কেমন করে যেন সময় চলে যায়। নিজের ব্লগের দিকে তাকিয়ে দেখি, জুলাই-এর পরে আর কোন লেখা নেই। আমি লেখাতে অনিয়মিতই থাকি ব্লগে, কিন্তু পুরো অগাস্টে কোনই লেখা নেই দেখে অদ্ভুত লাগছে। অন্তত নিজের ব্লগস্পটে তো হাবিজাবি অলেখাগুলো লিখি, কেউ দেখবে না ভেবে, সেখানেও কিছু নেই। এই মাসটায় কিছুই কি ঘটে নি লেখার মত? এমনকি নিজের ডায়েরীতেও? ...অগাস্ট মাসটাকে আমার ইচ্ছা করে আমার জীবন থেকেই মুছে দিই। কি আছে অগাস্টে? দুইটা তারিখ অভিশাপের মত কালো অন্ধকার হয়ে থাকে। পনেরো আর তেইশ। পনেরো অগাস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুদিন, পুরো পরিবারসহ। এরচেয়ে কালো কোন অধ্যায় তো আর নেই বাংলাদেশের ইতিহাসে...নির্মলেন্দু গুনের কবিতাটা মনে পড়ে, "আগস্ট শোকের মাস, কাঁদো"।
এরপরে আরেকটা তারিখ যোগ হলো ২০০৫-এ, ২১ অগাস্ট। বোমা মারা হলো আওয়ামী নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে। তিনি বেঁচে গেলেন ভাগ্যজোড়ে, হয়তো দুর্ভাগা পুরো পরিবারের অবশিষ্ট সবটুকু আশির্বাদ তাকে আগলে রেখেছিলো। কিন্তু মরতে হলো সেই সভায় আসা সাধারণ কিছু মানুষকে, ইশ, কি ভীষন অনর্থক মৃত্যু! জীবন্মৃত হয়ে আজো বেঁচে আছেন মৃতদের চাইতেও হতভাগ্য আরো ক'জন। লিখতে গিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেদিনের পেপার জুড়ে ছড়িয়ে থাকা লাশের ছবি! ওহ ঈশ্বর, আমি ভুলতে চাই...!
২০০৫-এর ২১শে আগস্টে আম্মুর সাথে কথা হলো, তখন আমি ইউনিভার্সিটির হলে, অনার্স থার্ড ইয়ার ফাইনাল চলছে। মামণি খুব চিন্তায় ছিলো, আমি আবার ওই সভায় গিয়েছি কিনা, কি অমূলক টেনশান- মায়েরাই কেবল করেন। তাকে বুঝিয়ে শান্ত করা হলো। আর মাত্র দু'দিন পরে ২৩ তারিখ, আমার শেষ পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ করেই বাসায় ফিরে আসব। তখন এইসব টেনশানের আলাপ বাদ দিয়ে আমরা সব মজার মজার গল্প করব। মা আমার আশ্বস্ত হন। একটা মাস ধরে দিন গুনে চলেছেন কবে আমি পরীক্ষা শেষ করে বাড়ি ফিরব, আর মাত্র দু'টো দিন। তেইশ তারিখের শেষ পরীক্ষাটা আমার খুব ভালো হলো। অভ্যাসবশত পরীক্ষা শেষ করেই আম্মুকে ফোন দিলাম, কেউ রিসিভ করলো না। ভাবলাম নিশ্চয়ই মা ঘুমুচ্ছেন। বন্ধুদের সাথে তুমুল আড্ডায় মেতে উঠলাম, শেষ পরীক্ষা বলে কথা। বাসা থেকে একটা ফোন এলো কিছুক্ষন পরে, আমি যেন বাসায় চলে যাই, মা'র শরীর খারাপ করেছে আরো।
বাসে যেতে যেতে কত কি ভাবলাম। মামণির একবার গলব্লাডার স্টোন অপারেশন হয়েছিলো, পুরো শরীর অচেতন করে এই অপারেশনটা করতে হয়। এই অপারেশনটাকে বলা হয় সবচেয়ে ছোট্ট, সহজ এবং রিস্ক ফ্রি অপারেশন। অপারেশন শেষ হয়ে যাবার পরে মা'কে কেবিনে ফেরত আনা হলো। একটু পরেই জ্ঞান ফিরবে-মা স্বাভাবিক হয়ে যাবেন জেনেও বিছানার ওপর তার অচেতন শরীর দেখে আমি শিউড়ে উঠেছিলাম। আমার মা কেন একটা মুহুর্তের জন্যও অমন হয়ে থাকবে? এইসব ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে দেখি এত এত মানুষ বাসায়...মা'র ঘরে ঢুকে দেখি মা ঠিক তেমনি অচেতন হয়ে শুয়ে আছেন বিছানায়...।
আর ভাবতে চাই না। আর লিখতে চাই না। আর সইতেও পারি না...। পৃথিবীটা তো অবিশ্বস্তই। ২৩ তারিখটাকে, অগাস্ট মাসটাকে জীবন থেকে মুছে দিলে কি কিছু বদলে যেতো?
