প্রথম পর্ব
সারা রাত এক অসুস্থ অস্থিরতায় কাটল। সকালে সে প্রকোপ থেকে জেগে দেখল, নিজের বিছানাতেই বিকট এক পোকায় পরিনত হয়ে গেছে গ্রেগর সামসা। ঢালের মতো মসৃন পিঠ। সে পিঠের উপর মাথাটি একটু উপরে তুলে দেখল, তার একটু ফুলে ওঠা পেটটি ধনুকের মতো খয়েরী রংএর বাঁকা বাঁকা রেখায় ভাগ করা। সে পেট এতোই মসৃণ যে, চাদরটিও সেখানে পিছলে যাচ্ছে বারবার। সরু সরু অনেকগুলো পা গজিয়েছে। সেগুলোর অনিয়ন্ত্রিত ইতস্তত: নড়াচড়াও দেখল চোখের সামনে ।
‘কি হল? আমার এ দশা কেন?’ ভাবল সে। সপ্ন বলেও মনে হচ্ছেনা! নিজের ছোটখাট ঘরটি তো পুরোনো চার দেয়ালের মাঝে আগের মতোই পরিচিত! চাকুরির খাতিরে শহরে শহরে ঘুরে বেড়ানো গ্রেগরের কাজ। নকাশাসহ কাপড়ের যে নমুনাগুলো খোলা হয়েছিল গতকাল, দেয়ালের পাশের টেবিলেই পড়ে আছে সেগুলো । পত্রিকা থেকে কাটা সোনালী ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটি তার উপরেই ঝুলছে। ঋজু হয়ে বসা পশমের টুপি মাথায় এক মহিলা। গলায় পশমের মাফলার আর হাতে ও বাহুতে কালো পশমের ঢাকনি।
গ্রেগর জানলার দিকে তাকালো। মন বিকল করে দেয়া বিষন্ন একটি দিন, জানলার উপর আছড়ে পড়ছে বৃষ্টির ছাট। ‘এসব ফালতু ভাবনা বাদ দিয়ে আরেকটু ঘুমিয়েই নিই’ ভাবলো সে। কিন্তু তা কতোটা অসাধ্য, টের পেতে দেরী হলো না। ডানপাশে শুয়ে ঘুমোনো বহুদিনের অভ্যাস। কিন্তু শারীরের কাঠামোর কারনে সেদিকে ঘুরতেই পারল না। যতবারই সমস্ত শক্তি দিয়ে ডানদিকে কাৎ হওয়ার চেষ্টা করলো, ততবারই ফিরে আসতে হলো আগেরই চীৎ হওয়া অবস্থায়। একবার দু’বার নয়, প্রায় একশোবার চেষ্টা করলো সে। চোখ বন্ধ করলো প্রতিবারই, যাতে পায়ের অনিয়ন্ত্রিত নড়াচড়া দেখতে না হয়। অবশেষ শরীরের ডানপাশে একটি অপরিচিত ভোঁতা যন্ত্রণা অনুভব করে হাল ছাড়তে বাধ্য হলো।
‘হায় খোদা! কি এক বাজে চাকুরী জীবন বেছে নিলাম! প্রতিদিনই ঘোরাঘুরি! আসলেই বাইরের কাজ অফিসে বসে কাজ করার চেয়ে অনেক বেশী কষ্টকর। ঘোরাঘুরির এই কষ্ট তো নি:শেষ করে দিলো আমাকে! ট্রেনের অনিয়িমত যোগাযোগ, প্রতিদিনের অখাদ্য খাবারদাবার, চারপাশের লোকেদের সাথে আত্মাহীন সম্পর্ক আর কতো সহ্য করা যায়! জাহান্নামে যাক সব!’ পেটের উপরের অংশে এক ধরণের চুলকানো অনুভব করলো সে। মাথা তুলে ভালো করে সে আংশটি দেখার জন্যে চীৎ থাকা অবস্থাতেই বিছানার প্রান্তের দিকে গড়িয়ে এলো। দেখলো সাদা সাদা ফুটকুড়িতে ছোট্ট একটি পেটের অংশ। পা দিয়ে সে জায়গাটি একবার স্পর্শ করেই অসহ্য শীতল এক শিহরণে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হলো।
বিছানায় আবার আগের অবস্থায় ফিরে এলো। ‘প্রতিদিন এত সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা একটি মানুষকে গর্ধভ বানিয়ে দেয়া জন্যে যথেষ্ট’। প্রত্যেকেরই নিয়মিত ঘুম দরকার। আন্যান্য পরিচিত যারা ঘুরে বেড়ানোর চাকুরী করে, হারেমের মেয়েদের মতো আরামের জীবন তাদের। নিজে যখন প্রতি সকালের শেষে চুক্তিপত্র সই করার জন্যে হোটেলে হোটেলে দৌড়াই, এরা তখন নাস্তার টেবিলে বসেছে মাত্র। আমি যদি এমন করি তাহলে চাকুরীটি মূহুর্তেই খেয়ে নেবে বস। আর তাতে যে কি ভয়ানক অবস্থা হবে আমার, তা ভাল ভাবেই জানি। শুধুমাত্র বাবা-মায়ের মুখ চেয়েই টিকে আছি, নইলে অনেক আগেই ছেড়ে দিতাম সব! বসের সামনে গিয়ে সমস্ত জমানো ক্ষোভ ঝাড়তাম। তার উঁচু মহাসন থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে আনতাম তাকে। অসহ্য ব্যটার ওই চরিত্র! নিজেকে মহাসনের উপরে বসিয়ে কর্মচারীদের সাথে নিচের দিকে তাকিয়ে কথা বলে! কানে কম শোনে বলে আমাদেরকেই কাছে এগিয়ে যেতে হয় এই ব্যাটার কাছাকাছি। তবে হাল এখনও ছাড়িনি। বাবা-মার ধারগুলো শোধ করে দেবার মতো হাতে যথেষ্ট টাকা জমলেই হলো। আর হয়ত পাঁচ থেকে ছয় বছরের মতো লাগবে। তাখনই নেয়া হবে দরকারী পদক্ষেপ। আপাতত: আমাকে এখন বিছানা ছেড়ে উঠে পাঁচটার ট্রেন ধরতেই হবে’।
বাক্সের উপর টিক টিক করে চলছে এলার্ম ঘড়িটি। সে সেদিকে তাকালো। ‘হায় আল্লা’। সাড়ে ছ’টা থেকে পৌঁনে সাতটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ঘড়ির কাটা। সে কি এলার্ম শোনেনি? বিছানা থেকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে, চারটায় এলার্ম দেয়া ছিল। নিশ্চয়ই বেজেও ছিল তখন । এই এলার্মের শব্দে তো ঘরবাড়ী অবধি কেঁপে ওঠে, এর মাঝে কি করে এতটা অঘোরে ঘুমোতে পারল সে? হয়তো এরাতের ঘুমের মাঝে অস্থিরতা থাকলেও গভীরতাও ছিল। কিন্তু এখন তার কি করনীয়? পরের ট্রেনটি ছাড়বে সাতটায়। সে ট্রেন ধরার আশায় এখন তাড়াতাড়ি করেও কোন ফল হবে না আর। নকশাগুলো পর্যন্ত বাক্সে গোছানো হয়নি। নিজেকেও খুব সুস্থ আর সচল বলেও মনে হচ্ছেনা। তাছাড়া ওটি ধরতে পারলেই যে বসের গালাগাল থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, সে ভরসাও নেই আর। হারামজাদা পিয়ন সকাল পাঁচটায় তাকে ষ্টেশনে না পেয়ে এতক্ষনে নিশ্চয়ই রিপোর্ট করেছে বসের কাছে। মেরুদন্ডহীন এই পিয়নটিকে বসের এক নম্বর চামচা বলা যেতে পারে ! এখন যদি অসুস্থ বলে ছুটি নেয়, তাহলেও অবিশ্বাস ও সন্দেহ ঘুচবে না। গত পাঁচ বছরের চাকুরী জীবনে একবারও অসুস্থ হয়নি। এবার অসুস্থ বলে জানালে সাথে সাথেই অফিসের ডাক্তার পাঠাবে বস। অলস সন্তানের অজুহাতে বাবা-মাকে ধিক্কার দেবে আর ডাক্তারের বরাত দিয়ে সমস্ত অসুস্থতাকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করবে। অসুস্থতা যে কি, এ ব্যাটা একেবারেই বুঝবে না। তার কাছে এ হচ্ছে কাজে ফাঁকি দেবার ফন্দি। এসব ভাবনার জাল বুনতে বুনতে ও গতরাতের লম্বা ঘুমের প্রভাবে কঠিন ঘোরের মাঝে পড়লো গ্রেগর। সেই সাথে নিজেকে ভীষন ক্ষুধাও পেলো তার।
এসব সিদ্ধান্তহীন নানা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বিছানাও ছাড়েনি ততক্ষনে। ঠিক তক্ষুনি পৌঁনে সাতটার সংকেত বেজে উঠলো ঘড়িতে। বিছানার মাথার দিকের কাছেই দরজা। মায়ের সাবধানী টোকা আর মোলায়েম আওয়াজও শোনা গেল। ‘গ্রেগর, পৌনে সাতটা বাজে, কাজে যাবি না আজ’? উত্তর দিতে গিয়ে নিজের গলার আওয়াজ শুনে হতচকিত হলো গ্রেগর। মূল স্বরটি আগের মতো হলেও নীচ থেকে তীব্র যন্ত্রনাকাতর চিহি চিহি আওয়াজ এসে সে স্বরের সাথে মিশে যাচ্ছে বারবার। উচ্চারণের প্রথম মূহুর্তেই মূল স্বরকে এমনভাবে নষ্ট করছে যে, পুরো শব্দটাকেই অবোধ্য হয়ে যাচ্ছে। গ্রেগর মা কে পুরো আবস্থাটি বর্ননা করতে চাইলেও নিজের অসহায় অবস্থা বুঝে সংক্ষিপ্ত করলো উত্তর। ‘হ্যা, হ্যা মা, ধন্যবাদ। এক্ষুনি উঠছি’। হয়তো দরজাটি কাঠের, তাই তার গলার স্বরের এই অস্বাভাকিতা মায়ের কানে পৌঁছালো না। মা তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে দরজা থেকে বিদায় নিলেন। কিন্তু তাদের এই কথোপকথনে বাড়ীর অন্যান্য সদস্যরাও টের পেলো যে, গ্রেগর সময়মতো বেরিয়ে পড়তে পারে নি। সুতরাং পাশের আরেকটি দরজায় হালকা হাতে ধাক্কা দিলেন বাবা। ‘গ্রেগর, গ্রেগর, উঠছিস না কেন? কি হলো’? তারপর একটু থেমে আবার মৃদুস্বরে ডাকলেন, ‘গ্রেগর, গ্রেগর’। অন্য দরজায় তার বোন এসে ডাকলো,’গ্রেগর, তোর কি শরীর খারাপ’? দু’দিকেই উত্তর দিল গ্রেগর,’হ্যা, আমি তৈরী’। খুব সাবধানে কথা বললো, বিরতিগুলো লম্বা করলো একটু, যাতে তার আওয়াজের অস্বাভাকিত্ব যতোটা সম্ভব কম টের পাওয়া যায়। বাবা তার নাস্তার টেবিলে ফিরে গেলেন। কিন্তু তার বোন তখনো দরজায়। ফিসফিসিয়ে বললো, ‘গ্রেগর, দরজাটা খোল, দেখছি কি হলো’। কিন্তু তার তখনও দরজা খোলার মতো অবস্থা নেই। যাযাবর জীবনের সতর্কতায় বন্ধ ঘরেই ঘুমোতে অভ্যস্ত সে। তাতে স্বস্তি বোধই করলো গ্রেগর।
সর্বপ্রথম উদ্দেশ্য হলো শান্ত থাকা ও কোনরকম বিরক্তিকে পাত্তা না দিয়ে বিছানা ছাড়া। তারপর কাপড় পড়া। বেশ ক্ষিদে পেয়েছে তার, তাই নাস্তা সারাও বেশ জরুরী। সবশেষে ঠান্ডা মাথায় সামনের পদক্ষেপগুলো ভাবা। বিছানায় শুযে শুয়ে হাজার ভেবেও যে কোনরকম কার্যকরী সিদ্ধান্তে আসা যাবে না, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। বিছানা ছাড়ার সময় এধরণের হালকা যন্ত্রনা নতুন কিছু নয়। অস্বাভাবিক কোন ভঙ্গীতে শোবার কারণেও হতে পারে। হয়তো তা নিতান্তই মনোগত। তবে আজকের ঘটনাটি কোন দিকে মোড় নিতে পারে ভেবে সামান্য উত্তেজিত সে। গলার স্বরের পরিবর্তন ঘোরাঘুরি ও সর্দি লাগার কারণেই হয়েছে, এব্যাপারে নি:সন্দেহ সে।
গা থেকে লেপটি নামানো একেবারেই সহজ, একটু নড়াচড়া করলেই খসে যাবে। কিন্তু বেশ চওড়া লেপ, তাই যেমন ভেবেছিল গ্রেগর, কাজটি তারচেয়ে কঠিন হয়ে দাড়ালো। উঠে বসার জন্যে হাতে ভর দেয়া দরকার, অথচ সেখানে রয়েছে হাতের বদলে অনেকগুলো শীর্ণ শীর্ণ পা। সে পা’গুলো আবার সারাক্ষনই ইতস্তত: নড়াচড়া করছে । সে নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণও তার ক্ষমতার বাইরে। একটি পা’কে সে সবার আগে সোজা করতে চাইল। অথচ সে পা’ই ভাজ হয়ে গেল বারবার। অন্য একটি পা’কে নিয়ন্ত্রণ কার সম্ভব হলেও বাকীগুলো স্বাধীনভাবে, এক অস্বাভাবিক বেদনাদায়ক উত্তেজনায় এদিক সেদিক নড়াচড়াতেই ব্যতিব্যাস্ত রইল। ‘না, আর কতোক্ষন এভাবে বিছানায় থাকা যায়!’, আপন মনেই বললো গ্রেগর।
প্রথমে সে তার শরীরের নীচের অংশটি নিয়ে বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করলো। কিন্তু সে অংশটিই তার চোখেই পড়েনি। সে আংশের চেহারা কেমন, সে ধারণাও এ অবধি হয়নি তার। চেষ্টা করতে গিয়ে একেই এখন তার কাছে সবচে’ ভারী ও নড়াচড়ার অযোগ্য বলে মনে হলো। উপায় না পেয়ে বন্য শক্তিতে দিয়ে নিজেকে সামনে ঠেলল সে। আর সেটাই ভুল হওয়ার কারণে বিছানার কোনে ধাক্কা লাগলো। জলন্ত এক যন্ত্রণায় অধীর হয়ে টের পেলো, তার শরীরের এই অংশই এমূহুর্তে সবচে’ বেশী স্পর্শকাতর। ব্যাথা পেয়ে এবার শরীরের উপরের অংশটি বিছানা থেকে নামানোর চেষ্টা করলো। সেজন্যে মাথাটি বিছানার প্রান্তের দিকে ঘুরিয়ে আনলো। এতে বেশী পরিশ্রম করতে হলোনা। যদিও তার শরীরের ব্যাপ্তি চওড়া ও ওজনে ভারী, তারপরেও তা ধীরে মাথার সাথে তাল মিলিয়ে ঘোরাতে সক্ষম হলো।কিন্তু মাথাকে আরেকটু বিছানার বাইরে এনেই আরো বেশী ঘুরতে ভয় পেলো সে। যদি বিছানা থেকে নীচে পড়ে, এবং কোন দৈবশক্তির বলে রক্ষা না পায়, তাহলে ভয়ংকর আঘাত লাগবে মাথায়। এর চাইতে বিছনায় পড়ে থাকাও গ্রহণযোগ্য মনে হলো তার।
ক্লান্ত নি:শ্বাসে আবারো আগের মতোই চীৎ হয়ে বিছানায় পড়ে রইল। আবারো দেখলো, তার পা গুলো কোন এক অজানা ক্রোধে পরস্পরের সাথে আরো বেশী যুদ্ধে মত্ত। পায়ের এই অরাজকতায় কোন রকম শৃঙ্খলা আনার উপায় সে খুঁজে বের করতে পারলো না। তারপরও কিছুতেই এভাবে বিছানায় পড়ে থাকতে চাইল না। এতে যদি সাফল্যের নুন্যতম সম্ভাবনাও থাকে, তাহলে সবরকম কষ্টই মেনে নিতে নিজেকে তৈরী করলো সে। পাশাপাশি এটাও ভুললো না, তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তের চেয়ে পরিকিল্পিত ও একমাত্র পরিকল্পিততম চেষ্টাই এঅবস্থায় সবচেয়ে জরুরী। যতোটা সম্ভব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জানলার দিকে তাকানোর চেষ্টা করলো । কিন্তু সেখানেও জমাট বেঁধে আছে সকালের ঘন কুয়াশা আর পাশের বাড়ীর ঘিন্জি দেয়াল। ঘড়ি সাতটা বাজার সংকেত দিল। ‘সাতটা বেজে গেল, এখনও এত কুয়াশা’? মনে মনে বললো সে। ক্লান্ত, ভারী নি:শ্বাস ফেলতে ফেলতে আরো কিছুক্ষন একই ভাবে পড়ে রইল সে। ভাবলো এই নি:স্তব্ধ নীরবতাই যেন তাকে তার পুরানো ও যথার্থ অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়ার পথে একমাত্র সহায়ক।
পরমূহুর্তেই ভাবল গ্রেগর,’সওয়া সাতটা বাজার আগে যে করেই হোক, বিছানা ছাড়তেই হবে। সাতটায় শুরু অফিস, যে কোন মূহুর্তেই কেউ না কেউ আমাকে খোঁজার জন্য এসে যেতে পারে’। দোলাতে দোলাতে নিজের শরীরকে আড়াআড়ি ভাবে একবারেই বিছানা থেকে নীচে ফেলার চেষ্টা করলো এবার। এভাবে যদি মাথাটি অনেকটা উঁচু করে নীচে পড়তে সক্ষম হয়, তাহলে ব্যাথা না ও পেতে পারে, এমনি আশা হল তার। পিঠ তো শক্ত বলেই মনে হচ্ছে। কার্পেটের উপর পড়লে বিপদজনক কিছু ঘটবে বলে মনে হয়না। যে বিকট আওয়াজ হবার সম্ভাবনা, এ নিয়েই ভাবনা হলো তার। হয়তো চার দেয়ালের আড়ালে সে আওয়াজ তেমন কোন ভাবনার কারণ ঘটাবে না। কিন্তু সাহস করে এই অসাধ্যই সাধন করতে হবে এখন!
