হিসেব করে দেখলাম শেষ দিনলিপি লিখেছিলাম দুই বছর আগে। প্রতি দুই বছরে একটা দিনলিপি লিখলেই আমার চলে যায়। আমার দিনগুলি মোটামুটি একই রকমের, একদিন ডায়েরি লিখে কন্ট্রোল-সি দিয়ে কপি করে বাকি ৩৬৪ এর পাতায় পেস্ট করে দেওয়া যায়। সুতরাং প্রতি দুই বছরে একবার করে দিনলিপি লেখার অপরাধ অবশ্যই ক্ষমার যোগ্য।
প্রায় প্রতিদিনই আমার ঘুম ভাঙে সকাল সাড়ে ছয়টায়। ঠিক শখ করে যে আমি অত সকালে উঠি সেটা নয়। আগের দিনে চাইনিজ এলার্ম ঘড়ির ব্যবহার ছিল - ওইগুলোর কন্ঠস্বর ছিল ইভা রহমানের গানের মতো প্রলয়ংকরী। ওরা বেজে উঠলে কুম্ভকর্ণের পক্ষেও কঠিন হয়ে যেত কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা। মোটামুটি ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে উঠে যেতে হতো। ইদানিং স্মার্ট ফোনের এলার্ম ব্যবহার করে সবাই। ওদের গলার স্বর অনেক সুরেলা। ছয়টা থেকে মৃদু ডাকাডাকি করতে থাকে ওরা, প্রায় আধা ঘন্টা ডাকাডাকি করলে হুঁশ ফেরে।
আমরা ছোটবেলাতে প্রায় প্রতি শীতকালেই একবার পিকনিকে যেতাম। প্রতিবার একই জায়গায় যাওয়া হতো। শালবনের ভেতর সেদ্ধ ডিম, কলা আর পাঁউরুটি দিয়ে প্রাতঃরাশ সারতে হতো। চারিদিকে কুয়াশার চাদর ঠেলে সূর্য বের হতে চেষ্টা করেছে - এরই মধ্যে ঘুম ঘুম চোখে সেদ্ধ ডিমের জন্য সামান্য লবণ কোথায় পাব এই চিন্তা করছি। আশা আছে দুপুরের খাবারটা ভালো হবে।
সময় বাঁচানো এবং পরিস্কার করার ঝামেলা কম হওয়াতে এতো বছর পরে "সাড়ে ছয়" সকালে উঠে সেই একই খাদ্য খেতে হয়। বাইরে তখনও প্রায় অন্ধকার কুয়াশার স্তর। সেদ্ধ ডিমের জন্য লবণ খুঁজতে খুঁজতে বাইরের সেই কুয়াশার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয় - এই জীবন যেন দৈব এক পিকনিক, কিছু আনন্দ, কিছু অশ্রু, কিছু প্রত্যাশা আর কিছু সেদ্ধ ডিমের মিশেল।
-২-
সকালে বাচ্চাদের স্কুলে নামাতে মিনিট দশেক লাগে। সকালের এই দশ মিনিট আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ । সত্যিকারের খবরাখবর এই সময়েই পাই। বাকিটা সময় সব অর্থহীন খবর যেগুলো আমার কোন কাজেই লাগবে না। যেমন রিপাব্লিকান পার্টি ইলেকশনে ডেমোক্র্যাটদের ধরাশায়ী করে ফেলেছে।
"আব্বু ডু ইউ নো গর্ডি লেফট হোম?"
গর্ডি আমাদের প্রতিবেশির বিড়াল। প্রকৃতির পাঠশালাতে সে আমার শিক্ষক। ওর কথা শিশুপালনের এই পর্বে লিখেছি। একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে আমি আমার পাড়ার মানুষদের প্রায় কারোর নামই জানি না - দুই-একজন বাদ দিলে। কিন্তু প্রায় সবার পোষা পশুদের নাম জানি। গর্ডির গৃহত্যাগ আমার জন্য নতুন খবর। জিজ্ঞেস করলাম সে কেন গৃহত্যাগ করল।
"হি ওয়ান্টেড টু লিভ হিজ ওউন লাইফ...সো হি লেফট হোম..."
