নবম পর্ব:
বক্সারের ভাঙ্গা ক্ষুর জোড়া লাগতে বেশ সময় লেগে যায়। বিজয় অনুষ্ঠানের পরদিনই বাতাসকল গড়ার কাজ শুরু হয় আবার। একটি দিনও কাজে অনুপস্থিত থাকতে রাজী নয় বক্সার। পায়ের যন্ত্রণা কাউকে বুঝতে দেয়াও যেন নিজের প্রতি অসন্মান! একমাত্র তুলসীপাতাকেই সে রাতে তার কষ্টের কথা জানায়। তুলসীপাতা লতাপাতা চিবিয়ে প্রলেপ দেয় তার পায়ে। সে আর বেনজামিন মিলে বারবারই তাকে অতিরিক্ত খাটুনী থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেয়। বলে, “ঘোড়ার ফুসফুসেও ক্ষয় ধরে একসময়”! কিন্তু এসব কথার কিছুই কানে নেয় না বক্সার। বলে, অবসরে যাবার আগে বাতাসকলের কাজ যথাসম্ভব এগিয়ে নেয়াই তার একমাত্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা।
পশুখামারের প্রথমবার আইন প্রণয়নের সময় ঘোড়া ও শুয়োরের অবসরে যাবার বয়েস নির্ধারণ হয় বারো বছর। গরুর জন্যে চৌদ্দ, কুকুরের জন্যে নয়, ভেড়ার জন্যে সাত, মোরগ-মুরগি আর হাঁসের জন্যে পাঁচ বছর। শুরুতে বেশ উদারতার সাথেই করা হয় বয়েসের হিসেব। এই অবধি কোনো পশুই অবসরে যায়নি, তারপরও বিষয়টি কেন্দ্র করে বেশ ঘনঘন আলোচনা জমে। ফলবাগানের পেছনে ছোট ক্ষেতটি যব চাষের জন্যে নির্ধারিত হবার পর এর পরিবর্তে বড় ক্ষেতের একটি অংশ আলাদা করে অবসরপ্রাপ্ত পশুদের বসবাসের পরিকল্পনা করা হয়। একটি ঘোড়া অবসর জীবনে গ্রীষ্মে প্রতিদিন পাঁচ পাউন্ড শস্যকণা, শীতে পনের পাউন্ড খড় পাবে। এর বাইরে সরকারী ছুটির দিনে একটি করে গাজর বা সম্ভব হলে একটি করে আপেলও দেয়া হবে তাদেরকে। সামনের বছরের গ্রীষ্মের শেষে বারো বছর হবে বক্সারের।
জীবন ধারণ আরও কঠিন হয়ে পড়ে। এ বছরের শীত গত বছরের চাইতেও তীব্র ও পশুদের খাবারেরও উৎপাদনও অনেক কম। শুয়োর ও কুকুর বাদে বাকী সবার জন্যে বরাদ্ধ খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়। সবার জন্যে সমান খাবার পশুতত্ব বিরোধী বলে সবাইকে বোঝায় চাপাবাজ। আপাতদৃষ্টিতে খাবারের অভাব মনে হলেও সত্যিকারের কোনো অভাব নেই, সেটি পশুদের বোঝাতে খুব বেগ পেতে হয় না তার। শুধুমাত্র জরুরী পদক্ষেপ হিসেবেই এর পরিমাণ নতুন করে নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু জোনসের সময়ের তুলনায় এই পরিমাণ তা স্বত্বেও অনেক বেশি। চাপাবাজ “খাবার কমানো” শব্দটি ব্যবহার না করে “খাবার নতুন করে নির্ধারণ” শব্দটি ব্যবহারেই অভ্যস্ত সবসময়। কাগজে সাজানো সংখ্যাগুলো এত তীক্ষ্ণ স্বরে ও দ্রুত পড়ে সে, সবার কাছে মনে হয়, এবছর জোনসের সময়ের চাইতে আরও বেশী গম, বেশী খড় ও বেশী গাজর পায় পশুরা। আরও কম ঘণ্টা খাটতে হয় ওদের, খাবার জলের মান আগের চাইতে অনেক ভালো, তারা আগের চাইতে আরও বেশিদিন বাঁচে ও শিশুমৃত্যুর হার আগের চাইতে অনেক কম। তাদের আস্তাবলে আগের চাইতে অনেক বেশি খড় ও শরীরেও আগের চাইতে কম উকুন। চাপাবাজের প্রতিটি কথাই বিশ্বাস পশুরা। সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয়, জোনসের সময় কী পরিস্থিতি ছিল, চাপাবাজের হাতে “মগজ ধোলাই” হবার পর সেটি ভুলেই গেছে পশুরা। তারা জানে, এখনকার জীবন কষ্ট ও অভাবের তাড়নায় খটখটে, খিদের জ্বালা, শীতের কাঁপুনির পাশাপাশি শুধুমাত্র ঘুমনোর সময় ছাড়া কাজ আর কাজ! কিন্তু জোনসের সময় অবশ্যই আরও কঠিন ছিল জীবন! এটি ভেবে খুব আনন্দ হয় তাদের। তাছাড়া সবচাইতে বড়ো পার্থক্য, তারা আগে ছিল দাস আর এখন পুরো স্বাধীন, এই কথাটি সবার সামনে বারবার তুলে ধরায় কোনো ক্লান্তি নেই চাপাবাজের।
