স্মৃতির নৌকা বেয়ে

নিঘাত তিথি এর ছবি
লিখেছেন নিঘাত তিথি (তারিখ: রবি, ১০/০৬/২০০৭ - ১২:৫২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:
বিকেলবেলাটায় বেশ ঠান্ডা বাতাস পাওয়া যায় বারান্দায় বসলে। গ্রীলের ওপাশে চোখ পেতে দোদুলকে দেখি আমি মুগ্ধ হয়ে। মাঠ নেই খেলার, তবু ভাগ্যিস আবাসিক এলাকা বলে বাসার সামনে এইটুকুনি রাস্তাটা পেয়েছে, যেখানে বড় যান চলে না। সেই সেইটুকুনি রাস্তাতেই কয়েকটা ইট একটার ওপর একটা সাজিয়ে উইকেট বানিয়ে ব্যাটসম্যান সেজে দাঁড়িয়ে গেছে তার সামনে। ২২ গজের তত্ত্ব এইটুকু জায়গায় ওরা মানতে পারে না, তাতে কি? অদূরে দাঁড়িয়েই হুংকার ছাড়ে ভবিস্যত মাশরাফি। আমি মুগ্ধ হয়ে ওদের দেখি। চারপাশের যেসব ক্ষুদে ফিল্ডার ছুটোছুটি করছে ওদের দেখি। উইকেটের পেছনের দুধভাত ছেলেটাকেও দেখি। দেখতে দেখতেই কানের ওপরে চাপড় পড়ে। চমকে ওঠে তাকাতেই দেখি ফজলু আর নুরু দাঁড়িয়ে ফ্যাকফ্যাক করে হাসছে। ঠিক বুঝতে পারি না কেন, কিন্তু আমার একটু খটকা লাগে। ভ্যাবলার মত তাকিয়ে থাকি আমি। আবার চাপড়। - ব্যাটা,আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখতাছোস কি? আকাশ দ্যাখ, কেমন ম্যাঘ করসে দেখছস? এক্ষনি নৌকা নিয়া বাইর হব। উঠ উঠ, সারাদিন বই পইড়া পইড়া ভ্যাবলা ভাবুক হইছস একটা। এবার আমার সম্বিত ফিরে, তাই তো ! আজ দুপুরেও না ইস্কুল থেকে ফেরার পরে এমন কথাই হয়েছিলো? এর মাঝেই ভুলে গেলাম? ফজলু, নুরু এবার হাত ধরে টান মেরে উঠিয়েই ফেলে আমাকে। বাংলা ঘর পেরিয়ে উঠোনে বসে থাকা মা’কে চিতকার করে একটুখানি জানিয়ে যাই কেবল, “মা রে, আমি গেলাম , চিন্তা করিস না”...। এবার ছুটতে থাকি তিন বন্ধু মিলে। নদীর ঘাটে নৌকা বাঁধাই ছিলো। নুরু আমাদের তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে ভালো পারে এইসব কাজ। আমি আর ফজলু একটু পরে দেখি নৌকা ভাসছে! আহা! চলতে থাকে আমাদের নৌকা... পারি না বলে কিছু নেই, তিনজনেই বৈঠা হাতে নেই পালা করে। আকাশের মেঘ একটু একটু করে বাড়তে থাকে, গুমগুম গুড়গুড় হাঁকডাক। এত জোরেলা বাতাস! আহা! পাড়ের বাড়িঘরের সামনে দাঁড়ানো কত্ত মানুষ, ছেলে, বুড়ো, বৌঝি, তাদের কচি কচি ননদেরা...! - সবাই বুঝি আমাদেরই দেখতাসে রে নুরু? - আররে না...অতদূর থেইকা অত বুঝা যায় নাকি রে? ওরা ম্যাঘ দেখে রে ম্যাঘ, বাতাস খায়! একটু একটু দূরে সরে যেতে থাকে পাড়ের ছবি...আমাদের ছোট তরী বেয়ে আমরা দূরে, আরো দূরে ভাসতে থাকি। ফজলু হঠাত নৌকার মাঝে উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত শূণ্যে তুলে চিতকার করতে থাকে। “ওরে ফজলা, হাসু...আমি তো উইড়া যাইতেসি রে...আআআআআআআআ”। বাতাস বাড়তে থাকে আমাদের আনন্দ আরো বাড়িয়ে দিতে। আমিও দাঁড়াই নুরুর পাশে, আমিও চিতকার করি। “ উউউউউউউউউউউ, হুইইইইইইইই”। দুইজন গলা জড়াজড়ি করে আমরা নৌকার ওপরে নাচতে থাকি দুলে দুলে। ফজলু বৈঠা হাতে দাঁত কেলিয়ে হাসে। “খাড়া...আমিও আই”। একজন একজন করে হাল ধরি। তুমুল হাসি, হুল্লোড়ের সাথে বেড়ে চলে পাগলা হাওয়া। নৌকা চলে, চলতে থাকে। নৌকা চলে, হাওয়া চলে...নৌকা চলে, হাওয়া চলে ! কৈশোরের উদ্দামতায় আনাড়ীপনাকে তুচ্ছ করে চালানো নৌকাও এবার একটু হাসে আমাদের সাথে, “দাঁড়া রে দাঁড়া। এবার আমার খেল দ্যাখ”। অতঃপর নৌকার গতি আর বাতাসের বেগ পাল্লা দিয়ে উল্লাস করে। এক সময় দেখি গ্রাম ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেছি। কৈশোরের পাগলা যৌবন টেনে নিয়ে এসেছে আমাদের এত দূরে, এবার হানা দেয় ভয় কৈশোরের আরেক রূপ-ভয় পাওয়া শৈশব। নুরু, ফজলু এবং আমি একে অন্যের নাম ধরে কান্না শুরু করে দেই এবার। মা’র কথা মনে হয়। এই নৌকা ঠিক দিক মেনে মেনে কেমনে বেয়ে নিব আবার আমাদের গ্রাম? ও আল্লাহ বাঁচাও, এইবার শুধু বাড়ী ফিরতে দাও, আর কোনদিন এরম করুম না। আল্লাহ তুমি মেহেরবান, তুমি দয়ালু...কাইল থেইকাই নামাজ পড়মু...গ্রামে ফিরাইয়া নাও, বাড়ী ফিরাইয়া নাও। আস্তে আস্তে বাতাস কমে আসে, নৌকাও কথা শোনে আমাদের। আল্লাহর নাম নিতে নিতে গ্রামের বাড়ীঘর চোখে পড়তে থাকে আবার একটু একটু করে। আপন ঘাটে নৌকা ভেড়াই আমরা।... এতক্ষনের উত্তেজনায় কাঁপছে শরীর। হঠাত সব রাগ গিয়ে পড়ে একজনের ওপর। রাগে কাঁপতে কাঁপতে তাকেই গালি দিতে থাকি একমনে...”শয়তান আল্লাহ, খুব পাট নিলি আমাদের ওপরে না? তোরে যদি আর ডাকসি জীবনে!”। - দাদু, আমি আজকে ৩৯ করেছি জানো? দোদুলের ডাকে নেমে আসি আমার কৈশোরের নৌকো থেকে। আনমনে বলি, “ আর আমি সেঞ্চুরি!” [পুনশ্চঃ সামহোয়ারইনে এই লেখায় আপাতত আটকে আছি আমি। এখানে কি ভেবে তুলে দিলাম, বুঝছি না। পুন"পুনশ্চঃ ছবিটা সম্ভবত অরূপদা'র তোলা। অনেক আগে অনুমতি নিয়েই সেভ করে রেখেছিলাম।]