নিজেকে প্রায় অর্ধেকটা বিছানা থেকে বের করে এনেছে গ্রেগর। শরীরের দোলুনি তখন যতোনা কষ্টকর, তারচেয়ে বেশী খেলার মতো মনে হলো তার কাছে। শুধুমাত্র পেছন দিকেই হেলে দুলে নড়তে হচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো, কারো সাহায্য পেলে কতোই না সহজ হতে কাজটি। তার বাবা আর বাড়ীর আয়া, দু’জনই যথেষ্ট। পিঠের নীচে হাত দিয়ে দু’জনের শক্তিতে টেনে ওঠাতে পারতো, তারপর দু’জনেই মেঝেতে উবু হয়ে তাকে উল্টে দিলেই কাজ সারা। পা গুলোও হয়তো কাজে আসতো তখন। কিনতু এখন সে আশায় গুড়ে বালি! সবক’টি দরজাও বন্ধ। কাউকে সাহায্যের জন্যে ডাকলে কি ভাল হতো ? একথা ভেবে এই নিদারুন শোচনীয় অবস্থাতেও একটি মৃদু হাসি চেপে রাখতে পারলো না।
দুলতে দুলতে একসময় ভারসাম্য বজায় রাখাই অসাধ্য হয়ে দাঁড়ালো। চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার সঠিক সময় এবার! ঘড়ির কাটা তখন সাতটা বিশের ঘরে। ঠিক তক্ষুনি কলিং বেল বেজে উঠলো সদর দরজায়। ‘নিশ্চয়ই অফিসের কেউ একজন’, মনে মনে বললো সে। নিজের পা গুলোর দিকে তাকিয়ে হিম হয়ে গেলো তার ভেতরটা। সেগুলো আরো উত্তেজিত হয়ে আরো দ্রুত এদিক সেদিক নাড়াচাড়া করছে। এক মূহুর্তের জন্যে যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেলো চারদিক। ‘দরজা খুলবে না কেউ’, কোন এক নিরর্থক বিশ্বাসের উপর ভরসা রেখে ভাবলো সে। কিন্তু পরমূহুর্তেই বাড়ীর আয়ার জোরালো পায়ের আওয়াজ ও দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল। সৌজন্য বিনিময়ের প্রথম শব্দটি শুনেই টের পেলো গ্রেগর, এ তাদের অফিসেরই আইনসঙ্গত প্রতিনিধি। এমনি এক সংস্থায় কর্মরত ভেবে নিজের প্রতিই ক্ষোভ হলো তার। সামান্যতেই এত সন্দেহ কেন? সবাই কি অলস আর অকর্মন্য? আজ সকালের পুরো সময়টুকু অফিসের কাজে ব্যবহার করতে না পেরে সে নিজেই আত্মসমালোচনায় জ্বলছে। অথচ বিছানা ছেড়ে উঠার ক্ষমতাও তার নেই। ঘটনা কি জানা এত জরুরী হলে একজন শিক্ষানবিসকে পাঠালেই তো চলতো। এই উকিল ব্যটার নিজে এখানে আসার কি দরকার ছিল? তাদের নিজেদের ভেতরে সন্দেহ, সেজন্যেই এই উকিলেরই উপস্থিতি, এই সহজ সহজ সরল পরিবারের সদস্যদের তা প্রমান করার কোন প্রয়োজন ছিল কি? এসব ভাবতে ভাবতে উত্তেজিত গ্রেগর একটা শক্তিশালী সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হলো। সমস্ত শক্তি দিয়ে হেলতে দুলতে বিছানা থেকে মেঝের উপর পড়লো। একটা ভোতা আওয়াজ হলেও তেমন বিকট মনে হলোনা। হয়তো মেঝের কার্পেটই সে আওয়াজ কমিয়ে দিয়েছে। হয়তো তার পিঠ শক্ত হলেও স্থিতিস্থাপকতার প্রভাব ছিল। কিন্তু মাথাটি তেমন সাবধানে রাখা গেল না। ব্যাথা পেলো বেশ ও রাগে ও যন্ত্রণায় মাথা কার্পেটে ঘসলো।
‘ও ঘরে মাটিতে ভারী কিছু একটা পড়েছে, আওয়াজ শুনলাম’, বললেন উকিল সাহেব বা’ পাশের ঘর থেকে। ‘এই উকিল হারামী একদিন এ অবস্থায় পড়লে ভালই হতো’, ভাবল গ্রেগর। ‘এ শাস্তি আমার বদলে তারই প্রাপ্য’। হয়তো তার ভাবনার যথাযথ উত্তর দেবার জন্যেই জদ্রলোক পাশের ঘরে জুতোয় মচমচ আওয়াজ তুলে স্থির ভাবে ভাবে এদিক সেদিক পা ফেললেন। ডান পাশের ঘর থেকে তার বোন ফিসফিসিয়ে উঠলো,’গ্রগর, তোমার অফিসের লোক এসেছেন’! ‘জানি’ বিড়বিড়িয়ে বললো গ্রেগর। কিন্তু বোন যে শুনতে পারবে, এতটা উঁচুতেও নিজের স্বরকে তোলার সাহস পেলো না।
‘গ্রেগর’ বা’ পাশের ঘর থেকে ডাকলেন বাবা। ‘তোর অফিসের লোক এসেছেন। জানতে চাইছেন, আজ সকালের ট্রেনে ট্যুরে বেরোসনি কেন। আমরা তাকে কি উত্তর দেব, জানিনা। তাছাড়া উনি তোর সাথে সামনাসামনি কথা বলতে চাইছেন। দরজাটা খোল বাবা! ঘর আগোছালো ভেবে লজ্জা করিস না’। ‘সুপ্রভাত মিষ্টার সামসা’, বললেন উকিল বাবার কথার মাঝই নরম স্বরে। ‘ওর শরীরটা হয়তো ভাল যাচ্ছেনা’, মা বললেন উকিলকে, বাবা তখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। ‘ওর শরীরটা ভাল যাচ্ছেনা, বিশ্বাস করুন উকিল সাহেব। তা না হলে গ্রেগর সময়মত ট্রেনে না উঠার মতো ছেলে না। ওর মাথায় তো সারাক্ষণ শুধু কাজ আর কাজ! বিকেলে বাইরে যায় না বলে আমি নিজেই মাঝে মাঝে রাগ করি। এইতো, গত আট দিন শহরে ছিল, প্রতিটি সন্ধ্যায় বাড়ীতেই কাটিয়েছে। সারাক্ষন বাড়ীতে বসে পত্রিকা পড়েছে আর ট্যুরের পরিকল্পনা নিয়েই ব্যাস্ত থেকেছে। এমনকি কাঠ খোদাই এর কাজেও মন বসাতে পারে নি। দুই, তিন সন্ধ্যায় কাজ করে একটি ছোট ফ্রেম শেষ করেছে মাত্র। তার ঘরেই ঝুলছে। দরজা খোলার সাথে সাথেই সেটা চোখে পড়বে আপনার। আপনি যে এসেছেন, তাতে আমি খুব খুশী হয়েছি উকিল সাহেব। আমাদের কথায় গ্রেগর কিছুতেই দরজা খুলতো না। যদিও তার অনেক গোয়ার্তুমি রয়েছে, তারপরও আজ সকালের ঘটনায় নিশ্চয়ই অনুতপ্ত।‘ ‘আমি এক্ষুনি আসছি’ অনেকটা ভেবে ভেবে আস্তে আস্তে বললো গ্রেগর। কিন্তু কোন নড়াচড়া করলো না, যাতে সবার প্রতিটি কথা পরিস্কার শুনতে পারে। ‘আপনার কথাই ঠিক, মিসেস সামসা। অন্য কোন ভাবনা আমার মাথাতেও আসছে না’ বললেন উকিল সাহেব। ‘তেমন গুরুতর কিছু হয়েছে বলে মনে হচ্ছেনা। এ কথাও মানতে হবে যে, আমাদের মতো কর্মজীবি মানুষদের ভালোমন্দ যা ই হোক না কেন, দ্বায়িত্বের কারণে অনেক সময়েই ছোটখাট অসুস্থতাকে ভ্রূক্ষেপ না করে এগিয়ে যেতে হয়’। ‘উকিল সাহেব কি এখন ঘরে ঢুকতে পারবেন”?, অধৈর্যে বাবা আরো কয়েকবার টোকা দিলেন দরজায়। ‘না’, উত্তর দিল গ্রেগর। বা’দিকের ঘরে এক বেদনাদায়ক নীরবতা এসে ভর করলো, পাশাপাশি ডানদিকের ঘরে শোনা গেল বোনের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ।
সবার সাথে বোনের তো বসার ঘরেই থাকার কথা? মনে হচ্ছে, ঘুম থেকে জেগেছে মাত্র। পোষাক আসাকও হয়তো ঠিকমতো পড়ে উঠতে পারে নি। কিন্তু কাঁদছে কেন সে? গ্রেগর সময়মতো জাগতে পারে নি, উকিল সাহেবকে ঘরে ঢুকতে দিতে পারে নি, এটা ঠিক। কিন্তু তাতে কাঁদার কি আছে? তার চাকুরী গেলে, বস বাবার উপর পুরানো দেনা কথা তুলে চাপ সৃষ্টি করবে, সেজন্যে ভয় পাচ্ছে সবাই? কিন্তু এই ভয়ের কোন কারণ থাকতে পারে না। সে এখনো সবার পাশাপাশি। সে তো সর্বক্ষন এই পরিবারে মঙ্গলের জন্যেই যা সম্ভব করে এসেছে। সামনেও করে যাবে। কিন্তু এই মুহুর্তে যে অবস্থায় কার্পেটের উপর পড়ে সে, তা চোখে পড়লে পরিবারের কেউই কিছুতেই উকিল সাহেবকে এ ঘরে ঢোকানোর দাবী করতে যেত না। অভদ্রতা হচ্ছে, এই অজুহাতে কিছু করা ঠিক হবে না। পরে সুবিধামতো উত্তর খুঁজে বের করে নিলেই হবে। আপাতত: বিরক্ত না করে বোনকে ঠান্ডা মাথায় কাঁদতে দেয়াই ভালো। কিন্তু তারপরও গভীর অনিশ্চয়তা এসে ভর করলো তার মাথায়।
‘মি সামসা’, বেশ জোর আওয়াজে বললেন উকিল। ‘কি ব্যাপার? আপনি নিজেকে ঘরে বন্ধ করে রাখছেন। হ্য বা না বলে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। এতে নিজের বাবা মাকেও কঠিন দূর্ভাবনার মাঝে ফেলছেন। সেই সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এই অসামাজিক ব্যাবহারে আপনি আপনার কর্তব্যকেও অবহেলা করছেন। আপনার বাবা মা ও বসের পক্ষ থেকে আপনার এই ব্যাবহারের কারণ দর্শানোর দাবী করছি আমি। আপনাকে একজন শান্ত ও দ্বায়ীত্বশীল মানুষ হিসেবেই জানি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আপনি আপনার অদ্ভুত ব্যাবহারে আমাদের ধৈর্যশক্তির পরীক্ষা করতে চাইছেন। গতদিনের বিল কোন কারণে জমা করেন নি আপনি। এবিষয়ে আমাদের বস আজ সকালে আপনার অক্ষমতা ও ভুলের কথা তুলে নিজের ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করেছেন। আমি স্পষ্ট ভাবে তাঁকে বুঝিয়েছি যে, আপনি তাতে দায়ী নন। কিন্তু আজ এখানে এসে আপনার এই নিরর্থক গোয়ার্তুমি দেখে আপনার স্বপক্ষে একটি কথা বলারও ধৈর্যও হারিয়ে ফেলছি। আপনার এই ব্যাবহার একেবারেই ভদ্রোচিত নয়। সবার সামনে না বলে এসব কথা আপনাকে একান্তভাবেই বলার ইচ্ছে ছিল আমার। কিন্তু যেহেতু অযথাই আপনি আমার মুল্যবান সময় নষ্ট করছেন, সেহেতু আপনার বাবা মাকে সে কথাগুলো না শোনানোর কোন কারণ দেখতে পাচ্ছি না। আপনার গত কয়েক মাসের কাজে একটুও সন্তুষ্ট নই। এটা ঠিক, বছরের এই সময়টি ব্যাবসার জন্য সুবিধাজনক নয়। কিন্তু ব্যাবসা একেবারেই বন্ধ থাকবে, বছরের এমন কোন সময় আছে বলে বিশ্বাস করি না। বুঝতে পারছেন জনাব সামসা, বছরের এমন একটি সময় কখনোই থাকতে পারে না’।
‘কিন্তু উকিল সাহেব’, উত্তেজিত গ্রেগর নিজের আবস্থাই ভুলে গেল। ‘এক্ষুনি, এই মূহুর্তেই দরজা খুলছি আমি। সামান্য অস্থিরতা, দুর্বলতার কারণে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনি। এখনো বিছানাতেই। অনেকটা ভালো বোধ করছি। এইতো নামলাম বিছানা ছেড়ে। আরেকটু ধৈর্য ধরুন। যতোটা ভাল বলে ভেবেছিলাম ততটা ভাল বোধ করছি না। তারপরেও ঠিক হয়ে যাব। দেখুন, কি দুরবস্থায় পড়লাম হঠাৎ! গতকাল সন্ধ্যায়ও ভালো ছিলাম, বাবা মা ও জানেন। যদিও কিছু একটা অসুস্থতার আভাস পাচ্ছিলাম। হয়তো আগে থেকেই কিছু করা দরকার ছিল। কেন যে অফিসে জানালাম না! কিন্তু বাড়ীতে না শুয়ে থেকেও কাজের মাঝেও সুস্থ হয়ে ওঠা যায়! উকিল সাহেব, আপনাকে অনুরোধ করছি, আমার বাবা মা কে এসবের মাঝে জড়াবেন না। যেসব অভিযোগ আপনি আমার বিরুদ্ধে আনছেন, তার কোন কারনই নেই। এ নিয়ে কেউ আমাকে কখনোই কিছু বলে নি। আমি যে শেষ চুক্তিপত্রটি পাঠিয়েছি, তা হয়তো আপনার চোখেই পড়ে নি। আজই আটটার ট্রেনে বেরিয়ে পড়ছি আমি। কয়েক ঘন্টা বাড়তি বিশ্রামে এখন অনেকটাই তাজা বোধ করছি। অযথা আপনার মুল্যবান সময় নষ্ট করবেন না উকিল সাহেব। আমি নিজেই একটু পরে অফিসে আসছি। দয়া করে বসকে সব জানাকেন ও আমার তরফ থেকে সন্মান দেবেন’।
নিজের কথার অনেকটা গ্রেগর নিজেই বুঝতে পারলো না। বিছানার উপরে নিজের শরীরকে নড়ানো জন্যে যেসব অনুশীলন শুরু করেছিল, তারই সাহায্যে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল বাক্সের দিকে। সেখানে ভর দিয়ে নিজেকে দাড়ঁ করানোর চেষ্টা করলো। নিজেকে লুকিয়ে রাখার কথা ভাবলো না। তাছাড়া উকিল সাহেবের সাথে কথাও বেশ জরুরী। যারা ডাকাডাকি করছে, তাকে এভাবে দেখার পর তাদের সামনাসামনি প্রতিক্রিয়া জানার খুব আগ্রহ হলো তার। যদি ভয় পায়, তা তাদের নিজেদের সমস্যা। যদি তাকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে, তাহলেও উত্তেজিত হবার কোন কারণ নেই। একটু দ্রুত তৈরী হতে পারলে আটটার গাড়ী সহজেই ধরা সম্ভব। নিজেকে দাঁড় করানোর চেষ্টায় কয়েকবারই মসৃন বাক্সে পিছলে গেল শরীর। তারপরও একসময় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারলো। শরীরের নীচের যতই ব্যাথা হলো না কেন, পাত্তা দিল না। এইভাবে একটা চেয়ারে হেলান দিতে পারলো। পা গুলো আকড়ে ধরলো চেয়ারের প্রান্ত। তাতে নিজের উপর নিয়ন্ত্রন আসার পর উকিল সাহেবের বাকী কথা শোনার জন্যে কান পেতে রইল।
‘তার একটি কথাও কি বুঝতে পেরেছেন? আমাদেরকে কিন্তু বোকা বানানো হচ্ছে!, উত্তেজিত উকিল সাহেব বাবা-মার কাছে অনুযোগ জানালেন। ‘না, হতেই পারেনা’, কাঁদতে কাঁদতে বললেন মা। ‘ও সত্যিই খুব অসুস্থ, আর আমরা তাকে আরো বেশী যণ্ত্রনা দিচ্ছি। গ্রেটে, গ্রেটে”! চিৎকার করে মেয়েকে ডাকলেন মা। ‘মা’ অন্য ঘর থেকে উত্তর দিল মেয়ে। গ্রেগরের ঘর ভেদ করেই দু’জনের কথাবার্তা চললো। ‘এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে যা। গ্রেগর খুব অসুস্থ। যাবি আর আসবি! তুই কি ওর গলার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিস’? ‘পশুর গলার আওয়াজ ছিল ওটা’, বললেন উকিল। মায়ের চিৎকারের চেয়ে অনেক শান্তভাবে ‘আনা, আনা’ বলে বসার ঘর ভেদ করে রান্নাঘরের দিকে ডাক দিলেন বাবা। ‘তাড়াতাড়ি একজন চাবিওয়ালা ডেকে আন’। বাবার কথার সাথে সাথে দু’জনই তাদের স্কার্টে ঘস ঘস শব্দ তুলে বসার ঘরে দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো। বোন পোষাক এত তাড়াতাড়ি কি করে পড়লো? সদর দরজা খোলার শব্দ শোনা গেলেও বন্ধ করা শব্দ পাওয়া গেলনা। হয়তে দরজা খোলা রেখেই ছুটেছে দু’জন। অতিমাত্রার অশুভ কোন ঘটনায় এটাই স্বাভাবিক।
এবার কিছুটা শান্ত হল গ্রেগর। বুঝতে পারলো, কথা বুঝতে পারলেও তার সমস্যার কিছুটা হলেও কাছাকাছি পৌঁছুতে পেরেছে ওরা। সে যে ভাল অবস্থায় নেই, অন্ততপক্ষে তা বোঝাতে পেরে অনেকটা স্বস্তি পেলো সে। এখন নিশ্চয়ই সবাই সাহায্যে এগিয়ে আসবে। যে আশা ও নিশ্চয়তার সাথে প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো নেয়া হলো, বেশ মনে ধরল তার। মানব সমাজ তাকে আবার নতুন করে গ্রহন করার জন্যে প্রস্তুত। ডাক্তার ও চাবিওয়ালার ভুমিকা সন্মণ্ধে বেশী ভাবনা করলো না সে। কিন্তু এ বিশ্বাস হলো যে, হলো তারা তাকে কার্যকরী কোন সাহায্য করতে পারবে। নিজের সমস্যা খুলে বলার জন্যে নিজেকে তৈরী করা দরকার। তাই একটু গলা খাকারি দিয়ে নিজের স্বর পরিস্কার করার চেষ্টা করলো। সে শব্দও যথাসম্ভব চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করলো। হয়তো তার নিজের কাছেই সে আওয়াজ মানুষের বলে মনে হল না। পাশের ঘরে তখন নি:স্তব্ধ নীরবতা। হয়তো উকিল সাহেবকে নিয়ে বাবা মা টেবিলে বসে ফিসফিস করে এ সমস্যা নিয়েই আলাপ করছেন। এমনও হতে পারে, সবাই তার দরজায় কান পেতে আছেন তার দরজায়।
গ্রেগর ধীরে ধীরে চেয়ারটি দরজার দিকে ঠেলে কাছাকাছি নিয়ে এল। তারপর ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো দরজার উপর। তার পায়ের জোড়ায় আঠালো এক পদার্থ তাকে দরজায় আটকে রাখায় সহায়ক হলো। কয়েক মূহুর্ত বিশ্রাম নিল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। চেষ্টা করলো মুখে কামড়ে দরজার চাবিটি ঘোরানোর। মুখে যে দাঁতই নেই, টের পেলো এবার। হতাশায় ভরে উঠল মন। পরমুহুর্তেই আশাহ্নিত হল এই ভেবে যে, দাঁত না থাকার কারণে মাড়ি হয়তো শক্ত হতে পারে। সে শক্ত মাড়ির চাপেই অবশেষে ঘোরাতে সক্ষম হলো চাবিটি। এত মনযোগী যে, মুখের ভেতর যে ক্ষত তৈরী হচ্ছে, টেরই পেলনা সে। এক বাদামী রং এর তরল পদার্থ মুখ থেকে বেরিয়ে এসে দরজার চাবি বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় মাটিতে পড়লো। ‘শুনতে পাচ্ছেন’? পাশের ঘর থেকে বললেন উকিল। ‘চাবি ঘোরাচ্ছে সে’। গ্রেগরকে কিছুটা সাহস জোগালো এই মন্তব্য। বাবা মা দুজনে মিলে উৎসাহ দিলে আরো ভাল হতো- ‘সাবাশ! গ্রেগর, সাবাশ! আরেকটু! আরেকটু’, ! তার প্রচেষ্টা নিয়েই আগ্রহী সবাই, এই বিশ্বাসে পুরো শক্তিতে চাবিটি যতোনা ঘোরানো সম্ভব হলো, তারচেয়ে কামড়েই ধরলো বেশী। এভাবেই যতটুকু ঘোরাতে পারলো, সে অবস্থায় স্থির রেখে শরীরের পুরো ওজনে তালাটি চেপে, আবার একটু ঘোরালো। অবশেষে তালা খোলার একটি জোরালো আওয়াজে সজাগ হলো ইন্দ্রিয়। ‘চাবিওয়ালার সাহায্যের ছাড়াই পেরেছি’! ভেবে মাথা রাখলো হাতলের উপর দরজাটি খোলার জন্যে।
দরজা খোলার চেষ্টায় নিয়ে এতই মনোযোগী গ্রেগর, চাবি ঘোরানোর পরপরই দরজার একটি পাল্লা যে খানিকটা খুলে গিয়েছিল, তা টেরই পায়নি। মাঝে সে নিজেই পাল্লাটির আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়ে ছিল। এখন সে পাল্লার সাথে নিজের শরীরকে তাল মিলিয়ে ঘোরানো ছাড়া আর কোন পথ রইল না। তাছাড়া বাইরের কারো ধাক্কায় সে নিজেই চীৎ হয়ে মাটিতে না পড়ে, সেদিকেও নজর রাখা দরকার।। নিজের প্রচেষ্টায় এতোই মনযোগী, অন্যরা কি করছে, সেদিকে নজরই ছিল না তার। সেই মুহুর্তে ‘ওফ’ বলে এক চিৎকার ঝড়ের মতো উকিল সাহেবের মুখ ফুড়ে বেরিয়ে এলো। দরজার সবচেয়ে কাছাকাছি থাকায় তিনিই সবার আগে গ্রেগরকে দেখতে পেলেন। বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যাওয়া মুখের সামনে হাতটি ধরে ধীরে ধীরে সরে গেলেন পেছনের দিকে। মনে হলো কোন এক অদৃশ্য শক্তি কোন এক অজানা আকর্ষনে টানছে তাকে। মা সারারাতের এলোমেলো চুলে এতোক্ষন উকিল সাহেবকেই সঙ্গ দিচ্ছিলেন। জোর হাতে ভোতা দৃষ্টিতে বাবার দিকে একবার তাকিয়েই দুই পা এগুলেন গ্রেগরের দিকে। তারপর সবার মাঝখানে স্কার্টটি ছড়িয়ে এলিয়ে পড়লেন মাটিতে। মাথাটি অবশ হয়ে ঝুলে রইলো বুকের উপর। বাবা কোন এক অদৃশ্য শত্রুকে হাত তুলে গালাগাল করলেন। মনে হলো গ্রেগরকে ঠেলে আবার ঘরের ভেতরই পাঠিয়ে দিতে চাইছেন। বসার ঘরে থেকেই ভীক,অচেনা দৃষ্টিতে ইতস্তত: চোখ ফেললেন, তারপর দুই হাতে চোখ ঢেকে ভেঙ্গে পড়লেন কান্নায়। কান্নার দমকে তার প্রশস্ত বুক কেঁপে উঠলো বারবার।
গ্রেগর বসার ঘরে টোকার চেষ্টা করলো না, বরং দরজার পাল্লার ভেতরের দিকেই হেলান দিয়ে পড়ে রইল। তার অর্ধেক শরীর ও হেলানো মাথাটি পাল্লাটির প্রান্তে বেরিয়ে রইল। এই অবস্থাতেই সতর্ক, হতচকিত, ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সবার দিকে। ততক্ষনে বাইরের পৃথিবী অনেকটা আলোকিত হয়ে উঠেছে। রাস্তার উল্টোদিকের হাসপাতালের একটি অংশ, ধুসর কালো সীমাহীন দেয়ালের পরিধি ও তাতে একটার পর একটা সাজানো অগুনতি জানালা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। অঝোর ঝারায় ঝড়ছে বৃষ্টি। বৃষ্টির ফোঁটা আরো বেশী বড়, আরো বেশী জোরালো হয়ে মাটির বুকে আছড়ে পড়লো। বাবার জন্যে নাস্তার সময়টি প্রতিদিনের খাওয়াদাওয়ার সবচেয়ে পছন্দের সময়। এ সময়টায় তিনি টেবিলে বসে পত্রিকা ও বিভিন্ন বই পড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতে অভ্যস্ত। আজ নাস্তার সব সরন্জাম স্তুপিকৃত হয়ে জমে থাকলো টেবিলে। উল্টোদিকের দেয়ালে গ্রেগরের একটি ছবি। সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন সময়ে তোলা। লেফটেনেন্টের পোষাকে তলোয়ার হাতে আত্মবিশ্বাসের হাসি। পোষাক ও চেহারায় নিজের প্রতি সন্মানের দাবী পরিস্ফুটিত। বসার ঘরের দরজা, বাইরের দরজা, দুটোই খোলা পড়ে রইল। এর ভেতর দিয়ে চোখে পড়ছে বাইরের বারান্দা ও নীচে নামার সিড়ির প্রথম অংশ।
একমাত্র গ্রেগরই নিজেকে শান্ত ও সংযত রাখতে পারলো। ‘এক্ষুনি কাপড় চোপড় পড়ে তৈরী হচ্ছি। কারো আপত্তি না থাকলে নমুনাগুলো বাক্সে ঢুকিয়ে এখনই বেরুচ্ছি। দেখুন উকিল সাহেব, আমি গোয়াড়ও নই, কর্মবিমুখও নই। জীবিকার জন্যে ঘুরে বেড়ানো সহজ নয়। কিন্তু টিকে থাকার জন্যে এটাই আমার একমাত্র পথ। অফিসে ফিরে যাচ্ছেন উকিল সাহেব? যান! যা দেখলেন, তাই সরাসরি জানাবেন। আপাতত: আমি একেবারেই কাজে করার যোগ্য নই। কিন্তু এ অবধি যতোটা সাফল্য আমার, তা ভাবার তো এটাই উপযুক্ত সময়। এই সমস্যার মোকাবিলা আমি ঠিকই করবো। তারপর আগের মতোই উদ্দীপনা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়বো নিজের কাজে। এটা ঠিক, বসের প্রতি আমার বিশাল দ্বায়িত্ব রয়েছে। অন্যদিকে বাবা মা ও বোনের জন্যেও আমার অনেক করণীয় রয়েছে। আপাতত: গর্তে পড়েছি, আবার বেরিয়েও আসবো। দেখতে পাচ্ছেন, আমার অবস্থা শোচনীয়। সে অবস্থাকে আরো কঠিন করে তুলবেন না। দয়া করে আমার দিকে নজর রাখুন। যারা শহর বন্দরে ঘোরে, তাদেরকে অপছন্দ করে সবাই। সবাই ভাবে, তাদের বিশাল আয় ও বিলাসবহুল জীবন। এই ভুল ধারণা দুর করার চেষ্টা কেউই করে না। কিন্তু উকিল সাহেব, আপনি নিশ্চয়ই অনেক কিছু অন্যদের চেয়ে সুক্ষভাবে দেখার ক্ষমতা রাখেন। গোপনেই বলছি, আমাদের বসের চেয়েও বোঝার ক্ষমতা আপনার বেশী। ওনি মালিক হিসেবে খুব সহজেই অনেক কর্মচারীর বিপক্ষে মতামত প্রদান করতে পারেন। আপনি ভাল করেই জানেন, ট্যুরের জন্যে প্রায় সারাটি বছরবি শহরের বাইরে থাকি। আর সে কারণেই অতি সহজেই যে কোন ধরণের পরনিন্দা, পরচর্চা ও বানোয়াট অভিযোগের শিকার হতে হয় আমাদেরকে। ঘুরে বেড়াই বলে এসব রটণা খবর সময়মতো জানতে পারি না, তাই উত্তরও দেয়া হয়না সবসময়। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে যখন বাড়ী ফিরি, তখন অকারণেই এর তাড়নায় জর্জরিত হতে হয়। চলে যাচ্ছেন উকিল সাহেব? সামান্য হলেও যে আমার কথা বুঝতে পেরেছেন, সে কথা অন্তত স্বীকার করে যান’!