ক্ষুধার্ত মুখের সংখ্যাও বাড়ে। শরতের শুরুতে চারটি মাদী শুয়োর প্রায় একই সময়ে একত্রিশটি শুয়োরের বাচ্চার জন্ম দেয়। বাচ্চাদের শরীর ডোরাকাটা। যেহেতু নেপোলিয়নই খামারের একমাত্র ডোরাকাটা শুয়োর, তাদের জন্ম-পরিচয়ও অজানা থাকে না। ইট-কাঠ জোগাড় করার পর খামারের বাগানে স্কুল খোলা হবে বলে জানানো হয়। আপাততঃ খামারবাড়ির রান্নাঘরে স্বয়ং নেপোলিয়নই পড়াশোনা শেখাবে শিশুদের। শুয়োরের বাচ্চারা খেলাধুলা করে বাগানে, অন্য পশুর বাচ্চাদের সাথে মেলামেশা বারণ। একই সময়ে আরও নতুন একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। যদি একই পথে কোনো পশু কোনো শুয়োরের মুখোমুখি হয়, শুয়োরের জন্যে পথ ছেড়ে দাঁড়াতে হবে সে পশুকে। এ ছাড়াও, প্রতিটি শুয়োরকে সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে রোববারে লেজে একটি সবুজ ফিতে জড়ানোর অধিকার দেয়া হয়।
এই বছরে সামান্য সাফল্যের মুখ দেখা গেলেও, আর্থিক অনটন রয়েই যায়। ইশকুলের জন্যে ইট, বালি, চুন কেনা দরকার। তাছাড়া বাতাসকলের জন্যেও টাকাপয়সা সঞ্চয় শুরু করার সময় হয়েছে। খামারবাড়ির জন্যে মোমবাতি ও কেরোসিন কিনতে হবে। নেপোলিয়নের জন্যে চিনি (অতিরিক্ত মোটা হবার সম্ভাবনায় অন্যান্য শুয়োরদের জন্যে চিনি নিষিদ্ধ) ও খামারের কাজে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, যেমন যন্ত্রপাতি, পেরেক, দড়ি, কয়লা, তার, পুরনো লোহা ইত্যাদি কেনাও জরুরী। এক গাড়ি খড় ও আলুর ফলনের একটি অংশ বিক্রি করে দেয়া হয়। বাজারে যে পরিমাণ ডিম সরবরাহের চুক্তি, বাড়িয়ে প্রতি সপ্তাহে ছয়শ করা হয় সেটি। মোরগ-মুরগির সংখ্যা অপরিবর্তিত রাখার উদ্দেশ্যে বাচ্চা ফোটানোর পর্যাপ্ত ডিমও থাকে না বললেই চলে। ডিসেম্বরে খাবারের একবার বরাদ্ধ কমানোর পরও ফেব্রুয়ারিতে আরেকবার কমানো হয়। তেলের খরচ কমানোর কারণে আস্তাবলও অন্ধকার। কিন্তু শুয়োরদের বেশ আরামেই সময় কাটে ও দিনে দিনেই মোটাও হতে শুরু করে তারা। ফেব্রুয়ারির শেষে, কোনো এক বিকেলে উষ্ণ, মজাদার, সুগন্ধ ভেসে আসে বাতাসে, যা পশুদের একেবারেই অপরিচিত। সে সুগন্ধের উৎস জোনসের রান্নাঘরের পেছনে মদ চোলাইয়ের ঘরটি। এক পশু এই গন্ধকে যব সেদ্ধর গন্ধ হিসেবে চিনতে পারে। ক্ষুধার্ত পশুরা গন্ধ শোঁকে বাতাসে, ভাবে, আজ বিকেলের খাবার হিসেবে গরম সুপ জুটবে। কিন্তু সুপের কোনো দেখাই মিলল না! পরদিন জানানো হয়, শুধুমাত্র শুয়োরদের জন্যেই যব বরাদ্ধ। ফলবাগানের পেছনের মাঠে যবের বীজ ছড়ানো হয়েছে আগেই। দ্রুত এই খবরটিও প্রকাশ হয়ে পড়ে যে, প্রতিটি শুয়োরের জন্যে প্রতিদিন আধ লিটার বিয়ার বরাদ্ধ করা হয়েছে। আর নেপোলিয়নকে মাইসনারের দামি সিরামিকের সুপের পাত্রে দৈনিক চার লিটার করে বিয়ার পরিবেশন করা হবে।