এক সময়ে চে-গুয়েভারার বিপ্লবী জীবন আমাদেরকে স্বপ্ন দেখাতো। বলিভিয়ার জঙ্গলে উপুড় হয়ে থাকা তাঁর মৃতদেহ আমাদের অপরাধী করে দিতো। কিন্তু বর্তমানের ছাপোষা জীবন এমনই এক জায়গাতে নিয়ে গেছে যে আমি গর্ডিকেও একটু একটু ঈর্ষা করা শুরু করি।
গাড়িতে টেইলার সুইফট গান গেয়ে চলছে। এর গান চলার সময় কথাবার্তা বন্ধ রাখতে হয়। গাড়ি স্কুলের নির্ধারিত জায়গাতে এসে থামতেই গানটাও শেষ হয়। মেয়েরা খুশি হয়। এইগুলো হচ্ছে মসৃণ দিনের লক্ষণ। দিন খারাপ হলে এই গানটা হয়তো এখনই শুরু হতো। দিনের শুরুটা ছোট-বড় নির্বিশেষে সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ । ইংরেজি একটা কথা আছে - মর্নিং শো'জ দ্য ডে।
হ্যাভ অ্যা গুড ডে ড্যাড...গাড়ির দরজা বন্ধ করে মেয়েরা স্কুলে ঢুকে পড়ে।
ক্রসিং গার্ড হাতের ইশারা দেয় - গাড়ি আস্তে আস্তে সরাতে হবে।
গাড়ির রেডিওতে ডিজনি চ্যানেল পাল্টে নিউজ চ্যানেল দেই। দিনটা শুরু করতে হবে।
-৩-
মার্কিন দেশে গাড়িতে দিনের অনেকটা সময় কেটে যায়। গাড়ির রেডিও সেই সময়ের বিনোদনের উৎস। রেডিওতে গানবাজনা শোনা উচিত, কিন্তু আমার খবর শোনাটা প্রায় নেশার মতো হয়ে গেছে। অফিসে যাওয়ার এবং আসার পথে প্রতিদিন রেডিওতে খবর শুনি। ন্যাশনাল পাব্লিক রেডিও অথবা বিবিসির নিউজ চ্যানেল। যদিও বিশ্বের যাবতীয় খবর আমার কাছে অ-দরকারি মনে হয় তবুও প্রতিদিন টিভি, রেডিও, অনলাইন মাধ্যমে আমি দুনিয়ার খবরাখবর নেই। ছোটবেলাতে আম্মা খবরের কাগজ পড়ার জন্য উৎসাহিত করতেন - তখন থেকেই আমার এই অভ্যাস। এতে আমার কোন উপকার সাধিত হয় নি, কিন্তু পৃথিবী যে খুব খারাপ জায়গা সেই ধারণা পরিস্কার হয়ে গেছে।
বিবিসিতে ইরানের উপর একটা নিউজ হচ্ছিল। ইরানের মোল্লাতন্ত্র সমকামিতাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো অপরাধ বলে গণ্য করে। কিন্তু লিঙ্গ পরিবর্তনের সার্জারি সমর্থন করে ওরা কেননা আয়াতুল্লাহ খোমেনি ফতোয়া দিয়েছিলেন যে নারীর শরীরে পুরুষ বা পুরুষের শরীরে নারী বন্দি হয়ে থাকতে পারে। সমকামিদেরকে ওরা এই অপারেশন করে লিঙ্গ পরিবর্তন করে নিতে বলে। অর্থাৎ সমকামিতা স্বাভাবিক ব্যাপার নয়, কাঁচি চালিয়ে একটাকে বিপরীত লিঙ্গ করে ফেললে সমস্যা মিটে যায়। সেই কাঁচির হাত থেকে বাঁচার জন্য যাদের উপায় আছে তাদের অনেকেই পালিয়ে যায় - এদেরই একজনের সাক্ষাৎকার শুনছিলাম।
ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলে - খবর জিনিসটাই খারাপ একটা ব্যাপার। কোনদিন খবর আসে না যে আজকে পৃথিবীর সর্বত্র আনন্দের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে, কেউ না খেয়ে নেই, একটু পরেই সুখী মানুষদের প্রেস কনফারেন্স সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। আমরা পয়সা খরচ করে রেডিও, টিভি, পত্রিকা কিনি এই দুঃসংবাদের জন্য।
পৃথিবীর কতজন মানুষ সুখে আছে? ঠিক কী অবস্থায় থাকলে মানুষ সুখে থাকে? চিরকাল ব্যাপিয়া সুখ বলে কিছুই নেই, কিন্তু গড়পরতা হিসাব নিলে কি মানুষকে সুখী একটা প্রজাতি বলা যাবে? মাথায় বুদ্ধি বেশি থাকলে সুখ কম থাকে। আমার সন্দেহ হয় সুখের হিসাবে মানুষের প্রাণীজগতের মধ্যে "লাস্ট" হওয়ার সম্ভাবনা আছে। গর্ডির গৃহত্যাগের ব্যাপারটা আবার মাথায় ফিরে আসে। চিন্তার জট কাটাতে সিডি লাগিয়ে দেই।
যদি ভেস্তে যাইতে চাও গো
অন্তরে রাইখো আল্লাহর ডর।
যদি আল্লাহর সন্ধান চাও গো
প্রেম রাখিও অন্তরের ভিতর।
ব্রেকার লেইনের সিগনালটা পার হতেই দুই-তিন মিনিট লেগে যায় কোন কোন দিন। চারিদিকে সকালের প্রসন্ন আলো। সকালের ভিড় এখনও কমেনি। প্রতিটি মোড়ে একজন করে ভিখিরি। সকালবেলাটা ওদেরও ব্যস্ত যায়।
গানটা পার্কিং লটে ঢোকার সাথে সাথে শেষ হয়। একেকটা দিন মসৃণ, ভোর থেকে শুরু করে রাতের শয্যা। অফিসের ব্যাজটা বেল্টে লাগিয়ে ঢুকে পড়ি অফিসের ভেতর। বেহেস্তের লোভ করি নাই, নাই দোজখের ভয় - গুনগুন করতে করতে দিনটা সত্যি সত্যি শুরু করে দেই।
-৩-
"ইলেকশনের রেজাল্ট দেখছ? ওবামার তো প্যান্ট খুলে দেওয়ার মতো অবস্থা।"
আমি রাজনীতিবিমুখ নই। কিন্তু মার্কিন দেশের রাজনীতি আমার কাছে সকালে ঘুম ঘুম চোখে খাওয়া লবণহীন সেদ্ধ ডিমের মতোই লাগে। ভোট দিতে গিয়েছিলাম। ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে ব্যালট পেপার ছিল ১৩ পৃষ্ঠা। একটা মিছিল নেই, মিটিং নেই - কে দাঁড়িয়েছে, কেন দাঁড়িয়েছে, আর কি কি ইস্যু থাকবে ব্যালটে এই প্রতিটি ব্যাপার গবেষণা করে ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়। ঠিকঠাক মতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করার চেয়ে ডিফারেনশিয়াল ইক্যুয়েশন সমাধান করা সহজ কাজ মনে হয় আমার। সম্ভবত এতো কষ্ট করতে হয় দেখে এই দেশের ভোটে মানুষের উপস্থিতি কম হয় বলে আমার মনে হয়। ভোটের কথা চিন্তা করলে বাংলাদেশ গণতন্ত্রকে আক্ষরিক অবস্থায় জনগণের দোরগোড়াতে পৌঁছে দিয়েছে, অর্থাৎ সারাদিন ঘরে বসে থাকলেও ভোটের সময় কিছু না জেনে থাকার উপায় নেই। আর পুরো ভোটে সিল মারতে হবে মাত্র একটা।
ডেমোক্রেটদের বিরাট পরাজয় হওয়ার সম্ভবনা মিডিয়াতে বলা হচ্ছিল। আমি পুরো বিশ্বাস করতে পারিনি। সাহেব-বিবি-গোলামের বাক্স দেখে দেখে বড় হওয়ার কারণে নিউজ মিডিয়া নামক পুরো ব্যাপারটার উপরেই আমার একটা চিরস্থায়ী সন্দেহ জন্মে গেছে।
