প্রিয় বন্ধু রতিকান্ত,
আজ হঠাৎ কয়েকজন মানুষের সামনাসামনি হতে বাধ্য হই। গতরাত যে গাছের নীচে ঘুমিয়েছি, তার সামান্য দূরে একটি স্থানে অনেক লোকের সমাবেশ। দূর থেকেই তার গুঞ্জন শোনা যায়। একটু আড়াল থেকে ওদেরকে দেখার জন্যে এগিয়ে যাই। সকালের সুর্য তখন অনেকটাই মাথার উপরে। সামান্য এগিয়ে একটি খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে উজ্জল আকাশের দিকে চোখ পড়ে। আকাশের এই একই চেহারা একেবারেই অপরিচিত নয়। আমাদের সময়েও দেখেছি বহুবার। মনে হলো, যে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যে এতগুলো বছরের সময়কে পাড়ি দিলাম, তার প্রতিটি উত্তরই এই আকাশের জানা থাকার কথা। পৃথিবীর প্রতিটি অংশের সাথে আকাশের চাক্ষুস যোগাযোগ তো প্রতিদিনই ঘটে। আহা, আকাশের সাথে কথা বলার যদি ক্ষমতা থাকতো আমার!
এসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে একটু অসাবধান হয়ে পড়ি। তখনই কয়েকজন লোকের একেবারে সামনে পড়ে যাই। মনে হয়, সেই সমাবেশ থেকেই ফিরছে ওরা। মাথায় ভর্তি বস্তা আর হাতে থলে। আমাকে দেখেই থমকে দাঁড়ায় দলটি। আমিও দাঁড়িয়ে পড়ি। আমার চেহারা শশ্রূমণ্ডিত, পরণে মলিন কৌপিন। অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে সবাই। অপরিচিতির আড়াল পেরিয়ে কয়েকজনের চোখে ভয় আর সমীহ আর কারো কারো চোখে অপছন্দের ছাপও দেখতে পাই। যুবক বয়েসের একজন মাথা আর হাতের জিনিসপত্র রেখে লাঠি নিয়ে তাড়া করতে চাইলে বাকীরা কী ভেবে থামিয়ে দেয় তাকে। তারপর নিজেদের মাঝে কী বলাবলি করলো ওরা, শুনতে পেলাম না। আমাকে পাশ কাটিয়ে নিজদের গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে যায় সবাই মিলে। আমি একটু সরে ওদেরকে পথ করে দিলাম। আমাকে পেরিয়ে গিয়েও বারবার পেছন ফিরে তাকায় ওরা। তারপর সবাই মিলে পথের বাঁক ঘুরে আমার দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। আমি কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে আবার সাবধানে এগিয়ে যাই সামনে।
একটি বিষয় নিয়ে ভাবলাম। ওদের দৃষ্টির সামনে নিজেকে পুরোটা অপরিচিত বলে মনে হলোনা। ভয়মিশ্রিত যে সমীহের ভাব দেখলাম ওদের চোখে, এর উৎস কোথায়? সে কথা ভাবার আগে আরও একটি চিন্তা মাথায় এলো। যেসব অদ্ভুত, অচেনা পশুদের সাথে ওদের যে নিত্যদিনের সহজ চলাফেরা দেখলাম, সে তুলনায় আমি নিদেনপক্ষে মানুষ তো বটে! এই মানুষ হিসেবেই নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তুলতে হবে। এদের সাথে চলে এদের জীবনকে জানতে হলে আমাকে এই সুবিধাটিই কাজে লাগাতে হবে।
কিন্তু আমার এই ধারণাটিই কতটা ভুল, আর প্রমাণ সামান্য পরেই পাই। নিজের ভাবনাতেই নিবদ্ধ থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই পথে। হঠাৎ কোনো অজানা এক আড়াল থেকে দৈবের মতো উদয় হলো ওরা জানিনা। একপাল ছেলেমেয়ের দল পাগল বলে চীৎকার করে উঠল আমাকে দেখে। রাস্তা থেকে মাটির ঢেলা তুলে ঢিল ছোঁড়া শুরু করল আমাকে লক্ষ করে। এতটা হতবাক ওদের এই আচরণে যে, পালিয়ে নিজেকে বাঁচানোর কথাও ভুলে যাই। বন্ধু রতিকান্ত, আমরা ছোট ছিলাম যখন, এভাবে অকারণে কাউকে আক্রমণ করার কথা কখনো ভাবতে পেরেছি? কখনোই না। কিন্তু এই পৃথিবীর ছেলেমেয়েরা অদ্ভুত ভয়ঙ্কর এক আগ্রাসী মনোভাবের বশ। এরা অকারনে কাউকে কষ্ট দিতে দ্বিধা বোধ করে না। বেশ কয়েকটি ঢিল আমার গায়ে লাগলো। মাথায় একটি ঢিল লেগে রক্তই পড়া শুরু হলো। ভাবলাম, এখানেই শেষ আমার। এই ছোটছোট ছেলেপিলেদের কবলে পড়েই আমার এই অভিযানের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। সেটিই হতো, যদি পরের ঘটনাটি না ঘটত।
একই পথের বাঁক থেকে উদয় হলো আরেকটি লোক। আমার অবস্থা দেখে গালাগালি করে ছেলেমেয়েদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে বাঁচায় আমাকে। তারপর দাঁড়ায় আমার সামনে এসে। যমের মতো চেহারা তার। পরণে পুরণো ময়লা পোষাক। মুখভর্তি ছোট ছোট ক্ষতচিহ্ণ। আবার ভয় পেলেও তার চোখের দৃষ্টির উজ্জ্বলতায় ভরসা পেলাম। একটু আগে আমার মাথার উপরের আকাশে যে ঔজ্বল্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি, তেমনি উজ্জ্বল তার চোখ। লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
এই হারামির বাচ্চা পুলাপাইনগুলা বহুত বদ! বেহুদাই জ্বালায় মাইনসেরে। তয় কন, আপনে কেডা?