কিন্তু গ্রেগরের বক্তব্যের শুরুতেই উল্টোদিকে ঘুরে গেলেন উকিল সাহেব। তারপর আবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে কম্পিত ঠেঁটে চোখ ফিরিয়ে ওর দিকেই তাকালেন। যতক্ষন কথা বলছিল সে, ততক্ষন এক মূহুর্তও স্থির হয়ে দাঁড়ালেন না। বরং খুব আস্তে আস্তে, মনে হলো কোন এক বিশাল বাধা যেন তাকে অতিক্রম করতে হচ্ছে, সেভাবেই গ্রেগরের উপর থেকে চোখ না সরিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর আচমকা, বসার ঘরের দরজার বাইরে এমনভাবে পা ফেললেন, মনে হলো তার জুতোর তলায় আগুন লাগিয়েছে কেউ। সেখান থেকে বারান্দা পেরিয়ে যেভাবে দু’হাত সামনে বাড়িয়ে যেভাবে এগিয়ে গেলেন সিড়ির দিকে, মনে হলো ওখানেই তার জন্যে অপেক্ষা করছে এক অলৌকিক মুক্তি।
উকিল সাহেবকে এভাবে যেতে দেয়া কিছুতেই যে ঠিক হচ্ছে না, তা বুঝলো গ্রেগর। তার কর্মজীবনে বিপদের শঙ্কা এতে নি:সন্দেহেই আরো বেশী বাড়বে। বাবা মায়ের তো এতোকিছু ভাবার অবকাশ নেই। বহু বছরের অভিজ্ঞতায় তারা ধরেই নিয়েছেন, গ্রেগরের এই চাকুরি তার সারা জীবনের জন্যেই স্থায়ী। তাছাড়া এ মূহুর্তে তাদের সবরকম চিন্তাশক্তির সীমার বাইরের এই সমস্যা নিয়েই ভাবনা সবচেয়ে বেশী। কিন্তু গ্রেগরের বিশ্বাস তখনও নষ্ট হয়নি। উকিল সাহেবকে এক্ষুনি থামাতে ও বোঝাতে হবে! টেনে আনতে হবে স্বপক্ষে! গ্রেগর ও তার পরিবারের ভবিষ্যত তো এরই উপর পুরো নির্ভর করেছে! বোনটি থাকলে ভাল হতো! সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতি। অনেক কেঁদেছে, যখন গ্রেগর মেঝের উপর চীৎ হয়ে পড়ে ছিল। নারীলিপ্সু এই উকিলকে একমাত্র বোনই থামাতে পারতো। বাইরের দরজা বন্ধ করে বসার ঘরে উকিল সাহেবেকে বসিয়ে, ভাল করে বুঝিয়ে মনের ভয় দুর করতে পারতো। কিন্তু এখন সে ও নেই! যা কিছু করার নিজেকেই করতে হবে। তার বক্তব্য উকিল কতটুকু বুঝলেন বা না বুঝলেন, তার নিজের চলার কতটুকু ক্ষমতা আছে বা নেই, এসব না ভেবেই সে দরজার পাল্লা থেকে সরে এলো। তাঁর দিকে এগিয়ে যাবার জন্যে দুই পাল্লার ফাঁকে নিজেকে ঢুকিয়ে দিল। উকিল তখনো হাস্যকর মূর্তিতে বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে। ছোট্ট এক চিৎকারে নিজের ছোট ছোট পায়ের উপর ভর করে মেঝেতে পড়লো গ্রেগর। পড়ার পরেই প্রথমবারের মতো শারিরীক আরাম টের পেল। পা মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই ফিরে পেল গ্রেগর সেগুলো নিযন্ত্রণের ক্ষমতা। আরো খুশী হলো, যখন দেখল, যেখানে যেতে চাইছে, পা তাকে সেখানেই নিয়ে যেতে সক্ষম। সমস্ত যন্ত্রণার সমাধান আর দূরে নয়, মূহুর্তেই এই বিশ্বাসই জাগলো মনে। হেলেদুলে হাঁটার নতুন অভ্যাসে বেশীদুর এগুতেও পারে নি, মা তখনো তার কাছাকাছিই অসাঢ় হয়ে পড়ে আছেন। ঠিক সেই মূহুর্তেই তিনি উপরের দিকে হাত তুলে লাফিয়ে উঠেই চিৎকার করে উঠলেন, ‘সাহায্য কর কেউ, খোদার দোহাই লাগে, সাহায্য কর কেউ’। মাথাটি নীচের দিকে, গ্রেগরের দিকে ফেরানো, মনে হলো ভাল করে দেখতে চাইছেন ওকে। কিন্তু নিজের অজান্তেই সরে গেলেন পেছনের দিকে, পেছনে নাস্তার টেবিলটি দেখতে পেলেন না । কাছাকাছি এসেই কোন এক অচেনা আচ্ছন্নতায় বসে পড়লেন টেবিলের উপর। টেরও পেলেন না যে, নাস্তার সব সরন্জাম, কফির কাপ, বড় জগ ছড়িয়ে পড়লো মেঝেতে। ঢক ঢক করে সে জগ থেকে কফি বেরিয়ে ভিজিয়ে দিল কার্পেট।
‘মা, মা’, বলে আস্তে আস্তে উপরে তাঁর দিকে তাকালো গ্রেগর। ঊকিলের কথা ভুলেই গেল এবার। ঢক ঢক করে কফি ছড়াচ্ছে মেঝেতে, সেদিকেও চোখ রেখে চোয়াল উচিয়ে শুন্যে কামড় দিল বারবার। এ দেখে মা আবার নতুন ভাবে চিৎকার করে উঠলেন। ভয়ে টেবিল ছেড়ে পালিয়ে ঝাপিয়ে পড়লেন বাবার বুকের উপর। বাবামায়ের দিক থেকে নজর সরিয়ে বারান্দার দিকে তাকালো গ্রেগর। । উকিল তখন সিড়িতে। রেলিংএর উপর থুতনী রেখে শেষবারের জন্যে একবার পেছন ফিরে তাকালেন। গ্রেগর তার শেষ ক্ষমতা নিয়ে চেষ্টা করলো তার কাছে পৌঁছানোর। উকিল সাহেব হয়তো তা টের পেয়ে থাকতে পারেন, এক লাফে বেশ কয়েকটা সিড়ি পার হয়ে বেরিয়ে গেলেন বাড়ী ছেড়ে। ‘হুহ্’ আওয়াজে তাঁর বিকট চিৎকার সিড়িঘরে প্রতিধ্বনিত হলো। বাবা এতক্ষন চুপচাপই ছিলেন। কিন্তু উকিলের এ ধরণের বিদায়ে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন। তিনি উকিল সাহেবকে থামানোর কোন চেষ্টা না করে গ্রেগরের প্রচেষ্টায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন। তাড়াহুড়োয় উকিল তার টুপি ও লাঠি সোফায় ফেলে গিয়েছিলেন। বাবা ডান হাতে সে লাঠি ও বাঁ হাতে টেবিলের উপর থেকে একটি পত্রিকা নিয়ে এগিয়ে এলেন । লাঠি নাড়িয়ে নাড়িয়ে তিনি গ্রেগরকে আবার তার ঘরে ঢোকানোর চেষ্টা করলেন। গ্রেগরের কোন অনুরোধ কাজে এলোনা, কোন কাকুতি মিনতি শুনলেন না তিনি। সে যতোই মাথা কাৎ করে বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, তিনি ততোই আরো তাকে বেশী শক্তিতে পায়ে ঠেল ঘরের ভেতরে পাঠিয়ে দিলেন। মা এই দৃশ্য সহ্য করতে পারলেন না। এই শীতের সময়েও জানালা পুরোটা খুলে মাথা অনেকটা বাইরে নিয়ে দুই হাতে মুখ ঢাকলেন। গলি ও সিড়িঘরের মাঝ বেয়ে দমকা বাতাস জানালার পর্দাগুলো এলোমেলো উড়াতে শুরু করলো। টেবিল থেকে পত্রিকার পাতাগুলো সর সর করে আওয়াজ করলো, কিছু কিছু ছড়িয়ে পড়লো মাটিতে। উম্মত্তের মতো হিস হিস আওয়াজ করে তাকে ধাক্কা দিতে থাকলেন বাবা। চেষ্টা করেও দ্রুত চলতে পারলো না গ্রেগর, কারণ পেছন দিকে চলার কোন অনুশীলন তখনো সে করেনি। নিজেকে যদি ঘরে দিকে ঘোরাতে পারতো, তাহলে তাড়াতাড়িই পৌঁছে যেত সেখানে। কিন্তু অস্থির বাবার সামনে সে সময়সাপেক্ষ প্রচেষ্টা শুরু করার সাহস পেল না। যো কোন মুহুর্তে তাঁর লাঠির মারাত্মক আঘাত তার পিঠে বা মাথায় পড়তে পারে, এই চিন্তাতেই আধমরা হয়ে রইল। একসময় ভয়ে কাঠ হয়ে টের পেলো গ্রেগর, পেছনে চলায় দিক নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব হচ্ছেনা তার। তাই কাতর চোখে কাৎ হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে যতো দ্রুত পারে ঘোরার চেষ্টা করলো এবার। যদিও প্রচেষ্টা একেবারেই ধীরগাতির, তারপরও বাবা তার এই সদিচ্ছা টের পেলেন। চাপ সৃষ্টি না করে লাঠিরখোঁচায় তাকে আস্তে আস্তে ঘুরতে সাহায্য করলেন। বাবার এই হিস হিস আওয়াজ কানে অসহ্য লাগলো। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটু বেশী ঘুরে গিয়েছিল। তাই আবার উল্টোদিকে ঘুরে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজা যতোটা খোলা, গ্রেগরের শরীর তা থেকে আরো বেশী চওড়া। কিন্তু বাবা এতোই উত্তেজিত যে, দরজার আরেকটি পাল্লা খোলার চেষ্টাও করলেন না। তার মাথায় উম্মত্ব চিন্তা যতো দ্রুত সম্ভব গ্রেগরকে চেখের সামনে থেকে দুর করা। এই ফাঁকটুকু ভেদ করে ঘরে ঢোকার জন্যে কিছুটা সোজা হওয়া ও সেজন্যে যতটুকু সময় ও প্রস্তুতি দরকার, বাবা তাকে ততটুকু দিতেও রাজী নন। বরং উম্মত্ত চিৎকারে তিনি গ্রেগরকে ধাক্কা দিলেন বারবার । তার এই চিৎকার গ্রেগরের কাছে নিজের বাবার গলার আওয়াজের বলে মনে হলোনা, তাই সেও প্রাণপনে দরজার দিকেই ঝাপিয়ে পড়লো। তার শরীর একপাশে কাত হয়ে গেলো, একটি দিক ক্ষতবিক্ষিত হলো অনেকটা। সাদা দরজায় নোংরা দাগ পড়ল। একসময় দরজার ফাঁকে আটকে গেল সে, নিজের শক্তিতে এগুনোর ক্ষমতাও রইল না। একপাশের পা গুলো শুন্যে কাঁপতে থাকলো, অন্যদিকের গুলো ব্যাথা যন্ত্রণায় মেঝেতে দুমড়ে রইল। একসময় মুক্তির ধাক্কা দিলেন বাবা। সে প্রায় উড়ে রক্তাক্ত শরীরে তার ঘরের ভেতর গিয়ে পড়লো। লাঠির ধাক্কায় দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো। তারপর অবশেষে নীরব, নি:স্তব্ধ চারপাশ।
২য় পর্ব
গভীর, ঘন সন্ধ্যায় গ্রেগর তার গভীর ঘুম থেকে জাগলো। কোন ব্যঘাত না ঘটলেও হয়তো সে আরো বেশীক্ষন ঘুমোতে পারতো না। মনে হলো একটা অচকিত পায়ের আওয়াজ ও বসার ঘরের দরজার শব্দই তার ঘুম ভাঙ্গার কারণ। রাস্তার আলো তার ঘরের আসবাপত্রের গায়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। কিন্তু নীচে, যেখানে গ্রেগর লুটিয়ে আছে, সেখানে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। ধীরে ধীরে উঠল সে। শুড়গুলোর ব্যবহার আবিস্কার করার চেষ্টা করলো। সেগুলো ডানে বায়ে ও সামনে স্পর্শ করে আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেল কৌতুহলে। শরীরের বাঁ’দিকের পুরোটাই একটা লম্বা ক্ষতের মতো । দু’টো পায়ে খুড়িয়ে হাটতে হচ্ছে। একটি পা সকালের ঘটনায় পুরোপুরি ক্ষতবিক্ষত। সেই অবশ পা’টিকে টেনে টেনেই নিতে হলো। তারপরও শুধুমাত্র একটিই পা অবশ, ভেবে বেশ অবাক লাগলো তার।
দরজার কাছাকাছি পৌঁছেই মনে হলো, কোন এক খাবারের গন্ধই তাকে টেনেছে এনেছে। সত্যি সত্যিই একটা দুধের বাটি সেখানে। সাদা রুটির ছোট ছোট টুকরো ভাসছে সে দুধের উপর। সকালের চেয়েও অনেক বেশী ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর গ্রেগর, আনন্দে হাসতে ইচ্ছে হলো তার। মাথা নুইয়ে প্রায় চোখ অবধি ডুবিয়ে দিল দুধে। কিন্তু সাথে সাথেই বিরক্ত হয়ে মুখ উঠিয়ে নিল সে। কিন্তু এ বিরক্তি এ কারনে নয় যে, বা’ দিকের যন্ত্রণায় শরীরের পেশীশিক্ততে টেনে দুধ খেতে অসুবিধা হচ্ছে তার। দুধ খুবই পছন্দের খাবার, সেটা জেনেই হয়তো বোন বাটিটি রেখেছে ওখানে। কিন্তু তেতো মুখে সে খাবার একেবারেই রুচিতে ধরলোনা তার। বেজার মুখে বাটিটি রেখে ঘরের মাঝে ফিরে এলো সে।
দরজার ফাঁক দিয়ে বসার ঘরে বাতি জ্বলতে দেখতে পেল গ্রেগর। সাধারনত: এসময়ে ওঘরে বসে বাবা মা ও বোনকে বিকেলের পত্রিকা থেকে কোন খবর জোর গলায় পড়ে শোনাতেন, আজ সেরকম কোন শব্দই শোনা গেল না। এটা যে তাদের প্রতি সন্ধ্যার রুটিন, তা তার বোন কয়েকবারই বলেছে, এমনকি লিখেও জানিয়েছে। হয়তো এ চর্চা কোন কারণে ক’দিন যাবৎ করাই হয়না। কিন্তু বাড়ীতে লোক থাকা সত্বেও চারপাশের এত বেশী নি:স্তদ্ধতা অস্বাভাবিক মনে হলো তার। অথচ ‘কি এক নিবিড়, নির্ঝন্জাট জীবন এই পরিবারের’! সে নিজেই তো তার বাবা মা ও বোনের জন্যে এমন এক সুন্দর বাড়ীতে এই সাজানো জীবনের কারিগর। অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে নিজে, জীবনের এই করুন, অসহায় পরিস্থিতি, তারপরও একথা ভেবে খুব গর্বিত হলো সে। কিন্তু প্রাচুর্য ও শান্তির এই জীবনের এমনি ভয়াল পরিসমাপ্তি ঘটবে? এই ভাবনায় ডুবে নিজেকে ফিরে পাবার চেষ্টায় অস্থির গ্রেগর তার ঘরের মাঝেই এদিক সেদিক চলাফেরা শুরু করলো।
পুরো সন্ধ্যায় প্রথমবার একটি দরজা ও পরেরবার আরেকটি দরজা অল্প ফাঁক করে একবার খুলেই দ্রুত বন্ধ করে দেয়া হলো। কেউ হয়তো এঘরে আসতে চেয়েছিল, কিন্তু সাহস হয়নি। গ্রেগর বসার ঘরের দরজার সামনে অগেক্ষায় রইল, যাতে কেউ আসতে চাইলেই তাকে ভেতরে ডেকে আনতে পারে। কিন্তু তার সমস্ত অধীর অপেক্ষাই নিস্ফল হলো। দরজা বন্ধ ছিল সকালে, সবাই এই ঘরে ঢোকার জন্যে উদগ্রীব! এখন এক এক করে দু’টো দরজাই খোলা, অথচ কেউই আসতে চাইছে না। চাবিও বাইরে থেকে আটকানো!