মন্তব্য

নিঘাত তিথি এর ছবি
ছবি আসে না কেন? সবাই তো দেখি দিচ্ছে। আমারটা আসে না কেন? কই ভুল করলাম বুঝি না :( --তিথি

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

কনফুসিয়াস এর ছবি
ছবি দেয়ার টিউটোরিয়ালটা মিস করে গেছিস! আমি বলে দিব নে পরে। -যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি
নি সু তি - র 'সু' কোথায় হারিয়ে গেলো? এভাবে সব 'সু' (সু মানে ভালো, জুতা ভেবে বিভ্রান্ত হবেন না কেউ!) কেবল স্মৃতির নৌকাতেই স্থান করে নিবে?
ভাস্কর এর ছবি
ছবির লিংকের লেইগা একটা সহজ বান স্কৃপ্টেড বাটন তৈরী কইরা দেওন যায় না? বাটন টিপলেই আপলোড... ----------------------------------------------------- বরফখচিত দেশ ক্যান এতোদূরে থাকো!

স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...

কনফুসিয়াস এর ছবি
img src=http://www.sachalayatan.com/next/files/pakhi%20amar%20akla%20pakhi.jpg align=left আগে পরে ঐ দু'টো সাইন। -যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

হযবরল এর ছবি
এত বড় ছবি ক্যান ।
কনফুসিয়াস এর ছবি
হযু ভাই, ওরে ইমেজ দেয়া শিখাইতেছি! :) -যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

নিঘাত তিথি এর ছবি
মুহিহিহিহিহিহি...অবশেষে আমি ছবি দিতে পেরেছি! :)) --তিথি

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

বিপ্লব রহমান এর ছবি

এই লেখাটি আগেও একাধিকবার পড়েছি। এখন আবারো পড়লাম। যতবার পড়ি, ততবার মন ভাল হয়ে যায়। মুগ্ধতার ঘোর কাটে না।...


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।