রিপাব্লিকানরা গ্লোবাল ওয়ার্মিং এ বিশ্বাস করে না, পাঠ্যসূচি থেকে বিবর্তন বাদ দেওয়ার পক্ষপাতী, গর্ভপাত বিরোধী, বন্দুক বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দিতে কোন রকম আগ্রহী নয়, যুদ্ধ করে নিজের দেশসহ পৃথিবীর নানান দেশের লালবাতি জ্বালানোতে আগ্রহী...এই দল মধ্যবর্তী নির্বাচনে জিতবে কেন? মার্কিন অর্থনীতি কিছুটা মন্দা কাটিয়ে উঠেছে। গত কয়েক বছরের তুলনাতে আমেরিকার অবস্থা ভালোই বলা যায়, এরপরও মানুষ পরিবর্তন চায়? ছাগুর বাম্পার ফলন শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবী জোড়া এর বিস্তার ঘটেছে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় বিশ্বব্যাপি ছাগু বেড়ে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করার জন্য গবেষণা হওয়া উচিত।
সামনে যেই ছাগুটা বসে আছে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারি। অফিসে সেগুন কাঠের একটা ক্রশ আর বাইবেল রাখা। মুখভর্তি হাসি, যেটা প্রায় সব সময়ে লেগে থাকে, আজ নির্বাচনের পরে সেটার পরিধি আরও বেড়েছে। ক্রিস টি-পার্টি রিপাব্লিকান।
"আগামী প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে রিপাব্লিকানরাই ক্ষমতায় আসছে..."
ক্রিসের বক্তব্যের শেষে অনুক্ত "ইনশাল্লাহ" শব্দটাও আমি যেন শুনতে পাই। আমার নিজেরও সন্দেহ সেটাই।
নিজের অফিসে ঢুকে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে থাকি। গানের চেয়ে বড় ওষুধ নেই।
"আমার বন্ধু দয়াময়,
তোমারে দেখিবার মনে লয়..."
রিপাব্লিকান পার্টির বিজয় আমাকে একটু চিন্তিত করে দেয়। ৯/১১ এর পরে ১৩ বছর কেটে গেছে। আইসিস সহ সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর প্রায় প্রতিটিই মুসলমানদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। মার্কিন সাধারন মানুষদের মধ্যে মুসলমান বিদ্বেষ বেড়ে চলেছে। শুধু রক্ষণশীল নয়, লিবারেল মানুষেরাও আস্তে আস্তে ক্ষেপে উঠছেন। সরকার থেকে আস্কারা আসলে সেই বাড় আরও বাড়ে, বিএনপি-জামাতের জোটের সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের মাত্রা অনেক অনেক বেশি ছিল। সামনে খারাপ দিন আসছে।
কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করি।
-৪-
"এই প্রজেক্টের এপ্রিল মাসের বদলে ফেব্রুয়ারি মাসে শেষ করতে হলে কি করা যেতে পারে...এই ধরো টিমে আমি আরও দুইজন লোক দিলাম, এতে কি এটা সম্ভব হবে?"
