লেখার চেয়ে পড়তেই আমার বরাবর বেশি ভালো লাগতো। যদিও বর্তমানকালে আমার বই পড়ার সময় নেই, ধৈর্য্যও তেমন অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। রাতে ক্লান্তি নিয়ে বইয়ের পাতা খুললেই দু'চোখ বুজে আসে, যদিও আগের জন্মে আমি একনিষ্ঠ পাঠক ছিলাম। ইচ্ছে আছে আগামীবার আবারও পাঠক হয়ে জন্ম নেওয়ার। সেই নতুন পাঠক কোনদিন যেন আর নিহত না হয় সেই বিষয়ে লক্ষ্য রাখব।
বহু বছর আগে একটা বাড়ি দর্শন করেছিলাম, সেদিন মনে মনে একটা রচনা লিখেছিলাম। ওই দিনটা কথা এখনো মনে পড়ে। আজকের গল্প সেটা নিয়ে।
আজ থেকে অনেক বছর আগে আমি সাউথ ডেকোটার ছোট্ট একটা শহরে থাকতাম। ইন্টারস্টেট ২৯ এর উপর একশ ছাব্বিশ নম্বর এক্সিট – ওই এক্সিটের নিচে লেখা আছে লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডারের বাসভবন এখানে।
ভদ্রমহিলাকে আমি খুব ভালোভাবেই চিনি। তেজগাঁর বাসার ঘরে শুয়ে ওনার লেখা বই পড়ে বহু দুপুর আমি কাটিয়ে দিয়েছি, ওনার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বোন মেরিও আমার অচেনা নন। তেপান্তরের ওই শহরের অনেককেই আমি ভালোমত চিনি, একসময়ে বিটিভি ওদেরকে নিয়ে মাইকেল ল্যান্ডন নামে এক ভদ্রলোকের তৈরি করা একটা টিভি সিরিজ দেখাতো।
তেপান্তরের ছোট্ট শহর বইটা আমার পড়া প্রথম বইগুলোর একটা। ষাটের দশকে প্রকাশিত বই। আমার বই পড়ার বয়েস হতে হতে বইটার অবস্থা বেশ শোচনীয় হয়ে গিয়েছিল। মলাটটাকে বেশ কষ্ট করেই যথাস্থানে রাখতে হতো। মলাটের ছবিটা ছিল সবুজ ঘাসের মধ্যে হলদে হলদে ফুল – আর সম্ভবত একটা ছোট মেয়ে আর তার ছোট্ট একটা বাড়ি। কল্পনার পাগলকে উস্কে দেওয়ার জন্য দারুণ একটা আয়োজন প্রচ্ছদেই ছিল। আমি কোনোদিনই ভাবিনি যে সেই দেশে আমি একদিন যাব।
আমি থাকতাম লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডারের শহর ডে-স্মেট থেকে প্রায় এক ঘন্টা দূরে। ইয়াহু ঘেঁটে লরা ইঙ্গলস সম্বন্ধে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করি। উইকিতে তাঁকে নিয়ে লেখা [url= http://en.wikipedia.org/wiki/Laura_Ingalls_Wilder]আর্টিকেলটার[/url] লিঙ্ক দিলাম।
লরা ইঙ্গলসদের পরিবার আমেরিকার মিডওয়েস্টের অনেকগুলো শহরেই থেকেছিলেন। তবে তেপান্তের ছোট্ট শহর এই ডে স্মেটই। ১৯৯৮ সালেরর সাউথ ডেকোটার কথা একটু বলি। বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় শতকরা ৩৫ ভাগ বড় এই রাজ্যে বাস করত সাড়ে সাত লক্ষ মানুষ। এর মধ্যে এক লাখ লোকই থাকত রাজ্যের সবচেয়ে বড় শহর স্যু-ফলসে। আমার ধারণা মোহাম্মদপুরের কয়েকটা রাস্তাতেই সাত লাখের বেশি আদম সন্তান পাওয়া যাবে। মার্কিন দেশের অন্যান্য রাজ্যেও এতো কম মানুষ থাকে না।
