গরমের দিনের সকালটা বিচ্ছিরি, নোংরা, ছয়দিনের ঘামে ভেজা গামছার মতো। মোটর সাইকেলের ভটভট, ফেরিওয়ালার চেঁচামেচি, চায়ের স্টলে মমতাজের গান, রিকশাওয়ালার ঝগড়া, রেডিওতে সরকারের গুণকীর্তন, সবকিছু মিলে মিশে বিকট এক বোম্বেটে মাছি হয়ে কানের কাছে অবিরত ভনভন করে। সেই সাথে বাকী দিনটির কথা ভাবতে গেলে বুকের ভেতরে হাজারো গরিলার প্রলয় নাচন শুরু হয়ে যায়। দিন বাড়ার সাথে সাথে বাড়তেই থাকে গরিলাদের নর্তন কুন্দন। রাতে ফ্যানের একঘেয়ে শনশন ঘড়ঘড় আওয়াজের কবলে পড়া অবধি চলতে থাকে এই অত্যাচার। সামান্য বিরতির পর শহরের তিনশো পঁয়ষট্টিটি মাইক একসাথে গর্জে ওঠে আরেকটা কর্কশ, উল্টে পড়া ডাস্টবিনের মতো পুঁতিগন্ধময় দিনের জানান দেয়।
এমনি এক দিনে সময়মত ক্লাসে পৌঁছানো চাট্টিখানি কথা নয়। মায়ের বকুনির সাথে তাল মিলিয়ে রুটি আলু-ভাজির গ্রাসটা মুখে ঢুকিয়েই ছুটতে হয় রিক্সার আশায়। কপাল ভালো হলে মিলে যায় একটি, না হলে খানা খন্দক পেরিয়ে ছুটতে হয় বড়ো রাস্তার মোড় অবধি। আজও দিশারা সে ভাবেই ছোটে। পাড়ার বখাটেদের শিশ আর নোংরা কথার বাণ হজম করে যখন বড়ো রাস্তার মোড়ে পৌঁছায় সে, ততক্ষণে সেই বোম্বেটে মাছি হাজারটা জেট বিমান হয়ে শহরের রাস্তাগুলোকে রানওয়ে বানিয়ে শম্বুক গতিতে এগিয়ে চলেছে ওড়ার প্রত্যাশায়।
যে বাসটি সামনে পড়লো, ভিড় ঠেলে তাতেই ওঠে দিশারা। এমনি বিকট একটি দিনে সামনে, বামে বা ডানে, যেদিকেই এগুনো যায়, তাতেই ঈশ্বরপ্রাপ্তির সম্ভাবনা সামান্য হলেও বাড়ে। আধ ঘণ্টা পর হাজার বার থেমে থেমে হুপিং কাশির বুড়োর মতো হাঁপাতে হাঁপাতে কাকরাইলের মোড়ে এসে বিশাল জ্যামের মুখোমুখি হয়ে থেমে যায় একেবারেই। দশ মিনিট আশায় আশায় অপেক্ষা করে দিশারা বাস থেকে নেমে পড়তে বাধ্য হয়।
কাকরাইলের মোড় লোকে জমজমাট। পুলিশের হুইশেলের শব্দ আর গাড়ির সাইরেনে কানে তালা লাগার জোগাড়। প্রথমে একটু ভয় পায় দিশারা। আবার কি বেরিয়ে পড়লো ক্ষুর চাপাতি হতে ধর্মরক্ষার তস্করের দল! কিন্তু লোকজনের চেহারায় এই দুর্দিনেও একটু উৎসব উৎসব আমেজ দেখে ভরসা পায় সে। ভিড় পেরিয়ে ডানদিকে এগিয়ে একটি রিকশা পাবার দুর্লভ আশায়। মোড়টি ঘুরেই ফুলে ফুলে সাজানো চকচকে একটি বাস ঘিরে বিশাল ভিড়। বাসের গায়ে সবুজ লালে কী যেন লেখা। পাশেই দাঁড়ানো পতাকা সাজানো কোনো এক মন্ত্রীমহোদয়ের গাড়ি। আদ্দির পাঞ্জাবি গায়ে ঘামে আর সকালের পরোটার চর্বিতে জবজবে মন্ত্রীমহোদয়ের কী এক উত্তেজিত নির্দেশ দিচ্ছেন তাঁর চারপাশে ঘিরে থাকা পুলিশ আর স্তাবকের দলকে। এদেরকে পাশ কাটিয়ে সামান্য এগুতেই হাতে হালকা টান পড়তেই থেমে দাঁড়ায় দিশারা। ছেড়া ফ্রক পড়া ছ-সাত বছরের একটি শিশু কী যেন বলতে চায় তাকে। বেশ বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞেস করে দিশারা,
- কী রে, কী চাস?
- আপা, বাসে উঠবেন?
- বাসে উঠি, বা না উঠি, তাতে তোর কি?
বলেই হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে দিশারা। ছাড়িয়ে একটু এড়িয়ে গেলেও মেয়েটা আসে তার সাথে সাথে। আবার ধরে হাত।
- কীরে, আবার কী হল?
- আপা!
বলে মুখ কাঁচুমাচু করে তাকিয়ে থেকে মেয়েটি। দিশারার মায়া হয়। আবারো হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ব্যাগ থেকে একটি পাঁচ টাকার নোট ধরে এগিয়ে দেয় মেয়েটির দিকে। কিন্তু মেয়েটা নেয় না সে টাকা।
- কী রে? টাকা নে!
- টাকা নিমুনা আপা। আপনের লগে বাসে উঠমু।
- পাগল নাকি? বাসে উঠে কী করবি?
- ডিজিটাল খামু আপা। ডিজিটাল বাসে উইঠ্যা ডিজিটাল খামু।
মন্তব্য
যাক, মাথায় মাখবে বলে নাই!!!
কঠিন বাস্তবতাকে তুলে এনেছেন ছোট্র কলেবরে! যদিও ভেতরটা ক্রমেই আরও পশ্চাতে ধাববান হচ্ছে, উপরটাকে একের পর এক ডিজিটাল, ওয়াই ফাই, হাই টেক দিয়ে ভরিয়ে ফেলা হচ্ছে!!!
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
কেউ কেউ হয়তো মাথাতেও মাখতে চাইবে। হাস্যকর, অর্থহীন বুলি ঝেড়ে যে ভাবে নিজেদেরকে খেলো করে তুলছে ক্ষমতাশীন দলটি, তার আড়ালে চাপা পড়ছে ভালো কাজগুলোও। জনগনের মাথা খারাপ হওয়া ছাড়া আর কী উপায়?
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
কে যেন বলেছিল ডিজিটালের ডিজি চলে গেছে, পড়ে আছে শুধু টাল! শরীরের ভেতরের অসুখ সারানোর ব্যবস্থা না করে শুধু মুখে ফেস পাউডার মাখলে কি আর রুগ্নতা ঢাকা যায়?
____________________________
আমরা দেখতে থাকি বিকৃতি আর উন্মাদ লোকজনের রাজনীতি, জনগণ এখন আর নেই, ওরা আমাদের এখোন থাকতে দেয় দেশটাতে এটা কম কী???
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
নতুন মন্তব্য করুন