এসব ঘটনা সহ্য করার মতো না হলেও, এখনকার জীবন আগের চাইতে অনেক সস্মানের, এই সত্যকে সামনে রেখে সব মেনে নেয়া হয়। আরও বেশী গান লেখা হয়, আরও বেশী বক্তৃতা ও আরও বেশী মিছিল! নেপোলিয়নের আদেশে প্রতি সপ্তাহে একবার পশুদের যুদ্ধ ও বিজয়ের স্মরণে “অপরিকল্পিত মিছিল” বের করে সবাই মিলে। নির্ধারিত সময়ে কাজে ছেড়ে সেনাদলের মতো মার্চ করতে করতে সবাই মিলে প্রদক্ষিণ করে খামারের সীমানা। সবার আগে শুয়োর, তারপর ঘোড়া, তার পেছনে ভেড়াদের সামনে গরুর পাল। সবার পেছনে পাখি জাতিয় প্রাণী। কুকুরের দল মিছিলের চারপাশে পাহারা দেয়। সবার সামনে দৃপ্ত ভঙ্গীতে নেপোলিয়নের সেই কালো মোরগ। ক্ষুর ও শিং আঁকা ও “নেপোলিয়ন দীর্ঘজীবী হোক!” লেখা একটি পোষ্টার বাতাসে উড়িয়ে পাশাপাশি চলে বক্সার ও তুলসীপাতা। নেপোলিয়নের সন্মানে কবিতা পাঠ চলে। তারপর বক্তৃতা দেয় চাপাবাজ। তাতে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির খুঁটিনাটি খবর দেয় সে। মাঝে মাঝে বন্দুকের গুলিও ছোড়া হয়। ভেড়াদের জন্যে এই “অপরিকল্পিত মিছিল”খুবই আনন্দের। মাঝে মাঝে কোনো পশুর কোনো সমালোচনা করার থাকলেও পারতপক্ষে শুয়োর ও কুকুরের সামনে করার সাহস হয় না। কোনো সুযোগে যদিও করে, সাথে সাথেই ত্রাহি চীৎকারে “চারপেয়েরা ভালো, দুপেয়েরা মন্দ” বলতে বলতে সে পশুকে থামাতে বাধ্য করে ভেড়ারা। ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করাই সার! তারপরও এই আনন্দোৎসব পশুরা উপভোগই করে। তারা নিজেরাই নিজেদের রাজা ও যা করে, নিজেদের জন্যেই করে, এই সত্য, এই বিশ্বাসই তাদের সান্ত্বনা। ফলাফল হিসেবে এই গানে, মিছিলে, চাপাবাজের সংখ্যার হিসেবে, বন্দুকের গুলির শব্দে, নেপোলিয়নের মোরগের ডাকে আর পতাকার পতপত আওয়াজে নিজেদের উদরের শূন্যতা ভুলে থাকতে পারে তারা।
এপ্রিলে পশুখামারকে রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এবার একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করাও জরুরী! একমাত্র পদপ্রার্থী হিসেবে নেপোলিয়নই সবার ভোটে নির্বাচিত হয়। সেদিনই জোনসের সাথে তুষারবলের যোগসাজশের চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে আরও কিছু দলিলপত্র হাতে পাওয়ার কথা জানা যায়। গোয়ালঘরের যুদ্ধে পশুদের পরাজয় কামনায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নি তুষারবল, এ কথাটিও এতদিন ভুল জেনেছে সবাই। এটি এখন প্রমাণিত সত্য যে, সরাসরি জোনসের পক্ষ নিয়েই যুদ্ধ করেছে সে। মানুষ সেনাদলের সেনাপতি ছিল তুষারবলই ও “মানবজাতি জিন্দাবাদ” শ্লোগান দিয়েই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার পিঠে যে ক্ষতের কথা বলে কিছু কিছু পশু, সেটি নেপোলিয়নের কামড়ের চিহ্ন।