আমেরিকার অন্যকোন রাজ্য থেকে এখানে আসলে বিরানভূমি মনে হতে পারে। অধিকাংশ শহরের লোকসংখ্যাই খুব কম, গাড়ি নিয়ে শহর পার হতে বড়জোর মিনিট দুয়েক লাগে। গ্রীষ্মের দিনগুলো মনোরম, সবুজ ঘাসের গালিচার ওপর হলদে রঙের ঘাসফুল – ঠিক ওই বইটার প্রচ্ছদের মত। বিংশ শতাব্দীর শেষে এসেও প্রায় তেপান্তরের মাঠই রয়ে গেছে এই রাজ্য। মার্কিন দেশের খুব কম লোকই ওই রাজ্যে স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য যান, ওই রাজ্যের জনসংখ্যা তাই বাড়ে না বললেই চলে। ডেকোটা রাজ্যের ঠাণ্ডা অত্যন্ত নির্দয়, যে একবার তার অত্যাচার দেখেছে, সেই পত্রপাঠ বিদায় নেবে সেই দেশ থেকে।
আমার অফিসের সহর্কমী যারা ছিলেন তাঁদের প্রায় সবাই স্থানীয় লোক। ওদের পূর্বপুরুষদের অনেকেই লরা ইঙ্গলসের আমল বা তারও আগে থেকে বসবাস শুরু করেছেন। তাদের কেউ কেউ ওই পরিবারের সাথে আত্মীয়তা বা অন্য সূত্রে জড়িত। সাধারণত দরিদ্র মানুষরাই ভাগ্যন্বেষণে ডেকোটা মুল্লুকে পাড়ি জমিয়েছিলেন। সরকার থেকে নাম-মাত্র মূল্যে জমি দেওয়া হতো - প্রতিকূল আবহাওয়া, স্থানীয় নেটিভ আমেরিকানদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের বেঁচে থাকতে হতো। অনেকটা পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি সেটেলার বা ইসরায়েলের ইহুদি বসতি স্থাপন করা হয়েছে যেই ভাবে - সেই ভাবে মার্কিন দেশ আস্তে আস্তে সাদা মানুষদের দখলে চলে গেছে।
আমার সহকর্মীরা ডেকোটা রাজ্য নিয়ে নানান গল্প বলত। ১৮৮০ সালের এক প্রবল শীতে আমার এক সহকর্মীর পূর্বপুরুষ তার দুই সন্তানকে হারিয়েছিলেন। সেবার এতো ঠাণ্ডা পড়েছিল যে মৃতদেহ সৎকার করার জন্য সেই পরিবারকে কয়েকমাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল। পুরোটা সময় ওদের মৃতদেহ বাইরের ঠাণ্ডায় রেখে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৮ সালের শীতকাল যেটাকে স্থানীয় লোক বলত “ওয়ার্ম উইন্টার” সেটা দেখেই আমি প্রায় কাবু হয়ে পরের বছরই পাট চুকিয়ে দেই ডেকোটার। তার আগের শতকের সেটেলারদের জীবন কি ভয়াবহ ছিল সেটা বুঝতে পারি, লরা ইঙ্গলস সেই সময়ের গল্পই এঁকেছেন। তবে কোনো সময়েই জীবন কোথাও খুব সহজ নয় – এই সত্যও বুঝে গেছি এতোদিনে।