প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট সম্বন্ধে অফিসে প্রচলিত অনেকগুলো রসিকতার একটা হচ্ছে, যদি একজন মেয়ে দশমাসের একটি বাচ্চা ডেলিভারি দিতে পারে, তবে দশজন মেয়ে নিশ্চয়ই এক মাসে একটা বাচ্চা ডেলিভারি দিতে পারবে। ঐকিক নিয়মও ঠিক তাই বলে।
মিটিং-এ বসে আমি মানুষজনের কথা শুনি।
আমার নিজের জীবনই এতো বোরিং নাকি সবারটাই তাই? বয়স্ক লোকজনদের প্রায় সবার জীবনই বেশ বোরিং হওয়া কথা। আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন ক্লাসরুমের পেছনে শব্দ না করে কাটা-গোল্লা খেলা, কার্টুন আঁকা, গল্প চালিয়ে যাওয়ার নিয়ম ছিল। বড় হলে সেই সব আর করা যায় না। বোরিং সব আলোচনাতে গম্ভীর মুখে অংশগ্রহন করতে হয়। বাচ্চাদের জগতে প্রতিদিনই নতুন কিছু না কিছু ঘটছে, ওদের ডায়েরির পাতা প্রতিদিন ভরে উঠে বিচিত্র সব গল্পে। অথচ আমি দুই বছরে একবার দিনলিপি লিখলেও চলে যায়।
ছোটবেলাটা যদি টি-২০ ম্যাচ হয়, তাহলে বড়বেলাটা হবে টেস্ট ক্রিকেট। আর বিদেশে আসলে সেটা মেগাসিরিয়ালের আকার ধারন করে। হয়ত গৌতম বুদ্ধও এইসব কারনেই হয়ত "আই ক্যান্ট টেইক ইট এনিমোর" বলে সংসার ত্যাগ করেছিলেন।
আমার আবারও ঘরছাড়া বিড়াল গর্ডির কথা মনে পড়ে।
মিটিং এ আলোচনা অনেক গভীরে চলে গেছে। আমি চিন্তা করছি যে এই চাকরি না করলে আমি আর কি করতে পারতাম। আমি কৃষিকাজ জানি না, গান গাইতে পারি না, পরিশ্রম করতে ইচ্ছুক নই - শুধু লিখে কিছুটা আরাম পাই। কিন্তু লেখালেখি করে জীবিকা নির্বাহ করতে চাইলে সেই আনন্দটা আর থাকতো না - সুতরাং কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে - পুণর্মূষিক ভব - অর্থাৎ যেই কাজ করছি সেটাকেই ভালোবাসার চেষ্টা চালিয়ে যাই।
এই লোকগুলো কখন কথা বন্ধ করবে?
যত তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে পারবো ততক্ষণ সময় পাওয়া যাবে বাচ্চাদের সাথে।
-৫-
"আব্বু কাম অন ব্যাক হিয়ার..."
বাচ্চাদের ডাক শুনে আমি বাসার পেছনে গিয়ে দাঁড়াই। বেড়ার পেছনে একটা খালি মাঠ আছে, ঝোপঝাড়ে ভর্তি।
"লুক দেয়ার...গর্ডি..." উত্তেজিত কন্ঠে মেয়ে আঙ্গুল তুলে বিড়ালটাকে দেখায়।
আমিও দেখতে পাই। মাঠের মাঝে দাপাদাপি করছে। বোঝাই যাচ্ছে বাসা ছেড়ে এই জঙ্গলে আস্তানা গেড়েছে সে।
আমরা বিস্মিত চোখে গর্ডির কার্যকলাপ দেখি। দেখে মনে হচ্ছে সে মহানন্দে আছে।
"আব্বু, গর্ডি হ্যাড অ্যা লট অফ ফুড অ্যাট হোম, হোয়াই ডিড হি চুজ টু লিভ?"