গ্রীষ্মের মাঝামাঝি কয়েক বছরের অনুপস্থিতির পর কাক মোসেস হাজির হয় হঠাৎ। আগে যেমন ছিল তেমনই কোনো কাজকর্মের ধার ধারে না সে। তার মিছরির পাহাড়ের গল্প শুনে শুনে আগের চাইতেও আরও বেশী কান ঝালাপালা! সারাদিন ঘরে বসে অলস সময় কাটায় মোসেস, কালো পাখা ঝাপটায় আর কোনো শ্রোতা পেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাজারো গল্প শোনায়। ঠোটের ডগা তুলে আকাশের কোনো এক দিকে নির্দেশ করে বলে, “ওই উপরে, ওপাশে কালো মেঘ দেখছ, তার সামান্য পেছনে মিছরির পাহাড়। হতভাগা পশুদের মৃত্যুর পর চিরদিনের স্থান সেখানেই।“ দূর ওড়াপথে একবার সেখানে গিয়েছে বলেও দাবী করে সে। দেখেছে অফুরন্ত শস্যখেত, ঝোপঝাড়ে বেড়ে ওঠা তেলের পিঠে আর চিনির টুকরো। পশুদের মাঝে অনেকেই তার কথা বিশ্বাস করে। তাদের বর্তমান জীবনে তো খিধে আর কষ্ট ছাড়া আর কিছুই পাওয়ার নেই! মৃত্যুর পর কোথাও যদি সুন্দর কোনো জীবনের অস্তিত্ব থেকে থাকে, সেটি শোনাও আনন্দের। শুয়োরেরা মোসেসকে কেমন চোখে দেখে, বোঝা যায় না সহজে। একদিকে বলে, মোসেসকে একেবারে পছন্দ নয় তাদের। তার মিছরির পাহাড়ের গল্প ডাহা মিথ্যে। অন্যদিকে, তারপরও তাকে খামারে থাকার অনুমতি দেয় শুয়োরেরা। কোনো কাজ নেই, কর্ম নেই, তবুও প্রতিদিন এক অষ্টাংশ লিটার বিয়ারও বরাদ্ধ হয় তার নামে।
পায়ের ক্ষুরের জখম সারার পর আরও বেশী পরিশ্রম করে বক্সার। আসলে প্রতিটি পশুই ক্রীতদাসের মতো খাটে এবছর। প্রতিদিনের কৃষিকাজের খাটুনি ছাড়াও রয়েছে বাতাসকলের পুনর্নির্মাণ ও শুয়োরের বাচ্চাদের ইশকুলঘর বানানোর কাজ। গত মার্চে ইশকুলঘরের কাজ শুরু হয়। প্রায় খালিপেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খাটুনী, অনেকেরই সহ্যসীমার বাইরে চলে যায় মাঝে মাঝে। কিন্তু বক্সারের কাজে কখনোই কোনো বিচ্যুতি দেখা যায় না। যা বলে বা যা ই করে সে, কখনোই তার শরীরের শক্তি আগের চাইতে কম বলে মনে হয় না। শুধুমাত্র তার চেহারায় কিছুটা পরিবর্তন দেখা যায়। গায়ের চামড়া আগের মতো চকচকে নেই আর, পায়ের পেশীর পরিধিও যেন আগের চাইতে কম। বাকীরা বলে, বসন্তে কচি ঘাস গজালে আবার বেড়ে উঠবে বক্সারের শরীর। কিন্তু বসন্ত আসার পরও বক্সারের শরীর আর মোটাতাজা হয়না। যখন সে গর্তের ঢালু স্থান বেয়ে বিশাল পাথরের চাই উপরে ঠেলে উঠিয়ে আনে, মনে হয় শারীরিক শক্তির জোরে নয়, শুধুমাত্র মনের জোরেই চারপায়ে দাঁড়িয়ে সে। এ সময়ে তাকে বলতে শোনা যায়, “আরও বেশী খাটতে হবে আমাকে”! কিন্তু গলার সেই আওয়াজও যেন নেই আর! আবারও তুলসীপাতা আর বেনজামিন তার শরীরের দিকে নজর রাখার কথা বলে, কিন্তু বক্সার কোনো পাত্তা দেয়না। তার বারো বছরের জন্মদিন আর দূরে নয়। কিন্তু সেদিকে নজর নেই তার। একমাত্র চিন্তা, অবসরে যাবার আগে কি করে প্রয়োজনের জন্যে যথেষ্ট পাথরের স্তূপ জমিয়ে যেতে পারে।
একদিন ভর সন্ধ্যায় বক্সারের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে খবর শোনা যায় খামারে। বাতাসকলের জন্যে একগাড়ি পাথর তুলে আনতে একাই গর্তে গিয়েছিল বক্সার। ঘটনাটি ঠিক জানিয়ে কিছুক্ষণ পরই দুটো কবুতর খবর নিয়ে আনে। মাথা ঘুরে মাটিতে একপাশে কাত হয়ে পড়ে বক্সার। নিজ চেষ্টায় উঠে দাঁড়ানোর কোনো ক্ষমতা নেই আর!
