মিরপুর চিড়িয়াখানা থেকে একমাত্র শিম্পাঞ্জি কিংকং যখন শেষরাতে খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে যায়, টের পায়নি কেউ। টের পাবার কথাও নয়, এই সময়ে পাহারাদারেরাও ঘুমিয়ে পড়ে। দিনের বেলা যে লোকটি খাবার দিতে এসেছিল, তার সাথে কিংকঙের কী চুক্তি হয়েছিল, সে খাঁচায় একটি কলার বদলে এক কাঁদি কলা রেখে দরজাটিও বন্ধ করতে ভুলে গেল, এসব খবরাদি জানতে হলে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে ডাকতে হয়। চিড়িয়াখানার পরিচালকদের এতো কিছু জানার আগ্রহও নেই, টাকাপয়সা খরচের তো কথাই আসে না। এন,এস,এর বিশাল এন্টেনার আড়ালে হারিয়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সেই রমরমা দিন আর নেই। শার্লক হোমস উত্তর লন্ডনের একটি জীর্ণ শীর্ণ ওল্ড হোমে যাবার পর থেকেই অবস্থা আরও খারাপ। ইয়ার্ডের রাস্তার সামনের ল্যাম্পপোস্টের টিমটিমে আলোটি দেখলেই ভেতরের অবস্থা টের যায়।
সে যাই হোক, যাবার সময় কলার কাঁদিটাও নিয়ে গেল শিম্পাঞ্জি কিংকং। পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে সে সময় আলোকিত দিন হলেও ঢাকা শহরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই অন্ধকারের রহস্যে নিজেকে আড়াল করে চারিদিকে কলার খোসা ছড়িয়ে ও নানাবিধ কুকর্ম চালিয়ে গেলো কিংকং। কাঁদির কলা ফুরিয়ে গেলেই মন্ত্রীদের সুরক্ষিত বাসস্থানের কলাগাছে থেকে আরেকটা ছিঁড়ে আনে।
কিংকঙের অপকর্মের প্রথম শিকার রিকশাওয়ালা জমির মিয়া। বউয়ের খক্কর খক্কর কাশি আর ছেলেমেয়ের প্যানপ্যানানিতে না ঘুমাতে পেরে মেজাজ তার এমনিতেই তিরিক্ষি। তার উপর সাতসকালের আধো অন্ধকারে মালিকের গ্যারেজ থেকে রিকশা নিয়ে গলিটি পেরুনোর সময় রাস্তায় একটি নেড়িকুত্তাকে শুয়ে থাকতে দেখে মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেলো। ইচ্ছে করলে কুত্তাটির উপর দিয়ে রিকশা চালিয়ে যেতে পারতো সে। কিন্তু সেটি না করে রিকশা থামিয়ে একটি গাছের ডাল হাতে নিয়ে কুকুরটিকে ভয় দেখাতেই করতেই বিপত্তি ঘটলো। একটি কলার খোসায় পা পিছলে প্রায় কুকুরটির পাশেই পড়লো সে। ওঠার আর ক্ষমতা রইলো না। ভয়ে ক্যাঁক করে উঠলেও পালানোর চাইতে আদর করে জমির মিয়ার গাল চেটে দেয়াই শ্রেয় মনে করলো কুকুরটি। তাতে কুশ্রী গালাগাল ঝেড়ে উঠে বসলেও রিকশা নিয়ে শহরে বেরুনোর পরিকল্পনা জমির মিয়াকে বাদই দিতে হল। মালিককে রিকশা ফেরত দিয়ে বউকে বুয়ার কাজে পাঠিয়ে শতরঞ্জিতে শুয়ে নিজেই কাতরাতে থাকল কোমরের ব্যথায়।
এদিকে চিড়িয়াখানার মহিলা ডিরেক্টর সকালে যথারীতি স্বরসাধনায় বসলেন। তানপুরা, গন্ধরাজ ফুলের তোড়া মিলিয়ে বেশ পবিত্র গুরুগম্ভীর পরিবেশ। স্বরসাধনার স্তর বহু বছর আগে শুরু হলেও আজ অবধি শুদ্ধ বিলাবলের সীমানা পেরিয়ে যেতে পারে নি তিনি। কিন্তু কী এক অভাব বোধে সাধনা তেমন জমে উঠতে চাইল না। হতাশ চোখে বেশ কিছুক্ষণ ওস্তাদ মুন্সী রইসউদ্দীনের ছোটোদের সারেগামা বইটির দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আসল কথাটি মনে পড়লো তাঁর। প্রতি সকালেই তো তিনি তাঁর স্বরের সাথে সুর মিলিয়ে শিম্পাঞ্জি কিংকঙের চীৎকার শুনতে পেতেন। এখন কোনো আওয়াজই শুনতে পাচ্ছেন না। তানপুরা আর বই রেখে তিনি ছুটলেন চিড়িয়াখানায়।