গভীর রাতে বসার ঘরের আলো নেভানো হলো। বোঝা গেল, বাবা মা আর বোন জেগেই ছিল এতক্ষন। তারা যে পা টিপে টিপে নিজেদের ঘরে ফিরছে, সে মৃদু পায়ের আওয়াজও শোনা গেল। অর্থাৎ কাল সকাল অবধি কারো আসার সম্ভাবনা আর নেই। এতক্ষনে গ্রেগর তার সামনের জীবনকে নতুন করে সাজানোর পথ খোঁজার অবসর পেলো । এই উঁচু একটি ঘরে লম্বা হয়ে মাটিতে পড়ে থাকতে এখন তার ভয় হচ্ছে খুব। অথচ গত পাঁচটি বছর ধরে তার এই ঘরেই বাস। স্বতস্ফুর্তভাবেই একটি সোফার নীচে স্থান খুঁজে পেল সে। পিঠ একটু ঠেকছে উপরে, মাথাও পুরোটা তুলতে পারছে না। তারপরও এই জায়গাটিই তার কাছে সবচেয়ে বেশী নির্ভরযেগ্য বলে মনে হলো। একটু হতাশ হলো এই ভেবে যে, তার চওড়া শরীর সোফার পরিসরে পুরোটা ঢাকলো না।
পুরো রাত সে আধোঘুমে ওখানেই কাটালো। মাঝে মাঝে জেগে উঠলো ক্ষুধায়, কখনো দুর্ভাবনায় কখনো বা নতুন কোন আশার হাতছনিতে। প্রতিবারই একই সিদ্ধান্তে উপনিত হলো যে, যেভাবেই হোক, নিজে শান্ত থেকে পরিবারকে সবরকম যন্ত্রণা থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। আজ সকালে যে পরিস্থিতি তৈরী করতে বাধ্য হয়েছে, এর পূনরাবৃত্তি যাতে আর না হয়।
পরদিন ভোর। বাইরে তখনও কিছুটা অন্ধকার। তখনই গতরাতের সিদ্ধান্তের দৃঢ়তা প্রমাণের সুযোগ পেলো গ্রেগর। বোন ঘরের দরজাটি একটু ফাঁক করে ভেতরের দিকে তাকালো। চেহারায় টান টান উত্তেজনার ছাপ । প্রথমে গ্রেগরকে সে দেখতে পেলনা। হায় খোদা! কোথায় সে! উড়ে গেল কি? পরমূহুর্তেই সোফার নীচে চোখ গেল তার। গ্রেগরকে দেখে এত বেশী ভয় পেলো যে, সে ভয় সামলাতে না পেরে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। পরমূহুর্তেই নিজের কাছে নিজেই লজ্জা পেলো সে। তাই সাথে সাথেই আবার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। কিন্তু এমন সাবধানে ঢুকলো যে, যেন অপরিচিত কেউ বা মরণাপন্ন কোন রোগীর এ ঘরে বাস। গ্রেগর তার মাথা সোফার প্রান্তে এনে বোনকে দেখলো। দুধটুকু খায়নি সে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে ক্ষিদে নেই। এটা কি বুঝতে পারবে সে? বুঝে কি এমন কোন খাবার দেবে, যাতে রুচি হতে পারে? নিজের আত্মসন্মানবোধের বিচারে বোনকে এ নিয়ে কিছু বলার চেয়ে ক্ষিদেয় মরে যাওয়াই নিজের কাছে বেশী গ্রহনযোগ্য। কিন্তু ভেতরে অদম্য ইচ্ছে হলো, সোফার নীচ থেকে বেরিয়ে বোনের পায়ে পড়ে পছন্দসই কিছু খাবার দিতে অনুরোধ করার। তার এই ভাবনার যেন তাল মিলিয়েই বোন অবাক চোখে বাটিটির দিকে তাকাল। সামান্য দুধ পড়ে আছে চারপাশে, কিন্তু প্রায় আগের মতোই ভরা। একটি ন্যাকড়ায় ধরে ওটাকে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল সে। কি হাতে নিয়ে আবার ফিরে আসে বোন, এ নিয়ে নানা ভাবনার ছক কাটলো গ্রেগর। কিন্তু কোন কুলকিনারা পেল না। একটু পরে একটি পুরোনো কাগজে উপর সাজিয়ে নতুন কিছু খাবার নিয়ে এল বোন। হয়তো গ্রেগরের রচি পরীক্ষাই করাই তার উদ্দেশ্য। একটুকরো আধপঁচা সবজী, গত রাতের খাবারের উচ্ছিষ্ট হাড়গোড়, যার গায়ে ঠান্ডা ঝোল শক্ত হয়ে লেগে। কয়েক টুকরো কিসমিস আর কাজুবাদাম, এক টুকরো পনির, যা দু’দিন আগে গ্রেগরই অখাদ্য বলে খেতে চায়নি। সেই সাথে আনলো এক এক টুকরো করে শুকনো রুটি, মাখন লাগানো রুটি ও নোনতা রুটি। আর গ্রেগরের প্রতি দয়া করেই হয়তো, খাবারগুলো রেখেই সে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। হয়তো ভাবলো গ্রেগর তার উপিস্থতিতে খেতে অস্বস্তি বোধ করতে পারে। বাইরে থেকে তালা বন্ধ করলো, যাতে তার কোনরকম সংকোচ না হয়। খাবারের কাছে যাবার সময় দূর্বলতায় সবগুলো পা কেঁপে উঠলো তার। কিন্তু শরীরের অন্যান্য স্থানে যে সব ক্ষত তৈরী হয়েছিল, সেখানে কোন ব্যথা টের পেল না। গ্রেগর অবাক হলো খুব। এক মাসেরও বেশী আগে ছুরির খোঁচায় আঙ্গুল কেটেছিল সামান্য। গত পরশু অবধিও টের পেয়েছে সে যন্ত্রণা। এখন সে যন্ত্রণা আর নেই।‘আমার অনুভুতি কি ভোতা হয়ে গেল’? ভাবতে ভাবতেই লোভীর মতো পনিরে মুখ দিল সে। এই পনিরের টুকরোটিই সমস্ত খাবারের মাঝে সবচেয়ে সুস্বাদু মনে হলো তার। খাবার আনন্দে চোখে জল এলো । পনির, সবজী ও ঝোলের পুরোটাই সে খেয়ে ফেললো, অথচ তাজা খাবার খাওয়ার কোন রুচিই তার হলোনা, এমনকি সেগুলোর গন্ধও তার সহ্য হলোনা। পছন্দের খাবারগুলো তাজা খাবার থেকে দুরে সরিয়ে এনে দ্রুত খাওয়া শেষ করে আলস্যে একই জায়গায় পড়ে রইল সে। বোন ধীরে ধীরে চাবি ঘুরিয়ে ভেতরে আসার ইঙ্গিত দেওয়ায় চমকে উঠলো গ্রেগর। টলতে টলতে হলেও তাড়াতাড়ি আবার সোফার তলায় জায়গা নিল সে। যেটুকু সামান্য সময় বোন ঘরে ছিল, সে সময় সোফার নিচে থাকতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল তার। অতিরিক্ত খাবারে শরীর কিছুটা ফেঁপে ওঠায় সোফার নীচের সংকীর্ন জায়গায় নি:শ্বাস নেয়া সহজ ছিল না। এই শ্বাসকষ্টের মাঝে বড় বড় চোখে দেখলো সে, শুধুমাত্র ইতস্তত: ছড়ানো খাবারই নয়, যে খাবার গ্রেগর ছোঁয় নি, সেগুলোও ঝাট দিয়ে দ্রুত একটি বালতিতে পুরলো বোন। তারপর একটি ঢাকনায় বালতিটি ঢেকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বোন চলে যাবার পরমূহুর্তেই সোফার নীচ থেকে বেরিয়ে এল গেগর। নিজের শরীর টান টান ও প্রসারিত করলো।
এভাবেই গ্রেগরকে প্রতিদিন তার খাবার দেয়া হলো। সকালে একবার, যখন বাবা মা ও আয়া ঘুমে। আরেকবার সবার দুপুরের খাবারের পর, যখন বাবা মা আগের মতোই ঘুমে। আয়াকে পাঠিয়ে দেয়া হতো কোন এক কাজের আজুহাতে বাড়ীর বাইরে। সে ক্ষিদের কষ্টে ভোগে, তা নিশ্চয়ই চাননি বাবা ও মা। সে খেতে পাচ্ছে, এটুকু জেনেই সন্তুষ্ট থাকতে হতো ওদের। তাছাড়া গ্রেগরের কাছাকাছি আসার সাহস হয়তো ওদের ছিলনা। এমনও হতে পারে বোনও তা চাইতো না। তাতে তাদের এই অসহনীয় কষ্ট আরো বেশী বেড়েই যেতো।
কি অজুহাত দাঁড় করিয়ে সেদিন সকালে ডাক্তার ও চাবিওয়ালাকে বাড়ী থেকে বিদায় করা হলো, তা আজ অবধি জানতে পারে নি গ্রেগর। তার কথাই তো বোঝেনা কেউ। অন্যদের কথা যে সে বুঝতে পারে, তা কারোরই মনে আসেনি। এমনকি বোনের মনেও আসে নি। সেকারণে প্রতিবারই যখন সে এ ঘরে আসতো, গ্রেগরকে কখনো তার দীর্ঘশ্বাস ও কখনো সখনো ‘হায় খোদা’ জাতীয় বিলাপ শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হতো। তার এ অবস্থায় পুরো মেনে নেবে সে, সে আশা করা করার প্রশ্নই আসে না। তারপরও কিছুটা অভ্যস্ত হবার পর সে একটা দু’টো ভাল মন্তব্যও করলো। গ্রেগর পরিস্কার করে পুরো খাবার খেয়ে নিলে বলতো,’আজ দেখি ভালই খেয়েছে’! উল্টোটা হলে বলতো, ‘আজ সবই রয়ে গেল’!
বাইরের জীবনের কোন খবরই পেতো না সে। তাই মাঝে মাঝে পাশের ঘরে কান পাততো গ্রেগর। সে ঘরে কোন আওয়াজ শুনলেই, দরজায় ছুটে যেত । নিজেকে দরজার সাথে সেটিয়ে কথা শোনার চেষ্টা করতো। প্রথম দিকে তাকে নিয়ে কোন কথাই হতো না। এ অবস্থায় কি করণীয়, এ নিয়েই আলোচনা চললো প্রথম দু’ দিন। দু’বেলা খাবারের মাঝামাঝি সময়েও একই বিষয়। কমপক্ষে পরিবারের দু’জন সদস্য সবসময়েই বাড়ীতে থাকতো। একা থাকার সাহস হতোনা কারো। আর পুরো বাড়ী খালি রাখার প্রশ্নই আসে না। বাড়ীর আয়া পুরো ঘটনা সম্পর্কে কতটা অবহিত, তা জানা যায়নি। তবে প্রথম দিনই সে মাটিতে হাঁটু গেড়ে মা কে অনুরোধ করলো তাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিতে। এতে তার কি বিরাট উপকার হলো, পনেরো মিনিট পর কাঁদতে কাঁদতে তা জানিয়ে বারবার ধন্যবাদ জানালো। তারপর কেউ কোন অনুরোধ করার আগেই সমস্ত ঘটনা গোপন রাখার কঠিন শপথ জানিয়ে বিদায় নিলো।
আয়া বিদায় নেবার পর মায়ের সাথে রান্নাবান্নার দায়িত্ব পড়লো বোনের হাতে। সে রান্নাবান্না করা তেমন কঠিন হলোনা, কারন খাওয়ার রুচি ছিলনা করোরই। প্রায়ই একজন আরেকজনকে আরেকটু খেতে অনুরোধ করতো। ‘ধন্যবাদ, যথেষ্ট খেয়েছি’, এধরণের উত্তর ছাড়া অন্য কোন উত্তর শোনা যেত না কখনোই। মাঝে মাঝেই বোন বাবাকে জিজ্ঞেস করতো, তার একটা বিয়ার চাই কি না। নিজেই এনে দিতে চাইতো। তারপরও বাবার কোন উত্তর না পেলে বাড়ীর কেয়ার টেকার কে দোকানে পাঠানোর কথা বলতো, যাতে বাবার কোন অস্বস্তি না হয় । একসময় বাবার দৃঢ় অসম্মতির পর এ আলোচনার সমাপ্তি ঘটতো।
প্রথম ক’দিনের মাঝেই বাবা তাদের তাদের আর্থিক অবস্থা ও সম্ভাবনার কথা মাকে ও একই সাথে বোনকেও তুলে ধরলেন। সুযোগ পেলেই তার ছোট বাক্স নিয়ে টেবিলে বসতেন। তার পাঁচ বছর আগের ব্যাবসায়িক বিপর্যয় থেকে এই বাক্সটিই বাঁচাতে পেরেছিলেন। এতে ছিল কিছু বিভিন্ন রশিদপত্র ও প্রমানের নথি। বাক্সের জটিল তালা খোলা, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বের করা ও আবার তালা বন্ধ করার আওয়াজ পাওয়া যেত। বাবার এই কর্মপ্রবাহ ছিল গ্রেগরের জন্যে তার বন্দীজীবনের সর্বপ্রথম আনন্দের খোরাক। তার ধারণা ছিল, বাবা তার নিজের ব্যবসা থেকে কিছুই বাঁচাতে পারেন নি। বাবাও তার এই ধারণার বিপক্ষে কখনোই কিছু বলেন নি। সে নিজ থেকে এর চেয়ে বেশী জানতে চায়নি। তার একমাত্র চিন্তা ছিল তখন, বাবার এ ব্যাবসায়িক বিপর্যয়ে পুরো পরিবার যে নিদারুন হতাশায় ডুবে ছিল, তা যথাসম্ভব ভুলিয়ে দেওয়া। নিজের ভেতরে কোন এক বিশেষ দহনের জ্বালায় চাকুরীতে যোগ দিয়েছিল সে। তাই সাধারণ শিক্ষানবীস থেকে খুব তাড়াতাড়িই এক যাযাবর দালাল হয়ে গেল। ভালো আয় করার সুযোগ ও দালালীর নগদ টাকাপয়সা হাতে আসতে থাকলো। ব্যাবসার খুব সুবিধাজনক সময় ছিল তখন । পরবর্তী সময়ে কখনোই এতোটা প্রাচুর্য ও জৌলুস ফিরে আসেনি। তারপরও গ্রেগর যতোটা আয় করতো, তার তার পুরো পরিবারের ভরণপোষনের জন্যে যথেষ্টই ছিল। পুরো পরিবারের ভরণপোষণের দ্বায়িত্ব তার হাতেই, একদিকে যেমন গ্রেগরের, অন্যদিকে তেমনি তার পরিবারের জন্যেও তা অভ্যাসে পরিনত হল। অন্যরা যেমন আনন্দের সাথে নিত, তেমনি গ্রেগরও দিয়েই আনন্দ পেত। কিন্তু এই দেয়ানেয়ার মাঝেও আন্তরিকতার অভাব ছিল স্পষ্ট। মনের দিক থেকে একমাত্র বোনটিই তার কাছাকাছি রইল। বোনের গান বাজনার প্রতি উৎসাহ। ভালো বেহালা বাজাতে পারে। যদিও ভীষন ব্যয়বহুল, তারপরও পরিকল্পনা ছিল সামনের বছর ওকে সঙ্গীত কলেজে পাঠানোর। প্রতিবারই অল্প সময়ের জল্যে যখন শহরে থাকতো গ্রেগর, বোনের সাথে নানা আলোচনায় সঙ্গীত কলেজের কথাই উঠতো বারবার। তখনও সে পরিকল্পনা ছিল এক সপ্নের মতোই। এর বাস্তবায়নের চিন্তা তখনও অনেক দুরে। বাবা মা এ বিষয়ে কোন কথাই শুনতে চাইতেন না। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল গ্রেগর। বড়দিনে সেকথা বাবা মা কে জানাতে মনে মনে তৈরীও হচ্ছিল।
দরজায় লেপ্টে কান পেতে থাকার সময় এসব চিন্তা ভাবনাই তার মাথায় খেলা করতো। যদিও জানতো, এই বর্তমান অবস্থায় এসব ভাবনা কল্পনার বিলাস মাত্র। মাঝে মাঝে স্বাভাবিক ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে শ্রবনশক্তি কাজ করতো না, তখন নিজের অজান্তেই মাথা খুঁটতো দরজায়। নিজেকে সামলে নিত সাথে সাথেই, কারন এ দুর্বল শব্দটিও সবার মনযোগ আকর্ষন করতো। চুপচাপ হয়ে যেত সবাই। কিছুক্ষন পর বাবার মুখে শোনা যেত,’ না জানি আবার সে কি করছে’? কিছুটা বিরতির পর আবার শুরু হতো অসমাপ্ত আলোচনা।
অনেক কিছুই জানতে পারলো গ্রেগর। বাবা একই কথার পূণরাবৃত্তি করতেন। এর একটি কারন, এসব বিষয় নিয়ে তিনি অনেক দিন যাবৎ না ভেবেই অভ্যস্ত। আরেকটি কারণ, মা সহজে সব বুঝে উঠতে পারতেন না বলেই বারবার বলতে হতো। নানা বিপর্যয়ের পরও পুরোনো সময়ের কিছু টাকাপয়সা জমা ছিল বাবার, যা সুদেআসলে বেশ ফেঁপে উঠেছে। সামান্য নিজের জন্যে রেখে পুরো টাকাপয়সা পতিমাসে বাবার হাতে তুলে দিত গ্রেগর। সে টাকার পুরোটা খরচ না হওয়াতে জমে জমে বেশ বড় একটা অঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গ্রেগর দরজার আড়ালে বসে এই আশাতীত সাবাধানতা ও মিতব্যায়িতার কথা শুনে পরিতৃপ্ত হয়ে মাথা নাড়লো। আসলে এ টাকায় তার বসের কাছে বাবার যা দেনা, সবই শোধ করা যেত। তাতে এই যাযাবরের কাজটি ছাড়াও সহজ হতো তার জন্যে। তারপরও এখন বাবা যা করেছেন, তা নি:সন্দেহে আরো বেশী জরুরী।
কিন্তু এই জমা টাকার সুদে পুরো পরিবারের খরচ চালানো অসম্ভব। হয়তো দু’বছর চালানো যাবে, এর বেশী নয়। সাধারণ বিচারে এই টাকাটি খরচ না করে কোন বিপদ আপদের জন্যেই জমা রাখারই কথা। সংসারের চালানোর জন্যে কারো উপার্জন দরকার। যদিও বাবা শারিরীকভাবে সুস্থ, তারপরও তার বয়েস হয়েছে যথেষ্ট। গত পাঁচ বছরে কোন চাকুরী করেন নি, তাই নিজের উপর বেশী আস্থা থাকার কথাও নয়। গত পাঁচটি বছরই ছিল তার ব্যার্থ ও পরিশ্রান্ত জীবনের প্রথম ছুটি। এখন বেশ মোটা হয়েছেন ও চলাফেরায়ও জড়তা এসেছে। বৃদ্ধা মা কাজ করবেন? তিনি তো হাঁপানীর রোগী। ঘরের ভেতর সামান্য চলাফেলার পরই হাঁপাতে থাকেন। শ্বাঁসকষ্টের কারণে জানালা খুলে সোফায় এলিয়ে পড়েন। বোন আয় করবে? তার তো মাত্র সতেরো বছর বয়েস। এ পর্যন্ত জীবনে যতটুকু শিখেছে, তা হচ্ছে, ভাল কাপড়চোপড় পড়া, বেশী বেলা করে ঘুমোনো, মাঝে মাঝে সাংসারিক অলোচনায় মতামত দেয়া ও বেহালা বাজানো। যখনই পাশের টাকাপয়সা সংক্রান্ত কোন কথাবার্তা হতো, চামড়ায় মোড়া শীতল সোফায় গা এলিয়ে দিত গ্রেগর। এসব আলোচনা শুনে লজ্জায় ও নিজের অক্ষমতায় গা ঘেমে উঠতো তার।
প্রায়ই সারারাত ঘুম হতোনা তার। সোফার নীচে শুয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা উপরের চামড়ার দিকে তাকিয়ে থাকতো। মাঝে মাঝে খুব পরিশ্রম করে সোফাটি জানালার কাছে টেনে নিয়ে যেত। সোফার উপর ভর করে এলিয়ে থাকতো জানালায়। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটো, তারপরও হয়তো জানালার কাছে পুরোনো কোন স্মৃতি জড়ানো ছিল। একটু দুরের জিনিসও সময়ের সাথে সাথে আবছা হয়ে উঠলো তার চোখের সামনে। রাস্তার উল্টো দিকের হাসপাতাল, যা প্রতিদিনই চোখের সামনে পড়ায় বিরক্ত হতো আগে। এখন সেটা আর দেখতেই পেত না। শহরের ভেতরে শার্লোটেনস্ট্রীটে তাদের বাড়ী। তা যদি জানা না থাকতো, তাহলে মনে হতো, এমনি এক খোলা প্রান্তরে বাড়ী ওদের, যেখানে ধুসর আকাশ আর ধুসর মাটি এক হয়ে আছে। দু’বার তার বোন সোফাটি জানালার সামনে দেখার পর, প্রতিবারই ঘর পরিস্কার করে সোফাটি নিজেই সেখানে ঠেলে নিয়ে যেত। জানালার একটি পাল্লাও খুলে রাখতো।
গ্রেগর যদি গ্রেটেকে তার কথা বোঝাতে ও ধন্যবাদ জানাতে পারতো, তাহলে তার সাহায্য নেয়াও অনেকটা সহজ হতো তার জন্যে। কিন্তু তা না করতে পেরে নিজের অক্ষমতায় নিজেই কষ্ট পেতো সে। বোনও চেষ্টা করতো এই বেদনাদায়ক পরিস্থিতি যতোটা সম্ভব সহনীয় করার। হয়তো সময়ের প্রবাহের সাথে সাথে তাতে কিছুটা সক্ষমও হয়েছে। এসবের পাশাপাশি গ্রেগরেরও এর মাঝে অনেক বিষয় আরো বেশী ষ্পষ্ট দাগ কাটলো। গ্রেটের জন্যে ঘরটিই যেন ভয়ংকর! ঢোকার পরপরই বোন দ্রুত তার কাজগুলো সেরে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করার জন্যে ব্যাস্ত হয়ে পড়তো। খুব চেষ্টা করতো, যাতে গ্রেগরের সামনাসামনি পড়তে না হয়। জানলার কাছে গিয়েই তড়িঘড়ি আওয়াজ করে খুলতো সেটি। বাইরে বেশ ঠান্ডা থাকলেও এমন ভাবে জানালার কাছে গিয়ে বুক ভরে নি:শ্বাস নিত, যেন শ্বাসকষ্ট ভুগছে সে। বোনের এই অস্থিরতা ও ধুম ধারাক্কা ভাব দিনে দু’বার আতঙ্কিত করতো ওকে। সে সময়টিতে ভয়ে সোফার নীচে কাঁপতে থাকতো।