খামারের প্রায় অর্ধেক পশু ছোটে বাতাসকলের সেই উঁচু টিলার দিকে। ঠেলাগাড়ি টানার দুই কাঠের মাঝখানে গলা বাড়িয়ে মাটিতে পড়ে বক্সার। এমনকি মাথা তুলতেও অক্ষম সে। তার চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, ঘামে জবজব পেশী, মুখ বেয়ে হালকা রক্তের ধারা। তুলসীপাতা হাঁটু গেড়ে তার কাছে বসে।
“বক্সার, কী হয়েছে তোমার?”, ডাকে সে।
খুব দুর্বল আওয়াজে বলে বক্সার, “আমার ফুসফুসে সমস্যা। তবে সেটি কোনো ব্যাপার নয়! আমার বিশ্বাস, আমাকে ছাড়াই বাতাসকলের কাজ শেষ করতে পারবে তোমরা। ইতিমধ্যেই সবাই মিলে যথেষ্ট পাথর জমিয়ে ফেলেছি। আর মাত্র এক মাস কাজ বাকী ছিল। সত্যি কথা বলতে কি, অবসরের কথা ভেবে আনন্দই হয়। বেনজামিনের বয়েসও নেহায়েত কম নয়। আশা করি দুজনে মিলে একসাথে অবসরে সময় কাটাতে পারব।”
“এই মুহূর্তেই কারো সাহায্য দরকার। দৌড়ে চাপাবাজকে খবর দাও!”, বলে তুলসীপাতা সবাইকে উদ্দেশ করে।
খবর দেয়ার জন্যে সমস্ত পশুরা খামারবাড়ির দিকে ছোটে। তুলসীপাতা আর বেনজামিন রয় বক্সারের কাছে। বেনজামিন কোনো কথা না বলে বক্সারের পাশে শুয়ে লেজের বাতাসে মাছির আক্রমণ থেকে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। পনেরো মিনিট পর খুব চিন্তিত ও ব্যথিত চেহারা করে চাপাবাজ আসে। জানায়, পশুখামারের একজন কঠিন পরিশ্রমী সদস্যের এই দুর্ঘটনার খবর শুনে মর্মাহত কমরেড নেপোলিয়ন। উইলিংডন হাসপাতালে বক্সারকে চিকিৎসার জন্যে যাতে পাঠানো হয়, সে জন্যে সবরকম ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুনে একটু চিন্তিত বোধ করে পশুরা। মলি আর তুষারবল বাদে আজ অবধি কোনো পশুই খামারের বাইরে যায়নি। তাদের অসুস্থ বন্ধু এবার মানুষের পড়তে যাচ্ছে, এই বিষয়টি একেবারেই পছন্দ হয় না তাদের। কিন্তু উইলিংডনের পশু-চিকিৎসকের কাছে বক্সারের চিকিৎসা এখানকার চাইতে অনেক বিধিসঙ্গত ভাবে করা যাবে বলে চাপাবাজ তাদেরকে সহজেই বোঝাতে সক্ষম হয়। আধ ঘণ্টা পর কিছুটা সুস্থ হবার পর খুব কষ্টে নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারে বক্সার। টলতে টলতে কোনোভাবে নিজের আস্তাবলে ফিরে যেতে সক্ষম হয়। আস্তাবলে খড় বিছিয়ে তার জন্যে আরামদায়ক বিশ্রামের জায়গা আগেই তৈরি করে রাখে তুলসীপাতা ও বেনজামিন।
পরে দুদিন বক্সার আস্তাবলেই থাকে। জোনসের গোসলখানায় ঔষধের আলমারিতে গোলাপি রঙের সিরাপের একটি বড় বোতল খুঁজে পায় শুয়োরেরা। তারা সেটি পাঠিয়ে দেয় বক্সারের জন্যে। তুলসীপাতা প্রতিদিন দুবেলা খাবারের পর সে ঔষধ খাইয়ে দেয়। সন্ধ্যাবেলা ওর আস্তাবলেই ওর পাশে শুয়ে গল্প করে তুলসীপাতা। বেনজামিন পাশে বসে বক্সারকে মাছির যন্ত্রণা থেকে মুক্ত রাখে। এই দুর্ঘটনার জন্যে কোনোরকম হতাশা প্রকাশ করে না বক্সার। সুস্থ হয়ে ওঠার পর আরও তিন বছর বেঁচে থাকতে পারে বলে আশা তার। অবসরের দিনগুলো বড়ো মাঠের কোনে শান্তিতে বসে বসে কাটাবে, এই আশায় এখনই উদ্বেলিত সে। পড়াশোনা শিখে নিজেকে শিক্ষিত করতে অবসরের কারণেই বাধ্য সে তখন। বলে, বাকী বাইশটি অক্ষর শিখতে পারাই তার শেষ জীবনের স্বপ্ন।