তার নির্দেশে চিড়িয়াখানা বড় থেকে শুরু করে অতি পাতি কর্মচারীরাও নিজদের সকালের আলস্য ছেড়ে ছুটে এলো। তাদের সবাইকে বেশ কয়েক প্রস্থ গালাগাল করেও ঝাল মিটল না মহিলা ডিরেক্টরের। তার স্বরের একটু আগের বিলাবলের ঝংকার আর গালাগাল মিলেমিশে এক হয়ে গেল। এদিকে টিভি-রেডিওতে বেশ ফলাও করে কিংকঙের অপকর্মের ধারাবিবরণী চলছে। রাস্তাঘাটে, অফিসে আদালতে কলার খোসার স্তূপ, মানুষজনের হাঁটাচলা এমনকি গাড়ি চলাও প্রায় বন্ধ। শোনা গেল, পুলিশ কমিশনারের স্ত্রীর অন্তর্বাস শুকোতে দিয়েছিলেন বারান্দায়, বেছে বেছে তার দামীগুলো চুরি করেছে কিংকং। শিল্পপতি বদন হাসানের সমাজসেবী স্ত্রীর গহনার বাক্স, এক অতি বিখ্যাত কবির সারা জীবনের লেখা কবিতার খাতা। সারা শহরে রীতিমতো সোরগোল পড়ে গেল।
অবশেষে একটি টাস্কফোর্স গঠন করলেন মিরপুর চিড়িয়াখানার মহিলা ডিরেক্টর। তাতে চিড়িয়াখানার সব কর্মচারীর সাথে একটি ভাড়াটে বাহিনী যোগ করা হল। বেশ কুখ্যাত বলে এদের বেশ সুখ্যাতি আছে ঢাকায়। এদের প্রতি নির্দেশ-, ছলে, বলে বা কৌশলে ও প্রয়োজন হলে সাধারণ নাগরিক জীবনকে বিপন্ন করে হলেও জীবিত বা মৃত অবস্থায় কিংকংকে যেন চিড়িয়াখানায় ফিরিয়ে আনা হয়।
কিংকঙের অনেক শিকারের আরেকজন হলেন ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত সমাজের এক সাধারণ গৃহিনী। স্বামী-ছেলেমেয়েদের উপর রেগে গজগজ করতে করতে পায়ের ব্যথায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাজারে যাচ্ছিলেন। একটু পরই ছোটো মেয়েটিকে স্কুলে দিয়ে আসতে হবে। তার আগে বাজার না করলে স্বামীকে সময়মতো নাস্তা দিতে পারবেন না। একটি সময় ছিল, যখন স্বামীরা, ছেলেরা বাজারের কাজ সারত। মেয়েরা বাজারে যাবে, কল্পনাও করা যেত না। নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের সুফল হিসেবে অফিস আদালতে কাজের পাশাপাশি সেই অধিকার পেয়েছেন নারীরা। কিন্তু লাভ হয়েছে স্বামীদের, ছেলেদের। নারীরা এখন বাজার সদাই করে, ব্যাগ টেনে টেনে. বাড়ি ফিরে রান্না করে, স্বামী-সন্তানদের উদরপূর্তি করে নব্য স্বাধীনতার সুফল উপভোগ করেন। স্বামী, যুবক পূত্রধন বাড়িতে পায়ের উপর পা তুলে সে খাবার খেয়ে আরামের ঢেকুর ছেড়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে আওয়াজ তোলে। এসব ভাবতে ভাবতে সামনের একটি কলার খোসা এড়িয়ে যেতে পারলেও পরেরটায় পিছলে গেলেন গৃহিনী। ধপাস করে পড়লেন রাস্তার মাঝখানে। একটি মোটর সাইকেল চালক থামার সুযোগ থাকলেও না থেমে পাশ কাটিয়ে চলার সময় তার বাঁ হাতের উপর চাকা তুলে দিল। পাড়ার ছেলে ছোকরা ও মসজিদ থেকে ফেরার পথের এক মুসল্লি খিক খিক করে হাসতে লাগল মহিলার এই অবস্থায়।