তার রূপান্তরের এক মাস পেরিয়ে গেছে প্রায়। এতদিনে অবশ্যই গ্রেগরের চেহারা বোনের গা’সওয়া হয়ে যাবার কথা। একদিন বাঁধাধরা সময়ে একটু আগেই ঘরে ঢুকলো বোন। গ্রগর খুব বিষন্ন মনে জানলার এলিয়ে তাকিয়েছিল বাইরে, বোন ঘরে আসায় চমকে উঠলো খুব। এক্ষুনি তো জানালা খুলতে চাইবে সে, আর নিজে সোফা সহ সেখানে জানলায় যাবার পথ বন্ধ করে! কিন্তু বোন ঘরে ঢুকে সাথে সাথেই বেরিয়ে গেল। দরজার তালা আটকে দিল। গ্রেগরের চমকানোর ভঙ্গী দেখে মনে হতে পারে যে, সে তার বোনকে কামড়ে দিতে চেয়েছিল। গ্রেগর ভয়ে সাথে সাথেই সোফার তলায় গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। কিন্তু সেদিন গ্রেগরকে দুপুর অবধি ওর জন্যে অপেক্ষা করতে হলো। দপুরে আগের চেয়ে অনেক বেশী অস্থির দেখা গেলো বোনকে। এতে বুঝতে শিখলো গ্রেগর, তার এই চেহারা বোনের জন্যে আজ অবধি সহনীয় নয় ও খুব দ্রুত যে সহনীয় হবে, সে আশাও করা যেতে পারে না। এ ঘটনার মনে হলো, সোফার বাইরে তার শরীরের যে অতি ছোট অংশ চোখে পড়ে, সেটুকুও তার বেরিয়ে যাবার কারণ হতে পরে। তাই একদিন প্রায় চার ঘন্টার পরিশ্রমে সোফার উপর একটি চাদর এমন ভাবে বিছাতে সক্ষম হলো, যাতে সে নিজে সোফার নীচে পুরোপুরি আড়ালে পড়ে এবং বোন উবু হয়েও তাকে দেখতে না পায়। এভাবে নিজেকে ঢাকার দরকার নেই, এটা ভাবলে তো বোন সে চাদর নিজেই সরিয়ে দিত। এমনভাবে অন্ধকারে পড়ে থাকা কারো জন্যোই আনন্দের নয়। কিন্তু বোন চাদরটি যেভাবে ছিল, সেভাবেই রেখে দিল। বরং একবার গ্রেগর চাদরটি সামান্য নাড়িয়ে এক পলক বাইরে তাকিয়ে বোনের চেহারায় কৃতজ্ঞতা ছাপই দেখতে পেলো।
প্রথম দুই সপ্তাহ বাবা মা একবারও এঘরে ঢোকেন নি। হয়তো তাদের সে মানসিক শক্তি তৈরী হয়নি ততদিনে। মেয়েকে তার কাজের খুব প্রশংসা করতেন, যদিও এর আগে অকর্মন্য বলেই গালাগালে অভ্যস্ত ছিলেন। মেয়ে ভেতরে ঢুকলে দু’জনেই গ্রেগরের ঘরের দরজার সামনে অপেক্ষা করতেন। কাজ শেষ করে ঘরের বাইরে আসার সাথে সাথেই মেয়ের কাছে বিস্তারিত জানতে চাইতেন, ঘরটি কেমন অবস্থায়, গ্রেগর খেয়েছে কি না, তার ব্যবহার কেমন ছিল, তার সুস্থ হওয়ার কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছে কি না, এসব। অন্যান্যদের তুলনায়, মা ই সবার আগে তাকে দেখতে আসতে চাইলেন। কিন্তু খুব আঘাত পেতে পারেন এ ভেবে বাবা ও বোন, দুজনেই জোর আপত্তি জানালো । খুব মনযোগ নিয়ে এ আলোচনা শোনার পর গ্রেগর নিজেও মনে মনে এ সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানালো। ক’দিন পরেও মাকে জোর করেই আটকে রাখতে হলো। ‘আমাকে যেতে তোমরা গ্রেগরের কাছে, আমার অভাগা সন্তানের কাছে। তোমরা কি টের পাওনা, আমাকে এখন খুব দরকার ওর’, বলে চিৎকার করলেন মা। তখন গ্রেগরের মনে হলো, মার যত্নেই হয়তো বেশী ভাল হতো ওর, ওকে বোনের চেয়ে আরো বেশী বুঝতে পারতেন হয়তো। বোন তো এখনো একটা শিশুর মতোই ও শিশুসুলভ চপলতার কারণেই এমন একটি গুরু দ্বায়িত্ব মাথায় নিয়েছে।]
মা কে দেখার ইচ্ছে পূরণ হলো বেশ তাড়াতাড়িই। বাবা মায়ের কথা ভেবেই গ্রেগর দিনে জানালার কাছে যেতে চাইতো না। ছোট্ট একটি ঘরের মেঝেতে নাড়াচড়াও তেমন বেশী হতো না, রাতে চুপচাপ শুয়ে থাকাও অসহ্য, খাবারও বিস্বাদ। নিজের অজান্তেই নতুন এক অভ্যাস তৈরী হলো তার। এদিক সেদিক দেয়াল বেয়ে বেয়ে কড়িকাঠে ওঠা। নীচে শোওয়ার চেয়ে কড়িকাঠে ঝুলতে ভাল লাগতো। ভাল নি:শ্বাস নেয়া যেত, হালকা এক তরঙ্গ বয়ে যেত শরীরে। আনন্দে আত্মভোলা হয়ে একদিন নীচে পড়ে নিজেই অবাক হলো। তার শরীরের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা আগের চেয়ে অন্যরকম, এত উঁচু থেকে পড়েও কোন ব্যাথা পেলো না। নিজের জন্যে নতুন এক আনন্দের উপকরণ খুঁজে পেয়েছে গ্রেগর, তা বোনের চোখ এড়ালো না। তার শরীরের আঠালো পদার্থের দাগ দেখা গেল সর্বত্রই। হামাগুড়ি দিতে গ্রেগরের যাতে আরো বেশী জায়গা হয়, সেজন্যে বোন চাইল ঘরের কিছু আসবাব, টেবিল ও বাক্সটি সরিয়ে দিতে। একা কাজটি করার মতো শক্তি না থাকারই কথা, বাবার সাহায্য চাইতেও ভরসা হলোনা। আগের আয়াকে ছাড়িয়ে দেবার পর প্রায় ষোল বছর বয়েসের নতুন একটা মেয়ে রান্নার কাজের দ্বায়িত্বে। তবে তার কাছে সাহায্যের আশা বৃথা। এই শর্তেই সে কাজ নিয়েছে, যাতে রান্নাঘরের দরজা সারাক্ষন বন্ধ রাখতে পারে। কারো বিশেষ সংকেতেই কেবল খুলবে। সুতরাং বাবার অনুপস্থিতির সুযোগে মায়ের সাহায্য ছাড়া বোনের কোন উপায় রইল না। মেয়ের ডাক শুনে আনন্দ ও উত্তেজনায় মা এলেন, কিন্তু দরজার সামনে এসেই চুপ হয়ে গেলেন। বোন প্রথমে ঘরে ঢুকে দেখল, সব ঠিক আছে কি না, তারপর মা কে ঢুকতে দিল। খুব দ্রুত গ্রেগর তার এলোমেলো চাদরে ভাজের আরো গভীরে স্থান নিল। মা এসেছেন, তাতেই এত আনন্দিত সে, চাদরের ফাঁকে মা কে একবার দেখার সুযোগটিও নিল না। ‘চল মা, ওকে দেখা যাচ্ছে না’, হাত ধরে মা কে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল বোন। সে শুনতে পেল, দু’জন রোগা মেয়েলোকের ভারী বাক্স ঠেলে ঠেলে জায়গা থেকে সরানো চেষ্টা। বেশী পরিশ্রম বোনই করছে, মা তাকে সাবধান করছিলেন বারবার, যাতে কোন ব্যথা না পায়। অনেক সময় লাগলো। পনেরো মিনিট পর ওটা আগের জায়গাতেই রাখার পরামর্শ দিলেন মা। প্রথমত: বেশ ভারী, দ্বিতীয়ত: বাবারও ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে। এভাবে ঘরের মাঝখানে বাক্সটি গ্রেগরের চলাফেরার জন্যেই বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া বাক্সটি এঘর থেকে সরানো গ্রেগরের আদৌ পছন্দ হচ্ছে কি না, সে সম্পর্কেও তিনি নিশ্চিত নন তখনও। এটা সরানোর পর খালি দেয়াল শেল হয়ে বিঁধছে তার নিজের বুকেই, একই অনুভুতি গ্রেগরেরও হতে পারে। সে তো ঘরের আসবাব এভাবেই দেখে অভ্যস্ত। বাকী কথাগুলো তিনি ফিসফিসিয়ে এমনভাবে বললেন, যাতে গ্রেগর কিছুতেই শুনতে না পারে। ‘ এগুলো সরালে কি মন খারাপ করবে না গ্রেগর? ভাববে না, যে আমরা তার সুস্থতার আশা পুরোপুরি ছেড়ে, ওর দিকে কোন নজর না রেখে পাষানের মতো একা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছি? আমার মনে হয়, ঘরটি আগের মতো রাখাই ভাল, যাতে সে তার পরিচিত পরিবেশ খুঁজে পায়। এর ফলে নিজের মাঝে ফিরে এসে সে মাঝখানের কঠিন সময় সহজে ভুলে যেতে পারবে’।
মায়ের এ কথা শুনে গ্রেগর মনে হলো, মানুষের মতো ব্যবহার না পেয়ে ও পরিবারের মাঝখানে গত দু’মাসের একঘেয়ে বদ্ধ জীবন তার বোধশক্তিকে প্রায় ভোতাই করে দিয়েছে। তার কথা বলার ক্ষমতা থাকলে সে নিজেও এগুলো সরিয়ে নিতেই বলতো। আসবাবে সাজানো উষ্ণ এই ঘরকে নরকে পরিণত করে স্বাধীনভাবে এদিক ওদিক লাফিয়ে বেড়ানো চায় কি সে? যে একসময় সে মানুষ ছিল, তা কি, এত দ্রুত, এত সহজেই ভুলে যাওয়া যায়? হয়তো ভুলেই যেত, যদি না মায়ের কথা আবার এসব না দিত তাকে। কোনকিছুই সরানো যাবে না আর, সবই থাকবে। সাজানো এই ঘরের প্রভাবকে অস্বীকার করা একেবারেই ঠিক হবে না। তাতে যদি তার চলাফেরার অসুবিধাও হয়, লাভ ছাড়া কোন ক্ষতি নেই তাতে।
কিন্তু বোনের মতামত অন্যরকম হওয়াতে দু:খ হলো তার। গ্রেগরের প্রতিদিনের জীবনে তার অবদানের কারণে বাবা মায়ের সাথে গ্রেগর সম্পর্কিত আলোচনায় বিশেষজ্ঞের ভুমিকা নিতে অভ্যস্ত বোন। সেজন্যেই মায়ের পরামর্শ তার কাছে খুব গ্রহনযোগ্য হলো না। আগের পরিকল্পনা অনুযায়ীই শুধুমাত্র টেবিল আর বাক্স নয়, সোফাটি বাদে, বাকী অন্যান্য সব আসবাবই তার সরানোর ইচ্ছে। শুধুমাত্র শিশুসুলভ জেদ বা গত কয়েকদিনের পরিশ্রমে অর্জিত আত্মবিশ্বাস নয়, সে সত্যিসত্যিই দেখেছে, গ্রেগরের চলাফেরার জন্যে আরো জায়গা দরকার। গ্রেগরের কাছে এই আসবাপত্রের কোন ব্যাবহারই নেই। হয়তো এটা বোনের অল্প বয়েসের জেদ ও প্রতি সুযোগেই আত্মসন্তুষ্টির পথ খোঁজা। গ্রেগরকে আরো অসহায় অবস্থায় নিয়ে তাকে নিজের উপর আরো বেশী নির্ভরশীল করানো। কারণও রয়েছে। এমনি এক ঘর, যে ঘরের খালি চার দেয়ালের মাঝে গ্রেগরের বাস, সে ঘরে একমাত্র গ্রেটে ছাড়া আর কার ঢোকার সাহস হয়েছে?
তাই মায়ের কথাকে পাত্তা না দিয়ে বোন নিজের সিদ্ধান্তেই অটল রইল। মাকেও এই উত্তেজনার মাঝে বেশ বিচলিত মনে হলো। আর কোন কথা না বলে মেয়েকে বাক্সটি সরাতে শারিরীক সাহায্য করলেন। বাক্সটি যাক, কিন্তু টেবিল থাকবে এঘরেই! তাই ঠেলে বাক্সটি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরপরই গ্রেগর সোফার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। তার উদ্দেশ্য সাবধানে ও যথাসম্ভব সতর্কতায় এ বিষয়ে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করা। বাইরে গ্রেটের বাক্স আঁকড়ে ঠেলাঠেলির শব্দ, একচুলও নড়াতে পারছে না, এরই মাঝে মা আবার ঢুকলেন ঘরে। গ্রেগরের চেহারা দেখে অভ্যস্ত নন তিনি, অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন। ভয় পেয়ে গ্রেগর দ্রুত পেছনে হেঁটেই চাদরে নীচে পালালো। পেছনের টানে সামনের দিকে একটু নড়ে উঠলো চাদরটি। এটাই তাঁকে সতর্ক করার জন্যে যথেষ্ট ছিল। থমকে এক মূহুর্ত দাঁড়িয়ে তিনি গ্রেটের কাছে ফিরে গেলেন আবার।
এত কিছু ঘটার পরও গ্রেগর এই বলে নিজেকে স্বান্তনা দিল যে, কয়েকটি আসবাব ছড়ানো ছাড়া খারাপ কিছু আর কি ঘটলো? কিন্তু পরমূহুর্তেই স্বীকার করতে বাধ্য হলো, দুজনের বারবার এই আসাযাওয়া, ডাকাডাকি, টানাটানির আওয়াজ চতুর্দিক থেকে বিরাট এক অত্যাচার তার উপর। সে পা গুলো টেনে মাথা নীচু করে সমস্ত শরীরে মেঝের উপর লেপ্টে তার সহ্যসীমার শেষ প্রান্তে। তার ঘরটি পুরো খালি করলো ওরা, যা তার পছন্দের, সেগুলো সহ বাকী সবই। একটি বাক্স, যেখানে তার করাত ও আন্যান্য যন্ত্রপাতি ছিল, সেটা বের করে মেঝেতে প্রায় আটকে পড়া টেবিল বের করতে ব্যাস্ত দু’জনে। এই টেবিলে বসে সে ব্যবসাপ্রশাসন, কলেজ ও স্কুলে পড়াশোনার সময় তার বাড়ীর কাজ করেছে। তাদের উদ্দেশ্যের ভালমন্দের বিচারের সময় আর নেই। তাদের কথাও তার আর মনে রইল না। তাছাড়া শারিরীক পারিশ্রমে তারা এতই ক্লান্ত যে, শুধুমাত্র ভারী পায়ের শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না আর।
ওরা দু’জন যখন পাশের ঘরে টেবিলে হেলান দিয়ে একটু বিশ্রামে, আড়াল থেকে বেরিয়ে এল গ্রেগর। চারবার দিক বদলে এদিক ওদিক দৌড়ালো। প্রথম একেবারেই বুঝতে পারছিল না, কোন আসবাবটি এ ঘরে রাখার চেষ্টা করবে। এর পরক্ষনেই খালি দেয়ালের গায়ে পশমি পোষাক পড়া মহিলার ছবিটির দিকে চোখ পড়লো তার। দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে ফ্রেমের কাঁচে চেপে ধরলো নিজেকে। উত্তেজনায় তপ্ত শরীরে কাঁচের শীতল স্পর্শে একটু আরাম হলো ওর। ছবিটি যেভাবে ঢেকে রাখছে সে, অন্তত:পক্ষে এটা সরাবে না কেউ! মাথাটি ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালো ওদের ফিরে আসার অপেক্ষায়।
বেশীক্ষন বিশ্রাম নিল না ওরা। একটু পরেই ফিরে এল। গ্রেটে মা কে জড়িয়ে অনেকটা টেনে হিঁচড়েই আনছে। ‘এখন কি নেব’? বলেই এদিক সেদিক তাকালো সে। দেয়ালের উপর গ্রেগরে সাথে চোখাচোখি হলো। হয়তো মায়ের উপস্থিতির কারনেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো বোন। মায়ের চোখের দিকে তাকালো, যাতে মা এদিকে না তাকান। কম্পিত স্বরে কিছু না ভেবেই বললো মা কে, ‘চল, আরেকটু বিশ্রাম নিই ওঘরে’। গ্রেটের উদ্দেশ্য গ্রেগরের কাছে পরিস্কার। সে মাকে নিরাপদে রেখে এসে গ্রেগরকে দেয়াল থেকে তাড়াতে চাইছে। ঠিক আছে, আসুক আবার, সে ছবির উপর বসে, সরাতে দেবেনা কিছুতেই। বেশী বাড়াবাড়ি করলে লাফিয়ে পড়বে ওর মুখের উপর।
কিন্তু গ্রেটের কথায় ধরণ শান্ত না হয়ে আরো বেশী বিচলিত হলেন মা। একপাশে সরে গেলেন। ফুল তোলা কার্পেটের উপর এক বড় বাদামী দাগের উপর চোখ পড়লো। যেন এতক্ষনে টের পেলেন, এটা গ্রগরের কর্ম। দুই হাত তুলে কর্কশ আওয়াজে ‘হায় খোদা, হায় খোদা’ বলতে বলতে অবশের মতো বাক্সের উপর এলিয়ে পড়লেন। ‘গ্রেগর’! বলে মুঠে হাত উপরে তুলে তীব্র ও শাসনের ভঙ্গীতে গ্রেগরের দিকে তাকালো বোন। তার এই রূপান্তরের পর এই প্রথম কেউ সরাসরি কথা বললো তার সাথে। পাশের ঘরে ছুটে গেল বোন, হয়তো মায়ের জ্ঞান ফেরানো জন্যে কোন ঔষধ খুঁজতে চাইছে। ছবিটার কথা নাহয় পরেই ভাববে, আপাতত: বোনকে সাহায্য করা দরকার, ছবির উপর থেকে নেমে বোনের পেছনে পেছনে যেতে চাইল গ্রেগর। কিন্তু তার শরীরের আঠায় কাঁচে আটকে আছে তার শরীর। কোনক্রমে নিজেকে ছাড়িয়ে পাশের ঘরে ছুটলো, বোনকে কোন পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে, যা এ ধরণের পরিস্থিতিতে চিরদিনই করে এসেছে। বোন তখন অজস্র শিশি বোতলের মাঝে দরকারী শিশিটি খোঁজায় ব্যাস্ত। ঠিক তারই পেছনে হতবাক হয়ে দাঁড়ানো গ্রেগর। পেছনে ঘুরেই হঠাৎ তাকে দেখতে পেয়ে ভীষন ভয় পেলো বোন। হাত থেকে একটি বোতল মাটিতে পড়ে চুরমার হয়ে গেল। ভাঙ্গা কাঁচের একটি টুকরো গ্রেগরের মুখে লোগে সেখানে ক্ষত তৈরী করলো। ছিটকে এক দুর্গন্ধজনক তরল পদার্থ ছড়ালো তার শরীরে। কিন্তু গ্রেটে থামলো না। যে ক’টি বোতল হাতে নেয়া যায় নিয়ে ছুটলো পাশের ঘরে মায়ের কাছে, মাঝের দরজাটি পায়ের ধাক্কায় বন্ধ করে দিল। গ্রেগরের এখন আর মায়ের কাছাকাছি হবার কোন উপায় নেই, তারই দোষে মা এখন হয়তো মৃত্যুমুখে। দরজা খুলে ওঘরে ঢুকে বোনকে তাড়াতে চাইল না সে। অপেক্ষায় থেকে থেকে, নিজের প্রতি দোষ আর ধিক্কারের গ্লানিতে এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো গ্রেগর। ভেতরের অদম্য অস্থিরতায় ঘরের দেয়াল, আসবাবপত্র, উপরের ছাদ সবখানে দৌড়ে বেড়ালো। একসময় ঘরের চারপাশই যেন তার চোখের সামনে ঘুরতে শুরু করলো। তারপরই ঘরের বড় টেবিলের উপর স্থির হয়ে বসে পড়লো সে।
কিছুটা সময় এভাবেই কাটলো। গ্রেগর আচ্ছন্নের মতো পড়ে রইল সেখানে। চারিদিক চুপচাপ, হয়তো শুভ কোন ইঙ্গিত। তখনই কলিং বেলে আওয়াজ শোনা গেল। কাজের মেয়েটি রান্নাঘরে, গ্রেটেই দরজা খুলতে ছুটে গেল। বাবা ফিরে এসেছেন। ‘কি হয়েছে’? এটাই ছিল তার প্রথম কথা। গ্রেটের চেহারা দেখেই খারাপ কিছু অনুমান করতে পেরেছেন। ভোঁতা স্বরে উত্তর দিল গ্রেটে, মনে হলো বাবার বুকে মুখ গুজে, ’মা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, তবে এখন ভালো আছে। গ্রেগর বেরিয়ে গেছে তার ঘর ছেড়ে’। ‘আমি প্রতিবারই বলেছি, আমার কথা শুনতে চাওনি কেউ’ বললেন বাবা। গ্রেগর পরিস্কার বুঝলো, বাবা গ্রেটের কথায় খারাপ কিছু ধারণা করেছেন ও ভেবেছেন, গ্রেগর আক্রমন করে কোন দূর্ঘটনা ঘটিয়েছে। তাঁকে বোঝানোর সময় ও সুযোগ গ্রেগরের নেই, শান্ত করাই সবচেয়ে বেশী জরুরী। তাই সে তার ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দরজায় চেপে ধরলো নিজেকে। তার ধারণা, বাবা বারান্দা পেরিয়েই গ্রেগরের উদ্দেশ্য টের পাবেন। বুঝবেন, দরজা খুলে দেয়া হলে সে মূহুর্তেই ঘরে ফিরে অদৃশ্য হয়ে যেতে প্রস্তুত।