ডে-স্মেটে যাওয়ার জন্য আমি ছটফটানি শুরু হয়। এটা প্রায় আমার শৈশবের তীর্থ দর্শন। মে মাসের শুরুতে এক সকালবেলা যাত্রা শুরু করি তেপান্তরের সেই শহরের দিকে। সমস্ত শীতকাল ডেকোটা রাজ্য বরফের স্তুপ থাকে, তাপমাত্রা কদাচিৎ হিমাংকের উপরে ওঠে বলে বরফ গলার ফুসরত মেলে না। মে মাসে তাপমাত্রা অনুকূল থাকলেও বরফের স্তুপ গলে শেষ হয় না তখনও। ওই সকালেও খুঁজলে রাস্তার পাশে বরফ মিলবে, নোংরা বরফের স্তুপের চেয়ে কুৎসিত জিনিস দুনিয়ায় বিরল।
নানান জিনিস ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম ডে-স্মেট। প্রায় দেড় ঘন্টার পথ। শহরটা ডেকোটা রাজ্যের অন্য শহরগুলোর মতোই অতি ছোট।
বাসাটা দেখেও বেশ হতাশ হলাম। পুরানো একটি বাসা - চারিদিকে ফাঁকা। অদূরে একটা নালা। একটা গিফট শপ আছে, জিনিস বিক্রি হচ্ছে অগ্নিমূল্যে। একটু পরেই বুঝতে পারলাম যে কল্পনার তীর্থে কখনো যেতে হয় না। কল্পনাকে বাস্তব কোনোদিনও অতিক্রম করতে পারে না। হাজার মাইল দূরে বসে হলুদ রঙের দুপুর বেলা আমি মনে মনে যেই শহরের ছবি এঁকেছিলাম – সেই তেপান্তরের শহরটাকে বাস্তব হারাতে পারবে না। কল্পনায় আমিও লরা আর মেরিদের সাথে বাস করেছি - ওদের প্রতিদিনের জীবনটাকে সামনে থেকে দেখেছি। হঠাৎ মনে পড়ে গেল তাঁর কথা যিনি এই বইগুলো বাংলাতে অনুবাদ করেছিলেন।
তিনি ছিলেন আমার শৈশবের কল্পনার রথের কারিগর। কৈশোরে এসে উত্তেজনা নিয়ে দেখেছি তাঁর আঁকা একাত্তুরের ঢাকা, নিমেষেই চেনা শহর যেন চলে গেছে হায়েনার দখলে। বারবার রুদ্ধশ্বাসে পড়ে গেছি সেই দিনলিপি, প্রতিবারই মনে হয়েছে এই বার যদি রুমিরা অলৌকিকভাবে বেঁচে যায়। যৌবনে এসে দেখেছি তাঁকে দুঃসাহসী এক মায়ের ভূমিকায়, একাত্তুরের ঘাতকের বিচারের দাবী নিয়ে সৃষ্টি করেছেন গনআদালত। সহ্য করেছেন পুলিশের নির্যাতন, মাথায় নিয়েছেন রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ। যেই রাষ্ট্র ঘাতককে ক্ষমতায় বসায় তিনি নিশ্চয় তার বিরুদ্ধে দ্রোহ করেছিলেন।
স্বাধীনতার পরের প্রথম প্রজন্মের আমি বড় হয়েছি সামরিক বুট, রাজাকার তোষণ, ঘাতকদের পুনর্বাসন আর উদ্ভট উটে চড়ে বসা পাকিস্তানগামী এক দেশ দেখে। তিনি যেন একাই সেই যাত্রা রুখে দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নবজাগরণ যেন হলো তাঁর হাত ধরেই। দুঃসাহসী এই মানুষটা ক্যান্সার নিয়ে বাস করতেন, সময় ছিল সংক্ষিপ্ত, জীবনের প্রতিটা মুহুর্তকেই যেন তিনি কাজে লাগিয়েছেন – যেন আমাদের জন্যই।
মে' মাসের সেই বিষণ্ণ সকালে ডে-স্মেট শহরে আমার শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কথাই বারবার মনে পড়ে গেল। সেই দিনটা ছিল তাঁর জন্মদিন। আজকেও তাই। কিছু কিছু মানুষ কখনো ফুরিয়ে যান না। তাঁরা হাসপাতালের শয্যা থেকেও লিখেন...