এদিকে শিম্পাঞ্জি কিংকংকে ধরা না গেলেও এই টাস্কফোর্সের কর্মকাণ্ড আগের খবরগুলোর সাথে মিলিয়ে মিশিয়ে নানা রঙ চড়িয়ে প্রকাশ হল পত্রিকায় ও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে। এই দুই প্রতিপক্ষের ভয়ে আজকাল শহরের লোকজন বাড়ি ছেড়ে বেরুতেই সাহস পায় না। অফিস আদালতে কাজকর্মও বন্ধ হয়ে গেল। পুরো শহরেই কেমন যেন এক হরতাল হরতাল ভাব। কিংকংকে ধরতে গিয়ে এক স্কুল ছাত্রকে ধরেছে টাস্কফোর্স, তাকে লক্ষ্য করে ছোড়া গুলি এক বিমানবালাকে হত্যা করেছে, এক অফিস যাত্রীকে ভুল করে ছুরিকাঘাত, এসব খবর বাতাসের মতো ছড়িয়ে পড়ল শহরের আনাচে কানাচে।
শহরের শাসকবর্গও দিশেহারা। কারা কিংকংকে ধরবে, এই নিয়ে বিবাদ শুরু হল বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। অপরাধ বিভাগ বলে, এটি পশু মন্ত্রণালয়ের কাজ। আমরা শুধুমাত্র মানুষের অপরাধ নিয়ে কাজ করি। পশু মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিল, এটি বন্য-প্রাণী ও পশু সংরক্ষণ বিভাগের দায়িত্ব। চিড়িয়াখানার সমস্যা একমাত্র তাদেরই এখতিয়ার ভুক্ত। বন্য-প্রাণী ও পশু সংরক্ষণ বিভাগের মন্ত্রীকে তার অফিসেই পাওয়া গেল না। বাকী আমলারা মন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া এক পা ও নড়তে বাজী হলেন না। এঁরা শহরের শাসনকত্রীর ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে মন্ত্রী মহোদয়ের ফিরে না অবধি অপেক্ষা করতে নির্দেশ দিলেন। ইতিমধ্যে সড়ক মন্ত্রণালয় শহরের রাস্তা কলার খোসা মুক্ত করার জন্যে টেন্ডার আহ্বান শুরু করেছে। বিভিন্ন মন্ত্রীবর্গের বিভিন্ন আত্মীয়-চামচা ও পাতি চামচার দল সে সব টেন্ডারের জন্যে টাকাপয়সা চলাচল শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। শহরের গাড়িগুলো কলার খোসায় পিছলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ল্যাম্পপোস্ট, আইল্যান্ড ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এগুলো মেরামত করার জন্যেও টেন্ডার ডাকা হয়েছে। অনেকে নাকি ডাক শেষ হাবার আগেই জরিপপত্র শুরু করেছেন। বাইরে থেকে এন,এস,এ ও নাকি সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে দূতাবাস মারফত। শহরের পশ্চিম প্রান্তে একটি আড়িপাতা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠারও নকশা দেয়া হয়েছে শাসনকত্রীকে। বিবেচনা করে দেখবেন, এই আশ্বাস দিয়েই নাকি ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছেন শাসনকত্রী।
এসব হট্টগোলের মাঝে একটি খবর কারো চেখেই পড়লো না। সেটি হল, দিন কয়েক এদিক সেদিক গোপন পরামর্শের পর কোনো এক কাকডাকা ভোরে কাউকে না জানিয়ে মহাজোট ত্যাগ করেছেন একসময়ের রাষ্ট্রপতি কবি হোসাইন মুহম্মদ এরশাদ। তার হাতে এক কাঁদি মর্তমান কলা ঝুলানো ছিল বলে জানিয়েছে কোনো এক বিশ্বস্ত সূত্র।
মন্তব্য
প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না গল্প কোনদিকে যাচ্ছে,
শেষে এসে সব খোলাসা !