কিন্তু বাবার পুরো অবস্থার সুক্ষ বিশ্লেষনের মেজাজ ছিল না। ‘আহ’ বলে যেভাবে শব্দ করে ঘরে ঢুকলেন তিনি, মনে হতে পারে, তিনি একাধারে ক্ষুব্ধ ও সেইসাথে আনন্দিত। গ্রেগর তার মাথা দরজা থেকে তুলে বাবার দিকে তাকালো। বাবা তাকে এভাবে দেখবেন আশা করেন নি। আর গ্রেগর গত ক’দিন তার লাফালাফিতেই ব্যাস্ত থাকায় বাড়ীতে কি ঘটছে, সেদিকে নজন রাখতে পারেনি। পারলে টের পেত যে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে অনেকখানি। তারপরও তার বিশ্বাস হতে চাচ্ছিল না, এই কি সেই বাবা! এ কি একটি লোক, যাকে গ্রেগর প্রতিবার ট্যুর থেকে ফিরে শোবার পোষাকে ইজিচেয়ারে এলিয়ে থাকতে দেখতো। চেয়ার ছেড়ে ওঠার শক্তিও ছিল না। আনন্দের প্রকাশ শুধুমাত্র হাত তুলে জানাতে পারতেন। মাঝে মাঝে রবিবার ও বিশেষ বিশেষ দিনে বেড়াতে বেরুতেন। মা নিজেও ভালো চলতে পারতেন না, তারপরও বাবা মা ও গ্রগরের মাঝখানে ওভারকোটে ঢেকে লাঠিতে ভর করে একটু একটু এগোতেন। কোন কথা বলতে চাইলে থেমে পড়তেন ও অন্যরাও থামলেই শোনা যেত তার কথা। এখন ওনি দাড়িয়েছেন ঋজু ভঙ্গীতে, ব্যাঙ্কের পাহাদারের মতো সোনালী বোতামের নীল রং এর ইস্ত্রী করা পোষাকে। সার্টের উঁচু কলারের উপর তার শক্তিমদমত্ত দোভাঙ্গা থুতনী। ঘন বাদামী ভ্রুর নীচে চোখের দৃপ্ত ও সতর্ক দৃষ্টি। আগের উস্কোখুস্কো চুল আচড়ে অতি যত্নে সিথি কাটা হয়েছে। কোন এক ব্যাঙ্কের সোনালী মনোগ্রাম আঁকা টুপিটা পুরো ঘর ছাড়িয়ে বাক্সের উপর ছুড়ে দু’হাত পকেটে পুরে বিরক্ত মুখে এগিয়ে গেলেন গ্রেগরের দিকে। কি করবেন, তা হয়তো নিজেই জানতেন না, তাই একটি পা আস্বাভাবিক উঁচুতে তুললেন। তা জুতোর তলার বিরাট আকৃতি দেখে অবাক হলো গ্রেগর। তার নতুন জীবনের শুরুতেই বুঝতে পেরেছিল গ্রেগর, তার বাবা তার প্রতি কঠিন থাকাই জরুরী মনে করেন। সে বাবার সামনে থেকে দৌড়ে পালালো, বাবা যখন থামলেন, থামলো সে ও, তিনি আবার এগিয়ে এলে সে ও অন্যদিকে সরে গেল। কোন গুরুতর কিছু ঘটার আগে, কয়েকবার চললো ঘরের ভেতরে এই দৌড়াদৌড়ি। একসময় কিছুক্ষনের জন্যে থামলো গ্রেগর। যদি সে দেয়ালে বা কড়িকাঠের উপর ওঠে, বাবা তা বদমাইসী মনে করে আরো বেশী রেগে যেতে পারেন। তাছাড়া সময়ের সাথে সাথে তার ক্লান্তিও বাড়ছিল। বাবা যদি এক পা হাটেন, তাকে এদিক সেদিক নড়াচড়া করে অনেকবার পা ফেলতে হচ্ছিল। নি:শ্বাসে কষ্ট হচ্ছিল খুব, ছোটবেলা থেকে ভোগা ফুসফুসের দুর্বলতা মাথা চাড়া দিলো আবার। সে আরেকবার দৌড়ের জন্যে সমস্ত শক্তি সঞ্চয়ে করলো, ক্লান্তিতে চোখও খুলতে পারছে না, অন্যকোন উপায়ে নিজেকে বাঁচানোর পথও বের করতে পারছে না। ঠিক সে মূহুর্তে তার খুব কাছেই একটি অপেল মাটিতে পড়ে তার শরীল ঘেসে অন্যদিকে গড়িয়ে গেল। পরমূহুর্তেই আরেকটি এসে পড়লো, গ্রেগর থমকে গেল ভয়ে। দৌড়ে কোন লাভ হবে না বুঝলো, বাবা তাকে আপেলের বোমা মারার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপেলের থালাটি ছিল উঁচু খাবার টেবিলের পাশে ছোট্ট আরেকটি টেবিলে। সেখান থেকে সেগুলো পকেটে ভরেছেন বাবা এবং একটা পর একটা পুরো লক্ষস্থির না করে ওর দিকে ছুড়ছেন। ছোট ছোট লাল আপেল বিদ্যুতের মতো একটির সাথে আরেকটির ধাক্কায় ছড়িয়ে পড়ছে সারা মেঝেতে। একটি গ্রেগরের পিঠ পিছলে বেরিয়ে গেল আঘাত না করেই। পরেরটি এসে সরাসরি ওর পিঠে আঘাত করলো। জায়গা থেকে সরে গেলেই যেন এই হঠাৎ অবিশ্বাস্য ব্যাথার উপশম হবে ভেবে সরতে চাইলো গ্রেগর। কিন্তু মনে হলো, পেরেকে আটকে আছে মেঝেতে আর পুরোপুরি অবিন্যস্ত অন্ধকারে ডুবে। শুধুমাত্র শেষ মূহুর্তে এক পলকে মায়ের পেছনে বোনকে ওর ঘরে থেকে চিৎকার করে বের হতে দেখল। মায়ের পরনে শুধু লম্বা অন্তর্বাস। উপরের পোষাক জ্ঞান হারানোর পর নি:শ্বাসের সুবিধার জন্যে খুলে নিয়েছ বোন। লুটানো ঘাগড়ায় হোঁচট খেয়ে ছুটতে ছুটতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে গ্রেগরের জীবন ভিক্ষা চাইলেন মা। এরপর কি হলো, তা দেখার মতো শক্তি গ্রেগরের আর রইল না।
তৃতীয় পর্ব
গ্রগরের এই ক্ষত একমাসেরও বেশী রইল। আপেলটিও রইল সে ক্ষতস্থানের উপরেই ঘটনার সাক্ষী হয়ে, সরাতে সাহস পেল না কেউ। তা দেখে বাবারও হয়তো ভাবলেন, করুণ ও বিরক্তিকর চেহারা সত্বেও তার সাথে এই পরিবারের সদস্যদের শত্রুর মতো ব্যাবহার করা ঠিক হবে না। যেহেতু সে একসময় এই পরিবারেরই সদস্য ছিল, তার প্রতি কর্তব্য পালন উচিৎ। পছন্দ না হলেও সহ্য করে নিতে হবে। তবে কখনোই সহ্যের বাইরে কিছুই নয়।
এই ক্ষতের প্রভাবে গ্রেগর তার চলৎশক্তি খুব সম্ভবতো চারদিনের জন্যেই হারিয়ে ফেলেছ। আপাতত: ঘরের একপাশ থেকে ওপাশে যেতেই এক অর্থব বৃদ্ধের মতো বেশ কয়েক মিনিট সময় নেয়। দেয়াল বেয়ে উঠার কথা তো কল্পনাই করা যায় না। তার এই কঠিন অবস্থার বিনিময়ে তাকে যে সুযোগ হলো, তা নিয়ে মনে মনে সন্তুষ্টই হলো সে। প্রতি সন্ধ্যাতেই বসার ঘরের দরজাটি খুলে দেয়া হতো ও সেজন্যে তার দু’ঘন্টা আগে থেকেই অধীর অপেক্ষা করতো সে। পরিবারের সবাই টেবিলে বসে আলোচনায় বাতির আলোয়, আর সে অন্ধকারে আড়ালে থেকে দেখছে সবাইকে। আগের মতো লুকিয়ে লুকিয়ো শোনা নয়, বরং সবার অনুমতিসাপেক্ষেই।
তবে এ আলোচনা আগের মতো প্রানবত্ত রইল না। আগে সারাদিনের কাজের ক্লান্তি শেষে ছোট হোটেলে বিছানায় পড়ে এসব আলোচনার কথা ভেবে মন খারাপ করতো গ্রগর। এখনকার পরিবেশ সে তুলনায় একেবারেই শীতল। বাবা রাতের খাবারের পর ঘুমিয়ে পড়তেন সোফাতেই, মা ও বোনের আলাপ চলতো মৃদুস্বরে। বাতির নীচে উবু হয়ে সেলাইএর কাজ করতেন মা। কোন এক হাল ফ্যাসানের দোকানের জন্যে অন্তর্বাসের সুক্ষ কারুকার্য। আর বোন বিক্রতার কাজ নিয়েছে কোথাও। সেইসাথে বাড়ীতে সন্ধ্যাবেলায় ষ্টেনোগ্রাফি আর ফরাসী ভাষা শিখছে, যাতে ভবিষ্যতে ভালো কোন কাজ পেতে পারে। মাঝে মাঝে ঘুম থেকে জেগে উঠতেন বাবা, কিন্তু ঘুমিয়ে যে পড়েছিলেন, কিছুতেই স্বীকার করতে চাইতেন না। মা কে বলতেন,’আর কতো সেলাই করবে আজ’! পরমূহুর্তেই মা আর বোনের ক্লান্ত মৃদু হাসির দৃষ্টিবিনিময়ের মাঝেই আবার ঘুমিয়ে পড়তেন।
কোন এক অর্থহীন জেদের বশে বাবা বাড়ীতেও তার কাজের পোষাক ছাড়তে চাইতেন না। ঘুমোনোর পড়ার পোষাক অযথাই আলনায় ঝুলছে, তিনি কাজের পোষাকেই তার সোফায় বসে ঝিমোতেন। মনে হতো তিনি যেন তার কাজের জন্যে সর্বদাই তৈবী ও প্রতিমূহুর্তেই তাঁর বস এর ডাকের অপেক্ষায় অছেন। এ কারণে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি মা ও বোনের বিশেষ সাবধানতার পরও সে পোষাক আর পরিস্কার রইল না। গ্রগর প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই চকচকে বোতামের নোংরা দাগে অপরিস্কার একটি পোষাক দেখতে পেত, যার আড়ালে এক বৃদ্ধ আরামদায়ক না হলেও গভীর ঘুমে নিমগ্ন।
রাত দশটার আওয়াজ হতেই মা খুব সাবধানে কথা বলে বাবাকে জাগানোর চেষ্টা করে নানাভাবে বিছানায় নেবার চেষ্টা করতেন। সকাল ছ’টায় তাঁর কাজে হাজির হতে হবে ও এক্ষেত্রে সোফার কষ্টদায়ক ঘুমের চেয়ে বিছানায় ভাল ঘুমোনো তার জন্যে খুবই জরুরী। কিন্তু অর্থহীন এই জেদ! যা বাবা নিজের বশে রাখতে পারেন নি, বরং নিজেই তার বশে। তিনি আরো অনেকক্ষন টেবিলে থাকতে চাইতেন, যদিও ঘুমিয়েই কাটাতেন বেশীভাগ সময়েই। সোফা থেকে বিছানায় নেয়াও এক মহা সমস্যা। মা ও বোনের বারবার পীড়েপিড়ির পর পনেরো মিনিট ধরে সোফায় বসেই ধীরে ধীরে মাথা ঝাকাতেন। চোখ বন্ধ থাকতো ও সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে চাইতেন না। মা সার্টের আস্তিন ধরে টান দিয়ে ফিসফিসিয়ে নরম নরম কথা বলতেন, বোন তার নিজের কাজ রেখে সাহায্য করতে যেতো মাকে। কিন্তু বাবার এসবে কোন খেয়ালই থাকতো না। আরো বেশী যেন ডুবে যেতেন সোফায়। একসময় যখন দু’বাহু ধরে টানাটানি করা হতো, চোখ খুলতেন তিনি। একবার মায়ের দিকে, একবার বোনের দিকে তাকাতেন ও বলতেন, ’এটাই জীবন, এ ই আমার শেষ বয়েসের শান্তি’। তারপর দু’জনের কাঁধে ভর করে এমন কষ্টে দাঁড়াতেন, মনে হতো তার শরীরটাই যেন তার বড় এক বোঝা। দু’জনের সাহায্যে দরজা অবধি গিয়ে হাত নেড়ে একা একাই যেতেন তাঁর শোবার ঘরে। মা ফিরে আসতেন তাঁর সেলাইএর উপকরণ গোছনোর জন্যে আর বোন তার খাতাকলম। গুছিয়ে দু’জনেই ছুটতেন বাবার পেছনে, যাতে তাঁকে আরো কোন সাহায্য করা যায়।
এই কর্মব্যাস্ত ও ক্লান্তির চুড়ান্ত সীমায় পৌঁছানো পরিবারের কার এত সময় গ্রগরের দিকে নিতান্ত প্রয়োজনের বাইরে বাড়তি নজর রাখার? সংসারের খরচপত্র যতটা সম্ভব কমানো হলো। কাজের মেয়েকেও বিদায় করা হলো। শুধুমাত্র ভারী কাজে সাহায্য করার জন্যে এক লম্বা, হাড্ডিসর্বস্ব, উসকো খুসকো সাদা চুলের মহিলাকে রাখা হলো। বাকী সব কাজ মা ই করতেন তাঁর সেলাইএর কাজের পাশাপাশি। এমনকি কিছু গহনাপত্র বিক্রি করা হলো, যা আগে মা ও বোন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খুব আমোদের সাথে পড়তো। প্রতি সন্ধ্যাবেলার আলাপ আলোচনায় গ্রেগর বিক্রির দামও জানতে পেল। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এই আর্থিক দুরবস্থায় এই বড়ো ভাড়াটে বাড়ীটি পাল্টানো জরুরী হলেও করা সম্ভব হচ্ছেনা গ্রেগরের কারণেই। ওকে এক বাড়ী থেকে আরেক সরানো কিভাবে সম্ভব, তা ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারে নি কেউ। কিন্তু একমাত্র তার প্রতি নজর রেখেই যে এটা করা হচ্ছেনা, এটাও ঠিক নয়। একটি বাক্সে কয়েকটি ছিদ্র রেখে সহজেই সরানো যায় তাকে। আসল কারণ হচ্ছে নিদারুন হতাশা ও এ থেকে সৃষ্ট দুর্ভাবনা। এই পরিবারটি এমন এক দুর্যোগে পড়েছে, যা আত্মীয় ও পরিচিতজনদের কখনোই হয়নি। পৃথিবী সবচেয়ে গরীব মানুষদের কাছ থেকে যা দাবী করতে পারে, তা প্রতিটিই পুরোপুরিভাবে পালন করা হচ্ছে। বাবা ছোট এক ব্যাংক কর্মচারীর জন্যে সকালের নাস্তা নিয়ে যেতেন। মা অপরিচিত মানুষের জন্যে পোষাক সেলাই করতেন। বোন ক্রেতাদের আদেশ পালন করার জন্যে ডেস্কের পেছনে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতো। এর বেশী করার শক্তি আর এই পরিবারের ছিলনা। গ্রেগরের পিঠের যন্ত্রনা শুরু হতো নুতন করে, যখন মা আর বোন বাবাকে বিছানায় রেখে আবার ফিরে আসতো বসার ঘরে। নিজেদের কাজ রেখে একজন আরেকজনকে ধরে গালে গাল লাগিয়ে বসে ডুবে থাকতো অন্ধকার বিমর্ষতায়। একসময় মা গ্রেটেকে গ্রেগরের ঘরের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলতেন,’দরজাটি বন্ধ করে দে’। আবার অন্ধকারে গ্রেগর, আর ওদিকে মা আর মেয়ের অশ্রুতে মাখামাখি বা শুন্য দৃষ্টিতে টেবিলের দিকে চেয়ে থাকা।
দিনের বা রাতের বেশীরভাগ সময়ই প্রায় না ঘুমিয়েই কাটাতো গ্রেগর। মাঝে মাঝে ভাবতো, পরের বার দরজা খুললেই পরিবারের সমস্ত দ্বায়িত্ব আর আগের মতোই বহন করার জন্যে এগিয়ে যাবে। তার ভাবনার বিস্তারে বহুদিন আবার তার বস ও উকিল সাহেব, কলিগ ও এক শিক্ষানবিস, সবাই একে একে জায়গা নিল। সেই সাথে আরো অনেকে। তাদের পাহাড়াদার, অন্য এক অফিসের আরো দু’জন বন্ধু, মফস্বল শহরের হোটেলে রুম পরিস্কার করার মেয়েটি। একটা দু’টো আবছা ভালো লাগার স্মৃতি, এক হ্যাটের দোকানের ক্যাশের মেয়েটির কথা। ভালো লেগেছিল তার। সে কথা স্পষ্ট ভাবে বললেও বেশ দেরীতেই বলা হয়েছিল। তাদের সবার কথা তার মনে এলো, আরো অনেক পরিচিত, অপরিচিত ও ভুলে যাওয়া জনের সাথে মিলেমিশে। তবে তার ও তার পরিবারের সমস্যার কাছাকাছি ওরা নয় ও ওদেরকে চিন্তা থেকে দুরে সরাতে পারলেই খুশী হতো গ্রেগর। পরমূহুর্তেই আবার পরিবারকে নিয়ে ভাবার মেজাজ আর ওর থাকতো না। নিজের অবমূল্যায়নে ক্রোধ জমতো নিজের ভেতরে। তার খেতে কি ভাল লাগে বা না লাগে তা ভাল করে না জেনেই মাঝে মাঝে নিজেই খাবার ঘরে যাবার পরিকল্পনা করতো। গ্রেগরের ভাল লাগুক বা না লাগুক তা নিয়ে কোন ভাবনা না করেই বোন সকালে ও দুপুরে যে কোন খাবার পায়ে ঠেলে দ্রুত ঘরে ঢুকিয়ে দিত। সন্ধ্যায় সে খাবার খাওয়া হল কি না হল তা না দেখেই ঝাড় দিয়ে ঘরের বাইরে নিয়ে যেত। যতো দ্রুত সম্ভব, ততো দ্রুত আর অবহেলায় একবারই সন্ধ্যায় পরিস্কার করতো ঘর। দেয়াল বেয়ে নোংরা দাগ জমলো, ধুলো ও আবর্জনা জমে থাকতো এদিক সেদিক। প্রথম দিকে অভিযোগ জানানোর উদ্দেশ্যে বোন ঘরে ঢোকার আগের মূহুর্তে এই বিশেষ স্থানগুলোতেই পড়ে থাকতো গ্রেগর। কিন্তু পরে টের পেলো, একসপ্তাহ পড়ে থাকলেও তা পরিস্কার করবে না বোন। সে হয়তে ময়লাগুলো এ ঘরে রাখারই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। এ ঘর পরিস্কার করার একচ্ছত্র অধিকার একমাত্র যেন তারই হাতে। একবার মা খুব ভালো করে পরিস্কার করলেন। কয়েক বালতি পানিতেই তা ভাল করে করা সম্ভব হলো। তাতে অতিরিক্ত আদ্রতায় গ্রেগরের বেশ অসুবিধাই হলো। বিরক্তিতে পড়ে রইল সোফার উপর নিশ্চল হয়ে। কিন্তু তাতেও ক্ষমা পেলেন না মা। সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরের গ্রেগরের ঘরের পরিবর্তন টের পেয়ে ভীষন অপমানিত বোধ করে বসার ঘরে ছুটলো। মা বারবার হাত তুলে শান্ত করার চেষটা করলেও কান্নাকাটি শুরু করলো। বাবা সোফায় ভয় পেয়ে গেলেন। প্রথমে অবাক হয়ে বোকার মতো এদিক ওদিক তাকালেন। একদিকে মায়ের বিরুদ্ধে বাবার অভিযোগ, অন্যদিকে বোনের চিৎকার, মা যেন আর কোনদিন গ্রেগরের ঘরে হাত না দেন। বাবা উত্তেজনায় আর থাকতে পারলেন না বসার ঘরে, শোবার ঘরে ছুটলেন। বোন দমকে কেঁদে কেঁদে টেবিলে কিল ঘুষি দিতে থাকলো। গ্রেগরের রাগ হলো একথা ভেবে যে, দরজাটি বন্ধ করে তাকে এই দৃশ্য আর শোরগোল থেকে মুক্তি দেবার কথা কেউ একবারও ভাবলো না।
কিন্তু কাজের চাপে বিরক্ত ও ক্লান্ত বোন যদি আগের মতো গ্রেগরকে দেখাশোনা করতো, তাহলে মাকে কিছুতেই তাকে সাহায্য করতে হতো না। গ্রেগরকেও অবহেলা করা হতো না। একবার হাজির হলো কাজের মহিলাটি। এই বৃদ্ধা বিধবা তার দীর্ঘ জীবন ও শক্ত শারিরীক কাঠামোর জোরেই অনেক কঠিন সময় অতিক্রম করেছেন। গ্রেগরের প্রতিও তার সত্যিকারের কোন ভয় ও ঘৃণা হলো না। কোন কৌতুহলের বশে নয়, কোন এক আকস্মিকতায় ওর ঘরের দরজা খোলেই গ্রেগরকে দেখে ভীষন অবাক হয়ে যান। তারপরও তাকে তাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে না দেখে হাতে হাত বেঁধে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকেন। তারপর থেকে প্রতিদিনই তিনি সকালে ও সন্ধ্যায় দরজাটি সামান্য ফাঁক করে গ্রেগরকে দেখতে আসা শুরু করলেন। প্রথম দিকে তিনি ওকে নিজের কাছে যে ভাষায় ডাকতেন, তার নিজের কাছে তা হয়তো বন্ধুত্বসুলভ বলেই মনে হতো। ‘আয়, আয়, এদিকে আয় গুবরে পোকা’ বা ‘দেখ, দেখ, গুবরে পোকা দেখ’! এধরণের ডাকাডাকির উত্তরে কোন সাড়া দিত না গ্রেগর, বরং নিজের জায়গাতেই পড়ে থাকতো। এই মহিলাকে যদি তাকে অপ্রয়োজনীয় ব্যাবহারে বিরক্ত করার বদলে প্রতিদিন তার ঘর পরিস্কার আদেশ দেয়া হতো, তাহলে কতো ভাল হতো! একদিন ঝড়ো বৃষ্টির ছাট আছড়ে পড়ছিল জানালায়, হয়তো নতুন বছেরর আগমনী চিহ্ন। মহিলা এসে তাকে ডাকাডাকি শুরু করলন। এতো বিরক্ত হলো গ্রেগর যে, আক্রমনাত্বক ভঙ্গীতে ঘুরে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল মহিলাটির দিকে। মহিলাটি ভয় পেয়ে পালালেন না। বরং দরজার কাছে রাখা একটি চেয়ার দু’হাতে তুলে মুখ হা করে এমনভাবে দাঁড়ালেন যে, গ্রেগরের পিঠে চেয়ারটি মেরেই মুখটি বন্ধ করবেন। ‘না, এর বেশী আর এগোনো যাচ্ছে না বুঝি’? প্রশ্ন করলেন। গ্রেগর উল্টোদিকে ফেরার পর আবার চেয়ারটি দরজার কোনে ফেরৎ রাখলেন।
