১.
অন্ধকারের যুবকেরা অন্ধকার খুঁজে ফেরে। মূলত জায়গাটা তাদের চেনাই। তবু তারা আরো রাত বাড়ার অপেক্ষায় থাকে। আরো অন্ধকারের অপেক্ষায় কিংবা গাঢ় অন্ধকারের অপেক্ষায়। যুবকদের যেকোন নামই হতে পারে। সুমন, বিল্টু কি মন্টু! নামে কি আসে যায়? তারা অন্ধকারের মানুষ। নামগুলোও তাই অন্ধকারেই থাকুক।
২.
মিতির চাইছিল না তবু দেরি হয়ে গেল। সে এসেছিল তার বাবু সোনার কাছে। ভারি দুষ্ট হয়েছে আজকাল। বেশ কথা শিখেছে।
মিতিল পচা, মিতিল গন্ধ!
কে শিখিয়েছে কে জানে? কাজের লোকটা হতে পারে। এই যে মিতিরের বাবু সোনা , সে কিন্তু মিতিরের আপন কেউ নয়!
মাস কয়েক আগের কথা। বাবা একদিন ওকে চমকে দিয়ে একটা মোবাইল ফোন কিনে আনে। সস্তার সেট। তাতে কি? একটা সেট তো! কথা তো বলা যায় বেশ! টানাটানির সংসারে এত পরে হলেও যে একটা সেট তার জুটেছে তাই বা কম কি? বিয়ের আগে কোনদিন তার নিজের একটা সেট হবে, সে কি ভেবেছিল?
তা নতুন সেট পেলে একটু তো মন উড়তে চাইবেই। সেরকমই উড়ছিল। একা চুপিচুপি সে ছাদে এসে আকাশের ঠিকানায় নম্বর টিপছিল। কেউ ধরে ফেললেই সে ভয়ে কেটেও দিচ্ছিল। বেশিরভাগই আবার ব্যাক করছিল। পুরুষ মানুষের যে কত রকম খুচরো স্বভাব থাকে তা তার বন্ধবীদের কাছ থেকে জানা হয়ে গ্যাছে।
মিতির ভীষণ অবাক হয়েছিল যে কিছু ফোন বন্ধ ছাড়া বেশির ভাগ ফোনই লোকজন ধরেছিল এবং তারা সবাই পুরুষ মানুষ। এদেশে কি পুরুষের সংখ্যাই বেশি নাকি মেয়েরা মোবাইল রাখে না! কই তার সব বান্ধবীরই তো কমপক্ষে একটা করে আছে।
হ্যালো, বাবা! তুমি পঁচা… অভ্যাস বশতই মিতির কেটে দিয়েছিল। কিন্তু এমন এমন মিঠা গলা ছেলেটার! মিতিরের খুব মায়া হয়েছিল! আবার কল করে সে..
৩.
অন্ধকারের মানুষগুলি একজনের অপেক্ষায় আছে। তার কাছেই আসল জিনিস। বড় কঠিন জিনিস। কত সাহসীরই মুত বেড়িয়ে যায়। কিংবা কত ভীতুরই ধাবমান মুত মাঝপথে থেমে যায়!
৪.
ছেলেটা বাবার অপেক্ষায় থাকে প্রতিদিন। তার বাবা সেই রাতে ফেরে। কোন কোন দিন গভীর রাতও হয়ে যায়। ছেলেটি তবু অপেক্ষা করে…নাম তার বুবাই।
বাসায় কেবল একটি মাত্র কাজের লোক। তারও কোন ঠিক ঠিকানা থাকে না। বুবাইকে যে লোকটা আদর করে না তা না! তবে কি সেও তো এক পুরুষ মানুষ। পাঁচ রুমওয়ালা এত বড় ফ্লাটে কতক্ষণ আর মন টেকে! দুনিয়ার মজা তো সব বাইরে! আমেনার মায়ের চায়ের দোকানে সে ই তো পান রাখার ব্যবস্থাটা করেছে…
মিতিরের খুব মায়া হয়েছিল! আবার কল করে সে..তারপর আবার… তারপর…
কেমন নেশার মত হয়ে যায়। প্রতিদিনই ফোন …
এই বাবু সোনার হাত ধরেই জহিরের সাথে পরিচয়। বুবাইয়ের বাবা। ভদ্রলোক একটি মাল্টিন্যাশনালে বেশ উঁচু পদে আছেন। দু’বছর হল স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি। তারপর আর বিয়ে করেনি। বুবাইয়ের জন্য যে নয় সেটা এতদিনে মিতির বুঝে গ্যাছে বেশ। ভদ্রলোকের আরো কারো সাথে কিছু একটা আছে..