কথাটা ভেবে দেখার মতো। যেই বাসাতে সে থাকতো সেখানে তার অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সমস্যা ছিল না। সেন্ট্রাল এসির ভেতরে থাকতো পারতো চব্বিশ ঘন্টা।
তবুও সে কেন এতো আরাম ছেড়ে এলো?
সারাদিন অন্ন-বস্ত্র আর বাসস্থানের চিন্তাতে দৌড়ানো মানুষের পক্ষে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব কঠিন হবে। আমরা কঠিন এক বাজার ব্যবস্থা তৈরি করে সেখানেই আটকে গেছি। এখান থেকে বের হওয়া নির্বাণপ্রাপ্তির মতোই কঠিন কাজ।
সন্ধ্যাতে অনেক কাজ আছে। বাচ্চাদের হোমওয়ার্কে সাহায্য করা, রাতের খাবারের শেষ থালাবাটি পরিস্কার করা, খবর দেখা, কিছু ফোনালাপ সারা...চায়ের কাপ নিয়ে আমি তাড়াহুড়া করে বাসায় ঢুকে পড়ি।
-৬-
"ডু ইউ নো হোয়াট হ্যাপেন্ড ইন আওয়ার স্কুল টুডে?"
আমি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাই।
"দিজ বয় জোনাথন ইজ সো নটি...হি হি হি..."
ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেটার সাথে আমার বাল্যবন্ধু রঞ্জনের সাঙ্ঘাতিক মিল পাওয়া যায়। বর্তমান রঞ্জনকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না - মধ্যপ্রাচ্যের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর সে - দাড়ির দৈর্ঘ্য বেড়েই চলছে। শুনেছি ওর বউয়ের সামনে পরপুরুষের যাওয়াও এখন নিষেধ। দুটি সরলরেখা একবারের বেশি ছেদ করতে পারে না। বাল্যবন্ধুরা সেই সরলরেখার মতো, শৈশব থেকে দূরে গেলে ব্যবধান বাড়তেই থাকে।
গল্প শুনতে শুনতে আমার আনন্দ লাগে। আমি যেন টাইম মেশিনে চড়ে বসেছি। চোখে ঘুম আস্তে আস্তে জড়িয়ে আসে। সারাদিনের বিরক্তিকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় নিয়ে আসি। দিনের শেষ মনে হয় এই বেশ ভালো আছি। একটু হাসি, একটু কান্না, একটু সেদ্ধ ডিম...এসেছি যেন এক দৈব পিকনিকে...
ছিঁড়েছে সম্রাজ্য ঢের, নতুন বসতি
পুরোনো হবার আগে দু‘বার উল্টায়
দিকে দিকে গণভোটে রটে যায় বেশ্যারাও সতী
রং পলেস্তারা পড়ে দেয়ালের চলটায়।
এরকম চলে আসে, তবু নিরালায়
ছোট এক কবি বলে যাবে সিধে কথা
সূর্যাস্তের অগ্নিপ্রভা লেগে আছে আকাশের গায়
জীবনই জীবন্ত হোক, তুচ্ছ অমরতা।
(এই জীবন/ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
মন্তব্য
রাইখা গেলাম আগেই
লেখা না পড়েই ইস্টক বর্ষণ?