গ্রেগর খাওয়াদাওয়া ছেড়েই দিল প্রায়। মাঝে মাঝে অন্য কোন কারনে যদি ছড়ানো খাবারের পাশ দিয়ে যেত, ছোট কোন এক টুকরো খেলাচ্ছলে মুখে পুরে নিত। ঘন্টার পর ঘন্টা সে খাবার মুখেই রেখে একসময় বের করে ফেলে দিত বাইরে। একবার মনে হলো তার, ঘরের এই করুন চেহারাই তার অরুচির কারণ। কিন্তু ঘরের সবরকম পরিবর্তনও একসময় তার সহ্য হয়ে গেল। বাড়ীর যা যা অপ্রয়েজনীয়, সব এঘরে ফেলে রাখা সবার অভ্যাসে পরিণত হল। বাড়ীর কোন ঘর যদি কাউকে ভাড়া দেওয়া হয়, তাহলে এসব অপ্রয়োজনীয় বস্তুর সংখ্যা বাড়ারই কথা। যে তিনজনকে একটি ঘর ভাড়া দেয়া হলো, এদের সকবারই মুখভর্তি দাড়ি। গ্রেগর একবার দরজার ফাঁক দিয়ে দেখেছে। এদের সবাইকেই শুচিবাইগ্রস্থ বলে মনে হলো। এর প্রভাব সারা বাড়ীতে ও বিশেষ করে রান্নাঘরে পড়লো। অপ্রয়োজনীয় ও নোংরা তাদের একেবারেই অসহ্য। তাছাড়া তাদের নিজেদের আসবাবপত্রের বেশীরভাগই নিজেরাই এনেছেন। তাতে অনেক কিছুই বাড়তি হয়ে পড়লো, যা বিক্রি করা যায়না, কিন্তু ফেলে দেবার কথাও ভাবতে মন চায়না। এ সবই গ্রেগরের ঘরে এনে জমা করা হলো। এমনকি রান্নাঘরের ছাই ও ময়লার বাক্সও। যে কোন মূহুর্তে যা অপ্রয়োজনীয়, এনে গ্রেগরের ঘরেই ফেলতেন কাজের মহিলাটি । খুব দ্রুত সারা হতো এ কর্ম। কপাল ভাল যে গ্রেগর শুধু ফেলে দেয়া ময়লা আর হাতটুকুই দেখতে পেত। মহিলার হয়তো পরিকল্পনা ছিল ওগুলো কোন সময় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া বা একবারে ফেলে দেয়া।কিন্তু পরিনামে ময়লা সেখানেই পড়ে রইলো প্রথমবার ছুড়ে ফেলা জায়গাতেই। গ্রেগরের নড়াচড়ার ফলে কিছুটা সরলো বটে। অনেকটা বাধ্য হয়েই সরালো সে, কারন তার নিজের চালাফেরার পথও ছিলনা। একসময় এসবে তার আনন্দই হতো, যদিও এভাবে চলাফেরার পর সে কয়েক ঘন্টার জন্যে মৃতের মতো ক্লান্ত ও বিমর্ষ হয়ে পড়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করতে পারতো না।
মাঝে মাঝে ভাড়াটিয়ারা বসার ঘরে রাতের খাবার খেতেন। তখন দরজাটি সে পুরো সন্ধ্যার জন্যে বন্ধই থাকতো। কিন্তু গ্রেগরের তাতে কোন আপত্তি রইলো না। এমনও সময় গিয়েছে, দরজা খোলা সত্বেও সে তার বাড়ীর লোকের অগোচরে অন্ধকার কোনেই পড়ে থাকতো। একদিন কাজের মহিলা দরজাটি একটু ফাঁক করে রেখেছিলেন। রাতের খাবারের জন্যে যখন ভাড়াটিয়ারা বসার ঘরে এসে বাতি জালালেন, খোলাই রইল সে দরজা। তারা এসে একই টেবিলে বসলেন, যেখানে আগে গ্রেগর ও তার বাবা মা বসে খাওয়াদাওয়া সারতেন। ন্যপকিন বিছিয়ে কাটাচামচ ও ছুড়ি হাতে নিয়ে বসতেই মা একপেয়ালা মাংশ ও বোন পেয়ালা বোঝাই আলুসেদ্ধ নিয়ে ঘরে ঢুকলো। গরম খাবার থেকে ধোঁযা বেরুচ্ছিল। তিনজনই এমনভাবে পেয়ালার উপর ঝুঁকে পড়লেন, মনে হলো খাবার আগে পরীক্ষা করে দেখতে চাইছেন। মাঝের জন সত্যি সত্যিই ছুড়ি দিয়ে একটি টুকরো কেটে পরীক্ষা করলেন, মাংশ কতোটা নরম, নাকি আরেকবার রান্নাঘরে পাঠাতে হবে। তাকেই তিনজনের মাঝে সবচেয়ে প্রভাবশালী মনে হলো। পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট মনে হলো তাকে। মা ও বোন উত্তেজনায় তাকিয়ে থেকে থেকে অবশেষে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
পরিবারের সবাই খাওয়াদাওয়া সারতো রান্নাঘরে। তারপরও বাবা রান্নাঘরে ঢোকার আগে এ ঘরেই ঢুকলেন। টুপি খুলে মাথা নীচু করে সম্ভাষন জানালেন সবাইকে টেবিলের চারপাশ ঘুরে। ভাড়াটিয়ারা উঠে দাঁড়িয়ে দাড়ির ফাঁকে কিছু একটা বললেন। বাবা চলে যাবার পর কোন তারা কথা কথা না বলে শুধু খেয়েই চললেন। খাবার সময়ে তাদের দাঁতের বিভিন্ন ধরণের বিচিত্র শব্দে অবাক হলো গ্রেগর। মনে হলো তারা গ্রগরকে বোঝাতে চাইছেন খাবার সময়ে দাঁতের প্রয়েজনীয়তা ও দাঁত না থাকলে অতি সুন্দর মাড়িও কোন কাজেই আসে না। ‘আমার রুচি আছে ঠিকই’, ভাবতে ভাবতে নিজেকেই বললো গ্রেগর। ‘তবে এসবের প্রতি নয়, ওরা যেভাবে খাচ্ছে, সেভাবে খেলে মারাই পড়বো’!
এই পুরো সময়ের মাঝে বোনের বেহালা বাজানো কোনদিন শুনেছে বলে মনে করতে পারছে না গ্রেগর, কিন্তু ঠিক সেই সন্ধ্যাতেই রান্নাঘর থেকে বেহালার আওয়াজ ভেসে এলো। ভাড়াটিয়ারা তাদের খাওয়াদাওয়া শেষ করেছেন, মাঝের জন একটি পত্রিকা বের করে বাকী দু’জনকে একটি করে পত্রিকার পাতা দিয়ে পড়া শুরু করেছেন। আরামে হেলান দিয়ে ধুমপান শুরু করেছেন মাত্র, বেহালায় বাজনা শুনেই সজাগ হয়ে উঠলেন। পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে একসাথে কান পাতলেন সবাই। হয়তো রান্নাঘর থেকেই শুনতে পেয়ে থাকবে কেউ। বাবা উচ্চস্বরে বললেন,’আপনাদের কারো কি অসুবিধা হচ্ছে এতে? তাহলে বাজনা সাথে সাথেই বন্ধ করে দেয়া যায়’। ‘বরং উল্টোটি’, বললেন মাঝের ভদ্রলোক। ‘ম্যাডাম আমাদের এখানে এসে এঘরে বাজালেই ভাল হতো। এঘরটি নিশ্চয়ই আরো বেশী আরামদায়ক’। ‘অবশ্যই’, বললেন বাবা, যেন তিনি নিজেই বাজাচ্ছেন বেহালা। ওরা আবার টেবিলে এসে বসলেন ও অপেক্ষা করলেন। পরমূহুর্তে বাবা এলেন স্বরলিপি রাখার স্ট্যান্ড, মা স্বরলিপির বই ও বোন বেহালা নিয়ে। বোন আস্তে আস্তে বাজনার জন্যে তৈরী হলো। বাবা মা আগে কখনও কাউকে ঘর ভাড়া দেননি, তাই ভদ্রতার আতিশয্যে সোফাতেও বসতে সাহস পেলেন না। বাবা দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, ডান হাতটি সার্টের দুই বন্ধ বোতামের মাঝে ঢুকিয়ে। ভাড়াটেদের একজন মা কে সোফায় বসার অনুরোধ জানালে, সেখানে বসলেন তিনি। একটু দুরে, এক কোনায়, যেখানে ভদ্রলোক সোফাটি সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আগেই।
বোন বাজনা শুরু করলো। বা আর মা দু’পাশ থেকেই বাহালার তারে তার হাতের চলাচলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। গ্রগর বাজনার প্রতি আগ্রহে এগিয়ে মাথাটি বসার ঘরে ঢুকিয়ে দিল। অন্যদের প্রতি নজর রাখলো না ভেবে অবাক হলোনা একেবারেই। আগে তো নিজের চেহারা নিয়ে গর্ববোধ ছিল তার। এখন তো নিজেকে লুকিয়ে রাখাই শ্রেয়। পুরো ঘরভর্তি ধুলো, সামান্য নড়াচড়াতেই আরো বেশী ছড়িয়ে পড়ে, তাতে তার নিজের শরীরও ধুলোয় ঢাকা। সুতো, চুল, খাবারের অবশিষ্ট, সবই বইছে সে পিঠে ও শরীরের পাশে। এখন সেদিকে নজরই নেই, অথচ প্রথম দিকে শরীর উল্টে কার্পেট সব ময়লা ছড়িয়ে নিজেকে পরিস্কার করতো। এখন নিটোল পরিস্কার বৈঠকখানার মেঝেতে এগিয়ে যেতে তান কোন দ্বিধাই হচ্ছে না।
আসলে কেউই তার দিকে নজর দিল না। বাবা আর মা বাজনাতেই ডুবে ছিলেন। ভাড়াটিয়ারা পকেটে হাত রেখে বোনের পেছনে স্বরলিপির ষ্ট্যন্ডের কাছে গিয়ে এমন ভাবে দাঁড়ালেন, যাতে স্বরলিপি দেখতে পারেন। বোনের এতে অবশ্যই বিরক্ত হবার কথা। তারা নীচুস্বরে কথা বলতে বলতে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন ও বাবার চিন্তিত দৃষ্টির সামনে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। পরিস্কার বোঝা গেলো, যে সুন্দর ও মনোমুগ্ধ বাজনা শোনার আশা তারা করেছিলেন, তা না পেয়ে আশাহত ও বিরক্ত হয়েছেন। শুধুমাত্র ভদ্রতা বজায় রাখার জন্যেই তার প্রকাশ ঘটাচ্ছেন না। যেভাবে নাকেমুখে উপরের দিকে চুরুটের ধোয়া ছাড়ছিলেন, তাতে তাদের চুড়ান্ত অসহিষ্ণুতাই প্রকাশ হলো। অথচ কত সুন্দর বাজাচ্ছিল বোন! মাথাটি একপাশে কাত করা, চোখের বিষাদময় দৃষ্টি নেচে বেড়াচ্ছিল স্বরলিপির ছত্রে ছত্রে। গ্রেগর আরেকটু সামনের দিকে এগিয়ে গেল, মাথাটি মেঝেতে নামিয়ে, হয়তো বোনের দৃষ্টিকে ধরার আশাতেই। আসলেই কি সে এক পশু, সঙ্গীতে যার এতোটা তৃষ্ণা? এটাই তার এতদিনের অজানা খোরাক, যা এতদিন খুঁজে এসেছে! তার স্থির সিদ্ধান্ত, বোনের আরো কাছাকাছি এগিয়ে যাওয়া, তার স্কার্টে টান দিয়ে তাকে বোঝানো, সে যেন বেহালা নিয়ে গ্রেগরের ঘরে আসে। তার বাজনার মুল্য গ্রেগরের কাছে যতো, এখানকার কারো কাছেই ততটা না। বোনকে তার ঘরের বাইরে বেরুতে আর কখনোই দেবে না, অন্ততপক্ষে: যতদিন সে বেঁচে থাকবে। এই ভয়ংকর চেহারা প্রথমবারের মতো কাজে আসবে তার। একই সাথে ঘরের প্রতিটি দরজা ও জানালায় সবরকম আক্রমণ প্রতিহত করবে । বোনকে থাকতে বাধ্য করতে হবে না, সে নিজেই থাকবে। সোফার উপর বসে ভাইএর দিকে কান পাতবে। তখন গ্রেগর বলতে পারবে, বোনকে সংগীত কলেজে পাঠানোর পুরো সিদ্ধান্ত সে নিয়েছিল। যদি নিজের এ সমস্যাটি না হতো, তাহলে কারো কথায় কোন পাত্তা না দিয়ে গত বড়দিনেই সবাইকে জানাতো। এবারের বড়দিন কি পেরিয়ে গেছে? একথা শুনে নিশ্চয়ই নরম হয়ে কাঁদতো বোন। গ্রেগর সোজা হয়ে আদর করে চুমু খেত বোনের গলায়। যতদিন ধরে দোকানে কাজে যাচ্ছে বোন, ততদিন ধরে কলার ও কোন ফিতে নেই তার গলায়।
‘মি: সামসা’, ডাকলেন মাঝের ভদ্রলোক ও আর কোন বাক্য ব্যয় না করে সামনের দিকে এগিয়ে আসা গ্রেগরের দিকে তর্জনী নির্দেশ করলেন। বেহালা থেমে গেল, ভদ্রলোক তার সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাকিয়ে হেসে আবার গ্রেগরের দিকে তাকালেন। বাবা গ্রেগরকে না থামিয়ে ওদেরকে শান্ত করাই বেশী জরুরী মনে করলেন বলে মনে হলো। তারপরও ওদেরকে খুব বিব্রত বলে মনে হলোনা, বাজনার চেয়ে গ্রেগরই এখন ওদের কাছে বড় আকর্ষন। বাবা তাদের দিকে এগিয়ে দুই হাত তুলে তাদেরকে তাদের ঘরের দিকে পাঠানোর চেষ্টায় নিয়োজিত হলেন ও সে সাথে শরীর দিয়ে গ্রেগরকে তাদের দৃষ্টির আড়াল করতে চাইলেন। তাদেরকে এবার বেশ বিরক্ত মনে হলো। কিন্তু বিরক্তির কারণ কি? বাবার ব্যাবহার, নাকি এইমাত্র গ্রেগরের মতো প্রতিবেশীর কথা জানা? নিজেদের দাড়িতে অস্থির হাত বুলিয়ে তারা বাবার কাছে এসবের ব্যাখ্যা দাবী করলেন ও নিজেদের ঘরে ফেরৎ যেতে রাজী হলেন না। এরই মাঝে বোন তার সচেতনতা ফিরে পেয়েছে, যা হঠাৎ তার বাজনা বন্ধ হওয়ায় হারিয়ে ফেলেছিল। এতোক্ষন বেহালার ছড়ি আর তারেই ছিল তার শিথিল হাত, আর দৃষ্টি স্বরলিপির পাতায়, যেন একটু পরই বাজনা শুরু করবে আবার। মা বসেছিলেন তার ঘন ঘন নি:শ্বাস আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে সোফাতে। বোন উঠে দাঁড়িয়ে মায়ের কোলের উপর বেহালাটি রেখে এঘর ছেড়ে পাশের ঘরের দিকে ছুটলো। বাবার চাপের মুখে ভাড়াটিয়ারাও সেদিকেই যেতে বাধ্য হচ্ছিল। তারা ঘরে ঢোকার আগেই গ্রেটে সে ঘরের বিছানা চাদর ছুড়ে ফেলল এদিক সেদিক। বাবার ভেতরেও কিছু একটা ভর করলো, যার প্রভাবে তিনি ভাড়াটিয়াদের তাদের প্রাপ্য সন্মান দিতেও ভুলে গেলেন। তাদের ঘরের দিকে গায়ের জোরে ঠেলে ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন বারবার। একসময় মাঝের জন দরজার কাঠে পা রেখে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। উপরের দিতে হাত তুলে মা ও বোনের দিকেও তাকালেন। ‘এই বাড়ীর পরিবারের সদস্যরা যে কদর্য পবিবেশে বাস করছেন, তার প্রতি সজাগ হয়ে বাড়িটি ছেড়ে দিলাম।‘ এটা বলে একদলা থুতু ফেললেন মেঝের উপর। ‘যে ক’দিন এখানে ছিলাম, তার জন্যে এক পয়সা ভাড়া তো দেবোই না, বরং প্রমাণ সাপেক্ষেই ক্ষতিপূরণ দাবী করার কথা চিন্তা করে দেখবো। বিশ্বাস করতে পারেন আমাকে, প্রমান করা বিন্দুমাত্রও কঠিন হবে না’। এটা বলেই তিনি থামলেন ও কোন প্রত্যাশায় এদিক ওদিক তাকালেন। সত্যিসত্যিই সাড়া দিলেন বাকী দু’জনও। ‘আমরাও এই মুহুর্তে বাড়িটি ছেড়ে দিলাম’। পরপরই মাঝের জন হাতল ধরে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
*********
বাবা টলতে টলতে সোফার কাছে এসে এলিয়ে পড়লেন সোফায়। মনে হলো, প্রতি সন্ধ্যার মতোই ঘুমোচ্ছেন সোফায়। কিন্তু তার মাথার অবাধ্য ঝাকুনি দেখে বোঝা গেল, জেগেই আছেন তিনি। গ্রেগর পুরো সময়টি সে জায়গাতেই পড়ে রইল, যেখানে ভাড়াটিয়ারা দেখতে পেয়েছিলেন তাকে। ব্যর্থ পরিকল্পনার হতাশা ও হয়তো অবিরাম উপোষের কারণেই নড়ার কোন ক্ষমতা ছিল না তার। মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে তার দিকে এগিয়ে আসা পরবর্তী ঝড়ের অপেক্ষায় রইল সে। মায়ের কাঁপা কাঁপা আঙ্গুলের ফাঁক গলে বেহালাটি তার কোল থেকে মেঝেতে পড়লো বিকট আওয়াজে। তাতেও আতঙ্কিত হলো না গ্রেগর।
‘প্রিয় বাবা ও মা’ মুষ্টিবদ্ধ হাতে টেবিলে ঘুষি মেরে জানালো বোন। ‘এভাবে আর চলতে পারে না। তোমাদের নিজেদের যদি তা মনে না হয়, আমার হচ্ছে। এই পশুকে আমি আর ভাই বলে ডাকতে চাইনা। সেজন্যে স্পষ্ট করে বলছি, একে বিদেয় করার চেষ্টা করতে হবে আমাদের। একজন মানুষের পক্ষে একে সহ্য করা, এর দেখাশোনা করার যতটুকো সম্ভব, তা আমরা করেছি। মনে হয়না, নিজেদের প্রতি এরপর কোন অভিযোগ থাকতে পারে আমাদের’।
‘তার কথা পুরোপুরি ঠিক!’, বললেন বাবা। মায়ের নি:শ্বাসে কষ্ট হচ্ছিল তখনও। দম না পেয়ে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে অবিরাম কাশতে শুরু করলেন।
বোন মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে কপালে হাত রাখলো। বাবা হয়তো বোনের কথায় কোন এক সিদ্ধান্তের দ্বারপ্রান্তে। ভাড়াটিয়াদের খাবার প্লেট পড়ে আছে টেবিলে তখনও। তারই মাঝে তার দারোয়ানের টুপিটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে গ্রেগরের দিকে তাকালেন।
‘একে বিদায় করতে হবে’ এবার বাবাকেই বললো বোন। কাশির দমকে মায়ের কিছু শোনার ক্ষমতা ছিল না। ‘স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি, এবার তোমাদের দু’জনকেই খুন করবে ও। যে রকম কঠিন পরিশ্রম করি আমরা, তারপর বাড়ীতে এসব ঝন্ঝাট আর সহ্য করা যায়না। অন্তপক্ষে আমি আর করতে পারছি না’। বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো বোন। তার চোখের অশ্ত্রু মায়ের মায়ের মুখমন্ডলে ঝরলো।
‘মা’! মেয়ের প্রতি সহানুভুতি ও একাত্মতায় অধীর হয়ে বললেন বাবা। ‘কিন্তু কি করতে পারি আমরা’?
বোন কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে কনুই ঝাঁকালো। মনে হলো কান্নার প্রভাবে তার আগের সেই নিশ্চিত ভাব অনেকটাই অবদমিত।
‘সে যদি আমাদেরকে বুঝতো’! অনেকটা প্রশ্নের মতোই বললেন বাবা। বাবার এ আশা নিতান্তই দূরাশা, কাঁদতে কাঁদতেই দু’হাত নাড়িয়ে তা জানালো বোন।
‘সে যদি আমাদেরকে বুঝতো’ আবারো বললেন বাবা। তারপর দু’চোখ বন্ধ করে যেন মেয়ের অবিশ্বাসের গভীরতাই টেনে নিলেন নিজের ভেতরে। ‘তাহলে হয়তো তার সাথে কোন এক সমঝোতায় আসা যেতো। কিন্তু এভাবে...’