কাজের লোক মতি মিয়ার কাছ থেকেও কিছু আঁচ পেয়েছে। এসব নিয়ে মাথা ঘামাতো মোটেই মিতির। কিন্তু ইদানিং ঘামাতে বাধ্য হচ্ছে।
ছোট মানুষদের সাথে সম্পর্ক একরকম চাওয়া পাওয়া ছাড়া হলেও বড় মানুষদের ক্ষেত্রে অনেক কিছুই পাল্টে যায়। ভদ্রলোক ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকবার ওর সাথে শোবার চেষ্টা করেছে।
মিতিরের বুবাইয়ের মা হতে আপত্তি নেই তবে তার আগে তার কিছু হতে আপত্তি আছে। সে আপত্তিও কত দিন ধরে রাখতে পারবে কে জানে!এই তো আজই পারছিল না।
৫.
সেই মানুষটাও এসে পড়েছে। এখন কাজে হাত দেয়া যেতে পারে অন্ধকারের মানুষগুলি তবু কেমন গতিহীন বিষন্নতায় ভোগে। উঠি উঠি করেও তাদের ওঠা হয়না। একজন অবশ্য তাড়া দেয়, তবে বাকীরা তেমন গা করে না। একজন তো পিচিক করে থুতুই ফেলে।
৬.
এই বাসায় মিতিরের যাতায়াত বেশি দিনের নয়। তবে ফোনের কল্যানে আগ থেকেই সে সবাইকে চেনে। বুবাই ছাড়াও জহির কিংবা মতি মিয়া দু’জনের সাথেই কথা হতো রোজ। বাসায় আসার আগ পর্যন্ত জহিরকে ভিষণ ভয় পেত ও। কি গম্ভীর একটা মানুষ! তার দুনো বয়েস হবে।
সেই গম্ভীর মানুষটাই যখন দীনের মত ওর দিকে হাত বড়ায় তখন কেমন একটা বোধ হয় মিতিরের। ঠিক রাগ নয়, ঠিক মায়া নয়। অন্যরকম। তাতে রাগও থাকে, মায়াও। এমনকি শরীরটাও বিদ্রোহী হতে চায়। ইচ্ছেরা জেগে ওঠে । ভদ্রলোক আকষর্ণীয়।
কিন্তু ঠিক কোথা থেকে জানা নেই অনিচ্ছারা হামলে পড়ে। এক ধাক্কায় নিয়ে আসে ওকে বুবাইর কাছে। ওর সর্বনাশের কারণই আবার রক্ষক হয়ে ওঠে।
আজও জহির ধরেছিল ওকে। মতি আর বুবাইকে পাঠিয়েছিল বাইরে। তারপর মিতিরকে ডেকেছিল। ঘরে কেউ না থাকলেও যে থাকা যায় সেইটুকু সম্পর্ক জহিরের সাথে তার আছে। অন্যান্য চাহিদার ফাঁকে ইতিমধ্যে তিন বার প্রপোজ করেছে ওকে জহির। না, বিয়ে করতে ওর অমত নেই। বাবা হয়ত মানবে না, তবু মিতিরের দ্বিতীয় বউ হতে আপত্তি নেই। এমনকি ওর ভার্সটির বন্ধু কাম একতরফা প্রমিককে ছাড়তেও কষ্ট হবে না।
বুবাই এখন ওর কাছে অনেক কিছু্।
আজ জহিরের সঙ্গ ভালই লাগছিল মিতিরের। কেমন ঘোর লাগা কথা! এক ফাঁকে বিয়ে থার কথাও হয়, আবারও। মিতির জানে এগুলি একরকম বাহানা। তবু ভালই লাগছিল। সময় কেমন করে কেটে যাচ্ছিল ও জানে না। এমনকি জহিরকে আজ একটু বেশিই সুযোগ দিয়েছিল। কিন্ত সেই বাধা, সেই ছিটকে বেড়িয়ে যাওয়া…মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্টের এই শেকল ভাঙতে সময় লাগবে তার।
মিতিরের শরীর ভালই জেগেছিল আজ। তাই রিকশায় উঠেও হাপাচ্ছিল। কোন ঘোরে রিকশা ঠিক করেছিল এখন আর তা মনে নেই। তবে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে যখন দেখে রাত সাড়ে দশটা তখন সব কিছুই মনে পড়ে যায় তার। মনে পড়ে বাসার কথা। মনে পড়ে সামনের অন্ধকার রাস্তাটাও। এমনকি ঘোরের মধ্যে খেয়ালও করেনি রিকশাওয়ালাকে। ভয়ংকর চোখ। লাল টকটকে। মাঝে মাঝেই সেই চোখে সে মিতিরকে দেখছে।
৭.