এখন অগাস্ট মাস এলে আতঙ্কে থাকি, কোন মানে নেই, তবুও। নিজের অজান্তে প্রতি মুহুর্তে এড়িয়ে যাই সময়টাকে। আমি যেন ঠিক আমি থাকি না। এর মাঝে দেশ থেকে খবর আসে, বাবার শরীর তেমন ভালো নেই। আমি রাতে দুঃস্বপ্ন দেখি। কুঁকড়ে ছোট হয়ে আসে শরীর। বাবা তুমি ভালো থাকো প্লিজ। প্লিজ বাবা।
ফুটনোটঃ সেপ্টেম্বার চলে এসেছে। ১ তারিখ থেকেই আমার মনটা খুশি খুশি হয়ে ওঠে, সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে "Happy birth month" বলে মাস শুরু করি। গতকাল বাবাকে ফোন করে জেনেছি, সব রিপোর্ট ভালো এসেছে। স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলে ভাবছি, এবার প্রিয় সচলে লিখতে না পারলেও অন্তত পড়তে তো পারব প্রিয় মানুষগুলোর লেখা।
মন্তব্য
গুছিয়ে লিখতে পারিনা বলে মন্তব্য করিনা । আপনার লেখাটা পড়ে দু'বার বের হয়ে গেছি ঠিক কি লিখব বুঝতে না পেরে ।
ভাল থাকবেন.. শুভ কামনা !
ওয়েবসাইট | ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল
মা যে কি মা চলে গেলে বুঝা যায়।
ছুঁয়ে গেলো ভীষন।
আপনার বাবা ভালো থাকবেন, তিথি।
শুভকামনা...
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
...
শুভ কামনা তিথি আপু।
ভালো থাকবেন।
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
খুব স্পর্শকাতর লেখা।
................................................................
তোমার হাতে রয়েছি যেটুকু আমি, আমার পকেটে আমি আছি যতটা, একদিন মনে হবে এটুকুই আমি, বাকি কিছু আমি নই আমার করুণ ছায়া
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী
মন টা থমকে গেল।
ভাল থাকবেন।
প্রিয় তিথি, আপনার মত অগাস্ট আমারও জন্য বিভীষিকার মাস। এক পনের তারিখই একজন মানুষের যতজন পিতৃস্থানীয় হতে পারে (পিতা, শ্বশুর, জাতির জনক), আমার জন্য তাদের সকলের মৃত্যুদিবস।
সতের তারিখ এক কাছের বন্ধুর বাবা-মা দু'জনের মৃত্যুদিবস।
তেইশ তারিখ দ্বিতীয় পাণ্ডবের পিতার মৃত্যুদিবস।
প্রতি অগাস্টে ভয় হয় তালিকাটা কি এবার আরো একটু লম্বা হয়ে যাবে?
===============================
তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আজকাল কী যে হলো ছাই। কথায় কথায় চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বুঝতে পারি, বয়স হচ্ছে তো!
ভালো থাকবেন তিথি আপু।।
(যদিও জানি, আসলে শেষ পর্যন্ত ভালো থাকা যায় না।)
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
=============================
তু লাল পাহাড়ীর দেশে যা!
রাঙ্গা মাটির দেশে যা!
ইতাক তুরে মানাইছে না গ!
ইক্কেবারে মানাইসে না গ!
খুব কষ্ট লাগল
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
সেপ্টেম্বরের তের দিন পার হয়ে গেল। এই তেরদিন তো দেখা যাইতে পারত।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
০১
কি আশ্চর্য ! হুবহু একই অনুভূতি আমার হয়েছিলো যখন মাস তিনেক আগে, আমার মায়ের গলায় একটা অপারেশন হয়েছিল। অপারেশনের পর যখন মা'কে অচেতন অবস্থায় কেবিনে আনা হল, অসম্ভব অসহায় লাগছিলো তখন। ডাক্তার বলেছিলেন, সম্ভব হলে সারা রাত একটু মনিটর করা, জ্বর উঠে কিনা, প্রেশার কেমন, ব্যাথা করে কি না ইত্যাদি। সারা রাত মা'র পাশে জেগে বসেছিলাম। সম্ভবত আমার জীবনের দীর্ঘতম রাত। অন্ধকার রুমে সারা রাত তাকিয়েছিলাম মায়ের মুখের দিকে। এতো অসহায় লাগছিলো নিজেকে......