শুধুমাত্র কাজের পরই তুলসীপাতা ও বেনজামিন বক্সারের কাছে থাকার সুযোগ পায়। এর মাঝে যে গাড়িতে বক্সারকে উইলিংডনে যাওয়া হবে, সেটি কোনো এক দিনদুপুরে এসে হাজির। সমস্ত পশুরা তখন এক শুয়োরের নির্দেশনায় গাজর ক্ষেতের আগাছা দূর করায় ব্যস্ত। বেনজামিনকে খামারবাড়ির দিক থেকে সর্বশক্তিতে চেঁচাতে চেঁচাতে আসতে দেখে হতবাক সবাই। এই প্রথমবার, বেনজামিনকে এমন ব্যতিব্যস্ত হতে দেখা যায়। এভাবে দৌড়াতেও দেখা যায় তাকে এই প্রথমবারের মতোই। “তাড়াতাড়ি আসো! এক্ষুণি! বক্সারকে নিয়ে যাচ্ছে ওরা”, বলে প্রাণপণে চেঁচায় সে। কোনো শুয়োরের অনুমতির অপেক্ষা না করেই কাজ রেখে সবাই ছোটে খামারবাড়ির দিকে। সত্যিই সত্যিই উঠোনে দুই ঘোড়ায় টানা বড় একটি বন্ধ গাড়ি দাঁড়িয়ে। গাড়িটির পাশে কিছু লেখা আর কোচোয়ানের জায়গায় চওড়া হ্যাট পরা খতমত দৃষ্টির একজন লোক বসে। বক্সারের আস্তাবল খালি।
গাড়িটি ঘিরে দাঁড়ায় পশুরা। “ আবার দেখা হবে! আবার দেখা হবে বক্সার! ”, বলে সমবেত আওয়াজে চীৎকার করে সবাই।
“বোকার হদ্দ সব! সব বোকার হদ্দ! গাড়ির পাশে কী লেখা, দেখ না তোমরা!”, বলে চীৎকার করে এদিক ওদিক লাফায় বেনজামিন। তার ছোট ছোট ক্ষুরে মাটিতে গুঁতো দেয় বারবার।
পশুদের মনোযোগ আকর্ষিত হয়। মুরিয়েল লেখাটি বানান করে পড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বেনজামিন তাকে এক ধাক্কায় পাশে সরিয়ে দিয়ে মৃত্যুর মতো নীরবতার মাঝে পড়ে যায়,
“আলফ্রেড সিমন্ডস, ঘোড়ার কসাই ও আঠা প্রস্তুতকারী, উইলিংডন। চামড়া ও হাড়ের ময়দার ব্যবসায়ী। কুকুরের খাদ্য সরবরাহকারী।“
“বুঝতে পার না, এর অর্থ কী? বক্সারকে কসাইখানায় নিয়ে যাচ্ছে ওরা!”, বলে আবার চেঁচায় বেনজামিন।
বিস্ময়ের ব্যথায় চীৎকার করে ওঠে পশুরা। ঠিক সেই মুহূর্তে ঘোড়ার পেটে চাবুক চালায় লোকটি। দ্রুত চলতে শুরু করে গাড়িটি। যতটা সম্ভব, ততটা জোরে চেঁচাতে চেঁচাতে গাড়িটির পেছনে পেছনে ছোটে সবাই। সবাইকে ফেলে আগে দৌড়ায় তুলসীপাতা। আরও দ্রুত চলতে শুরু করে গাড়িটি। তার শক্তিশালী পেশীর জোড়ে আরও দ্রুত দৌড়ানের চেষ্টা করতে গিয়ে কাত হয়ে পড়ে যায় তুলসীপাতা। “বক্সার!, বক্সার!, বক্সার!”, বলে প্রাণপণে ডাকে সে। মনে হয়, বাইরের এই গোলমাল শুনতে পায় বক্সার। গাড়ির পেছনের ছোট্ট জানালা দিয়ে নাকের দাগটি সহ দেখা যায় তার মুখ।
