বেশ বুঝতে পারছি আজকে আমার খবরই আছে। মাত্র্র দেখলাম আজগরের ঠোঁটে স্যার কসকো সাবান লাগিয়ে দিয়েছেন। আমার কি হবে আজকে কে জানে। এক কানে হাত আর এক হাতে বই নিযে রচনা মুখস্হ করতে দেয়া হয়েছে আমাকে। কিন্তু পড়ায় আমার মন নেই। আজগরের শুকনো মুখ দেখে আমার খুব হাসি আসছে। ওদিকে আপুদের মুখও আমশি। স্যার এবার আমার দিকে মাথা ফিরালেন। তাড়াতাড়ি মাথা নামিয়ে মন দেই রচনা মু্খস্হ করায়।
এবার আজগরকে স্যার পড়া ধরছেন। পারেনি। শাস্তি হল দাঁত দিয়ে দরজা খুলে বুয়াকে বলতে হবে কড়া করে এক মগ কফি আনতে। আমার কাঁপাকাঁপি শুরু হল আজগরের দশা দেখে। দম বন্ধ করে রচনা মুখস্হ করতে থাকি। একে একে সবার পড়া দেয়া হয়ে যায়। আজকের মতন আজাবের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে সবাই খুশি। স্যার সবে ফেরদৌস আপুকে প্রথম আলো পড়তে দিয়েছেন। আপু আর স্যার চরম কথা কাটাকাটি করছে গল্পের চরিত্র নিয়ে। এসবে আমার মন নেই। কি করে আমি স্যারের হাত থেকে মুক্তি নিয়ে নিচে খেলতে যাব তাই নিয়ে আমার আজকের দুঃচিন্তা। স্যার কফির মগে দু চুমুক দিয়ে মগ সরিয়ে রাখলেন। লুনা আপু কড়া চোখে তা দেখছে। তার মতে স্যার যদি অতগুলো কফি নাই খাবেন তবে নস্ট করার জন্যে মগ ধরে বানাবেন কেন? আমাদের চারজনের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে বুদ্ধিমতি বলে স্যারের বিশ্বাস। কারণ লুনা আপু সবার আগে পড়া দেন এবং খুব সুন্দর করে পড়া ঝরঝর মুখস্ত বলতে পারেন।
এদিকে আমার পড়া ধরার আগ দিয়ে স্যারের মুড হঠাৎ করেই যেন ভাল হয়ে গেল। আমাকে স্যার রচনা মুখস্হ লিখতে দিলেন। আমার খুব খুশি লাগছে। কারণ ‘অধ্যাবসায়’ এর শেষ দু প্যারা তখনো মুখস্হ হয়নি আমার। মুখস্হ বলতে গেলে কান টানা নিশিচত! লিখতে বসে দেখলাম আপুদের বাসায় পড়তে আসার আগে ব্যাগে করে আজকেও কলম আনা হয়নি। স্যারের চোখে চোখ রেখে আস্তে করে কলমদানির দিকে হাত বাড়ালাম। দানিতে হাত রাখার আগেই টের পেলাম আমার হাতে কে যেন কলম তুলে দিয়েছে। ফিরে দেখি লুবনা আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করছে। তাড়াতাড়ি কলম হাতে তুলে মোটা করে প্রায ১৬ ফন্ট দিয়ে খাতার অনেকটা জুড়ে লিখলাম ‘অধ্যাবসায়’। এবার মুখ তুলে তাকালাম। শুনছি স্যার হা-বিতং করে বলছেন কেন তিনি দোজখে যেতে চান। নামটি হিন্দু ধর্মালম্বীদের হলেও নাস্তিক স্যার ধর্ম নিয়ে কথা তুললেই দোজখে যাবার সুবিধাগুলো খুব ভাল বলতে পারেন। স্যার আজকেও বণর্না করছেন কি করে সহজেই মাধুরি, জুহিদের সাথে নাচগান করবার পথ হতে পারে দোজখ। বাকি সবার পড়া শেষ। তারা মজা নিয়ে স্যারের কথা শুনছে। আমিও মোটা দাগে ‘অধ্যাবসায়’ লিখে হা করে স্যারের কথা গিলছি আর সবার সাথে গলা মিলিযে হি হি হাসছি। হঠাৎ স্যার উনার নিস্ঠুর, ক্রর চোখে আমার দিকে তাকেতেই ঝটিত বেগে খাতার মধ্যে সদ্য শেখা বিদ্যা উগ্রে দিতে লাগলাম।
আজকেও স্যারের পড়া তৈরি করতে পারিনি আমি আর আজগর। স্যার আমাদের ডায়রি হাতে নিয়ে নিস্ঠুর হাতে লিখে দিলেন-- আবার। দিনে দিনে আমার ডায়রির পাতা ভরে উঠছে আবার দিয়ে। সেদিকে আমার মন নেই। আমার যত মন সদ্য শুরু হওয়া ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেটে। বাসায় বাবা, আমি আর মেঝ বোন বাজি ধরেছি কোন দল কাপ জিতবে তা নিয়ে। যে জিতবে নগদ ২০,০০০ টাকা পাবে বলে বাবা ঘোষণা দেয়। যার যার পছন্দ ছোট কাগজে লিখে বাবার কাছে দেয়া হয়েছে। সুবিধা বুঝে একদিন আমি পালটে দিলাম আমার চিরকুটটি। ধরাও পড়ে গেলাম শিগগিরি। তবুও আমার আক্ষেপ নেই। এসবেরই মাঝে বাড়ি পালিয়ে নিচে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারি। পড়া ফাঁকিও সমান তালে চলছে।