এনএসআই বলতে কি বুঝিয়েছেন?
এনএসআই=ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স (বাংলাদেশি সংস্থা)
এনএসএ = মার্কিন আড়িপাতা সংস্থা
বাইরে থেকে হলে এটা এনএসএ হবার কথা নয় কি?
শুভেচ্ছা
প্রথমেই অনেক ধন্যবাদ যত্নের সাথে পড়ে ভুলটি ধরিয়ে দেবার জন্যে। এক্ষুনি ঠিক করে নিচ্ছি। ভালো থাকবেন।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
একটি সময় ছিল, যখন স্বামীরা, ছেলেরা বাজারের কাজ সারত। মেয়েরা বাজারে যাবে, কল্পনাও করা যেত না। নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের সুফল হিসেবে অফিস আদালতে কাজের পাশাপাশি সেই অধিকার পেয়েছেন নারীরা। কিন্তু লাভ হয়েছে স্বামীদের, ছেলেদের। নারীরা এখন বাজার সদাই করে, ব্যাগ টেনে টেনে. বাড়ি ফিরে রান্না করে, স্বামী-সন্তানদের উদরপূর্তি করে নব্য স্বাধীনতার সুফল উপভোগ করেন। স্বামী, যুবক পূত্রধন বাড়িতে পায়ের উপর পা তুলে সে খাবার খেয়ে আরামের ঢেকুর ছেড়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে আওয়াজ তোলে। - আগে বাজার আমিই করতাম। এখন মাজা আর পিঠের ব্যথার জন্য সম্ভব হয়না দেখে আমার বউ বাজারে যায়।
এটি একটি সামগ্রিক বক্তব্য রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থাকে কটাক্ষ করে। ব্যাক্তিবিশেষকে রা অযাচিত সমস্যাকে লক্ষ্য করে নয়। মাজা আর পিঠের ব্যথার দ্রূত উপশম ঘটে, এই কামনা রইল।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
হাঁটুসম্রাট লেজেহোমোএর্শাদ এখন সপরিবারে বঙ্গভবনে শপথ নিতে যায়। ঘোর কলি। অথবা এরকমই আসলে হবার কথা ছিলো।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
সবকিছুই একই সাথে হাস্যকর ও বেদনাদায়ক।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
দিন কয়েক এদিক সেদিক গোপন পরামর্শের পর কোনো এক কাকডাকা ভোরে কাউকে না জানিয়ে মহাজোট ত্যাগ করেছেন একসময়ের রাষ্ট্রপতি কবি হোসাইন মুহম্মদ এরশাদ। তার হাতে এক কাঁদি মর্তমান কলা ঝুলানো ছিল বলে জানিয়েছে কোনো এক বিশ্বস্ত সূত্র। ।।।।
অবশেষে বোঝা গেল
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
হ্যা, একেবারে শেষে এসে বোঝার জন্যেই লিখেছি। তবে এখন মনে হচ্ছে, আগে থেকেই একটু আবছা এগিয়ে গেলে ভালো হতো। ভালো থাকবেন শাহীন।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
শেষটা অনুমানই করতে পারিনি।
অনেকদিন পর তীরুদা'র গল্প পড়লাম।
নতুন মন্তব্য করুন