তার ভাষা পরিচিত মনে হলো। কিন্তু উচ্চারণ আর বলার ভঙ্গী এত বেশী অন্যরকম যে, বুঝতে না পেরে ফ্যলফ্যল করে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।
আপনে কেডা, আপনে কে? আপনের কী নাম?
বলে আমাকে হাত ধরে মাটি থেকে তুলল লোকটি। বুঝলাম, আমার নাম জানতে চাইছে সে। কাঁধের ঝোলাটি দিয়ে মাথার রক্ত মুছতে মুছতে বললাম,
রামকুমার আমার নাম।
রামকুমার? আপনে হিন্দু?
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
হিন্দু হন, না মুসলমান হল, এই জাওড়া পোলাপাইনরা মাইরাই ফালাইত আপনেরে। আপনের বাড়ি কই, কন। আপনেরে বাড়িত দিয়া আই।
এবারও তার কথা পুরো বুঝতে পারলাম না। সে সেটি টের পেয়ে আবার বলল,
আপনের বড়ি কই?
বাড়ি নেই।
বাড়ি নাই? এইডা কী কন! তয় আপনে কইত্তে আইছেন?
এবারও কোনো উত্তর দেবার ক্ষমতা হল না আমার। মাথার ক্ষতস্থান থেকে আবার রক্ত ঝরা শুরু হওয়ায় আমার থলেটি দিয়ে মুছলাম। তা দেখে লোকটি তার নিজের কাঁধে জড়ানো একটি কাপড়ের টুকরো খুলে এগিয়ে দিল আমার দিকে।
হিন্দু হন, বৌদ্ধ হন, মুসলমান হন, আপনের ঘরবাড়ি আছে, না নাই, এই দবির মিয়া চোর অইলেও আপনেরে ফালাইয়া যাওনের বান্দা না। আইয়েন, আমার লগে আইয়েন বলে ইশারা করল লোকটি তার সাথে যাবার। কোনো কথা না বলে আমিও চললাম লোকটি পেছন পেছন।
কোনো কারণ গুছিয়ে বলতে পারব না রতিকান্ত, এই মানুষটির প্রতি নিজের বুকের ভেতরে অকারনেই একটি বিশ্বাসবোধের সরোবর তৈরি হয়ে গেল। অথচ বাইরে থেকে দেখলে সে বোধ একেবারেই হবার কথা নয়। লোকটির চেহারা ডাকাতের মতো, মুখে কাটাকাটা দাগ, গলার আওয়াজ কর্কশ। তারপরও তার চোখের দৃষ্টিতে যে সারল্য, সে সারল্যই উজ্জ্বল আলো হয়ে তার প্রতি বিশ্বাসী হতে বাধ্য করল। এই অজানা পড়িপথে শুধুমাত্র এই একটি কারণে একটি মানুষকে বিশ্বাস করা যায় কি না, সেটি নিয়ে অনেক ভাবনার অবকাশ থাকে। কিন্তু আমি সেদিকে না গিয়ে নিজের বিশ্বাসেই স্থির হয়ে রইলাম।
তার বাড়িতে যাবার পথে সারাক্ষনই বকবক করে দবির মিয়া। কথার মাঝে তার পোষাকের আড়াল থেকে কী একটা বের করে দুই ঠোঁটের ফাকে লাগায়। তারপর পোষাক হাতড়ে হাতড়ে সবুজ রঙের আরেকটা চকমকে বস্তু বের করে হাতে নেয়। আমি অবাক বিস্ময়ে তার কর্মকান্ডের দিকে তাকিয়ে থাকি। সবুজ বত্তুটি হাতে নিয়ে আঙুলে চাপ দিতেই আগুন জ্বলে বস্তুটির মাথায়। সে আগুন প্রথম বস্তুটিতে লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে টান দেয় দবির মিয়া। তারপরই মুখভর্তি ধোঁয়া ছাড়ে বাতাসে। একটি অপরিচিত কড়া গন্ধ এসে আমার নাকে লাগে। সবুজ বস্তুটি কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে এবার ঠোঁটের মাঝখানের বস্তুটি আবার হাতে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দেয় সে। আমি ভয়ে ভয়ে নেই সেটি। ঠোঁটের ফাঁকে নিয়ে ওর মতো টান দিতেই কাঁশতে শুরু করি। মনে হয়, দমই বন্ধ হয়ে যাবে। আমার অবস্থা দেখে জোর আওয়াজে হাসে দবির মিয়া। তার হাসির দমকে ভয় পেয়ে কয়েকটা পাখি উড়ে যায় গাছপালা ছেড়ে। আরও দবির মিয়া বলে,
বুজতাছি, আপনে শরীফ মাইনষের পোলা। বিড়ি খাওনের অব্যাস নাই। দেন, আমিই খাই!