০২
আজ মনটা ভালো নেই। আমার খুব প্রিয় এক বন্ধুর মা'র শরীরটা বেশ খারাপ। সারাটা দিনই মনে হচ্ছে, আমরা কত অসহায় !
০৩
আমি শুধু আশা করতে পারি। তাই আশা করি, যেই উৎকণ্ঠায়, উদ্বেগে আর অসহায়ত্বে রাত কেটেছে, তা যেন আর কাউকে কাটাতে না হয়।
০৪
লেখাটা অনেক হৃদয়স্পর্শী হয়েছে, তাই বিশাল এই মন্তব্য করলাম। ভালো থাকুন, আর অনেক বেশি বেশি লিখুন - মন ভালো করা লেখা।
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
অসাধারন লিখেছ। লেখাটা পড়ার একটু আগেই আম্মুর সাথে ঝগড়া করলাম। এখন লেখাটা পড়ে খুব খারাপ লাগছে, কেন যে আম্মুর সাথে এমন রেগে যাই, আম্মু কখনও থাকবেনা ভাবতেই পারিনা, তখন কার ওপর রাগ হব? প্রচন্ড ভাল লাগল লেখাটা। আমার প্রিয় পোস্ট।
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
মনটা খারাপ হয়ে গেল আপুনি আপনার লেখা পড়ে।
এক, আপনার মায়ের জন্য খারাপ লাগায় আরেকটা কারন হল আগস্ট মাসটা খুব বিশেষ মাস আমার কাছে। শুধু নিজের জন্মের মাস বলেই নয় আমার কাছের কিছু বন্ধু এবং আত্মীয়ের জন্মমাসও এটা। আর কিনা এ মাসই কারো জন্য এমন বিভীষিকাময় হয়ে উঠতে পারে তার ধারনা আমার কখনোই হয়তো হতোনা আপনার এ লেখা না পড়লে।দোয়া করি সর্বশক্তিমান প্রতিটি আগস্টে আপনার মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করে দিক যেন আগস্টের সব কষ্টকে মোকাবেলা করতে পারেন।
--------------------------------------------------------
- ভাবলাম প্রাচ্যের দার্শনিকের বুড়োত্ব উদযাপন নিয়ে মিসেস দার্শনিক একটা পোস্ট দিবে তা-না দিলো কিনা স্যাঁতস্যাঁতে এক পোস্ট!
বলি খাওয়াটা ভালে না জুটে থাকুক, অন্ততঃ খাওয়ার গল্পটাতো শুনতে পারি নাকি?
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
অসম্ভব ছুঁয়ে গেল লেখাটা। ভাল থাকুন আপু, কষ্ট জয় করুন, শুধু এই প্রার্থনাই করি।
_______________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?
আমার চোখে তাকিয়ে মা তুই
কান্না চেপে হাসতে পারিস
সব দুনিয়ার ভালোবাসা
এক সাথে তুই বাসতে পারিস।
তোর ছেলে মা যত দুরেই
যাকনা চলে তোকে ছেড়েই
একটুক্ষণের জন্য তবু
হাতটা আমার ছাড়িসনা
এমন করে সারাজীবন
রাঙিয়ে আমার ছোট্ট ভুবন
বলনা মাগো মা, তুই আমার
বাঁচতে কেন পারিস না?
কালকে থেকেই মন টন অনেক খারাপ। এই লেখাটা পড়ে আরো খারাপ লাগলো....
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
মায়ের জন্য শোক
বাবার জন্য শুভকামনা
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
বড় কষ্টের, বুঝতে পারি। আপনার বাবার জন্য শুভকামণা।
যে রাতে গুঁজেছো চুলে বেগুনি রিবন বাঁধা ভাট,
সে রাতে নরকও ছিলো প্রেমের তল্লাট।
. . . . . . . . . . . . . . . . . . (আবু হাসান শাহরিয়ার)
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
লেখার মা-মেয়ে অংশটি পড়ে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। মুজিব মেহদী ভাইয়ের সঙ্গে আমি একমত। খুবই স্পর্শকাতর একটি লেখা। চিরকালীনতার গুণে শিল্পোত্তীর্ণও।
____________________________
বন্ধুত্ব মানেই তুমি বিচ্ছেদের চুক্তি মেনে নিলে
[আবু হাসান শাহরিয়ার]
ভালো ভালো
ভালো ভালো
নতুন মন্তব্য করুন