“বক্সার! বক্সার! তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আস! তাড়াতাড়ি! মেরে ফেলবে ওরা তোমাকে!”, ভয়ার্ত আওয়াজে চেঁচায় তুলসীপাতা।
সমস্ত পশুরা মিলে চেঁচায়, “বক্সার বেরিয়ে আস! বক্সার বেরিয়ে আস!” কিন্তু গাড়িটিও সেই সাথে দ্রুত থেকে দ্রুততর চলতে থাকে। তুলসীপাতার চীৎকার বক্সার শুনেছে কি না, সেটি বলা মুস্কিল। কিন্তু এক মুহূর্ত পর জানালা থেকে সরে যায় তার মুখ। ঢোলের শব্দের মতো ক্ষুরের আওয়াজ শোনা যায় গাড়ির ভেতরে। মনে হয়, নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে সে। আগের সময় থাকলে তার ক্ষুরের আঘাতেই চুরমার হয়ে যেত গাড়িটি। কিন্তু সে শক্তি ফুরিয়ে গেছে তার ও সামান্য পরেই গাড়ির ভেতরে তার ক্ষুরের আঘাত দুর্বল থেকে দুর্বল হয়ে থেমে যায় একসময়। কোনো উপায় না দেখে পশুরা গাড়ি টানার ঘোড়া দুটোকে থামানোর চেষ্টা করে। চীৎকার করে বলে, “কমরেড, কমরেড, নিজেদের ভাইকে মৃত্যুমুখে নিয়ে যেও না তোমরা”! কিন্তু দুই বুদ্ধিহীন ঘোড়া ঘটনার কিছুই বুঝতে না পেরে কান খাড়া করে গতি আরও বাড়িয়ে দেয়। বক্সারের চেহারাও জানালায় আর দেখতে পাওয়া যায়না। দ্রুত ছুটে গিয়ে মূল দরজা বন্ধ করার কথা কথা ভাবে কেউ একজন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। পর মুহূর্তেই দরজাটি পেরিয়ে বড় রাস্তা ধরে দ্রুত চলতে চলতে অদৃশ্য হয়ে যায় গাড়িটি। তারপর থেকে বক্সারকে কেউই দেখতে পায়নি আর।
তিন দিন পর খবর দেয়া হয়, একটি ঘোড়ার প্রতি যতোটা যত্ন নেয়া সম্ভব, ততটা যত্ন নেবার পরও উইলিংডনের হাসপাতালে মারা গেছে বক্সার। খবরটি নিয়ে সবার কাছে আসে চাপাবাজ। বক্সারের শেষ সময়ে নাকি তার কাছেই ছিল সে।
“এমন এক হৃদয়বিদারক অবস্থার মুখোমুখি আগে কখনও হই নি!”, সামনের পায়ে চোখের জল মোছে চাপাবাজ। বলে, “শেষ মুহূর্ত অবধি তার বিছানার কাছে ছিলাম। শেষের দিকে কথা বলতেও খুব দুর্বল, আমাকে কাছে নিয়ে কানে কানে এই একটি কষ্টের কথাটিই বলে সে, বাতাসকলের সমাপ্তি দেখে যেতে পারে নি। বিপ্লব এগিয়ে যাক! পশুখামার জিন্দাবাদ! কমরেড নেপোলিয়ন জিন্দাবাদ! কমরেড নেপোলিয়নের কথা সবসময়েই সঠিক! এই ছিল তার শেষ কথা, কমরেড।”
এটুকু বলার পর চাপাবাজের ধরণ ধারণ পালটে যায় হঠাৎ। একটু থেমে আবার কথা শুরু করার আগে আড় চোখে এদিক সেদিক তাকায়।