বলে বস্তুটি আমার হাত থেকে নিয়ে আবারো ঠোটের ফাঁকে ধরে টেনে আরামে ধোঁয়া ছাড়ে। আমি তার কথা পুরো না বুঝলেও, বস্তটির নাম বিড়ি, সেটি বুঝতে পারলাম।
এক আগেও আড়াল থেকে অনেককেই এভাবে ধোঁয়া ছাড়তে দেখেছি। আমার মনে হয়, এটা এখনকার মানুষের অগ্নিউপাসনার কোনো পদ্ধতি। উপাসনার সময়ে ও পরে যে শান্তি, সে অপার শান্তির পরশ আমি দবির মিয়ার চোখেও দেখছি। সুতরাং পৃথিবীতে এখনও অগ্নি উপাসনা করা হয়, এই অভিজ্ঞতার পর সে কথা সুক্তিসঙ্গত ভাবেই বলা যায়। তবে আগুন জ্বালানো ও লাগানোর পদ্ধতি আগের চাইতে অনেক উন্নত।
আজ আর লিখতে পারছি না। মাথায় ক্ষতস্থানে একটু যন্ত্রণা বোধ করছি। একটু দূরে এই দিন দুপুরেই অকাতরে ঘুমোচ্ছে দবির মিয়া। রাতে নাকি কাজে বেরুতে হবে তাকে। আমার লেখালেখি ও নড়াচড়ায় একবার জেগে চোখ লাল করে তাকিয়েছিল। তারপর আরেকবার অগ্নিউপাসনা করে আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে ঘুমিয়ে পড়েছে আবার। গতকালকের সেই বিকট জন্তুটার আওয়াজের মতো তার নাক ডাকানো শুনতে পাচ্ছি।
তুমি ভালো থেকো।
ইতি
তোমার বন্ধু রামকুমার
চলবে ....
মন্তব্য
এই অংশটি খুব ভালো লাগলো। দৃষ্টিভঙ্গীর সামান্য পরিবর্তনেই অনেক কিছুরই মানে বদলে যায়। আগেরটাতে মন্তব্য করা হয়নি। চলুক ভাই।
ফারাসাত
অনেক ধন্যবাদ ফারাসাত। অবশ্যই চলবে।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
ভালো লাগলো তীরন্দাজ ভাই। পর্বগুলো চলুক।
ধন্যবাদ আপনাকে।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
হাহাহা
এই সিরিজটা পড়তে বেশ মজা লাগছে আমার।
চেনা সবকিছুকে অচেনা আর আদিম এক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা।
"সুতরাং পৃথিবীতে এখনও অগ্নি উপাসনা করা হয়, এই অভিজ্ঞতার পর সে কথা যুক্তিসঙ্গত ভাবেই বলা যায়।"
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
অচেনা আর পুরণো, .... আদিম বলা যায় কি না জানি না, আমরা আদিম শব্দটিতে অন্য অর্থে প্রবাহিত করেছি,... ।
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
তীরুদা,
আগেও বলেছি আবার বলি; আপনি রতিক্ন্ত আর রামকুমার নাম দুটো বদলান। লেখা এখনো শুরুর দিকে আছে, বদলাতে বড় ঝামেলা হবার কথা নয়। আপনি ত্রৈলক্ষচন্দর রাখলেও আপত্তি নেই। কিন্তু এই নাম অচল বিশেষ করে কেন্দ্রীয় চরিত্রে। এত সিরিয়াস লেখা ! শুধু অদ্ভুত রতি আর রামকুমারে জন্য পড়ে কেমন হাস্যকর কিছুর কথা মনে আসে। পরের পর্ব থেকে বিস্বস্ত নাম না থাকলে আপনার বিরোদ্ধে বিদ্রোহ করব কইলাম।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
পুতুল ভাই, আমার কাছে নাম দুটো অতিমাত্রায় পুরণো বলে মনে হয়, পুরনো বলে যদি হাস্যকর হয়, সেটি আলাদা কথা , তবে এর বাইরে মনে হবার মতো কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিনা। তারপরও আপনার কথা মনে নিয়ে বলছি, আপনি ছয়শ বছর আগের সময়ানূযায়ী দুটো নাম দিন, অবশ্যই পাল্টে দেবো। পরের পর্বেই।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
নতুন মন্তব্য করুন