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
আহা!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ধন্যবাদ।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
০১
প্রতিটা দিন যে আসলে আগের দিনটার কপি পেস্ট, এই সত্যটা আমি আবিষ্কার করি আন্ডারগ্র্যাড শেষ করে চাকরিতে ঢোকার পর। একই রুটিনে, একই গতিতে, প্রায় প্রতিদিনই একই কাজ করে যাওয়া। এর মধ্যে শুধু স্বস্তির ছিলো, প্রতি সন্ধ্যায় আড্ডা। এই একটা কাজই দৈনিক একই রুটিনে করার পরও বিন্দুমাত্র ক্লান্তি আসেনি। অথচ এর আগে যখন ছাত্র ছিলাম, তখন কখনোই জীবন সত্যিকার অর্থে বোরিং লাগেনি। মাঝেমাঝে আহা উহু করেছি, কিন্তু সেইগুলা একধরনের দুঃখবিলাস। বিরক্তিকর বোরিং জীবনের চেহারা দেখার শুরু চাকরিতে ঢুকেই।
এরপর দেশ ছাড়লাম, আবার পড়াশোনা শুরু করলাম। কিন্তু জীবন আর প্রথমবারের সেই ছাত্রজীবনের মতো সহজ থাকলো না। বরং চাকরিজীবনের চেয়েও বহুগুণে, ঘোরতর কঠিন হয়ে গেলো। এইটাকে নিয়তি মেনে নিয়েছি- আমি জানি, দিন যতোই যাবে, এ শুধু খারাপই হবে।
০২
গর্ডির সম্পর্কে শেষের আগের প্যারাটা পড়ে জীবনানন্দের আট বছর আগে একদিন কবিতার কথা মনে পড়লো। বিপন্ন বিস্ময় যে শুধু মানুষ না, প্রাণীকূলের অন্যান্যদেরও সমস্যা, সেটা জেনে ভালো লাগলো!
০৩
আপনার আরো নিয়মিত দিনপঞ্জী লেখা উচিত। লেখাতে
অলমিতি বিস্তারেণ
আট বছর আগে কবিতাটা ব্যবহার করতে গিয়েও করিনি। এই লাইনগুলো।
অর্থ নয়, র্কীতি নয়, সচ্ছলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত ক্লান্ত করে
কপি-পেস্ট জীবনের ভবিতব্য মনে হয়।
ধন্যবাদ।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
আপনার লেখা ভাল্লাগে, প্রতি দুই বছরে একটা দিনলিপি লিখলেই আপনার চললেও আমাদের চলে না। অন্তত মাসে একটা আসাই উচিত।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
কিন্তু এতো ঘটনা কই পাবো?
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
আমাদের জন্য হলেও কিছু ঘটনা ঘটান
১। কিছু কিছু অ্যালার্ম আসলেই ঘুম পাড়িয়ে দেয়। কিছু কিছু অ্যালার্ম যেগুলো আগগে ব্যবহার করেছি, সেগুলো শুনলে পুরোনো সময়ের কথা মনে পড়ে।
২। বিড়ালকে নাকি স্পে বা নিউটার না করলে এরা এমন পালিয়ে যায় শুনেছি।
৩।
-কারণ মানুষ নিজেই জানে না সে কি চায়, আর কিছু পেলে সেটা দিয়ে কি করবে সেটাও জানে না, তাই কেবল পরিবর্তন চায়।
৪। অ্যাডমিরাল জেনারেল আলাদিন বলছিলেন, 'মিডিয়া একটা আজব জিনিস। জনস্বার্থে কোন কাজ করলে সেই কাজের বিরুদ্ধে জনগনকে ক্ষেপিয়ে তোলার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে মিডিয়ার'। কাজেই, ফক্স নিউজের দর্শক কম না, আর উজবুকও দুর্লভ না।
৫। জনাব রঞ্জনের ঘটনা শুনে মজা লাগলো। কত কত 'দুষ্ট ছেলেপেলে' লাইনে চলে আসলো, তার হিসেব নাই।
শুভেচ্ছা
সহমত
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
মানুষ যত বেশ নিজ ধর্মের প্রতি একনিষ্ঠ এবং অন্ধভক্ত হয়ে উঠবে ততই অন্য ধর্মকে কতল করার পণে সক্রিয় হয়ে উঠবে আর পৃথিবীতে অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে। আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর সবখানেই হয়তো এখন চর্চা বিরাজমান।
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
দিনে দিনে এই জিনিস বাড়ছে।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
১। কিছু কিছু অ্যালার্ম আসলেই ঘুম পাড়িয়ে দেয়। কিছু কিছু অ্যালার্ম যেগুলো আগগে ব্যবহার করেছি, সেগুলো শুনলে পুরোনো সময়ের কথা মনে পড়ে।
সহমত।
২। বিড়ালকে নাকি স্পে বা নিউটার না করলে এরা এমন পালিয়ে যায় শুনেছি।
রাইট। প্রায় সবাই মালিকই সেটা করে, পোষার সুবিধার্থে। গর্ডি ব্যতিক্রম।
মিডিয়া আসলেই অদ্ভুত। অ্যাডমিরাল জেনারেল আলাদিনের সাথে আমিও একমত।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
আপনার পিচ্চি দুইটার কথাবার্তা রেকর্ড করে ফেললেই তো হয়ে যায়!