তার নাকি কানে এসেছে, বক্সারকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া নিয়ে কিছু নিরর্থক ও জঘন্য রটনা ছড়ানো হয়েছে। কিছু কিছু পশু নাকি দেখেছে, যে গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় বক্সারকে, তা গায়ে “ঘোড়ার কসাই” শব্দটি লেখা ছিল। সেটি দেখেই তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, বক্সারকে কশাইখানায় পাঠানো হয়েছে। কোনো কোনো পশু এতোটা বোকা হতে পারে যে, তার কাছে অবিশ্বাস্য! লেজ উপরের তুলে এদিক ওদিক নড়াচড়া করতে করতে বিরক্তির সাথে বলে চাপাবাজ, প্রিয় নেতা কমরেড নেপোলিয়নকে নিশ্চয়ই ভালো করে চেনার কথা তাদের। অথচ আসল বিষয়টি একেবারেই সহজ। গাড়িটির আগের মালিক ছিল এক কসাই। পশু-ডাক্তার সেই কসাইয়ের কাছ থেকে সেটি কিনে নেবার পর গাড়ির গায়ের লেখা মুছে ফেলার সময় পায়নি। সেজন্যেই এই ভুল বোঝাবুঝি।
এসব শুনে অবিশ্বাস্য হালকা বোধ করে পশুরা। তারপর চাপাবাজ বক্সারের মৃত্যুশয্যার চাক্ষুষ কিছু বিবরণ দেয়। অসম্ভব ভালো যত্ন পেয়েছে বক্সার, দামি দামি ঔষধ দেয়া হয়েছে ও নেপোলিয়ন অকাতরে পরিশোধ করেছে সে ঔষধের দাম। এসব শুনে পশুদের শেষ সন্দেহও দুর হয়ে যায়। তাদের প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর শোক এই ভেবে প্রশমিত করতে পারে যে, অন্ততপক্ষে সুখী অবস্থায় বিদায় নিতে পেরেছে সে।
পরের রোববারের সভায় নেপোলিয়ন নিজেই আসে ও একটি ছোট বক্তৃতা দেয় বক্সারের সন্মানে। বক্সারের মরদেহ এনে তার শোকার্ত প্রিয় বন্ধুদের কাছাকাছি খামারে সমাহিত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু খামারের বাগান থেকে ফুল তুলে একটি বড় মালা গাঁথার নির্দেশ দিয়েছে সে। সে মালা উইলিংডনে বক্সারের সমাধিতে রাখা হবে। কিছু দিন পরেই বক্সারের সন্মানে একটি ভোজসভার আয়োজন করা হবে। বক্সারে দুটো শেষ শ্লোগানের কথা বলে বক্তৃতা শেষ করে নেপোলিয়ন। “আমাকে আরও বেশী খাটতে হবে” ও “কমরেড নেপোলিয়নের কথা সবসময়েই সঠিক!” বলে, এই কথা দুটো নিজের করে নেয়া প্রতিটি পশুর জন্যে সবচাইতে মঙ্গলজনক।
ভোজসভার দিনে উইলিংডনের এক ব্যবসায়ী গাড়ি করে একটি বড় কাঠের বাক্স খামারে পৌঁছে দিয়ে যায়। সে রাতেই খামারবাড়ি থেকে হুমহাম চীৎকার আর গোলমাল ভেসে আসে, যেন ঝগড়া করছে কয়েকজন মিলে। রাত এগারোটার দিকে কর্কশ কাঁচ ভাঙার আওয়াজের মাঝে শেষ হয় সে গোলমাল। পরের দিন দুপুর অবধি একেবারে নিস্তব্ধ খামারবাড়ি। শোনা যায়, শুয়োরেরা এক বাক্স হুইস্কি কেনার টাকা কোনো না কোনো ভাবে জোগাড় করতে সক্ষম হয়েছে।
পরের পর্বে সমাপ্য
পশুখামার (এক)
পশুখামার (দুই)
পশুখামার (তিন)
পশুখামার (চার)
পশুখামার (পাঁচ)
পশুখামার (ছয়)
পশুখামার (সাত)
পশুখামার (আট)
পশুখামার (নয়)
পশুখামার (দশ)
মন্তব্য
পড়ছি। জানানোর জন্য মন্তব্য ঠুকে দিলাম।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
অ্যানিমেল ফার্ম এর পর অরওয়েল এর "১৯৮৪" ও অনুবাদ করে ফেলেন। আমার অসম্ভব প্রিয় বই ১৯৮৪। কিন্তু বাংলায় কোন অনুবাদ পাইনি ।
নতুন মন্তব্য করুন