‘একে দুর করতে হবে’, জোরে বললো বোন। ‘এটাই একমাত্র পথ বাবা। আমাদের ভুলতে হবে যে, এ গ্রেগর। আমরা যে এ পর্যন্ত তা করতে পারিনি, আমাদেরই দুর্ভাগ্য তা। এ কিভাবে গ্রেগর হতে পারে? যদি গ্রেগর হতো, এতদিনে নিজেই বুঝতে পারতো, মানুষের সাথে পশুর বসবাস কতোটা অসম্ভব ও নিজ থেকেই বিদেয় হতো। আমার কোন ভাই থাকতো না, কিন্তু তার স্মৃতিকে সন্মানে রাখতে পারতাম। কিন্তু এখন এই পশু আমাদেরকে সবসময় অনুসরণ করছে, ভাড়াটিয়াদের তাড়িয়েছে। আমাদেরকে রাস্তায় বের করে সে পুরো বাড়ীটিই নিজের দখলে নিতে চাইছে। দেখ বাবা! সে আবার শুরু করেছে’ বলেই গ্রেগরের অবোধ্য কোন এক কারণে চিৎকার করে সোফাটি রেখে মায়ের কাছ থেকে সরে বাবার পেছনে পালালো সে। মনে হলো গ্রেগরের সামনা সামনি হওয়ার পরিবর্তে সে মা কেও বলি দিতে তৈরী। মেয়ের ব্যাবহারে উৎকন্ঠিত বাবাও সোফা ছেড়ে দাঁড়ালেন ও ওর সামনে প্রতিরক্ষার জন্যে দু’হাত তুললেন।
কিন্তু তার বোনকে বা অন্য কাউকে ভয় দেখনোর মতো কিছু করেছে বলে গ্রগরের কিছুতেই মনে হলো না। সে তো শুধু তার ঘরে ফেরার জন্যে তার শরীরকে ঘোরাতে শুরু করেছিল। শক্তিহীনতার কারনে বিষয়টি খুব সহজ ছিলনা বলেই হয়তো চোখে পড়েছে সবার। বারবার মাথা তুলে আবার মাটিতে আঘাত করে ঘোরার জন্যে শক্তি সঞ্চয় করতে হচ্ছিল তাকে। একটু থেমে এদিক সেদিক তাকালো সে। তার সদিচ্ছা সবাই বুঝতে পেরেছে বলে মনে হলো। হয়তো শুধুমাত্র মূহুর্তের এক আতঙ্ক কাজ করেছিল সবার ভেতর। এখন সবাই চুপ হয়ে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মা সোফায় পা’ দুটো ছড়িয়ে ফাঁক করে পড়ে আছেন, ক্লান্তিতে প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে চেখদুটো। বাবা ও বোন বসে আছে পাশাপাশি, বোন এক হাতে বাবা গলা জড়িয়ে।
‘এখন আবার ফেরার চেষ্টা করতে পারি’, ভাবলো গ্রেগর ও তার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হলো আবার। পরিশ্রমের কারণে সে তার ফোঁস ফোঁস নি:শ্বাসকে চেপে রাখতে পারছিল না। মাঝে মাঝে বিরতিও নিতে হচ্ছিল। তাছাড়া বাইরের চাপও ছিলনা। ঘোরা শেষ করে সোজা নিজের ঘরের দিকে রওয়ানা হতেই দুরত্ব মেপে অবাক হলো সে। বুঝতেই পারলোনা, তার এই দুর্বল শারিরীক অবস্থায় এতোটা দুরত্ব এতো অল্প সময়ে কি করে পার করলো। তার চিন্তা ছিল, কিভাবে দ্রূত এগিয়ে যেতে পারে। খেয়ালই করলো না যে, তার পরিবারের কোন কথা বা কোন ডাক তাকে বাঁধা দিল না। শুধুমাত্র দরজার কাছাকাছি এসে ঘাড়ে ব্যথা সত্বেও মাথাটি অর্ধেক ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকালো। বোনের উঠে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোন পরিবর্তন দেখলো না। তার সর্বশেষ দৃষ্টি গেলো মায়ের দিকে, মা সোফার উপরেই গভীর ঘুমে নিমগ্ন।
সে ঘরে ঢুকতেই দরজাটি বাইরে থেকে চেপে, বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দেয়া হলো। পেছনের হঠাৎ আওয়াজে গ্রেগর এত ভয় পেলো যে, তার কয়েকটা পা অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভাঁজ হয়ে গেল। বোনই এতটা তাড়াহুড়ো করেছে। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়েছিল, পা টিপে টিপে এগিয়ে এসেছে, গ্রেগর শুনতে পায়নি। দরজায় চাবি লাগাতে লাগাতে বাবা মার দিকে তাকিয়ে বললো, ’গেল অবশেষে’!
‘এবার’? নিজেকেই পশ্ন করে অন্ধকারে তাকালো গ্রেগর। একটু পরেই টের পেলো, তার চলার ক্ষমতা একেবারেই নি:শেষ। সে অবাক হলো না, বরং তার এই সরু, শীর্ন পায়ে যে এতদুর আসতে পেরেছে, সেটাই অস্বাভাবিক মনে হলো। কিছুটা ভালো বোধ করছিল নিজেকে। যদিও তার সারা শরীরেই ব্যথা, তারপরেও তার মনে হলো সে ব্যথা কমে কমে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। তার পিঠের উপরের পঁচা আপেল ও তার চারপাশের ধুলো আর পুঁজে ঢাকা ক্ষত প্রায় টেরই পাচ্ছিল না। নিজেকে এখান থেকে দুর করতে হবে, এই সিদ্ধান্ত, তার বোনের না যতোটা, নিজের কাছে আরো বেশী দৃঢ় মনে হলো। এই অবস্থায় এক শুন্যতা ও শান্তির মাঝে ডুবে রইল রাতের তৃতীয় প্রহর অবধি। রাত শেষ হওয়ার চিহ্ণ হিসেবে বাইরের আলোর আভাস অনুভবও করলো। তারপর তারা মাথা ঝুলে পড়লো একদিকে ও নাকের ভেতর দিয়ে তার সর্বশেষ নি:শ্বাসটি বেরিয়ে এলো।
পরদিন সকালে কাজের মহিলা এলেন। শক্তি ও তাড়াহুড়োয় সারা বাড়ী দরজাগুলো এমনভাবে খুললেন আর বন্ধ করলেন যে, কারো ঘুমানোর কোন সুযোগ রইল না। তাকে যে এ ব্যাপারে সাবধান হওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল, সেদিকে তার নজরই রইল না। প্রতিদিনের মতোই অল্প সময়ের জন্যে গ্রগরের ঘরে ঢুকে প্রথমে অস্বাভাবিক কিছুই টের পেলেন না। তিনি ভাবলেন, গ্রেগর ইচ্ছে করেই নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে বা কোন ভান ধরে আছে। তার হাতে যে ঝাড়ুটি ছিল, তার খোঁচায় চেষ্টা করলেন গ্রেগরকে দরজা থেকে সরানোর। কিন্তু তাতে সফল না হয়ে একটু রেগে গুতো দিলেন তার শরীরে। কোন রকম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি না করে যখন সরে গেলো গ্রেগরের শরীর, তখন সতর্ক হলেন তিনি। তারপর ঘটনাটি পুরো বুঝতে পেরে শিশ বাজাতে শুরু করলেন ও বেশীক্ষন না থেকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। বাবা মায়ের শোবার ঘরের দরজা পুরো খুলে অন্ধকারে ঢুকে বললেন, ’মরেছে সে, দেখুন, দেখুন, মরে ভুত হয়ে গেছে’!
কাজের মহিলার তড়িৎ প্রবেশে হতচকিত সামসা দম্পতি কোনকিছু বোঝার আগেই সোজা হয়ে বিছানায় বসে পড়লেন। তারপর দ্রুত নিজেদের দিক থেকে বিছানা ছেড়ে নামলেন। মি: সামসা একটি চাদর জড়ালেন গায়ে আর মিসেস সামসা রাতের পোষাকেই ঢুকলেন গ্রেগরের ঘরে। এর মাঝে খুললো বসার ঘরের দরজাও, যেখানে গ্রেটে ভাড়াটিয়া আসার পর রাতে ঘুমোতো। পুরো পোষাকে তার ফ্যকাশে চেহারা দেখে মনে হলো, সারারাত ঘুমোতে পারে নি। ‘মৃত’? কাজের মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন মিসেস সামসা, যদিও নিজেই তা পরীক্ষা করে বা না করেই বুঝতে পেরেছেন। ‘আমি তা ই মনে করছি’, বলেই তা প্রমান করার জন্যে ঝাড়ু দিয়ে ঠেলে গ্রেগরের লাশটি আরেকটু পাশে সরিয়ে দিলেন মহিলাটি। মিসেস সামসা এমন ভাবে এগুলেন যে, যেন তিনি ঝাড়ুর আঘাত ঠেকাতে চাইছেন, কিন্তু পরিনামে করলেন কিছুই। ‘এখন আমরা খোদাকে ধন্যবাদ জানাতে পারি’, বললেন মি: সামসা। বুকে ক্রশ আঁকলেন ও তিন মহিলাও তাকে অনুসরণ করলো। গ্রেটে এতক্ষন লাশের দিক থেকে একবারও দৃষ্টি ফেরায় নি। এবার বললো, ‘দেখ, দেখ, কতোটা শুকিয়ে গিয়েছিল সে। অনেকদিন ধরে তো কিছই খেতো না। প্রতিদিন যতোটা খাবার দেয়া হতো ঘরে, বেরও করা হতো ততটাই’! সত্যি সত্যিই গ্রেগরের শরীর ছিল পুরোপুরি শুকনো আর হালকা। তার পা’গুলো যে শরীরকে আর বহন করছে না, সেটাও চোখে পড়ল এতক্ষনে।
‘চল গ্রেটে, আমাদের ঘরে কিছুক্ষনের জন্যে যাই’, ম্লান হাসি হেসে বললেন মিসেস সামসা। গ্রেটে লাশের দিকে তাকাতে তাকাতে বাবা মায়ের পেছনে পেছনে শোবার ঘরে ঢুকলো। কাজের মহিলা দরজা বন্ধ করে জানালাটি খুলে দিলেন পুরেপুরি। মাচের্র শেষে সকালের বাতাসে তখন অনেকটাই ভেজা ভেজা ভাব।
নিজেদের ঘর থেকে তিনজন ভাড়াটিয়া সকালে নাস্তার জন্যে বসার ঘরে ঢুকলেন। সবাই মনে হয় তাদের কথা ভুলেই গেছে। ‘আমাদের নাস্তা কোথায়’? বিরক্ত হয়ে কাজের মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন মাঝের ভদ্রলোক। মহিলা মুখে আঙ্গুল রেখে ওদেরকে গ্রেগরের ঘরের দিকে ইশারা করলেন। তারা সেখানে ঢুকলেন ও এলোমেলো পোষাকে পকেটে হাত রেখে গ্রেগরের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। গ্রেগরের ঘর তখন ভোরের আলোয় আলোকিত।
তখনই শোবার ঘরের দরজা খুললো। ড্রেসিং গাউন গায়ে একহাতে স্ত্রী ও একহাতে মেয়েকে ধরে মি: সামসা বেরোলেন সে ঘর থেকে। কান্নাচ্ছন্ন মনে হলো ওদেরকে, গ্রেটের মুখ বাবার বাহুতে লুকোনো।
‘এই মূহুর্তেই এ বাড়ী ছাড়ুন আপনারা’ বললেন মি: সামসা স্ত্রী ও মেয়েকে দু’হাতে জড়িয়ে। ‘কি বোঝাতে চাইছেন আপনি’? প্রশ্ন করলেন মাঝের ভদ্রলোক একটু অবাক ও মিষ্টি হেসে। বাকী দুজন কোমরে হাত রেখে এমন ভাবে অবিরত ঘষছিলেন যে, মনে হচ্ছিল অবশ্যই জিতে যাবেন, এমনি এক বড় যুদ্ধের জন্যে মনে মনে তৈরী করছেন নিজেদের। ‘আমি যা বলেছি, তাই বুঝাতে চাইছি। বলে মি: সামসা দুই মহিলাকে নিয়ে সোজা ভাড়াটিয়াদের দিকে এগিয়ে গেলেন। মাঝের ভদ্রলোক তখন মাটির দিকে তাকিয়ে তার সমস্ত চিন্তাভাবনা নতুন করে সাজানোর চেষ্টায়। ‘ঠিক আছে, তাহলে যাচ্ছি আমরা’ বলে মি: সামনার দিকে তাকালেন তিনি। মনে হলো এই অকস্মাত অপমানে এই সিদ্ধান্তের পেছনে আরো একবার অনুমতির দরকার। মি: সামসা কঠিন চোখে করে মাথা নাড়লেন কয়েকবার। তাতে ভদ্রলোক লম্বা পা ফেলে ফেলে তাদের ঘরে ঢুকলেন। বাকী দু’জন চুপচাপ কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে পেছন পেছন গেলেন। মি: সামসা তাদের আগেই সে ঘরে ঢুকে তাদের তিনজনের একত্রিত হওয়াকে বাধাগ্রস্থ করলেন। তিনজন তাদের টুপি পড়লেন, রাখার জায়গা থেকে তাদের লাঠি হাতে নিলেন, সন্মানে একটু মাথা নীচু করে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলেন। তারপরও কোন এক যুক্তিহীন সন্দেহের বশে দুই মহিলাকে নিয়ে মি: সামসা সিড়ির কাছে এগিয়ে গেলেন। রেলিংএ হেলান দিয়ে তিনজনই দেখলেন, তিন ভদ্রলোকই নেমে যাচ্ছেন নীচে, লম্বা সিড়িটি বেয়ে ধীরে ধীরে, কিন্তু একই গতিতে। সিড়িটা যেখানে বাঁক নিচ্ছে, সেখানে আদৃশ্য, পরমূহুর্তেই আবার দৃষ্টিসীমার ভেতরে। যতই দুরে সরছেন তারা, ততই কমছে সামসা পরিবারের আগ্রহ তাদের প্রতি। অবশেষে যখন একজন ফরিওয়ালা কশাই তার মাথায় বোঝা নিয়ে শক্তিশালী পদক্ষেপে উপরে ওঠা শুরু করলো, তখন মি: সামসা তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে সিড়ির ঘর ছেড়ে নিশ্চিত মনে নিজেদের ঘরে ফিরে গেলেন।
সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন কর্মস্থলে না গিয়ে আজকের দিনটি কিছুটা বাড়ীতে ও কিছুটা একসাথে বাইরে হাঁটাহাঁটি করে কাটাবেন। এই ছুটি শুধু তাদের প্রাপ্যই নয়, তাদের জীবনের জন্যেও অতি জরুরী। সেজন্যে তারা টেবিলে বসলেন ও তিনটি অনুপস্থিতির চিঠি লিখলেন তাদের কাজের জায়গায়। মি: সামসা লিখলেন তার ব্যাংকের পরিচালকদের কাছে, মিসেস সামসা লিখলেন যাদের কাছে কাপড় পাঠাবেন, তাদেরকে ও গ্রেটে লিখলো তার প্রিন্সিপ্যালের কাছে। এর মাঝে তার সকালের কাজ শেষে কাজের মহিলা বিদায় নিতে এলেন এ ঘরে। তিনজনই তার দিকে না তাকিয়েই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। তারপরেও মহিলাটি দাঁড়িয়ে থাকায় তিনজনই বিরক্ত হয়ে তাকালেন। ‘কি হলো’? জানতে চাইলেন মি: সামসা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এমনভাবে হাসলেন মহিলা, মনে হলো সবাইকে বিরাট এক সুসংবাদ জানানোর আছে তার ও কারো বিশেষ অনুরোধেই তা জানাবেন। এদিক ওদিক দুলছে সোজা করে গাঁথা টুপির পালক, যা দেখে মি: সামসা সবসময়েই বিরক্ত। ‘ঠিক আছে, বলুন, কি বলতে চান আপনি’? এবার প্রশ্ন করলেন মিসেস সামসা। তার প্রতিই এই মহিলার সবচেয়ে বেশী সন্মান। ‘হ্যা’, বলেই মহিলা বলেই আনন্দের আতিশয্যে বিরতি নিতে বাধ্য হলেন। ‘পাশের ওঘরের ওই বস্তুটি কি ভাবে কোথায় ফেলতে হবে, তা নিয়ে আপনার ভাবনা করার আর দরকার পড়বে না। আমি সব ঠিকঠাক করে দিয়েছি’। মিসেস সামসা ও গ্রেটে তাদের চিঠির উপর এমনভাবে ঝুঁকে পড়লো, যেন আরো লিখতে চাইছে। মি: সামসা দেখলেন মহিলাটি আরো বিশদ বর্ননায় শুরু করতে চাইছেন। বাঁধা দেয়ার জন্যে তাই হাত তুলে ইশারা কললেন। বাঁধা পেয়ে বেশ অপমানিত বোধ করলেন মহিলা, কিন্তু ভাব দেখালেন এমন যে খুব তাড়াহুড়োর মাঝে আছেন। সবাইকে বিদায় বলে বিকট আওয়াজে দরজাটি বন্ধ করে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলেন।
‘সন্ধ্যাবেলা কাজ থেকে বিদেয় করবো তাকে’। বললেন মি: সামসা, কিন্তু স্ত্রী ও মেয়ের কাছে কোন সাড়া পেলেন না। মনে হলোনা কাজের মহিলা তাদের এইমাত্র অর্জিত শান্তিতে কোন ব্যঘাত ঘটাতে পেরেছেন। দু’জনেই চেয়ার ছেড়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে জানালার সামনে দাঁড়ালেন। মি: সামসা সোফা থেকে মাথা ঘুরিয়ে তাদের দিকে কতোক্ষন নীরবে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ডেকে বললেন, ’এদিকে আস তোমরা। পুরোনো বিষয়কে রাখো এবার! আমার দিকেও একটু নজর দাও’! পরক্ষনেই তার দিকে এগিয়ে এলো দু’জনেই। তাকে আদর করে নিজেদের চিঠি শেষ করায় মনযোগী হলেন।
তারপর তিনজনই একসাথে বেরুলেন বাড়ীর বাইরে। গত কয়েক মাস ধরে তাদের এ সুযোগ হয়নি। একটি ট্রামে চড়ে শহরের খোলা প্রান্তে রওয়ানা হলেন একসাথে। যে কামরায় বসেছিলেন, রৌদ্রের উজ্জল আলো এসে পড়লো সে কামরায়। আরামে তাদের বসার সিটে হেলান দিয়ে তাদের ভবিষ্যত নিয়ে জল্পনা কল্পনা করলেন। এ ভবিস্যত তাদের কাছে বেশ অলোকিত বলেই মনে হলো। এতোদিন এ নিয়ে কোন আলাপ করেন নি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সামনের দিনগুলো অনেক সুন্দর ও বিশেষ করে ভবিষ্যত আরো অনেক বেশী সম্ভাবনাময়। পরিস্থিতি ভালো করা সর্বপ্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে এই বাড়িটি বদলানো। এই বাড়িটি খুঁজে বের করেছিল গ্রেগর, ওরা এটা ছেড়ে আরেকটা ছোট, কিন্তু ভাল এলাকায় আরেকটি বাড়ি খুজে বের করতে চান। এসব অলোচনায় ব্যাস্ত, মি: ও মিসেস সামসা তাদের ধীরে ধীরে আরো বেড়ে ওঠা মেয়ের দিকে পূর্ণ দৃষ্টাতে তাকালেন। গত কয়েক মাসের ঝক্কিঝামেলায় কিছুটা মলিন হয়েছে বটে গালের রং, কিন্তু তারপরেও একটি সুন্দরী ও সাস্থ্যবতী তরুনীর ছাপ পড়েছে চেহারায়। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, এখন একজন ভালো স্বামী ওর জন্যে খোঁজার সময় হয়েছে। এর প্রমাণ হিসেবেই যেন যাত্রার লক্ষে পৌঁছানোর পর মেয়েটিই সবার আগে তার যুবতী শরীরকে টানটান করে উঠে দাঁড়ালো।
শেষ
মন্তব্য
প্রথম পর্ব পড়লাম। আগে পড়েছিলাম মনে হয়!
..চলুক আরও পর্ব।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
মনে আছে এখনো যেদিন কাফকার এই গল্পটি ইংরেজী অনুবাদে প্রথম পড়েছিলাম আমার সারা রাত গেছে হেলুসিনেশনের ভেতর; কি যে অস্বস্তিকর একটা রাত ছিলো! চালিয়ে যান......
অনুবাদ এত কঠিন! নিজের অবিজ্ঞতা না থাকলে বুঝতে পারতাম না। হেরমান হেসের দুটি লাইন এক সপ্তাহ যাবত অনুবাদের চেষ্টা করছি। "ফেরবান্ডলুং" ভাবগত দিকে "স্টেপেন বল্ফ " এর চেয়ে আরো কঠিন। এমন একটা কাজে কোন পরামর্শ আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব না। মূল লেখাটি জার্মান ভাষায় পরেছি। চলচিত্রটি দেখেছি।
লেখাটি পড়ে মনে হল (ক্ষেত্র বিশেষে) অনেক জায়গায় মূল ভাষার প্রভাব বাংলাও রয়েগেছে। খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিছু কিছু বর্ণ চোখ ফাকি দিয়ে বেঁচে গেছে। সার্বিক ভাবে অনুবাদটি ভাল লেগেছে।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
kabir chy er ekta translation chilo...
sheta engraje theke..
amar tinta version english porar shujog hoise... kintu, bangali krao kora mul german theke bangla dekhi nai age..
আপনাদের নানা মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ। অনেকে এটাকে ধারাবাহিক ভেবেছেন, আমি কিন্তু এক খন্ডেই শেষ করেছি।
বানানে কিছু ভুল রয়েছে। পরে চোখে পড়েছে। দু:খিত!
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
কাফকার মেটামরফসিসের কিছু কুৎসিত অনুবাদ পড়েছি, কিন্তু এটা অসাধারন!
অনেক ধন্যবাদ ফারলিন!
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
নতুন মন্তব্য করুন