অন্ধকারর মানুষ গুলোর মধ্যে হঠাৎ একরকম চাঞ্চল্য দেখা যায়। কারণ বেশ দূরে একটা রিকশা দেখা যাচ্ছে। তাদের বড় কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য। একেক জন একেক দিকে ছড়িয়ে পড়ে। চারপাশ থেকে তাদের আসতে হবে। একেক জনের দায়িত্বও ভিন্ন। সেসব ভালই জানে তারা। তবে এই নির্জনে আর মুখ চেপে ধরার ঝক্কি নেই। খুবই রিস্কি কাজ। অনেকেই আতঙ্কে হাত কামড়ে দেয়।
৮.
এই রাস্তাটার অনেকটাই অন্ধকার। হঠাৎ মিতিরের রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়ে ফলল। আতঙ্কে মিতিরের পা কেঁপে উঠল। শরীরে বয়ে গেলো শীতল স্রোত। সে জানে এই রিকশাওয়ালাদের সাথে খারাপ লোকদের আতাত থাকে। তারা রিকশা থামাবে, ওরা নিশ্চিন্তে কাজ সারবে। মিতির তার মোবাইলটা শক্ত করে চেপে ধরে। এটা তার কোনো শক্ত আশ্রয় নয়, তবু কেনো যেনো চেপে ধরে অবলম্বন খোঁজে। বাবার ভয়ে সেটা এতক্ষণ বন্ধ করে রেখেছিল্। হৃদকম্পন দ্রুত হয়ে ওঠে মিতিরের। মোবাইলের সুইচটা অকারণেই টিপে দেয়। হাত ঘেমে ওঠে।রিকশাওয়ালা চেইন ঠিক করায় ব্যস্ত হয়। মিতিরের মনে হয়, স্লো-মোশন ছবির মতো আস্তে আস্তে সে চেইন ঠিক করছে! স্পষ্টই বোঝা যায় সে কারো অপেক্ষায় আছে।
৯.
অন্ধকারের মানুষেরা টর্চ জ্বেলে অন্ধকার বাড়িয়ে তোলে যাত্রীর। তারপর হামলে পড়ে রিকশায়।
১০.
মিতির দেখলো কেমন করে মানুষ সামান্য জিনিস আগলে রাখতে গিয়ে খুন হয়ে যায়। আর বেশি দেখার সময় সে পেলো না।
কারণ তার রিকশা তখন হাওয়ার বেগে ছুটছে। বিপদ দেখেই তার রিকশাওয়ালা পঙ্খীরাজ ঘোড়া ছোটায়।
চেইন পড়ার কারণে আক্রান্ত রিকশাটা মাত্রই তার রিকশাটা ক্রস করেছিল।
মন্তব্য
টাটকা গল্প।
শেষটায় চমক ভালই হয়েছে। দু একটা জায়গায় ছাপাখানার ভূত আছে, ও সেরে নেয়া যাবে।
আরও লিখুন।
---------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি কেবল...
সুন্দর।
_________________
[খোমাখাতা]
শেষের টুইস্ট টা ভালো হয়েছে, ভয়ে শক্ত হতে হতে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচলাম।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
শেষটা ভেবেই বাকি অংশের চেষ্টা
শেষের টুইস্ট টা ভালো হয়েছে, ভয়ে শক্ত হতে হতে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচলাম।
সহমত
সহমত
গল্প হঠাৎ এলেও তার আয়োজন চলতে থাকে সবসময়েই আমাদের ঘিরে, চুপিসারে বা অজান্তে।
লেখার হাত দেখে মনে হচ্ছে পরিচিত টিটো রহমানই হবে।
অনেক ভালো লাগলো।ধন্যবাদ।
নূপুর দা ভালো আছেন??
এই তো, আছি।
অনেকদিন পর তোমার লেখা পড়লাম।
শেষের চমকটা দারুণ! কিছু একটা চমক আছে বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু একদম শেষ লাইনটা না আসা পর্যন্ত বুঝতেই পারিনি। আপনার বর্ননাভঙ্গি চমৎকার।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
অনেক অনেক
সুন্দর লেখা
কিন্তু লেখাটা এপ্রিল ২৬, ২০০৯ এ ক্যাডেট কলেজ ব্লগে এবং আগস্ট ১৩, ২০১১ এ ফেসবুকের ভালবাসার গল্প পাতায় মিতির নামে প্রকাশিত হয়েছে। সচলায়তনে শুধুমাত্র 'মিতির' এর জায়গায় 'হঠাৎ গল্প' নামটাই পরিবর্তিত হয়েছে।
এটা যতদূর জানি সচলায়তনের নীতিমালা-এর পরিপন্থী।
নতুন মন্তব্য করুন