো বেশ স্পষ্টভাবেই লেখা হল। আর নেপোলিয়ন যেভাবে সবাইকে পড়ে শোনায়, কাজে লাগে খুব। প্রতিটি দফার সাথে মাথা নেড়ে সন্মতি জানায় পশুরা ও যারা বুদ্ধিমান, সাথে সাথে মুখস্থ করার চেষ্টা করে।
তুষারবল রঙের ব্রাশটি ছুড়ে ফেলে সবার দিকে তাকিয়ে বলে, "বন্ধুরা, চল এবার মাঠে যাই! আমরা যদি ক্ষেতের ফসল মানুষদের চাইতে দ্রুত ঘরে আনতে পারি, এর চাইতে বড়ো সম্মান আর আমাদের জন্যে কী হতে পারে।"
ঠিক সে মূহুর্তেই তিনটি গরু বেশ জোরে সোরেই চেঁচামেচি শুরু করে। অনেক আগে থেকেই বেশ অস্বস্তিতে ভুগছিল ওরা। গত চব্বিশ ঘণ্টায় একবারও দুধ দোয়ানো হয়নি। তাদের ওলন প্রায় ফেটে পড়ার উপক্রম। সামান্য ভাবনার পর শুয়োরদের নির্দেশে বালতি আনা হয়। বেশ সাফল্যের সাথেই দুধ দোয়ায় শুয়োরেরা। তাদের সামনের পায়ের নরম পাতা এজন্যে বেশ উপযোগীই। কিছুক্ষণের মাঝেই পাঁচ বালতি দুধ জমল ও অনেকে অধীর আগ্রহে সে দুধের দিকে তাকায়।
"এই দুধের কী হবে?", জানতে চায় একজন।
"মাঝে মাঝে আমদের খাবারের সাথে মিশিয়ে দিত জোনস।", জানায় এক মোরগ।
নেপোলিয়ান দুধের বালতিগুলোকে নিজের দেহের আড়াল দিয়ে বলে, "এই দুধ নিয়ে তোমরা ভেবো না, বন্ধুরা। যা করার. আমরাই করব। দুধের চাইতে ফসল জরুরী। কমরেড তুষারবল তোমাদের মাঠে পরিচালনা করবে। কয়েক মিনিটের মাঝে আমিও আসছি। এগিয়ে যাও বন্ধুরা। তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে ঘাস।"
সারে সারে মাঠের দিকে এগিয়ে যায় পশুর দল মাঠের কাজ সারার জন্যে। কাজ শেষে বিকেলে ফিরে এসে সে দুধ আর দেখতে পায়না কেউ।
চলবে………
মন্তব্য
চলুক চলুক
..................................................................
#Banshibir.
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
****************************************
পড়ছি।
দারুন বর্ণনা। পড়ে মনে হয় না এটা কোনো বিদেশী গল্প। পড়তে আরাম লেগেছে।
<দেখক>
আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। প্লিজ থামবেন না।
১ খাবার শেষে সবাই মিলে পর পর সাতবার "ইংল্যান্ডের পশু" গাওয়ার পর ঘুমোতে যায় সবাই। [সবাই শব্দটি দুবার একই বাক্যে]
২ মনে হয় অবিশ্বাস্য এই ঐশ্বর্যে আর জাঁকজমকের মুখোমুখি হয়ে অজানা ভয় জাপটে ধরেছে ওদেরকে।
৩ সামনের দুই পায়ে ব্রাশ ধরে সবচাইতে উঁচু খামে "পুরুষদের খামার" লাইনটি মুছে লিখে "পশু খামার"।
৪ ৭) সব পশু সমান সমান।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
নতুন মন্তব্য করুন