সহযোদ্ধা দেশবাসীগণ, আপনারা গত তিন বছর একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমসহ স্বাধীনতাবিরোধী সকল অপশক্তির বিরোদ্ধে লড়াই করে আসছেন। এই লড়াইয়ে আপনারা দেশবাসী অভূতপূর্ব ঐক্যবদ্ধতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আন্দোলনের শুরুতে আমি আপনাদের সঙ্গে ছিলাম। আমাদের অঙ্গীকার ছিল লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কেউ রাজপথ ছেড়ে যাবো না। মরণব্যাধি ক্যান্সার আমাকে শেষ মরণ কামড় দিয়েছে। আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাই নি। মৃত্যুর পথে বাধা দেবার ক্ষমতা কারো নেই। তাই আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি এবং অঙ্গীকার পালনের কথা আরেকবার আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। আপনারা আপনাদের অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণ করবেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে থাকবেন। আমি না থাকলেও আপনারা আমার সন্তান-সন্ততিরা - আপনাদের উত্তরসূরিরা সোনার বাংলায় থাকবেন। এই আন্দোলনকে এখনো অনেক দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মুক্তিযোদ্ধা, নারী, ছাত্র ও যুবশক্তি, নারীসমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই লড়াইয়ে আছে। তবু আমি জানি জনগণের মতো বিশ্বস্ত আর কেউ নয়। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। তাই গোলাম আযম ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের দায়িত্বভার আমি আপনাদের, বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পন করলাম। অবশ্যই, জয় আমাদের হবেই। জাহানারা ইমাম
শুভ জন্মদিন আম্মা। অবশ্যই, অবশ্যই জয় আমাদের হবেই।
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ মুফতি মুনির
মন্তব্য
শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে সালাম।
সুন্দর লেখাটার জন্য তাসনীম ভাইকে শুভেচ্ছা।
শুভ জন্মদিন আম্মা। অবশ্যই, অবশ্যই জয় আমাদের হবেই।
শুভ জন্মদিন আম্মা। অবশ্যই, অবশ্যই জয় আমাদের হবেই।
শুভ জন্মদিন আম্মা
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
১৩ বছর বয়সে যেদিন প্রথম "একতত্তুরের দিনগুলি" পড়ে কেঁদেছিলাম সেদিন থেকেই এখন পর্যন্ত নিজেকে গড়তে যার কথা নিজেকে বার বার মনে করিয়ে দেই সেই শহীদ জননীকে শুভ জন্মদিন।
শুভ জন্মদিন আম্মা
উনার ভাষণ শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল স্কুল জীবনে, নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয় সেই কারণে।
লরার বই এখনো প্রতিনিয়ত পড়ি, আপনি কি দ্য লং উইন্টারের কথা বললেন এইখানে? (গুড়)
facebook
হুম, লং উইন্টার স্থানীয় লোকেরা এটার কথা এখনো স্মরণ করে।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
খুব গভীর থেকে লেখা তাসনীম ভাই। জয় আমাদের হতেই হবে।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
জননীর জন্য ।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ভালো লেগেছে লেখাটা।
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
প্রথম প্যারাটুকু যেন ঠিক আমার মনের কথা তাসনীম ভাইয়া।
জননীকে শুভ জন্মদিন আর অসম্ভব সুন্দর এই লেখার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।
আম্মার জন্য শ্রদ্ধা।
শহীদ জননীর প্রতি
আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
শুভ জন্মদিন আম্মা। অবশ্যই, অবশ্যই জয় আমাদের হবেই।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
জননীর আদর্শ-নীতি আমরা যেন ভুলে না যাই।(মোম)
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
উনার মত নারী এই পৃথিবীতে খুব অল্প জন্মায়। জয় হোক, শুভ হোক।
ডাকঘর | ছবিঘর
আমার আদর্শ, প্রেরণা
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
ডি স্মেট শহরে যাওয়া হয়েছিল। জাহানারা ইমামের সেই অনুবাদ্গুলো আবার রিপ্রিন্ট হয়েছে, সংগ্রহ করে ফেলন আশা করি।
facebook
নতুন মন্তব্য করুন