মাঝে মাঝে স্যারের কাছে ইসলাম শিক্ষা পড়া মুখস্হ দিতে হচ্ছে। কিন্তু কিছুই শেখা হয়না। ইসলাম শিক্ষা পড়তে বসলেই ভেসে আসে স্যারের কথা- কি করে ধর্মের অজ্ঞতা দিয়ে স্কুলের ছেলেমেয়েদের মাথা নস্ট করা হচ্ছে। কিংবা আসলে ইসলাম আমাদের কি শিক্ষা দিয়েছে আর আমরা কি করছি। স্যারের কোরান, হাদিস সম্পর্কে সম্মক জ্ঞান দেখে আমার ভিরমি খাবার জোগাড়।
বাদল স্যারের মতন এমন জাঁদরেল আর ঘোড়েলের হাতে পড়েও আমার পড়াশোনা হচ্ছে না দেখে মা ক্রমশই অস্হির হয়ে উঠছেন। এদিকে স্যারের কাছে নিত্য পড়া না পারা আমার গা সওয়া হয়ে দাড়িয়েছে। একদিকে নতুন ইস্কুল হাঁফ ধরিয়ে দিচ্ছে আমাকে। অন্যদিকে স্যারের কাছে সিলেবাসের অতিরিক্ত পড়া আর সহ্য না হওয়া দিনে দিনে আমাকে আরো বেপরোয়া করে তুলেছে।
এরকমই একদিন সক্কাল বেলা না বলে কয়ে নিচে নেমেছি বন্ধুরা কেউ আড্ডা মারতে নামল কিনা দেখতে। এমন সময বাসা থেকে কাজের লোক নেমে এসে জানালো স্যার এসেছেন। আপুদের বাসায় পড়তে ডাকছে। মন বিষিয়ে উঠল। আড্ডার সময় করে স্যারের আগমন আমার জন্য বরাবরই অশুভ বার্তা বয়ে এনেছে। দেখা গেছে সেদিনই স্যার এমন ভাবে পড়া ধরা শুরু করেছেন যে সকাল গড়িযে বিকেল হবার জোগাড়। ঠিক করলাম আজকে দেরি করে যেয়ে বলব, বাসায় কেউ জানায়নি ওনার আসার কথা। এই ভেবে দোকান থেকে একটা বড়সড় মার্স কিনে খেতে খেতে বাসার সিঁড়ি দিয়ে উঠছি। এমন সময় সম্মুখ আজ্রাঈলের সামনে। কি করব, কোথা লুকোবো; নিজে লুকোবো নাকি মার্স আগে লুকোবো বুঝার আগেই স্যার থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় ছিলে? মুখ ভর্তি মার্স নিয়ে আমি তখন বিষম খাবার ভান করব কিনা বুঝতে পারছি না। উত্তরের অপেক্ষা না করে মুচকি হেসে, ক্ষিণ স্বরে স্যার বল্লেন, আমি কিছুদিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছি। এর মধ্যে ছুটির পড়া তৈরি করে রেখ। আমি মাথা নিচু করে একটু কাঁত করলাম। পিছন ফিরে দেখি মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুলে, লিকপিকে শরীরের পাঁচ ফুট ছুঁইছুঁই বাদল স্যার চলে যাচ্ছেন।
প্রায় তিন মাস পর স্যারের খোঁজ পাওয়া গেল। স্যার চল্লিশ বছর বয়সে প্রায় অর্ধেক বয়সি কোলকাতার কোন এক মেয়েকে বিয়ে করে ওখানেই থিতু হয়েছেন। আর কারো কথা জানি না, স্যারের এহেন নিরুদ্দেশ যাত্রা আমাকে দিনে দিনে আরো ডানপিটে ও দস্যি করে তুলেছিল।
মন্তব্য
লেখাটি পড়ে স্মৃতিকাতর হলাম। আমাদেরও এমনি একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন যার দাপটে বাঘ-গরু একঘাটে জল খেতো। দেখি কোন একদিন তাঁকে নিয়ে কিছু একটা লেখা যায় কিনা।
-জাহিদ হোসেন
________________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
বললেই হবে? প্রমাণ করুন! দ্রুত লেখা নামান। আমি আপনার বিশ্ববিদ্যালয় সিরিজের খুবই ভক্ত।
অনেক ধন্যবাদ আমার লেখা নিয়ে আপনার সহৃদয় মন্তব্যের জন্য। আমার মাস্টারমশাইকে নিয়ে লিখতে বসবো হাতে একটু সময় পেলেই।
-জাহিদ হোসেন
________________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
এই তাহলে রহস্য...
এহেম! কিসের?
আহ, সেইটা তো আরো এক রহস্য!!
পড়তে হবে!.. আসছি।
====================
অবিরাম ছুটে চলায় হঠাৎ থমকে যাওয়া
'
=========================================
নিজেকেই নিজে চিনি না, পরকে চেনার মিছে বাহানা
ভাল লাগল।
কেমন আচমকা শেষ করে দিলেন...। মুখ ফস্কেই প্রশ্ন চলে এলো- তারপর?
-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
ইচ্ছে আছে আরও কিছু লিখবার। দেখা যাক।
আরো আসছে নিশ্চয়ই। অপেক্ষায় থাকলাম....
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
খুব ভালো লাগল।
-নিরিবিলি
নতুন মন্তব্য করুন