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
ভালা বুদ্দি
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
চারপাশ থেকে আসা খবরগুলো টুটি চেপে ধরে। ভাল থাকার সহজ উপায় খবর পড়া/দেখা ছেড়ে দেয়া - অনেক ভেবেছি; কাজ হয়নি।
এতো সহজ কথাটা বুঝতে মানুষের যত কষ্ট!
পুরো দুনিয়াটাই কেমন জানি ছাগু বান্ধব লাগে, সামনে আরো খারাপ দিন আসছে...
পোষ্য কলঙ্ক গর্ডির ঘুচে গেল, ও এখন স্বাধীনভাবে মরতে পারবে! - অন্তত এটাই একটা ভাল খবর
লেখা বরাবরের মতই অসাধারণ লাগলো।
ধন্যবাদ। খবর দেখা ছেড়ে দেব এই প্রতিজ্ঞা অনেকবার করেছি। সিগারেট ছেড়ে দিতে পারলেও খবর ছাড়া হয় নি আর।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
খুব ভালো লেগেছে, ভাই।
ধন্যবাদ শিবলী।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
আপনার দিনপঞ্জি আরেকটু ঘন ঘন আসলে ভাল হত!
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
ভাবছি এই লেখাটা কপি পেস্ট করে আবার সামনের সপ্তাহে পোস্ট করব
ধন্যবাদ মরুদ্যান।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
ধন্যবাদ।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
পরে আবার আসতে পারবো কিনা তাই এখনই চিহ্ন রেখে যাই। ছাড়াছাড়া ভাবে পড়লাম। যথারীতি মনে হল--কিভাবে লেখেন!
ধন্যবাদ। পরে ফিরে এসে আবারও পড়বেন এই আশা রাখি
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
কি সুন্দর লেখা! এরকম লেখা প্যারা অদলবদল করে, লাইনের শুরু শেষ পালটে মাসে মাসে একবার দিলেই পারো ভাইয়া!
তোমার মেয়েদুটোই বেশ মজার! ওদের সাথে বিছানার তোষক নামিয়ে গ্লেসিয়ারে স্কেটিং করার গেইমের কথা মনে পড়ে গেলো!
আবার কোনও একদিন খেলা হবে ওদের সাথে!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
দেখা অবশ্যই হতে পারে অদূর ভবিষ্যতে
আমার হাতে আরেকটু সময় থাকলে আমি আরও বেশি লিখতাম। লিখে আমিও বড় আনন্দ পাই।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
ভীষণ ভালো।
শুভকামনা জানবেন। অনিঃশেষ। সবসময়।
দীপংকর চন্দ
ধন্যবাদ দীপংকর, শুভকামনা রইল।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
চমৎকার একটি লেখা পড়লাম। শুভকামনা।
ধন্যবাদ আপনাকে।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
বরাবরের মতই চমৎকার তাসনীম ভাই।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
ধন্যবাদ জাহিদ।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
আমিও একদিন গর্ডি হব।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
নতুন মন্তব্য করুন